আল্লাহর একত্ববাদের সত্যতা ও তার প্রচার সেই আদম আ:-এর সময় থেকেই। এই একত্ববাদের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যুগে যুগে আসা সব নবী ও রাসূল। আল্লাহর ঘরে এর প্রচার ও প্রসার প্রতিষ্ঠা করেছেন ইব্রাহিম আ: নিজেও। তারপর চূড়ান্তভাবে করেছেন রাসূল সা:। ইসলাম সত্য দ্বীন। এটা এর সঠিকরূপে অবস্থান করছে। কাবার উপস্থিতি ইসলামের সত্যতার প্রমাণ। এটা মানবজাতির জন্য এক বিরাট স্থিতিশীলতার নিদর্শন, যা প্রথম মানবের সন্তানেরা যারা নানা বর্ণের, নানা গোত্রের তাদের সম্মেলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই সত্য প্রকাশের জন্য তারা সেখানে একত্র হতে গিয়ে বলেন, ‘লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’অমাতা, লাকা ওয়াল মুলক লা-শারিকা লাক’।
হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। সালাত, সাওম, জাকাতÑ এই ইবাদতগুলো পৃথিবীর যেকোনো স্থানেই পালন করা সম্ভব। কিন্তু হজের সাথে সফর ও স্থান জড়িত। অন্য ইবাদতগুলো থেকে তাই এটা একটু ভিন্নতর। এটা পালন করতে গেলে আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ স্থানগুলোতে অবস্থান করতে হয়। অবস্থান করতে হয় আরাফায়Ñ যেখানে আদম আ: ও হাওয়া আ: একত্র হয়েছিলেন, রাত যাপন করতে হয় মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে। সব ধরনের শিরকমুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ বিনয়চিত্তে আল্লাহর ঘর কাবাকে কেন্দ্র করে তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য করতে হয় তাওয়াফ। তাঁর প্রশংসার সাথে সাথে দুনিয়া ও আখিরাতের সব কল্যাণ কামনা করা হয় একমাত্র তাঁরই কাছে। সাঈ করতে হয় সেই মহীয়সী নারী হাজেরা রা:-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাফা ও মারওয়ার মাঝেÑ যিনি কোনো সহায়-সম্বল না থাকা সত্ত্বেও বিপদের আশঙ্কা তুচ্ছ জ্ঞান করে আল্লাহর ইচ্ছা মেনে নেন ও প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন, প্রতিষ্ঠা করেন আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা বিশ্বাসের এক আদর্শ উদাহরণ। কোরবানি করতে হয় ইব্রাহিম আ:-এর অনুসরণে যিনি আল্লাহর যেকোনো নির্দেশ বাস্তবায়নে সদা প্রস্তুত ছিলেন। প্রস্তুত ছিলেন আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে নিজের সব থেকে প্রিয় এমন সব কিছুইÑ এমনকি নিজের সন্তানকেও। অবস্থান করতে হয় মিনায়, যেখানে শয়তানকে বর্জনের পুনঃ পুনঃ প্রচেষ্টারত থাকে মুমিনের জীবন। আল্লাহকে ভয় করে যে মুত্তাকি সে এসব শিক্ষা ও তাৎপর্য ধারণ করে বারবার প্রচেষ্টার মাধ্যমে হয়ে ওঠে মুহসিন। আল্লাহকে ঘিরে জীবনযাপন করার জন্য যে বিষয়গুলোর দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে এবং যে প্রচেষ্টাগুলো অব্যাহতভাবে চালু রাখতে হবে হজ আমাদের তারই ট্রেনিং দেয়। এটা আল্লাহর পথে জীবনযাপনের জন্য কয়েক দিনব্যাপী ট্রেনিং। ইসলাম একটি জীবনব্যবস্থাÑ অর্থাৎ দুনিয়াতে আমরা কিভাবে জীবনযাপন করব তার পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। আর হজ হলো বাস্তব জীবনে কিভাবে চলতে হবে সেই শিক্ষার ট্রেনিং ক্ষেত্র।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সব কাজের মূল কেন্দ্র কাবার মালিককে ঘিরেই হওয়া উচিত। এখানে সব কিছু এভাবেই করা উচিত যেভাবে আল্লাহর নির্দেশ এসেছে ও যেভাবে আল্লাহর রাসূল সা: দেখিয়ে দিয়েছেন। নামাজ, রোজা, জাকাত তো পালন করতেই হবে, জীবনের প্রতিটি কাজই কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ অনুসারে হওয়া জরুরি। শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতই যথেষ্ট নয়, প্রতিটি কাজ আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী করা ও তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য পুনঃ পুনঃ প্রচেষ্টা জরুরিÑ এটাই হজের ট্রেনিং। আমরা ‘লাকা ওয়াল মূলক’ বা রাজত্ব আল্লাহর বলি অথচ সমাজ ব্যবস্থায়, সংস্কৃতিতে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়, আইনের ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের পরিপন্থী কাজ করি, এসব ক্ষেত্রে আমরা সেকুলার হয়ে যাইÑ এটা হজের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। সমস্যা সমাধানে কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ প্রদত্ত সমাধান খোঁজা জরুরি। হজ ও তার প্রতিটি কার্যক্রম কোনো প্রহসনের বিষয় নয়। হজের কার্যক্রমগুলোর তাৎপর্য বোঝা ও আল্লাহর দরবারে উপস্থিতির শিক্ষা ধারণ করা ও তা স্মরণ রাখা এবং সেই অনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনা করা উচিত। হজ আমাদের সব ক্ষেত্রে এভাবে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবনকে সাজাতে ও চলতে শিক্ষা দেয়।
হজ থেকে এই শিক্ষার পাশাপাশি কিছু প্রাপ্তিও আছে। এই হজের সময়টায় হাজীরা আল্লাহর নিদর্শনগুলো দেখতে পান ও উপলব্ধি করেন। ইসলামের বাস্তবতা ও সত্যতার প্রমাণে তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ দ্বীনের সত্যতা তাদের সামনে প্রকাশিত হয়। আমরা জানতে পারি আমাদের আসল পরিচয়। নিজের মর্যাদা নিজের সামনে পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে আজ মুসলমানেরা বিভিন্ন অপবাদে জর্জরিত। মুসলিম পরিচয় যেন একই সাথে ভীত ও লজ্জার। মুসিলম পরিচয় যেন আজ অপমানের ও নিগৃহীতের। মুসলিম নাকি প্রাচীরপন্থী, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না জানা কত মর্যাদাহীন মানুষ! এসব মন্তব্য এতই প্রচার পায় যে, আমরা নিজেদের অজান্তেই এসব পরিচয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাই। লাখো লাখো লোকের এ সম্মেলন ও এর শিক্ষা এসব ভ্রান্ত অপবাদ ও বিভ্রান্তিকর ধারণা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। পুরো পৃথিবী যেখানে আমাদের হীন করে দেখাতে চায়, সেখানে এ সম্মেলন ও এর কার্যক্রম নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় যে সে ‘স্পেশাল’।
আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করতে পারার কারণে তারা নিজেকে ‘স্পেশাল’ অনুভব করে। মুসলিম তাদের প্রধান মর্যাদার পরিচয়। আল্লাহর বান্দা হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। এ মর্যাদার অনুভূতি আমাদের সব উত্তম কাজগুলো করার অনুপ্রেরণা দিক।