শেষ পর্ব
(গ) তাওহীদে আসমা ওয়াছ ছিফাত : কুরআন ও হাদীছে আল্লাহর নাম ও ছিফাত (গুণাবলী) সমূহ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করা এবং সেগুলোর প্রতি ঈমান আনা হচ্ছে তাওহীদে আসমা ওয়াছ ছিফাত। কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন না করে, অস্বীকার না করে, অবস্থা বর্ণনা না করে এবং কারো সাথে সাদৃশ্য প্রদান না করে আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর উপর ঈমান আনতে হবে।[ইবনু তায়মিয়া, শারহুল আক্বীদা আল-ওয়াসিতিয়্যাহ, পৃঃ ১৩ ] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর আল্লাহর সুন্দর নাম সমূহ রয়েছে। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামে ডাকো, আর তাদেরকে বর্জন করো যারা তাঁর নাম সমূহ বিকৃত করে, সত্বরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে’ (আ‘রাফ ১৮০)। সুতরাং আল্লাহর নাম ও গুণাবলী যেভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে। কারো সাথে তার সাদৃশ্য করা যাবে না। তিনি বলেন,
‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা (শূরা ১১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পিছনে পড়ো না’ (বনী ইসরাঈল ৩৬)। আয়াতটিতে আল্লাহর অবস্থা কেমন তা বর্ণনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন এবং ছহীহ হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করতে বলা হয়েছে।[মুহাম্মাদ ছালেহ আল-ওছায়মীন, ফাৎহু রাবিবল বারিয়্যাহ, মানব জীবনে তিন প্রকার তাওহীদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঈমান মযবূত হবে ও ইহকাল-পরকাল সুখময় হবে।
আল্লাহ তা‘আলার নামগুলো যেভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করতঃ অর্থ বুঝে মুখস্থ করে আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলে ঈমান বাড়বে এবং জান্নাত লাভ করা যাবে ইনশাআল্লাহ। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার এক কম একশটি অর্থাৎ নিরানববইটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এগুলো মুখস্থ করবে (অর্থ বুঝে আমল করবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[বুখারী হা/৭৩৯২, অন্য বর্ণনায় এসেছে,‘আল্লাহ তা‘আলার নিরানববইটি নাম রয়েছে,যে ব্যক্তি এগুলোর হিফাযত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ বেজোড়। তিনি বেজোড় পসন্দ করেন’।[বুখারী হা/৬৪১০ হাদীছটির ব্যাখ্যা হচ্ছে,যে ব্যক্তি আল্লাহর নিরানববইটি নাম হেফাযত করবে এবং মর্মার্থ বুঝে আমল করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[মাজমূউ ফাতাওয়া,
(২) ইবাদত কবুলের শর্তদ্বয় মানব জীবনে বাস্তবায়ন করা : ইবাদত কবুলের মৌলিক দু’টি শর্ত হ’ল- (ক) ইখলাছ বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করা (খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা। এ দু’টি শর্তের প্রতি খেয়াল রেখে ইবাদত করলে তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে এবং এতে ঈমানও বৃদ্ধি হবে। সকল প্রকার ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই সম্পাদন করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদত করতে এবং ছালাত কায়েম করতে ও যাকাত প্রদান করতে, এটাই সু-প্রতিষ্ঠিত সঠিক দ্বীন’ (বাইয়িনাহ ৫)। মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন,‘হে নবী! বল, আমি একমাত্র আল্লাহর জন্যই ইবাদত করি তাঁর প্রতি আমার আনুগত্যকে একনিষ্ঠ রেখে’ (যুমার ১৪)। সকল প্রকার ইবাদত যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, যবেহ-কুরবানী, নযর-নিয়াজ, রুকূ-সিজদা, দো‘আ-প্রার্থনা, ভয়-ভীতি, আশা-ভরসা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে। কোন পীর, অলী-আওলিয়ার নামে বা মাযার-কবরের নিকট নয়। ইবাদত অন্যের জন্য করলেই শিরক হয়ে যাবে এবং পরকালীন জীবনে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হ’তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি এ মর্মে ওহী হয়েছে যে, যদি তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক কর তবে নিঃসন্দেহে তোমার সকল আমল বাতিল হয়ে যাবে এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৬৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১১০)।
প্রতিটি কাজের জন্য সর্বপ্রথম নিয়ত ঠিক করতে হবে এবং সর্বপ্রকার ইবাদত আললাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা সৎ আমল করেছে তাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট বস্ত্ত (জান্নাত) রয়েছে এবং আরো রয়েছে অতিরিক্ত উৎকৃষ্ট জিনিস (আল্লাহর সাক্ষাৎ) (ইউনুস ২৬)। তিনি আরো বলেন ‘আল্লাহ তা‘আলা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে এমন জান্নাত সমূহের ওয়াদা করেছেন যার পাদদেশে নহর সমূহ প্রবাহিত রয়েছে। সেখানে তারা অনন্তকাল বসবাস করবে। আরও (ওয়াদা করেছেন) ঐ উত্তম বাসস্থান সমূহের, যা আদন নামক জান্নাতের মাঝে অবস্থিত। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড়। এটা হচ্ছে অতি বড় সফলতা’ (তওবা ৭২)।
অতএব পরকালে সুখময় স্থান লাভ করার জন্য সকল সৎকর্ম আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে করতে হবে এবং নিয়ত খালেছ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার হিজরত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে হবে, তার হিজরত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যেই গন্য হবে। আর যার হিজরত হবে ইহকাল লাভের জন্য অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে, তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে, যে জন্য সে হিজরত করেছে’।[বুখারী হা/১; মুসলিম হা/৪৯২৭ ]
ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর দো‘আয় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার সকল আমল কবুল কর (রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী করার তাওফীক দাও), সেটি শুধুমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য করার তাওফীক দাও এবং সেটি যেন কারো উদ্দেশ্যে না হয়।
ফুযাইল বিন ইয়ায বলেন, আমল হ’তে হবে ইখলাছের সাথে ও সঠিক পদ্ধতিতে। বলা হ’ল হে আবু আলী! ইখলাছ ও সঠিক পদ্ধতিটা কি? তিনি বললেন, আমলটি যদি খালেছ হয়, সঠিক পদ্ধতিতে না হয় তাহ’লে কবুল হবে না। আর যদি সেটি সঠিক পদ্ধতিতে হয় কিন্তু খালেছ নিয়তে না হয়, তাহ’লেও কবুল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত খালেছ নিয়তে ও সঠিক পদ্ধতিতে না হবে। আর খালেছ নিয়ত হ’ল শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত করা ও সঠিক পদ্ধতি হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী করা।[ইবনে তায়মিয়াহ, শারহু রিসালাহ তাদামুরিয়্যাহ ]
(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে নবী! বল, যদি তোমরা আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহ’লে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন ও তোমাদের অপরাধ সমূহ মার্জনা করে দিবেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়’ (আলে ইমরান ৩১)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে যা দিয়েছেন তার অনুসরণ করতে হবে আর যা থেকে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা হ’তে বিরত থাকো, আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি খুবই কঠিন’ (হাশর ৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে কেউ এমন কোন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের অনুমোদন নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[মুসলিম হা/৪৪৯৩, ] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে নেই এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, তা প্রত্যাখ্যাত’।[মুসলিম হা/৪৪৯২। ]
ইবাদত কবুলের দু’টি শর্তের সাথে আরেকটি শর্ত : আমলটি বিশুদ্ধ আক্বীদার ভিত্তিতে সম্পন্ন হ’তে হবে, নচেৎ তা কবুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
‘মুমিন পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কর্ম করবে, তাকে আমরা নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রদান করব’ (নাহল ৯৭)। আয়াতটিতে শর্তযুক্ত হয়েছে যে, আমল কবুলের জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদায় বিশ্বাসী হ’তে হবে এবং মুমিন হ’তে হবে। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আমল করলে আল্লাহর নিকট কশ্মিনকালেও তা কবুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
‘আমরা তাদের কৃতকর্মগুলোর দিকে অগ্রসর হব, অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৩)। ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ বান্দার ভাল-মন্দের বিচার করবেন। ঐ সময় মুশরিকরা তাদের আমল থেকে কোন ফায়দা পাবে না এবং সেগুলো তাদেরকে নাজাত দিতে পারবে না। কেননা তাদের আমল শরী‘আত অনুযায়ী হয়নি এবং তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়নি। সুতরাং সেটা বাতিল হবে।[তাফসীর ইবনে কাছীর ৬/১১৪ ] মহান আল্লাহ বলেন,
‘তারা এমন লোক যে, তাদের জন্য আখেরাতে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই। আর তারা যা কিছু করেছিল তাও বিফল হবে এবং তারা যা করে তা বাতিল হবে’ (হূদ ১৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,
‘যারা কুফরী করে তাদের কর্ম মরুভূমির মরীচিকা সদৃশ, পিপাসার্ত যাকে পানি মনে করে থাকে; কিন্তু সে ওর নিকট উপস্থিত হ’লে দেখবে ওটা কিছু নয় এবং সে তার নিকট পাবে আল্লাহকে। অতঃপর তিনি তার কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দিবেন। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর’ (নূর ৩৯)। তিনি আরো বলেন,
‘যারা তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে তাদের উপমা তাদের কর্মসমূহ ভস্ম সদৃশ যা ঝড়ের দিনে বাতাস প্রচন্ড বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়; যা তারা উপার্জন করে তার কিছুই তারা তাদের কাজে লাগাতে পারে না; এটা তো ঘোর বিভ্রান্তি’ (ইবরাহীম ১৮)।
(৩) কল্যাণকর ইলম শিক্ষা করা : মানুষ যখন শরী‘আতের জ্ঞান অর্জন করবে, কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখনই তার ঈমান বাড়বে। এটি ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম উপায়। মহান আল্লাহ বলেন ‘আল্লাহ সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং ফেরেশতাগণ, ন্যায়নিষ্ঠ বিদ্বানগণও (সাক্ষ্য প্রদান করেন) তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বূদ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ১৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিশ্বাসীগণের মধ্যে যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যারা ছালাত প্রতিষ্ঠাকারী ও যাকাত প্রদানকারী এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী, তাদেরকেই আমি মহা পুরস্কার দেব’ (নিসা ১৬২)। কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে ঈমান বাড়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বল, তোমরা কুরআনে বিশ্বাস কর অথবা বিশ্বাস না কর, যাদেরকে এর পূর্বে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের নিকট যখন এটা পাঠ করা হয় তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলে, আমাদের প্রতিপালক পবিত্র। আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’ (বানী ইসরাঈল ১০৭-১০৯)।
বিদ্বানগণ কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে নিজেরা তদনুযায়ী আমল করেন এবং অন্যদের নিকট প্রচার করে থাকেন। এতে একে অপরের ঈমান বাড়ে এবং ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন,
‘আর এজন্যও যে, যাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা যেন জানতে পারে যে, এটা তোমার প্রতিপালকের নিকট হ’তে প্রেরিত সত্য। অতঃপর তারা যেন বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর যেন ওর প্রতি অনুগত হয়। যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ সরল পথে পরিচালিত করেন’ (হজ্জ ৫৪)। মানুষ কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন দ্বারাই সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা বিশ্বাস করে যে, তোমার প্রতিপালকের নিকট হ’তে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য। এটা মানুষকে পরাক্রমশালী ও মহা প্রশংসিত আল্লাহর পথ নির্দেশ করে’ (সাবা ৬)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্য যারা আলেম তারা তাঁকে ভয় করে। আল্লাহ পরাক্রমশালী,ক্ষমাশীল’ (ফাতির ২৮)। কল্যাণকর ইলম শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করা এবং ঈমান বৃদ্ধি করা সম্ভব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে’ (যুমার ৯)। অতএব কুরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জন করা ফরয। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের উপর (শরী‘আতের) জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরয’।[ইবনু মাজাহ হা/২২৪ সনদ ছহীহ ] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকেই দ্বীনের ইলম দান করেন’।[বুখারী হা/৭১। ] ইলম শিক্ষা করলে জান্নাতে যাবার পথ সহজ হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষার জন্য পথ চলে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন।[বুখারী ‘ইলম’ অধ্যায়, পৃঃ ১৬। ] ইলম অর্জনের মাধ্যমে নবীগণের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘আলেমগণই হ’লেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামের উত্তরাধিকারী করেন না। নিশ্চয়ই তাঁরা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল, সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল’।[আবু দাঊদ হা/৩১৫৭; ] ইলম অর্জন করে অপরকে শিক্ষা দিলে, সে অনুযায়ী আমলকারী যে নেকী পাবে, শিক্ষাদাতাও অনুরূপ নেকী পাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিবে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় ছওয়াব পাবে, যে তার উপর আমল করল। কিন্তু আমলকারীর ছওয়াব থেকে একটুকুও কমানো হবে না’।[ইবনু মাজাহ হা/২৪০, সনদ হাসান ]
কল্যাণকর জ্ঞান অর্জনকারীর উপর আল্লাহ রহম করেন। আর ফেরেশতাগণ, আসমান-যমীনের অধিবাসীগণ, পিপীলিকা এমনকি সমুদ্রের মাছও তার জন্য দো‘আ করতে থাকে। আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সামনে দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করা হ’ল। তাদের একজন আলেম, অপর জন আবেদ। তখন তিনি বলেন, আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর ঐরূপ, যেরূপ আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণের উপর। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ রহমত করেন এবং তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, আসমান-যমীনের অধিবাসী এমনকি পিপীলিকা তার গর্তে থেকে এবং মাছও কল্যাণের শিক্ষা দানকারীর জন্য দো‘আ করে’।[ছহীহ তারগীব হা/৭৭; মিশকাত হা/২১৩ ] দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিয়ে গেলে মৃত্যুর পরেও তার ছওয়াব পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তিনটি ব্যতীত তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। ঐ তিনটি আমল হ’ল প্রবাহমান দান-ছাদাক্বা, এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে’।[মুসলিম হা/১৬৩১।
অতএব ঈমান বাড়াতে হ’লে ও ইহলোক-পারলোক সুখময় জীবন-যাপন করতে হ’লে সবার উপর আবশ্যক হবে সন্তান-সন্ততিক ছোট থেকেই দ্বীনের সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া। দ্বীনী ইলম শিক্ষা লাভ না করলে পৃথিবী অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। ফলে মানুষ দ্বীনী বিষয়ে অজ্ঞদের নিকট থেকে ফৎওয়া নিয়ে গোমরাহ হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের থেকে ইলম ছিনিয়ে নেন না। বরং দ্বীনের আলেমদের উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নিবেন। তখন কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে লোকেরা মূর্খদেরকেই নেতা বানিয়ে নিবে, তাদের জিজ্ঞেস করা হ’লে তারা না জেনে ফৎওয়া প্রদান করবে, এতে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে’।[বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩। ] সমাপ্ত.