মালায়িকা বা ফেরেশ্‌তাগণের প্রতি ঈমান

maalaeka

ফেরেশতা আল্লাহর সৃষ্টজীবের একটি সৃষ্টি। তারা নূরের তৈরি, ফেরেশতা না নর না নারী। আল্লাহ তাদেরকে পাখা বিশিষ্ট করে সৃষ্টি করেছেন। কারো দুটি পাখা, কারো চারটি পাখা  কারো এর বেশি কারো ছয়শতাধিক পাখা রয়েছে। গঠন প্রণালীর দিক থেকে কোন কোন ফেরেশতা অন্য ফেরেশতা হতে বড় ছোট রয়েছে। যে ফেরেশতা আরশ বহন করে আছেন, তাঁর কান হতে কাঁদের দূরত্ব হলো সাতশত বছরের পথ। মর্যাদার দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা হলো হযরত জিবরাইল (আ.)

ক- ফেরেশ্‌তাগণের প্রতি ঈমান আনার অর্থ: ফেরেশতাগণের অস্তিত্ব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। তাঁরাও আল্লাহর এক প্রকার সৃষ্টি, আল্লাহ্‌ তাঁদেরকে যা আদেশ করেন অবাধ্য না হয়ে তাঁরা তা সাথে সাথে পালন করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

﴿بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ (26) لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ﴾ (27)  [الأنبياء [

অর্থ: বরং ফেরেশ্‌তাগণ তো আল্লাহর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলতে পারেন না এবং তারা তাঁর আদেশেই কাজ করেন। সূরাহ আম্বিয়া আয়াত ২৬-২৭।

 

ফেরেশ্‌তাগণের প্রতি ঈমান চারটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে:

১- ফেরেশ্‌তাগণ আছেন এ বিশ্বাস রাখা।

২- আমরা যে সকল ফেরেশ্‌তার নাম জানি যেমন জিবরীল (u) তাঁদের প্রতি বিশ্বাস রাখা। যাদের নাম জানিনা তাঁদের প্রতি মুজমাল তথা সংক্ষিপ্তাকারে ঈমান রাখা। অর্থাৎ নাম না জানা ফেরেশ্‌তাগণের অস্তিত্বে সংক্ষেপে বিশ্বাস রাখতে হবে।

৩- ফেরেশ্‌তাগণের যে গুণসমূহ আমরা জানি তা বিশ্বাস করা।

৪- আমাদের জানামতে আল্লাহর আদেশে তাঁরা যে সকল কাজ করেন তার প্রতি বিশ্বাস রাখা। যেমন: আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষনা করা, ক্লান্তি ও অবসাদ ছাড়া দিন রাত্রি তাঁর ইবাদাত করা। ফেরেশ্‌তাগণের প্রতি ঈমান আনায়ন ঈমানের অন্যতম রুকন বা স্তম্ভ।

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন:﴿آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ

অর্থ:  রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বাস রাখেন ঐ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যা তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুসলিমরাও সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমুহের প্রতি। সূরাহ্‌ আল বাক্বারাহ্‌ – ২৮৫।

রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈমান সম্পর্কে বলেছেন:

 ﴿أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ﴾অর্থ: ঈমান হলো, আল্লাহ, তাঁর ফেরেশ্‌তাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, ক্বিয়ামত দিবস এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখা। সহীহ্‌ মুসলিম।

 

খ- ফেরেশ্‌তাগণের গুণাবলী:

 

– সৃষ্টিগত গুণের মধ্যে রয়েছে যা আল্লাহর রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উল্লেখ করেছেন: তাঁরা নূর তথা আলোর তৈরী, রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

﴿خُلِقَتْ الْمَلَائِكَةُ مِنْ نُورٍ﴾

 অর্থ: ফেরেশ্‌তাগণকে নূর বা আলো থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সহীহ্‌ মুসলিম, ১৪/২৭৩।

– আল্লাহতায়ালা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি ফেরেশ্‌তাগণকে বিভিন্ন সংখ্যক পাখা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন:

﴿الْحَمْدُ لِلَّهِ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ جَاعِلِ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا أُولِي أَجْنِحَةٍ مَثْنَى وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ يَزِيدُ فِي  الْخَلْقِ مَا يَشَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾ (فاطر : 1)

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা এবং ফেরেশতাগণকে করেছেন বার্তাবাহক-তারা দুই দুই, তিন তিন ও চার চার পাখাবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টি মধ্যে যা ইচছা যোগ করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সক্ষম। সূরাহ্‌ আল ফাত্বির আয়াত ১।

– রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিবরীল u কে ছয়শত পাখাসহ দেখেছেন। বুখারী ও মুসলিম।

–  আল্লাহর শক্তিতে ফেরেশ্‌তাগণ কখনো মানুষের রুপে পরিবর্তিত হয়ে থাকেন। যেমন, মারইয়াম (আলাইহাস সালাম) এর নিকটে আল্লাহ্‌ তায়ালা জিবরীল uকে মানুষের আকৃতিতে প্রেরণ করেছিলেন। এমনিভাবে আল্লাহ্ (আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম) ইবরাহীম ও লুত্ব আলাইহিমাস্ সালামের নিকটে ফেরেশ্তাগণকেমানুষের আকৃতিতে প্রেরণ করেছিলেন।

– ফেরেশ্‌তাগণ অদৃশ্য জগত (তাঁদেরকে দেখা যায় না)তাঁরাও আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর ইবাদাত করেন। পালনকর্তা বা মাবূদ হওয়ার কোন যোগ্যতা তাঁদের মাঝে নেই। বরং তাঁরাই আল্লাহর বান্দা এবং সর্বদা আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য করছেন। যেমন আল্লাহ বলেন:

 ﴿لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ[التحريم: 6 [

অর্থ: তারা (ফেরেশ্‌তাগণ) আল্লাহ যা আদেশ করেন, তা অমান্য করেন না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করেন। সূরাহ্‌ আত তাহরীম আয়াত

 

গ- ফেরেশ্‌তাগণের প্রকার ও কাজ:

 

এ পৃথিবীতে ফেরেশতাগণ বিভিন্ন কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন। তাঁরা বিভিন্ন প্রকার এবং প্রত্যেক প্রকারের আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে। তাঁদের অন্যতম হলেন:

১- জিবরীল, তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর রাসূলগণের নিকটে ওহী নিয়ে আসার দায়িত্ব প্রাপ্ত।

২- বৃষ্টি ও তা পরিচালনার দায়িত্বশীল ফেরেশতা হলেন মীকাঈল u|

৩- সিঙ্গায় ফুৎকারের দায়িত্ব প্রাপ্ত ফেরেশ্‌তা হলেন ইসরাফীল u|

৪- আত্মাসমূহ কবজের দায়িত্বশীল ফেরেশতা হলেন মালাকুল মাওত ও তাঁর সহযোগী বৃন্দ।

. রেদওয়ান জান্নাতের দরজার প্রহরী

. আনিয়া: এর সংখ্যা ১৯ তাদের কাজ হলো জাহান্নামীদের শাস্তি প্রদান করা।

. হামালাতুল আরশ: এদের সংখ্যা ৪কিয়ামতের পরে আরো ৪ জন যোগ করা হবে।

. হাফাজাহ: তাদের কাজ হলো মানুষকে নিরাপত্তা প্রদান করা।

. কিরাম কাতিবুন: যারা মানুষের কর্মের হিসাব রাখেন, ডান দিকের ফেরেশতাগণ ভালো কাজের আর বাম দিকের ফেরেশতাগণ খারাপ কাজের হিসাব রাখেন।

১০. মুক্বীম, সফর, নিদ্রা অনিদ্রা এবং সর্বাবস্থায় বান্দাদের হেফাযতে নিয়োজিত ফেরেশতাগণ। তাঁরা হলেন,سياحينপর্যবেক্ষণকারী।

এছাড়াও রয়েছেভ্রাম্যমান ফেরেশ্‌তাগণ: তাঁরা কল্যাণ ও ইলমের মজলিসের অনুসন্ধানে নিয়োজিত, পাহাড়ের দায়িত্বশীল ফেরেশতাগণ, একদল ফেরেশ্‌তা রয়েছেন যারা সর্বদা সারিবদ্ধভাবে আল্লাহর ইবাদাতে ব্যস্ত রয়েছেনএতে তাঁরা কোন সময় ক্লান্ত হননা। আল্লাহ তায়ালার সৈন্য সংখ্যা তিনি ব্যতীত কেউ জানে না।

 ফেরেশতাগণের উপর ঈমান আনা ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِوَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِوَرُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُواسَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَالْمَصِيرالبقرة: 285{

প্রত্যেক মুমিনের  উচিত যে, তারা অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা জাতি সৃষ্টি করে রেখেছেন। ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন

  أن تؤمن بالله وملائكته وكتبه ورسله واليوم الآخروتؤمن بالقدر خيره وشره
যারা ফেরেশতাদের অস্তিত্ত অস্বীকার করবে,তারা নিশ্চয়েই পথভ্রষ্ট ও কাফের । আল্লাহ বলেন:

 وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِوَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلالابَعِيدًاالنساء: 136

 

ঘ- ফেরেশ্‌তাগণের প্রতি ঈমান আনার প্রভাব:

 

মুমিনের জীবনে ফেরেশ্‌তাগণের প্রতি ঈমান আনার বড় প্রভাব রয়েছে। তার মধ্যে নিম্নে কিছু উল্লেখ করা হল:

১- আল্লাহর বড়ত্ব, শক্তি এবং পরিপূর্ণ ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। কেননা, সৃষ্টির বড়ত্ব স্রষ্টার বড়ত্বের উপর প্রমাণ বহন করে। ফলে মুমিন আল্লাহকে আরো বেশী সম্মান ও মর্যাদা দান করে। কারণ আল্লাহ্‌ (আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম) আলো থেকে বহু সংখ্যক পাখা বিশিষ্ট্য ফেরেশ্‌তাগণকে সৃষ্টি করেছেন।

২- আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকা, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে ফেরেশ্‌তাগণ তার সকল আমল লিপিবদ্ধ করেন সে অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করবে, ফলে সে প্রকাশ্য বা গোপনে আল্লাহর অবাধ্য হবে না।

৩- আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য্য ধারণ করা। মুমিন ব্যক্তি যখন এ বিশ্বাস রাখবে যে বিশাল পৃথিবীতে হাজারো ফেরেশ্‌তা তার সাথে আল্লাহর আনুগত্য করছে তখন সে প্রফুল্লতা এবং আত্ম তৃপ্তি অনুভব করবে।

৪- আল্লাহ্‌ তায়ালা কর্তৃক আদম সন্তানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার দরুন তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কেননা, তিনি (আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম) এমন কিছু ফেরেশ্‌তা নিযুক্ত করেছেন যারা তাদের হেফাযতে সদা প্রস্তুত রয়েছেন।

৫- যখন কেউ মালাকুল মাওতের কথা স্মরণ করবে তখন সতর্ক হবে যে, এই দুনিয়া ধ্বংশশীল, চিরস্থায়ী নয়। ফলে সে ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।

Related Post