পূর্বে প্রকাশিতের পর (৩য় পর্ব)
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ
ইসলামী আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে যখন কোন দিক দিয়েই হামলা করে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ পাওয়া যায়না, তখন শয়তান তাকে পিঠের দিক দিয়ে আঘাত করার প্ররোচনা দেয়। আর শয়তানের দৃষ্টিতে পিঠের দিক দিয়ে আঘাত করার সর্বোত্তম পন্থা হলো, এর নেতা ও তার অনুসারীদের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ওপর কলংক লেপন করা। শয়তানের এ কাজে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে কর্মবিমুখ নৈরাজ্যবাদী মহল। যখন কোন সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক আন্দোলনের কবলে পড়ে, তখন তারা এ আন্দোলনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আদাপানি খেয়ে লেগে পড়ে। অল্লাহ এবং জনগণের প্রতিও তারা কোন দায়দায়িত্ব অনুভব করেনা। এজন্য সকল শক্তি ও প্রতিভা অতি সহজেই নেতিবাচক তৎপরতায় নিয়োগ করে। এসব লোক সংস্কারবাদী ও গঠনমূলক আন্দোলনের নেতাকর্মীদেরকে ভূতের মত চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে, দূরবিক্ষণ ও অনুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তাদের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণের চেষ্টা চালায়। যাতে তারা মুসলিম সমাজ ব্যবস্থার অভ্যন্তরে নাশকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য তাদের একটা বিশেষ ধরনের অনুকূল পরিবেশ তৈরী হয়। এই পরিবেশ সমাজের শৃংখলা ও নৈতিকতার কোন ত্রুটির কারণেই সৃষ্টি হোক, অথবা পরিস্থিতির ও পরিবেশগত বাধ্যবদকতার কারণেই হোক, বিভ্রান্তির সৃষ্টির সুযোগ তৈরী হলেই তারা তিলকে তাল বানিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করে জনমতকে ক্ষেপিয়ে তোলে।
সত্যের নিশানবাহী মাত্রেরই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার উপর একটা না একটা কালিমা লেপনের জন্য বিরোধীরা প্রত্যেক যুগেই অপবাদ আরোপ করে থাকে। রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে কিরামও এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। রাসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ও যাকাতের মাল আত্মসাতের এক উদ্ভট অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিলো, যাতে সত্যের লেশ মাত্রও ছিলনা।
রাসূল (সা.) হিজরত করে মদীনায় চলে আসার পর কুরাইশদের গোয়েন্দারা মদীনার চারপাশে ঘোরাফেরা করতো এবং মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য ইহুদীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের সামরিক দল যখন তখন মদীনার সীমানায় ঢুকে পড়তো। একারণে রাসূল (সা.) ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলমানদের জান-মাল হেফাযতের জন্য টহল ব্যবস্থার আওতায় দ্বিতীয় হিজরীর রজব মাসে আটজনের একটা সেনাদলকে শত্রুদের গতিবিধি খোঁজ নেয়ার জন্য পাঠালেন। তাদেরকে কোন সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। কিন্তু টহল দানের সময় একবার এক ক্ষুদ্র কাফেলার সাথে তাদের মুখোমুখি হওয়ায় উভয় দলের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে টহল দল আক্রমন চালিয়ে শত্রুদের একজনকে হত্যা করে বাকীদের গ্রেফতার করে পণ্যসহ মদীনায় আনা হলো। এঘটনা যেহেতু রজব মাসের (নিষিদ্ধ মাসের) শেষে ও শাবানের শুরুতে রাতের বেলায় ঘটেছিল, এজন্য সন্দেহের সুযোগ নিয়ে একদিকে কুরাইশ অপরদিকে মদীনার ইহুদী ও মুনাফেকরা অপপ্রচারের তান্ডব সৃষ্টি করে জনগণকে উত্তেজিত করতে লাগলো যে, এরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চায়, অথচ নিষিদ্ধ মাসে রক্তপাতের মাধ্যমে ধর্মীয় প্রতীক সমূহের পবিত্রতা নষ্টকরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে দ্বিধা করেনা। এই অপপ্রচারের ফল মুসলমানদের জন্য খুবই ক্ষতিকর ছিল। কেননা নিষিদ্ধ মাসের এই সম্মান বহাল থাকার ওপরই আরবের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতি নির্ভরশীল ছিল। এতে মুসলমানদের সমর্থকরা তাদের বিরোধী হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। কিন্তু বিরোধীদের এই অপপ্রচারের বিজ্ঞান সম্মত ও পরিচ্ছন্নভাবে দাঁতভাঙ্গা জবাব ওহীর মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহ নিজেই দিলেন।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : লোকেরা জিজ্ঞসা করে, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা কেমন কথা! হে নবী আপনি বলে দিন, এটা খুব অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে চলতে মানুষকে বাধা দেয়া, অল্লাহর অবাধ্যতা করা, আল্লাহর বান্দদেরকে মসজিদুল হারামে যেতে না দেয়া এবং সেখান থেকে তার অধিবাসীদেরকে বের করে দেয়া আল্লাহর দৃষ্টিতে এর চাইতে অনেক বড় অন্যায়। আর রক্তপাতের চেয়েও অরাজকতা মারাত্মক। (সূরা বাকারাহ-২১৭)
এঘটনার ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় বুঝা যায়, ইসলামের শত্রুরা কিভাবে ওৎ পেতে বসে থাকে যে, পান থেকে চুন খসলেই তারা হামলা করে দেবে। কারো দ্বারা সামান্যতম ভুলত্রুটি হয়ে গেলেই তারা তৎক্ষণাত তা সারা দুনিয়ায় নিজস্ব ব্যাখ্যায় রং মাখিয়ে ছড়িয়ে দেবে। যেখানে প্রতি মুহুর্তে প্রতিটি ব্যাপারে বিভ্রান্তি, খারাপ ও উস্কানি ছড়ানোর অপচেষ্টা চলে, সেখানে শত্রু পরিবেষ্টিত ইসলামী নেতৃত্ব ও তার অনুসারীগণ কত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এ ধরনের বাধাবিপত্তি কখনো কোন আদর্শবাদী ও চরিত্রবান সংগঠনের বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
যাকাতের মাল আত্মসাতের অভিযোগঃ
মদীনার ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্রে যখন যাকাত আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো, তখন রাসূল সা.এর ওপর একটা হীন অপবাদ এই মর্মে আরোপ করা হলো যে, তিনি বাইতুল মালে জমাকৃত যাকাত সদকার অর্থ নিজের খেয়ালখুশী মোতাবেক আত্মসাত করে ফেলেন। ব্যাপারটা ছিল এইযে, সকল সঞ্চিত সম্পত্তি, বাণিজ্যিক পুঁজি, গবাদিপশু ও কৃষিজাত সম্পদ একই কেন্দ্রে জমা হতে লাগলো এবং রাসূল সা. এর হাতে তা বণ্টিত হতে লাগলো। ধন সম্পদের এই বিপুলাকৃতির স্তুপ দেখে ধনলোভীরা লালায়িত হয়ে উঠতো। তারা চাইতো জাহেলী যুগের ন্যায় আজও এই সম্পদ তাদের ন্যায় ধনীদের হাতেই কেন্দ্রীভূত হোক। কিন্তু ইসলামের বিধান মতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পদকে দরিদ্রমুখী করে দেয়। বিত্তশালীরা এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনে দারুণ অসন্তুষ্ট ছিল। তারা ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর তো আক্রমণ চালাতে পারতো না, যা তাদের পকেট ভর্তি করার পরিবর্তে উল্টা তাদের কাছ থেকে ‘যাকাত’ আদায় করা হতো। তাই তারা মনের আক্রোশ মেটানোর জন্য রাসূল সা. কে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতো। তারা বলতো, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের পরিবার পরিজন, সমর্থক ও আত্মীয় স্বজনের জন্য ব্যয় করেছেন। একটা ধর্মীয় ও নৈতিক সমাজ ব্যবস্থায়, যেখানে কোষাগারকে আল্লাহর সম্পদ বলা হয়ে থাকে এবং যার প্রতিটি আয় ব্যয় আল্লাহর নামে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে, সেখানে এ ধরনের অভিযোগ থেকে নিদারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি করা সম্ভব। ভাববার বিষয় হলো, এ অপবাদ সেই আদর্শ মানবের বিরুদ্ধে আরোপ করা হচ্ছে যিনি যাকাত সদকার অর্থকে শুধু নিজের ও নিজের পরিবারের জন্যই নয়, গোটা বনু হাশেম গোত্রের জন্য আইনত হারাম করে দিয়েছেন। এমন নিস্বার্থ ব্যক্তিত্বের তুলনা সমগ্র মানবেতিহাসেও কোথাও পাওয়া যাবেনা। অথচ সেই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের ললাটেও নিতান্ত হীন চরিত্রের চুনোপুটিরা কালিমা লেপনের ধৃষ্টতা দেখালো। এই লোকদের পরিচয় কুরআনে এভাবে দিয়েছেন যে, তারা নিজেদের জঘন্য কথাবার্তা দ্বারা রাসূলের সা.এর মনে কষ্ট দেয়। (তাওবা ৬১)।
রাসূল সা:-এর পরিবারে কলহ বাধানোর অপচেষ্টা
মদীনায় বসবাসকারী ইসলামের শত্রুরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবারে বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে। ইসলামী আন্দোলনের নেতাকে ঘরোয়া বিবাদে জড়িয়ে ফেলার চক্রান্ত সফল হলে তার ফলাফল ধ্বংসাত্মক হতে পারে এই আশায় তারা এ কাজটি করেছে। এ উদ্দেশ্যে তারা কিছু সংখ্যক মহিলাকে গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে অন্যতম গুপ্তচর মহিলার নাম উম্মে জালদাহ। তার কাজ ছিল রাসূল সা: এর স্ত্রীদেরকে উস্কে দেয়া। এ ধরনের মহিলাদের ষড়যন্ত্রেই হযরত আয়েশা রা:-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করা সম্ভব হয়েছিল। দুশ্চরিত্র লোকদের এ জাতীয় চক্রান্তের ফলে এমন কতগুলো ঘটনা ঘটে, যা সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য, রাসূল সা: এর চরিত্র, বিশিষ্ট সাহাবীদের সহায়তায় ও স্ত্রীগণের সৌজন্যের প্রভাবে যথাসময়ে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এসবের মধ্যে বিপজ্জনক ছিল ভরণ পোষণ বাবদ বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য স্ত্রীগণের দাবী। এই দাবীর ফলেই রাসূল সা: কতৃক স্ত্রীদের সংশ্রব সাময়িকভাবে পরিত্যাগ করা হয়েছিল। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ছিল যে, আবু বকর ও ওমর রা: অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ নিয়ে তাদের কন্যাদ্বয়কে উৎসাহ দেয়ার পরিবর্তে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। এদিকে আল্লাহ তায়া‘লার পক্ষ থেকে আসলো কঠোর হুঁশিয়ারীঃ “হে নবী! তোমার স্ত্রীদের বলে দাও, তোমরা যদি দুনিয়ার জীবন ও তার বিলাসব্যসন চাও, তবে এস, আমি তোমাদের ভোগ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেই এবং বিদায়ের পোশাক দিয়ে সুন্দরভাবে বিদায় করে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের জীবনকে চাও, তাহলে জেনে রেখ, আল্লাহ সৎকর্মশীলা মহিলাদের জন্য বিরাট পুরস্কার নির্ধারণ করে রেখেছেন।” (আহযাব-২৮,২৯ )। বস্তুত রাসূল সা: এর স্ত্রীদের সামনে দুটো পথ খোলাছিল। দুটো পথের যে কোন একটি তারা গ্রহণ করতে পারতেন। স্ত্রীরা আপন মহত্বের গুণে তৎক্ষণাত সাবধান হয়ে গেলেন। যিনি নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং অসাধারণ মেধা প্রতিভার কারণে এই দাবীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন,সেই হযরত আয়েশাকেই রাসূল সা: সর্ব প্রথম আল্লাহর এই সিদ্ধান্ত জানালেন। আর হযরত আয়েশাই সর্ব প্রথম ঘোষণা করলেন, আমি আল্লাহ ও রাসূল ছাড়া আর কিছু চাইনা। তারপর একে একে অন্য সব স্ত্রীও সর্বান্তকরণে দাবীদাওয়া পরিহার করলেন। শক্র পরিবেষ্টিত একটি পরিবারে দুষ্ট লোকদের ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের ফলে এবং নিকৃষ্ট ধরনের গুপ্তচর মহিলাদের অপতৎপরতার কারণে যদি কোন এক পর্যায়ে দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টি হয়ে যায়, তবে সেটা বিচিত্র কিছু নয়। বরং এত ষড়যন্ত্রের পরও এই পরিবারটির নিরাপদে টিকে থাকাটাই তার সদস্যদের দৃঢ়তা, একাত্মতা ও মহত্বের লক্ষণ। উল্লেখিত বিষয় গুলো থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, চারিদিকে কত রকমের ষড়যন্ত্রের জাল পাতা হচ্ছিল ইসলামী আন্দোলনের নেতার বিরুদ্ধে।
চরম সংকট : আরব দেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার যুগ। আল্লাহ পাকের মনোনীত ও প্রেরিত মহাসত্যের প্রথম প্রকাশ ঘটার পর মক্কার মুষ্টিমেয় মুসলমানদের উপর নেমে আসলো যুলুম,নির্যাতন ও লাঞ্ছনার চরম পরীক্ষা। রহমতের নবী, শেষ নবী অসাধারণ ধৈর্য ও ত্যাগ-তিতিক্ষার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে ইসলামের শাশ্বত নূরের বাণী প্রচারে অগ্রসর হলেন। একদিকে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। অন্য দিকে সত্যের গতিও হলো অপ্রতিরোদ্ধ। যুলুম নির্যাতন এতটাই বৃদ্ধি পেল যে, শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর হুকুমে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হলেন। কুরাইশরা এতেও ক্ষান্ত হলো না। তাদের ভাবনা হলো ইসলামের শক্তি সঞ্চয় প্রকৃতপক্ষে তাদের জাহেলী ব্যবস্থারই মৃত্যু ঘটার শামিল। অপর দিকে মক্কাবাসীদের জীবিকার একটি বড়ো উপায় ছিল ইয়েমেন ও সিরিয়ায় বাণিজ্য। আর যাতায়াতের পথছিল মদীনার উপর দিয়ে। সুতরাং মদীনায় মুসলমানদের শক্তি অর্জনের অর্থ ছিলো তাদের চিন্তার কারণ। একদিকে বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা অপর দিকে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে যেভাবেই হোক, চিরতরে মিটিয়ে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। বাণিজ্য কাফেলা রক্ষার অজুহাত খাড়া করে মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করল। হিজরতের পর দু’বছরও অতিμান্ত হয়নি। সহায় স¤¦ল সব হারিয়ে মুহাজিরগণ রিত্ত হস্ত। আনসারগণ যুদ্ধ বিদ্যায় তেমন পারদর্শী নয়। অন্যদিকে অনেকগুলো ইহুদী গোত্র বিরোধিতার জন্য প্রস্তুত। খোদ মদীনায় মুনাফিক ও মুশরিকদের উপস্থিতি আভ্যন্তরীণ বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি অবস্থায় কুরাইশরা যদি মদীনা আμমণ করে, তাহলে মুসলমানদের এই মুষ্টিমেয় দলটি হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। আর যদি হামলা না-ও করে বরং আপন শক্তিবলে শুধু কাফেলাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে শত্রুরা মাথা তুলে দাঁড়াবে। ফলে মুসলমানদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। এই চরম সংকট কালে আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম আসলো “যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ, তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে; আল্লাহ নিশ্চয় তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম”। ( সূরা হাজ্জ: ৩৯) এসব কারণেই রাসূল (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন যতটুকু শক্তি আছে, তা নিয়েই ময়দানে টিকে থাকার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
যুদ্ধের সূত্রপাত: দ্বিতীয় হিজরীর শা’বান মাস (ঈসায়ী ৬২৩ সালের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাস) কুরাইশদের এক বিরাট কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে প্রত্যাবর্তনকালে মুসলিম অধিকৃত এলাকার কাছাকাছি এসে পৌঁছালো। কাফেলাটির সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার আশরাফী মূল্যের সামগ্রী এবং ৩০/৪০ জনের মত রক্ষী ছিলো। তাদের ভয় ছিলো, মদীনার নিকটে পৌঁছলে মুসলমানগণ হয়ত তাদের ওপর হামলা করতে পারে। কাফেলার নেতা ছিলো আবু সুফিয়ান। সে এই বিপদাশঙ্কা উপলব্ধি করেই এক ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্যে মক্কায় পাঠিয়ে দিলো। লোকটি মক্কায় পৌঁছেই আরবের প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী উটের কান কেটে ফেললো, তার নাক চিরে দিল, উটের পিঠের আসন উল্টে দিলো, নিজের জামা সামনের দিকে ও পিছনের দিকে ছিঁড়ে এই বলে চিৎকার করতে থাকলো ঃ ‘হে কুরাইশগণ! তোমাদের বাণিজ্য কাফেলার খবর শুনো। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের যে সম্পদ রয়েছে, মুহাম্মাদ তার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে তার পিছনে ধাওয়া করেছে। তোমাদের তা পাবার আশা নেই। সাহায্যের জন্য দৌড়ে চলো।’ কাফেলার সঙ্গে যে সম্পদ ছিলো, তার সাথে বহু লোকের স্বার্থ জড়িত ছিলো। ফলে এই সাহায্যের ডাকে সাড়া দিয়ে কুরাইশদের সমস্ত বড় বড় নেতাগণ যুদ্ধের জন্যে তৈরী হলো। এভাবে প্রায় এক হাজার যোদ্ধা রণসাজে সজ্জিত হয়ে পূর্ণ আড়¤¦র ও জাঁক-জমকের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রওনা হলো। এদের হৃদয়ে একমাত্র সংকল্প মুসলমানদের অস্তিত্ব এবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে, যেনো নিত্যকার এই ঝঞ্ঝাট চিরতরে মিটে যায়। বস্তুতঃ একদিকে তাদের ধন-মাল রক্ষার আগ্রহ অন্যদিকে পুরনো দুশমনী ও বিদ্বেষের তাড়না- এই দ্বিবিধ ক্রোধ ও উম্মাদনার সঙ্গে কুরাইশ বাহিনী মদীনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।
মুসলমানদের প্রস্তুতি: কুরাইশদের এই সিদ্ধান্তের পর রাসূল (সা.) মুহাজির ও আনসারগণকে একত্রিত করে তাদের সামনে বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে বললেন, “একদিকে মদীনার উত্তর প্রান্তে রয়েছে ব্যবসায়ী কাফেলা আর দক্ষিণ দিক থেকে আসছে কুরাইশদের সৈন্য-সামন্ত। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, এর যে কোনো একটি তোমরা লাভ করবে। বলো, এর কোন্টির মুকাবিলা করতে চাও?” জবাবে বহু সাহাবী কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি তাঁর প্রশ্নটি পূনরাবৃত্তি করলেন। এরপর মুহাজিরদের ভেতর থেকে মিকদাদ বিন আমর (রা.) দাঁড়িয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহ্র রাসূল! আল্লাহ আপনাকে যে দিকে আদেশ করেছেন, সেদিকেই চলুন। আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা বনী ইসরাঈলের মতো বলতে চাই না-যাও, তুমি এবং তোমার আল্লাহ গিয়ে লড়াই করো, আমরা এখানে বসে থাকবো।”
অপর দিকে এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আনসারদেরও মতামত গ্রহণের প্রয়োজন ছিলো। এজন্যে নবী (সা.) উল্লিখিত প্রশ্নটি পূনরাবৃত্তি করলেন। সা’দ বিন মায়াজ (রা.) দাঁড়িয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি এবং আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সবই সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছি। সর্বোপরি আমরা আপনার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছি। কাজেই হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা কাজে পরিণত করে ফেলুন। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তাহলে আমরা আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে পড়ে থাকবে না। আমরা যুদ্ধে অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকবো। কাজেই আল্লাহ খুব শিগগিরই আমাদের দ্বারা আপনাকে এমন জিনিস দেখাবেন, যা দেখে আপনার চক্ষু শীতল হয়ে যাবে। অতএব, আল্লাহর রহমত ও বরকতের ওপর ভরসা করে আপনি আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলুন।” এই আলোচনা ও বক্তৃতার পর সিদ্ধান্ত হলো, বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে সৈন্যদলেরই মুকাবিলা করা হবে।
উভয় বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ও রণ সম্ভার: বাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে সৈন্যদলেরই মুকাবিলা করা হবে, এটা কোন মামুলী সিদ্ধান্ত ছিলো না। কারণ কুরাইশদের তুলনায় মুসলমানদের অবস্থা ছিল নেহায়েত দুর্বল। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যারা (মুসলমানরা) যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন, তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। এদের মধ্যে মাত্র দু’তিন জনের কাছে ঘোড়া ছিল। আর বাকী লোকদের জন্য ৭০ টির বেশি উট ছিলো না। রণ সম্ভারও ছিল একে বারেই অপ্রতুল। মাত্র ৬০ জনের কাছে ছিল বর্ম।
অপর দিকে কুরাইশরা আবু জাহলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য নিয়ে রওনা হলো। এ বাহিনীতে ১০০ টি ঘোড়া, ৬০০ টি বর্ম এবং প্রত্যেকেরই তরবারী ছিল। উট সংখ্যায় এতবেশি ছিল যে, প্রতিদিন তারা ৯ বা ১০ টি করে জবেহ করে খেত। সৈন্যরা প্রত্যেকেই যোদ্ধা ও যুদ্ধে পারদর্শী ছিল। সারী গায়িকা বাঁদীদল তাদের বাদ্যযন্ত্রসহ ছিল। তদুপরী সুরাকারূপী ইবলীসকে সঙ্গে নিল। এসব কারণেই কতিপয় মুমিনদের মনে ভীতির সঞ্চার হলো। যা সূরা আনফালের (৫-৮) আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন। (চলবে)