রাসূলে কারিম (সা.)-এর দোয়া

দোয়া করুন, আল্লাহ কবুল করবেন

রাসূল (সা.)-এর দোয়া

দোয়া হচ্ছে ইবাদতের মূল ও ইবাদতের প্রাণ। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করাই ইবাদতের মূল চেতনা। নবী পাক সা: এরশাদ করেছেন ‘দোয়াই হচ্ছে ইবাদত।’ কারণ দোয়ার মাধ্যমে বান্দাহ (আব্দ) নিজের প্রতিপালকের কাছে স্বীয় অভাব ও কষ্টের কথা পেশ করে এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা করে আল্লাহর মহত্ত্ব ও প্রভুত্বের স্বীকৃতি দান করে, নিজের দাসত্বের অঙ্গীকার করে এবং নিজের অক্ষমতা ও দুর্বলতা প্রকাশের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। বন্দেগির এরূপ প্রকাশ নিছক একটি ইবাদত নয়, বরং ‘ইবাদতের নির্যাস।’ নু’মান ইবনে বাশির রা:-এর সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, দোয়াই ইবাদত। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন :﴿وَقَالَرَبُّكُمُادْعُونِيأَسْتَجِبْلَكُمْۚ তোমরা আমাকে ডাক। আমি তোমাদের (ডাকে) সাড়া দেবো। (সূরা মুমিন : ৬০)। নবী করিম সা: তাই আল্লাহর কাছে তাঁর যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া, অভাব-অভিযোগসহ জাগতিক ও পরকালীন সব বিষয়ে বিনয়সহকারে কাতর হৃদয়ে প্রার্থনা করতেন। কুরআনে বর্ণিত দোয়া ও মুনাজাত পাঠের পাশাপাশি নিজ থেকেও তিনি অনেক দোয়া ও ফরিয়াদ আল্লাহর কাছে পেশ করতেন। কিছু দোয়া তিনি সর্বদা করতেন আর কিছু দোয়া তিনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্থান-কাল অনুসারে করতেন। তবে প্রায় সব দোয়ার মধ্যেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের কথা ঘোষণা করেই তাঁর আবেদনের বিষয়বস্তু তুলে ধরতেন। এসব দোয়া কখনো নামাজে কখনো নামাজের বাইরে, আবার কখনো দুই হাত তুলে, আবার কখনো বা হাত না তুলে তিনি তা নিবেদন করতেন। ইবনে আব্বাস রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা: যখন রাতের বেলায় তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়াতেন, তখন বলতেন ‘হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা একমাত্র তোমারই জন্য। তুমিই আসমান-জমিন ও এ দুইয়ের মধ্যস্থিত সব কিছুর ব্যবস্থাপক, তোমার জন্যই সকল প্রশংসা, তুমি আসমান-জমিন ও এ দুইয়ের মধ্যস্থিত সব কিছুর নূর বা আলো। সব প্রশংসা তোমারই। একমাত্র তুমিই আসমান-জমিন ও এ দুয়ের মধ্যস্থিত সকল জিনিসের মালিক, সব প্রশংসা একমাত্র তোমারই, তুমিই বাস্তব ও সত্য, তোমার প্রতিশ্রুতি সত্য, তোমার সাথে সাক্ষাৎ সত্য, তোমার বাণী সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, সকল নবীই সত্য, মুহাম্মদ সা: সত্য ও কিয়ামত সত্য। হে আল্লাহ আমি তোমার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছি, তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি, তোমার ওপরই তাওয়াক্কুল করেছি, তোমাকে স্মরণে রেখেই আমার সব কাজের ব্যবস্থাপনা করেছি, তোমার কারণে বিবাদে লিপ্ত হয়েছি এবং তোমার কাছেই সব বিষয়ে মীমাংসার জন্য পেশ করেছি। অতএব আমার অতীত ও ভবিষ্যতের প্রকাশ্য ও গোপন সব অপরাধ ক্ষমা করে দাও। তুমিই অগ্রবর্তী ও পরবর্তী। তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ বা রব নেই।’
বিপদে-আপদে ফজরের নামাজের শেষ রাকাতে রুকু থেকে দাঁড়িয়ে তিনি কুনুতে নাজিলা পড়তেন। আর তা হচ্ছে : ‘হে আল্লাহ যাদের তুমি পথ দেখিয়েছ তাদের দলে শামিল করে আমাকেও পথ দেখাও, যাদের তুমি ক্ষমা করেছ তাদের দলে শামিল করে আমাকেও ক্ষমা করো, যাদের তুমি অভিভাবকত্ব করেছ, আমাকেও তুমি তাদের দলে শামিল করে নাও। আমাকে যা দিয়েছ তাতে বরকত দান করো। দূরদৃষ্টি থেকে তুমি আমাকে রক্ষা করো। নিশ্চয় তুমি নিয়ন্ত্রতা কখনো নিয়ন্ত্রিত নও। যে তোমার বন্ধু হবে সে লাঞ্ছিত হবে না। হে প্রভু! তুমিই বরকতের মালিক ও সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।’ ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করেন বিপদে-আপদে কুনুত পড়া এবং তা দূর হলে ছেড়ে দেয়া হজরতের রীতি ছিল। তিনি ফজর নামাজের জন্য এটা নির্দিষ্ট করেননি, তবে সেই নামাজেই বেশি পড়তেন। ইমাম আহমদ ইবনে আব্বাস রা: থেকে হাদিস বর্ণনা করে বলেন, হজরত সা: জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজের সময় দোয়া কুনুত পড়তেন, যখন তিনি শেষ রাকাতে সামিআল্লাহ হুলিমান হামিদাহ বলে দাঁড়াতেন তখন তিনি বনু সালিম, রা-আল, জাকোয়ান ও ইসিয়া গোত্রের জন্য বদদোয়া করতেন, পেছনের মুক্তাদিরা আমিন বলতেন। এভাবে রাসূলে করিম সা: আল্লাহর কাছে অবারিতভাবে দোয়া করতেন, আর আল্লাহর মহান দরবারে সে দোয়া কবুল হয়ে যেত। হাদিস শরিফে রাসূলে পাক সা:-এর এরূপ অসংখ্য দোয়া ও মুনাজাত দেখতে পাওয়া যায়। নবী পাক সা:-এর কয়েকটি দোয়া :
হে আল্লাহ! কবরের আজাব দজ্জালের ফিতনা জীবন-মরণের সর্ববিধ ঝঞ্ঝাট এবং পাপ ও ঋণের হাত থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।
হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করো। আমার ঘরের দৈন্যদশা দূর করে দাও, আর আমার রিজিকে বরকত দান করো।
হে আল্লাহ! আমার কাজকর্মে দৃঢ়তা ও অগ্রগামিতা দান করো, তোমার উত্তম ইবাদতের ক্ষমতা দাও। সুস্থ আত্মা ও সত্য ভাষণের অধিকারী করো, তোমার যা কিছু ভালো বলে জানা রয়েছে তা দাও, আর যা কিছু তুমি ক্ষতিকর বলে জানো তা থেকে রক্ষা করো। আমার যত পাপ যা তোমার জানা রয়েছে তা থেকে তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাই।
হে প্রভু! তুমি আমাকে নামাজে পরহেজগারি দান করো, তাতে পবিত্র রাখো। তুমি উত্তম পবিত্রকারী, তুমি আমার নামাজের অভিভাবক ও প্রভু।
হে প্রভু! আমাকে ক্ষমা করো, দয়া করো এবং পথ দেখাও।
হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় চাই অলসতা, অতি বার্ধক্য, সর্বপ্রকারের গুনাহ, ঋণগ্রস্থতা, কবরের আজাব, জাহান্নামের আজাব ও প্রাচুর্যের মন্দ পরিমাণ থেকে। তোমার কাছে আরো আশ্রয় চাই দারিদ্র্যের ফিতনা থেকে ও মসীহ দজ্জালের ফিতনা থেকে। হে আল্লাহ তুমি আমার পাপসমূহ তুষার ও শিলা বৃষ্টি দ্বারা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দাও। আমার হৃদয় মনকে এমনভাবে পরিষ্কার করে দাও, যেমন সাদা বস্ত্রকে ময়লা থেকে পরিষ্কার করা হয়। আমি ও আমার পাপসমূহের মাঝে এতটা দূরত্ব সৃষ্টি করে দাও যতটা দূরত্ব তুমি সৃষ্টি করেছ পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের মধ্যে।
হে আল্লাহ! আমি তোমার জ্ঞানের সাহায্যে তোমার কাছে কল্যাণ কামনা করছি, আমি তোমার শক্তির সাহায্যে তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি, কেননা তুমি ক্ষমতাবান ও আমি অক্ষম, তুমি জ্ঞানবান আর আমি জ্ঞানহীন, আর অদৃশ্য বিষয়ে তুমি পূর্ণরূপে পরিজ্ঞাত। হে আল্লাহ! তোমার জ্ঞানে, আমার এ কাজ (সংশ্লিষ্ট কাজের বর্ণনা) আমার দ্বীন, জীবন ও জীবিকা, কর্মের পরিণাম বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যে যদি কল্যাণকর হয়, তাহলে তুমি তা আমার জন্য নির্ধারিত করে দাও। আর যদি তোমার জ্ঞানে এ কাজ আমার জন্য মঙ্গল না হয়, তাহলে তা আমার থেকে ফিরিয়ে নাও এবং আমাকেও তা থেকে ফিরিয়ে রাখো। আমার জন্য সর্বক্ষেত্রে কল্যাণ নির্ধারণ করো।
হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে চারটি বিষয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করি। এমন জ্ঞান থেকে যা কোনো উপকারে আসে না, এমন অন্তর থেকে যা ভয় করে না, এমন আত্মা থেকে যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দোয়া থেকে যা কবুল হয় না।
হে আল্লাহ! আমার আত্মাকে তুমি অপবিত্রতা থেকে পবিত্র রাখো, আমার আমলকে তুমি প্রদর্শনী থেকে মুক্ত রাখো, আমার চুকে তুমি খিয়ানত থেকে মুক্ত রাখো। কেননা চুর খিয়ানত সম্পর্কে এবং অন্তরের গোপনীয়তা সম্পর্কে তুমি সম্যক অবগত।
আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক ও তাঁর কোনো শরিক নেই। সব সাম্রাজ্য তাঁর এবং সকল প্রশংসাও তাঁর। তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
হে আল্লাহ! দুনিয়া ও আখিরাতে তোমার কাছে ক্ষমা ও সুস্থতা প্রার্থনা করি।
হে প্রভু! তোমার কাছে দোয়া কামনায় আমাকে ব্যর্থকাম করো না এবং আমার অনুকূলে তুমি বড়ই মেহেরবান ও দয়ালু হিসেবে ধরা দাও। হে সর্বোত্তম প্রার্থনা পূরণকারী ও সর্বদাতা প্রভু!
হে আল্লাহ! তুমি আমার অন্তরে নূর (আলো) দাও, আমার কবরে নূর দাও, আমার সামনে ও আমার পেছনে নূর দাও। আমার ডান ও আমার বামে নূর দাও। আমার ওপরে এবং আমার নিচে নূর দাও। আমার কানে, আমার চোখে, আমার পশমে, আমার চামড়ায়, আমার মাংসে, আমার রক্তে, আমার হাড়ে নূর দাও। হে আল্লাহ! আমার নূরকে বর্ধিত করে দাও এবং আমার জন্য নূরের স্থায়ী ব্যবস্থা করো। তুমি পবিত্র (আল্লাহ), যিনি ইজ্জত ও মহত্ত্বের চাদরে আবৃত এবং নিজের জন্য তাকে বিশিষ্ট করে নিয়েছ। তিনি পবিত্র যিনি সম্মানের জামা পরিহিত এবং মর্যাদা দ্বারা সম্মানিত। তিনিই সুমহান যিনি ছাড়া আর কারো জন্য তাসবিহ পড়া বাঞ্ছনীয় নয়। তিনিই পবিত্র যিনি সমস্ত দানের ও নিয়ামতের অধিকারী, যিনি সুমহান ও মর্যাদাবান। পবিত্র তিনি যিনি মহিমাময় ও মহানুভব।
সাইয়্যেদুল ইসতিগফার হিসেবে যে দোয়াটি নবী পাক সা: আমাদের শিখিয়েছেন তা হচ্ছে : হে আল্লাহ! তুমি আমার রব, তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আমি তোমার গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সাথে কৃত ওয়াদা ও অঙ্গীকারের ওপর অটল আছি। আমার কর্মের মন্দ পরিণাম থেকে তোমার আশ্রয় চাই। তুমি আমাকে যত নিয়ামত দান করেছ, আমি সবই স্বীকার করেছি এবং স্বীকার করছি আমার গোনাহের কথাও। হে প্রভু! তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তুমি ছাড়া আর কেউ ক্ষমা করতে পারে না। (বোখারি)
==0=

Related Post