রাসূল (সঃ)-এর জীবনী (জন্ম থেকে নবুয়্যাতের আগ পর্যন্ত )

 

রাসূল (সঃ)-এর জীবনী (জন্ম থেকে নবুয়্যাতের আগ পর্যন্ত )

রাসূল (সঃ)-এর জীবনী (জন্ম থেকে নবুয়্যাতের আগ পর্যন্ত )

তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি

 ঈসায়ী ষষ্ঠ শতকের পৃথিবী।  সর্বত্র যুদ্ধ সংঘাত, রক্তপাত আর হানা হানী।  ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বের সর্বত্রই ছিল নৈরাজ্য আর অশান্তি।  যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল নিত্য নৈমিত্যিক ব্যাপার।  ঐতিহাসিকগণের মতে, জাহেলিয়াতের যুগে আরবে প্রায় ১৭০০ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল।  শান্তির দূরতম লক্ষণ কোথাও দৃষ্টি গোচর ছিল না।  বিশ্ব মানবতা ও সভ্যতার এহেন অশান্তিময় পরিস্হিতিতে, সারা দুনিয়া থেকে জাহেলিয়াতের অন্ধকার বিদূরিত করে হেদায়েতের আলোয় গোটা মানবতাকে উদ্ভাসিত করার জন্যে যাঁর আবির্ভাব ছিলো একান্ত অপরিহার্য এবং যিনি ছিলেন কিয়ামত পর্যন্ত এ দুনিয়ায় বসবাসকারী সমগ্র মানুষের প্রতি বিশ্ব প্রভুর পরম আশীর্বাদ স্বরূপ।  বিপর্যস্ত মানুষের শান্তি তথা বিশ্ব শান্তির জন্যে ৫৭০ খ্রীঃ ১২ই রবিউল আউয়াল, মতান্তরে ৫৭১ খ্রীঃ ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার সুবেহ সাদেকের সময় আল্লাহ তা’আলা রাসূল (সঃ) কে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন।  জন্মের আগেই এ মহামানবের পিতার ইন্তেকাল হয়েছিল।  তাই দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখলেন মুহাম্মদ। 

তিনি ছিলেন বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত 

  মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত।  তাঁর জন্মের ৫০ দিন পূর্বে   বায়তুল্লাহ আক্রমণকারী ইয়ামানের শক্তিশালী বাদশাহ আব্‌রাহা তার সৈন্যসহ সমূলে ধ্বংস হয়েছিল।  মক্কায় তখন মহা দুর্ভিক্ষ চলছিলো, তিনি তাঁর মায়ের গর্ভে আসার সাথেই দুর্ভিক্ষ অবসান হতে লাগলো।  হারিয়ে যাওয়া যম্‌যম্‌ কূপের সন্ধান পাওয়া গেলো।  তাঁর মা জননী আমেনা বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ তার পেটে অবস্থান নেয়ার সাথেই সারা বিশ্বে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়লো, যার সাহায্যে তিনি সুদূর সিরিয়ার রাজ প্রাসাদসমূহ পরিস্কার দেখতে ছিলেন।  এমনিভাবে আরো অসংখ্য ঘটনা পৃথিবীতে ঘটতে ছিল।  অতঃপর তিনি যখন জন্মগ্রহণ করলেন, মক্কায় তখন ভূ কম্পনের দ্বারা মূর্তি গুলো ভেঙ্গে চুরমার হতে লাগলো।  জ্বিনদের আসমান থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল।  অপর দিকে পারস্য সম্রাটের রাজমহলে ভূ কম্পনের আঘাতে রাজমহলের ১৪ টি স্তম্ভ  ধ্বসে পড়ে ছিলো।  এক দিকে শান্তির আগমন অপর দিকে বাতিলের মাথায় আঘাত।  তাইতো আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, “আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার উপর, ফলে সত্য মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ” ( আম্বিয়া-১৮)। 

হালিমা সাদিয়ার ঘরে বরকত 

সর্বপ্রথম মুহাম্মদ (সঃ)-এর জননী আমিনা তাঁকে দুধ পান করান।  দু’তিন দিন পর চাচা আবু লাহাবের বাঁদী সাওবিয়া তাঁকে স্তন্য দান করেন।  এরপর তৎকালীন আরবের নিয়ম অনুযায়ী গ্রামের মেয়েরা শহরে এসে বড়ো বড়ো অভিজাত পরিবারের সন্তানদের লালন-পালনের জন্যে সঙ্গে নিয়ে যেতো।  তাই মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্মের কয়েক দিন পরই হালিমা সা’দিয়া তাঁকে নিয়ে নিলেন।  হালিমা বর্ণনা করেন, আমি এতটা অসহায় ছিলাম যে, আমার উটে দুধ ছিলনা।  খাদ্যাভাবে খুবই দুর্বল ছিল, আমার নিজের সন্তান দুধের অভাবে হীনবল হয়ে পড়ে ছিল।  এমনই এক করুন পরিস্হিতিতে কোন ধনী লোকের সন্তান লালন-পালনের জন্যে যখন কেউ আমাকে পছন্দ করলোনা, তখন অনন্যপায় হয়ে এতিম মুহাম্মদকে গ্রহণ করলাম।  মুহাম্মদকে গ্রহণ করার সাথে সাথেই আমার দৈন্য দশা দূর হতে লাগল।  আমার উট শক্তিশালী হয়ে সবার আগে চলতে লাগল।  আমার ফসলাদি থেকে আরম্ভ করে সব কিছুতেই বরকত হতে লাগল।  এমন কি বনী সা’য়াদ গোত্রের প্রত্যেকের ঘর থেকে সু ঘ্রাণ  বের হতে লাগল।  কেনই বা এমনটি হবে না? তাঁকে তো পাঠানো হয়েছে বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত হিসেবে, “আমি তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি শুধু রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি। ” (আম্বিয়া-১০৭)। 

শিশু কালে মুহাম্মদ

হালিমা বর্ণনা করেন, শিশু কালে মুহাম্মদকে কখনও আমার দু’টি স্তন থেকে দুধ পান করাতে পারি নি।  সব সময় একটি দুধ পান করেছেন, অপরটি তাঁর দুধ ভাইয়ের জন্যে রেখেছেন।  মানবাধিকার রক্ষা করার প্রতি আল্লাহ পাকের যে নির্দেশ- “তোমরা পরস্পরের অধিকার ক্ষুন্ন করো না। ” (বাকারা-২৩৭)।  তা যেন তিনি শিশু কালেই বাস্তবায়ন শুরু করে ছিলেন।  হালিমা আরো বর্ণনা করেন, চিরাচরিত শিশু স্বভাবের ন্যায় মুহাম্মদ কখনও পায়খানা প্রশ্রাব করে নিজেকে অপবিত্র করেন নি।  যতক্ষণ না তাঁকে আমি দু পায়ের উপর বসাতাম ততক্ষণ তিনি প্রশ্রাব-পায়খানা করতেন না।  “পবিত্রতা ঈমানের অংগ। ” এ যেন তারই বাস্তবায়ন তিনি করছেন।  তিনি (হালিমা) আরো বলেন, শিশু মুহাম্মদকে কখনও উলঙ্গ রাখা যায় নি।  জীবনে কখনও তিনি সতর ঢাকা যে ফরজ তা তরক করেন নি।  তাঁর চাচা আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, কা’বা ঘর সংস্কারের সময় অন্যদের সাথে বালক মুহাম্মদও কাঁধে করে পাথর বহন করছিলেন, এতে তাঁর কাঁধে দাগ বসে যাচ্ছিলো, এ কষ্ট লাঘবের জন্যে আমি তাঁকে তাঁর লুঙ্গি খুলে ব্যবহার করতে বলি।  লুঙ্গি খোলার মুহূর্তেই তিনি লজ্বায় বেহুশ হয়ে পড়েন।  প্রত্যেকটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষেরই সতর ঢাকা যে ফরজ তা তিনি বাস্তবায়ন করে দুনিয়াবাসীকে বুঝায়ে দিলেন এবং জাহেলিয়াতের যুগের উলঙ্গপনার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন।  “লজ্বা ঈমানের অংগ। ” আজ আমরা তাঁর উম্মত হয়ে সেই জাহেলিয়াতের নগ্নতার দিকেই ধাবিত হচ্ছি।  আল্লাহ সকলকে হেফাজত করুন।

অসহায় মুহাম্মদ  

জন্মের ছয় মাস পূর্বে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন।  ছয় বছর পর মা জননীও ইন্তেকাল করলেন।  দাদা আব্দুল মুত্তালেব হলেন তাঁর এক মাত্র আশ্রয়দাতা।  আট বছর বয়সে শেষ পর্যন্ত তাকেও হারাতে হলো, দাদা ইন্তেকাল করলেন।  এবার দেখা-শোনার ভার ন্যস্ত হলো চাচা আবু তালিবের ওপর।  আবু তালিবের সংসার ছিল অসচ্ছল।  তিনি ব্যবসা করতে বছরে একবার সিরিয়া যেতেন। 

সিরিয়া গমন এবং বিখ্যাত পাদ্রী বহিরার সাক্ষাৎ

বারো বছরের কিশোর মুহাম্মদ, চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসায়ী কাফেলার সহিত সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।  কাফেলা যখন হেজাজে উপনীত হলো, তখন এ এলাকায়ই সামুদ জাতির ধ্বংসের কাহিনী শুনতে ছিলেন।  আল্লাহর হুকুম লংঘনের শাস্তি  দুনিয়াতেই হতে পারে এবং তার  যে ভয়াবহ রূপ কি, (“নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের পাকড়াও বড়ই কঠিন”   বুরূজ-১২) তা শুনে এবং স্বচক্ষে তাঁর দেশ ও জাতির শোচনীয় অবস্হা দেখে তিনি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন।  মরুভূমি পার হয়ে কাফেলা বসরা নগরীর উপকন্ঠে তাবু ফেললো।  পাশেই ছিল বিখ্যাত পাদ্রী বহিরার অবস্হান।  বহিরা চতুর্দিকে লক্ষ্য করে দেখতে পেলেন, গাছ-পালা পাহাড় পর্বত মুহাম্মদ এর সম্মানে সেজদাবনত হয়ে আছে।  তদুপরি তিনি ইঞ্জিল কিতাবে অনাগত মহানবীর আবির্ভাবের সমস্ত লক্ষণ বালক মুহাম্মদ- এর মধ্যে দেখতে পেলেন।  বহিরা মুহাম্মদ-এর সম্মানে এক ভোজ সভার আয়োজন করলেন।  ভোজ সভায় একান্ত একাকিত্বে বহিরা মুহাম্মদকে বললেন, “লাত ও উজ্বার” (দুটি মূর্তির নাম) কসম দিয়ে তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই? সাথে সাথে মুহাম্মদ দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলেন, “লাত ও উজ্বার” কসম দিয়ে নয়, বরং আল্লাহর কসম দিয়ে আপনার যা মন চায় জিজ্ঞেস করতে পারেন।  সেই অন্ধকার যুগে তিনি বালক অবস্হায় আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে শপথ করা মেনে নেন নি।  কারণ মুসলমানের জন্যে এটা বৈধ নয় যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে শপথ করবে।  আজ আমরা যারা তার উত্তরসূরী হয়ে নবী  প্রেমের দাবী করার পর, বিভিন্ন অমুসলিম দেশে ভ্রমণে গিয়ে তাদের সংস্কৃতি আমদানী করছি, এমনকি নিজের দেশে বসেও অমুসলিমদের সংস্কৃতির রঙ্গে রঙ্গীণ হয়ে কপালে টিপ, লাল ফিতার শাড়ী, পূজা-পার্বনের প্রতীক ধারণ করে কাকে খুশী করছি? অথচ আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে-“  তোমরা আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গীণ হও, তাঁর রংয়ের চেয়ে উত্তম রং আর কার হতে পারে?” (বাকারা-১৩৮)।  বহিরা বুঝতে পারলেন, এ বালকই হবেন শেষ নবী।  অতএব কাল বিলম্ব না করে, মুহাম্মদ-এর যাতে বিপদ না হয় সে জন্যে তার অনুরোধে কাফেলা মক্কায় ফিরে আসে।  ( চলবে-)

 

 

Related Post