অপসংস্কৃতি শব্দসংস্কৃতির ছোবল

অপসংস্কৃতির ছোবল : মধ্যযুগীয় বর্বরতা

অপসংস্কৃতির ছোবল : মধ্যযুগীয় বর্বরতা

মধ্যযুগীয় বর্বরতা
মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ আমাদের সমাজে লেখায়, বক্তৃতয়, আলাপচারিতায় একটি সাধারণ শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসলামের দুশমনরা যেমন ব্যবহার করছে, ইসলামপন্থীরাও ব্যবহার করছেন। যারা ব্যবহার করেন, তারা কি জানেন, মধ্যযুগের শুরু কখন থেকে আর শেষ কখন? তারা কি জানেন এই যুগকে কেন বর্বর যুগ বলা হয়? ১৯৯৩ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিকে একজন ইসলামী ব্যক্তিত্ব পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে পর পর দু’দিন তার বিবৃতির এক স্থানে মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। বাধ্য হয়ে এই লোকের অজ্ঞতার বিরুদ্ধে একটি সপ্তাহিকীতে আমি আলোচনা করি।
আসুন, আমরা প্রথমে মধ্যযুগের চৌহদ্দি নিরুপণ করি, অতঃপর আলোচনা করে দেখি, এ যুগকে কেন বর্বর যুগ বলা হলো, এবং কারা বললো? সর্বশেষ আমরা দেখবো, এই শব্দ মুসলমানরা ব্যবহার করতে পারেন কিনা? আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রমাণ্য ইতিহাসে ও তথ্য গাইডে মধ্যযুগের সময়-সীমা চিহ্নিত করেছেন ‘৫ম শতাব্দি থেকে ১৫শ, শতাব্দি পর্যন্ত পিরিয়ডকে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, the period from the decline of the Roman Empire in the 5th century to the revival of latters in Europe at the end of the 15th century. অর্থাৎ রোমের পতন ও ইউরোপের মুদ্রণযন্ত্র আবিস্কারের মধ্যবর্তী সময় বা যুগ। এই সংজ্ঞাকে সমর্থন করেছে সর্বজন স্বীকৃত প্রামাণ্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক অভিধান ও বিশ্বকোষ। শুধু ড. এন্নানডেল তার কনসাইজ ডিকশনারীতে (৪৩৩ পৃষ্ঠায়) মধ্যযুগের সময় কালের শুরুটা ৩শ, বছর এগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যুগের শেষ সীমানা অপরিবর্তিত রেখেছেন। তিনি বলেছেন, the period extending from the decline of the roman empire till the revival of latters in Europe or from the eight to the middle of the fifteenth century of the christan Era. তার মতে মধ্যযুগের শুরু অষ্টম শতাব্দি থেকে।
আমাদের বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের ৮৭৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, মধ্যযুগ ১১শ, শতাব্দি থেকে ১৭শ, শতাব্দি পর্যন্ত। কলিকাতার সংসদ বাংলা অভিধান একই মত পোষণ করে। একটার নকল অন্যটি। সুতরাং মত অভিন্ন হওয়ার কথা। তবে এ মতের সমর্থনে আর কেউ নেই।
ঢাকাস্থ ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগ্রামসের তত্ত্বাবধানে সংকলিত ও সম্পাদিত জুলাই ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত বাংলা বিশ্ব কোষের তৃতীয় খন্ডে ৬২৮ পৃষ্ঠায় মধ্য যুগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাসে একটি সময় বিভাগ । এই যুগকে অন্ধকার যুগ বলা হয়। এর সঠিক সময় নির্দেশ করা সম্ভব নয়। তবে মোটামুটিভাবে ৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দ অর্থাৎ পশ্চিম রোমক স¤্রাজ্যের পতনকাল থেকে শুরু করে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ, কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিস্কারের সময় পর্যন্ত মধ্যযুগ বলা হয়।
আমার মতে ড. এন্নানডেল এর মতই সঠিক। ৫ম শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময় আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ। ইসলামের অভ্যুদয়ের, প্রসারের, বিজয়ের সময়কাল মধ্যযুগের অন্তর্ভুক্ত। মুসলমানদের প্রশাসনিক পতনও ইউরোপের শিল্প বিপ্লব থেকে শুরু হয় আধুনিককাল। সুতরাং মধ্য যুগকে বলা যায় ইসলামের যুগ।
ইসলামের যুগ এই মধ্যযুগকে কেন বর্বরযুগ বলা হলো এবং কারা বললো, তা আমাদের দেখতে হবে। শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ইউরোপে নতুন ধারা প্রবর্তন এবং মুদ্রণযন্ত্র আবিস্কারের সাথে সাথে মধ্যযুগের অবসান ঘটে। ইসলামের বিজয় অভিযানে খ্রীষ্ট জগত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এদিকে স্পেনে মুসলমানদের জ্ঞান চর্চা ইউরোপকে তথা খ্রীষ্টান জগতকে নাড়া দেয়। খ্রীষ্টানরা পশ্চিম ইউরোপকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে উত্থানের চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। মধ্যযুগের প্রথম যুগে এমনকি মধ্যম পর্যায়েও খ্রীষ্ট ধর্ম ও খ্রীষ্টানরা ভীষণ প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটচ্ছিল। তারা প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজছিলো। কিন্তু মধ্যযুগের ইসলামী সংষ্কৃতির প্রভাব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। তখন তারা ইসলামের এই যুগকে বর্বর যুগ বলতে শুরু করে। মধ্যযুগ তথা ইসলামের আধিপত্যের যুগ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইউরোপে বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপে পূণর্জাগরণ ঘটে এবং তা খ্রীষ্টানদের নেতৃত্বেই ঘটে। তারা তখন নতুন করে ইতিহাস লিখতে শুরু করে। খ্রীষ্টানদের উত্থানের যুগে শাসন দণ্ড ও কলম দু’টি তাদের হাতে ছিল। মুসলমানদের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাসকে তারা বিকৃত করতে থাকে। সে ইতিহাসই পরবর্তি সময়ে আমাদের দেশের পাঠ্য পুস্তক হয়ে যায়। তাদের লেখা ইতিহাস পাঠ করেই আমরা শিখলাম মধ্যযুগ-বর্বরযুগ। মধ্যযুগের সব কিছুকে তারা বর্বরতার সাথে তুলনা করতে থাকে। মুসলমানরা নিজেদের ইতিাহস পাঠ ছেড়ে দেয়। ইংরেজ লেখকদের ইতিহাস থেকে পাঠ নিতে শুরু করে। তারা তখন বলতে থাকে, মধ্যযুগ ছিল অন্ধকার যুগ। তারা একবারও ভেবে দেখেনি যে, এই মধ্যযুগে বিশ্বের জাহেলিয়াতকে ধ্বংস করে জাহেলিয়াতের ধ্বংসাবশেষের ওপর ইসলামের বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করে। মধ্যযুগের ৮শ, বছর স্পেনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে ইউরোপের খ্রীষ্টান জ্ঞান-পিপাসার্তরা জ্ঞান বারি পান করতো। ইবনে সিনা, আল গাজালী, আল ফারাবী, ইবনে খালদুন এরা সবই মধ্যযুগের স্বর্ণ ফসল। এম আকবর আলীর ‘বিজ্ঞানে মুসলমানের দান’ পুস্তকগুলোর পৃষ্ঠা উল্টালেই তা বুঝতে পারবেন, মধ্যযুগ অন্ধকার না আলোকময় ছিল।
আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শামস উদ্দীন মিয়া (ইতিহাসে গোল্ড মেডেলিষ্ট) তার   Islam and the modern world পুস্তকে লিখেছেন, Mediaeval age was not the dark age. The was the age of the most civilized and enlightened nation.Mediaeval age were ids the mother of modern age. Ethical values and scientific that modern age. Is far behnd of mediaeval standard.  অর্থাৎ মধ্যযুগ অন্ধকার যুগ ছিল না। মধ্যযুগ হচ্ছে আধুনিক যুগের জননী। মধ্যযুগের নৈতিক মূল্যবোধ এতো উচ্চ, পরিশিলীত এবং যৌক্তিক ছিল, যার অনেক পিছনে বর্তমান যুগ রয়েছে। স্টেনলি রেন পুল, হিট্টি, মুয়ীর, টয়েনবির মতো ঐতিহাসিকরা মধ্যযুগ সম্পর্কে একই রায় দিয়েছেন। মধ্যযুগে যারা বর্বর জীবন-যাপন করতো, তারা মুসলমান ছিল না। ছিলো ভিন্ন জাতি, যারা আধুনিক যুগে সভ্য হয়েছে। স্পেনের কর্ডোবায় ও আন্দালোসিয়ায় এবং নিশাপুরে লেখা পড়া করে শিক্ষিত হয়েছে। বর্বর মানুষ সব যুগেই থাকে এবং মধ্যযুগেও ছিলো। মধ্যযুগের বর্বররা বর্বর ছিল বটে, কিন্তু আধুনিক যুগের বর্বরদের চেয়ে অনেক অনেক সভ্য ছিলো। সে যুগের বর্বররা মানুষ খুন করে লাশকে অক্ষত রাখতো। কিন্তু আধুনিক বর্বররা খুন করে লাশকে কেটে কুটি কুটি করে বাক্স ভরে রাস্তায় বা নদীতে ফেলে দেয়।
যে সব মুসলমান ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ শব্দ ব্যবহার করেন, তারাতো প্রকারান্তরে নিজেদেরই বর্বর বলছেন, তা কি তারা খেয়াল করে দেখেছেন? মধ্যযুগে আমরা যে দ্বীন, শারীয়াত, কুরআন, হাদীস, ফিকাহ্  পেয়েছি, তাতে উল্লেখিত বিধান অনুযায়ী আমাদের নাম, আমাদের পরিচিতি, আমাদের বিবাহ, আকীকা, খতনা, নামায, রোযা, অযু, গোসল, সামাজিক বন্ধন সবই, আমরাই মধ্যযুগের গর্ভজাত সন্তান। এখন যদি মধ্যযুগকে আমরা বর্বর যুগ বলি, মধ্যযুগের বোধ আর মূল্যবোধকে আমরা বর্বরতা বলি, তা হলে সে যুগের গর্ভ থেকে যাদের জন্ম, সেই মুল্যবোধে যারা মানুষ, তারাও বর্বর। যিনি ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ শব্দ ব্যবহার করেন, তারাও বর্বর। তাহলে আমাদের অস্তিত্ব থাকছে কোথায়? আমার মা যদি অসুন্দরীও হোন, তবুও তিনি আমাদের মা। আমি পারি না, আমার মার রূপের নিন্দা করতে। যে সন্তান তা করে, সে বর্বর ও কুলাঙ্গার। অথচ নিজের মা তো পরমা সুন্দরী, এই গর্ভে আমার জন্ম এই জন্য আমার গর্ব হওয়া উচিত। তারা ইতিহাসের আয়নায় যুগের চেহারাও দেখছে না, জানছে না, কোন গর্ব থেকে তাদের জন্ম। ওরা বড়ই বদ নসীব।
মধ্যযুগ আমাদের গৌরবের যুগ। বর্বরতা সব যুগের বর্বররাই করেছে, এখনো করছে। আগামীতেও করবে। সময়, কাল, যুগকে গালি দিতে নেই। ইসলামই তা করতে মানা করেছে। ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ এ শব্দের মানে টা কি? ইসলামের যুগকে গালি দেয়া ছাড়া এর আর কোন মানে নেই।
দুশমনদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাদের বুলি মুখে বা কলমে নিয়ে আত্মঘাতি প্রয়োগে আর যেন আগ্রহ প্রকাশ না করি। কোন্ কথা, কোন্ শব্দ, আমাদের জন্য ভাল আর কোন্টা মন্দ তা বুঝার তৌফিক যেন আল্লাহ আমাদের দেন। আমীন।

Related Post