অপসংস্কৃতি শব্দ সংস্কৃতির ছোবল

অপসংস্কৃতি শব্দ সংস্কৃতির ছোবল

অপসংস্কৃতি শব্দ সংস্কৃতির ছোবল

অপসংস্কৃতি শব্দ সংস্কৃতির ছোবলঃ

ভেস্ত/হদিস
ভেস্ত আর হদিস এই দুটি শব্দ বেহেশত ও হাদীস বানানের বিকৃত বানান ও রূপভেদ। কলিকাতার একটি অভিধানেও এই ব্যাখ্যা লিখা আছে। শব্দ দু’টি পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন প্রতিবেদনের সিরোনামে, বিবরণে ও বয়ানে প্রতিদিন ব্যবহার হচ্ছে। বক্তাদের বক্তব্যেও আসছে। বাংলাদেশে এই শব্দ দু’টির ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সকলেই। অন্য ধর্মাবলম্বী বাংলাভাষাভাষীরা কোন নিয়তে ব্যবহার করেন তা পরিস্কার। কিন্তু মুসলমানরা কেন তাদের বেহেশত ও হাদীসকে বিকৃত বানানে ও বিকৃত অর্থে ব্যবহার করেন, তা আমি বুঝি না। কলিকাতা থেকে প্রকাশিত সংসদ বাঙ্গলা অভিধান চতুর্থ সংস্করণে ৫৪৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, বেস্ত= ‘বেহেশত’-এর রূপভেদ বা বানানভেদ। হাদীস সম্পর্কে ৭১১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, হাদীস আরবী শব্দ। এর থেকে হদিস এর উদ্ভব। অর্থ হচ্ছে তত্ত্ব, সন্ধান, খোঁজ। কলকাতার বাবু লিখকেরা বেহেস্ত ও হাদীসের বানানের বিকৃত রূপ নিয়েও যদি খুশী থাকতেন, আর আগে বারতেন না, তা হলে মনে করতাম, স্বভাব দোষে তারা ইসলামী পরিভাষা ও মুসলমানী নামকে বিকৃত বানানে লিখে থাকেন, এ তাদের ফেতরত। কিন্তু তারা এ পর্যন্ত ইতি না টেনে দু’টি পবিত্র শব্দকে বিকৃত বানানে বিকৃত অর্থে অপপ্রয়োগ করে বুঝিয়ে দিলেন যে, যেসব মুসলমান বেহেশতে যাওয়ার আশা করে, তারা গোল্লায় যায়। আর হাদীসতো খোজখুজির একটি শব্দ। এছাড়া তার কোন মূল্য নেই। মুসলমানরা কোন ভাবনা-চিন্তা ছাড়া বাবুদের কলমের ডগা দিয়ে যা আসে, তা যাচাই-বাছাই না করে বিষকে অমৃত মনে করে গলাধঃকরণ করেন। তারা ভেবেও দেখেন না, শব্দ দু’টির অরেজিন অবস্থা কি ছিলো, কেন বিকৃত করা হলো, কারা বিকৃত করলো এবং প্রয়োগে কেন অপপ্রয়োগের আশ্রয় নেয়া হলো? না, এদিকে কোন-ভাবনা চিন্তা নেই। অনেক মুসলমান লেখক, বক্তা নিজ নিজ লেখায় ও বক্তৃতায় এবং সাধারণ শিক্ষিত লোকের আটপৌরে ভাষায় ও বিকৃত বানানের ভেস্ত/হদিস বিকৃত অর্থেই প্রয়োগ হচ্ছে। যারা কথায় কথায় ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ টানেন, তারাও পত্র-পত্রিকায় লেখেন,‘প্রকল্পটি ভেস্তে গেছে’। অর্থাৎ গোল্লায় গেছে অথবা পুলিশ কোন হদিস পায়নি আসামির, অর্থাৎ সন্ধান পায়নি।
আগেই বলেছি, শব্দ দু’টির বিকৃত রূপ ও বিকৃত বানানের জন্মদাতা এক শ্রেণীর হিন্দু লেখক। মুসলমানদের বেহেশত নসীব হওয়াকে বা বেহেশতে যাওয়ার আশাকে গোল্লায় যাওয়ার অর্থে ব্যঙ্গ করে ব্যবহার করেন। এ কারণে তারা বেহেশতের শুদ্ধ বানানকে উপহাস করে ভুল বানানে লেখেন। অনুরূপভাবে তারা হাদীসকে হদিস বলেন, বিকৃত উচ্চারণ অনুযায়ী বানানও লেখেন। হাদীসের স্থান কুরআনের পরই। কুরআনের ব্যাখ্যায় হচ্ছে হাদীস। হাদীস দিয়েই ব্যাখ্যা জানতে হয় কুরআনের অনেক আদেশ-নিষেধের। কুরআনে সালাত আদায় করার হুকুম-নির্দেশ আছে। কিন্তু সালাতের রাকায়াতের সংখ্যা কতো এবং কিভাবে সালাত আদায় করতে হয়, তার বর্ণনা কুরআনে নেই, তা রয়েছে হাদীসে। এ জন্য নেক নিয়াতে সন্ধান অর্থে তারা হাদীসকে গ্রহণ না করে বিকৃত বানানে, অর্থে ব্যঞ্জনায় এক সাধারণ শব্দে পরিণত করে ব্যবহার করে থাকেন। কুরআনের পরে যে হাদীসের স্থান এই হাদীসকে ‘হদিস’ বানিয়ে যেমন ইচ্ছ তেমন ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ আসামী খুঁজে পাচ্ছে না, এ ক্ষেত্রেও ‘হদিস’ প্রয়োগ হচ্ছে অর্থাৎ পুলিশ আসামীর কোন হদিস পাচ্ছে না। বাবুর্চি কোথায় চামুচ রেখেছে তা খুঁজে পাচ্ছে না, এখানেও হদিসের ব্যবহার। কোথায় তিনি মানি ব্যাগ রেখেছেন খুঁজে পাচ্ছেন না, এখানেও হদিসের’ ব্যবহার। অর্থাৎ মানি ব্যাগের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। হিন্দু লেখকরা এই শব্দকে বানানে ও অর্থে বিকৃত করে এবং এর প্রয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শব্দ দু’টিকে মুসলমানদের বিকৃত ব্যবহারের জন্যে ছেড়ে দিয়েছেন। মুসলমানরা বাবুদেরই অনুসরণ করছেন বোকার অনুসরণের মতো। এক শ্রেণীর হিন্দু লেখক এতই মুসলিম বিদ্বেষী, তারা ‘মুসলমান’ শব্দকে শুদ্ধ বানানে লেখেন না। তাদের লেখায় মুসলমান শব্দ পাওয়া যায় ‘মুচলমান’। বানানে ইসলাম পাওয়া যায় ইশলাম বা এশলাম। তারা ‘সোহরাওয়ার্দী’ আর ‘আকরাম’ খা কে বরাবরই লিখলেন ‘সুবাবর্দি’ ও ‘আক্রমন’ খা বানানে। তাদের বদ নিয়তের বদ মতলবের গরাগরিতে আমাদের পরভিাষার বানানের বিকৃতিকে আর অপপ্রয়োগকে আমরা কিভাবে গ্রহণ করতে পারি। আমাদের বেহেশত ও হাদীসকে বিকৃত বানানে অভিধানে পৃথকভাবে উল্লেখ করে বিকৃত অর্থ আবিস্কার করার পর হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদেরই উপহার দলেন, কি জঘন্য ধৃষ্ট্রতা। আর আমরাও ব্যবহার করছি তাদের যোগ্য সেবাদাসীদের ন্যায়। এও এক জঘন্য মানসিকতা।
এলাহিকাণ্ড
এলাহিকাণ্ড মানে বিরাট ব্যাপার, অনাড়ম্বর বা অকল্পনীয় বিরাট কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা। ইংরেজিতে মৎধহফ ঢ়ড়সঢ়ঁংং শব্দ দ্বারা এলাহিকাণ্ড বুঝানো হয়। শব্দ যথাস্থানে সঠিক। লেখায় সঠিক অর্থে প্রয়োগ হলে কোন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়না। আলাপচারিতায় উচ্চারিত হলেও ভাল। ‘এলাহিকাণ্ড’ মানে যা সাধারণত ঘটেনা এমন কাণ্ড। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ঘটনার পিছনে এলাহি নেই? তার কুদরতি হাততো রয়েছে সর্বোত্রই, সকল আয়োজনে, প্রত্যেক কর্মকাণ্ডে এবং প্রত্যেক ব্যাপারে। যদি আমরা তা স্বীকার করি, তা হলেতো এলাহির শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
‘এলাহিকাণ্ড’ বিরাট ও শুভ অনুষ্ঠানের বর্ণনার ক্ষেত্রে যেমন প্রয়োগ হতে পারে তেমনি অপর দিকে বিরাট দুর্ঘটনা, মহা  দুর্যোগ মহাবিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও বর্ণনার প্রয়োজনে আসতে পারে। কিন্তু কথা হলো, যিনি এ শব্দের প্রয়োগ করবেন, এলাহিতে তার ঈমান গভীর না হালকা, না ঈমানই নেই, তার প্রয়োগ-বুদ্ধি ও বিবেচনা বোধ কেমন, তাও দেখতে হবে। অথবা তিনি কি শুধু কৌতুক বা উপহাস করার জন্য শব্দটি প্রয়োগ করছেন কিনা, এ সব দিক বিবেচনা করে অভিমত ব্যক্ত করতে পারি যে, তিনি শব্দটির সঠিক অর্থে সঠিক ব্যবহার করছেন কিনা। ধরুন, বিন ধর্মের এক উগ্র সাম্প্রদায়িক লেখক বা সাংবাদিক, যিনি সুযোগ পেলেই মুসলিম পরিভাষা, মুসলিম কৃষ্টি সংস্কৃতিমূলক শব্দ ব্যবহার করেন ব্যঙ্গ বা তীর্যক মন্তব্য করার জন্য। তিনি যখন ‘এলাহিকাণ্ড’ দিয়ে কোন রচনা করবেন, তখন এ শব্দের ব্যবহারে সুবিচার করবেন না। মুসলমান শব্দকে মুচলমান বানানে না লেখলে তিনি মনে শান্তি পাবেন না। একজন মুসলিম লেখক দুনিয়াকে বলেছেন, কুদরতের কারখানা, একে অমুসলিম লেখক বলেছেন, দুনিয়া এক অগ্নিকুণ্ড। এভাবে যার ঈমান যে দৃষ্টিকোন থেকে দুনিয়াকে গ্রহণ করেছেন, তিনি সেভাবে দুনিয়াকে চিত্রিত করেছেন বা করে থাকেন। ‘এলাহিকাণ্ড’ প্রয়োগে আমাদের ঈমানি সচেতনতা থাকা উচিত।

Related Post