ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হওয়ার একমাত্র কারণ, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর সুন্দর ও সুশৃঙ্খল অবদান। অর্থনীতির মূল কথা হচ্ছে, সীমিত সম্পদকে অত্যন্ত দক্ষভাবে বিপুল পরিমাণ চাহিদা মিটানো। প্রাচীন ইহুদিদের দ্বারা যে সুদ ভিত্তিক ক্ষতিকর অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে উঠেছিল যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা, যা কিনা অর্থনৈতিক শোষণ ও চরম বৈষম্য সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া। ইসলামের সুদ মুক্ত অর্থনীতির মাধ্যমে মানুষ পেয়েছে একটি সুস্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে কারো অধিকার খর্ব হবে না, সম্পদের সুষম বণ্টন সম্ভব হবে, ধনীর সম্পদের উপর গরীবদের একটি নির্দিষ্ট অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। হ্যাঁ, এই সুষম বণ্টন ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যই যাকাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর কোরআন করীমে সালাতের পাশাপাশি অনেক জায়গায় যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এটি ধনীদের উপর ফরজ যেমনটি ফরজ রোজা, নামাজ ও হজ্জ।
পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজে আমরা দেখতে পাই, বিশ্বের ৮৩ ভাগ মানুষ দারিদের কশাঘাতে মানবেতর জীবন-যাপন করছে আর মাত্র ১৭ ভাগ মানুষ বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে এই শোষণ ও নিপীড়নকে স্থায়ী কাঠামো দেয়ার ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ক্লাসিক্যাল ও নিও ক্লাসিক্যাল পদ্ধতিতে তাদের অর্থনীতিকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী, যেখানে সুযোগ-সুবিধা পাবার অধিকার রাখা হচ্ছে কেবল যার টাকা আছে তার। অর্থাৎ যার অর্থ নেই তার উন্নত জীবন, চিকিৎসা ও শিক্ষার কোন অধিকার নেই। এর ফলে ধনী ও গরীবের মধ্যে ব্যবধান আরও বেশি তরান্বিত হচ্ছে। পরার্থপরতার অর্থনীতির যে বুলি আওরানো হচ্ছে তা নিছক টকিং শপ ( Talking Shop) ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইসলামের সাথে অন্য সকল ধর্মের মূল পার্থক্য হচ্ছে, এটি নিছক নীতিমালা সর্বস্ব ধর্ম নয়। এখানে নীতিমালা গুলোর জীবন চর্চার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ নবী (সা:) ও তার সাহাবী (রা) কর্তৃক ইসলামী স্বর্ণযুগ প্রতিষ্ঠা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীতে কাউকে কারো দাস বা অধীন হিসেবে পাঠান নি। এটা শোষক আর সুবিধাবাদীদের নিকৃষ্ট পদ্ধতি যা বিশ্বব্যাপী আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এই সুবিধাবাদীরা যাতে অর্থনৈতিক পরাধীনতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে গোলাম আর নিজেকে প্রভুর আসনে অধিষ্ঠিত করতে না পারে তাই যাকাত নামক একটি সুন্দর ও কার্যকরী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার উপর হক কেবল দরিদ্রের।
আমাদের দেশে যে সব মানুষের উপর যাকাত ফরজ হয়েছে তারা যদি তা যথাযথভাবে আদায় করেন, তাতে যে সমাজের দারিদ্র বহুলাংশে হ্রাস পাবে তা বোঝার জন্য কারো খুব বেশি চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু যে নগণ্য সংখ্যক ধনিক শ্রেণী যাকাত দেয় তাতে দারিদ্র তো দুরের কথা ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করছে। এখানে যাকাত প্রদানের জন্য তাদের ক্যালকুলেটর দরকার পরে না। এক সেকেন্ডেই হিসেব কষে নেন কটা শাড়ি-লুঙ্গি দিতে হবে। তাও আবার সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই মাইক ও ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচারণা দিয়ে। এতে ঐ এলাকায় যাকাত দাতার ব্যাপক সুনাম ছড়িয়ে পরে, মানুষ তাকে সালাম দেয়। বছর ঘুরে নির্দিষ্ট সময় আসলেই সবাই তাকে যাকাত কবে দেবেন এই রকম প্রশ্ন করেন রাজপথ, চায়ের দোকান ইত্যাদি জায়গায়। ফলে তিনি অনেক সম্মান ও আত্মতৃপ্তি উপলব্ধি করে থাকেন। একসময় সমাজ সেবকের মালা তার গলায় শোভা পায়, নির্বাচনে দাঁড়ালে সবাই তাকে চেনেন একজন দাতা হিসেবে। ফলে ইহকালেই তিনি জান্নাতের সুবাতাস পেতে থাকেন। তাই বুঝি এই টাইপের যাকাত বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে গিয়েছে?
গত সপ্তাহে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম এক গাঁটটি শাড়ি। দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না যে কাপড়গুলো যাকাতের উদ্দেশ্যে কেনা। কারণ কাপড়ের দোকান গুলোতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ‘এখানে যাকাতের কাপড় পাওয়া’ যায় বলে প্রচারণা দেখা যায়। এই যাকাত প্রদানকারীরা কি পারবেন ঐ টাইপের শাড়ীগুলো নিজে পরতে? আর যাকাতের টাকা দিয়ে তিনি যে শাড়ি দিচ্ছেন এই অধিকার তিনি কোথা থেকে পেলেন? যাকাত একমাত্র গরীবের হক। নির্দিষ্ট টাকা পেয়ে তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা দিয়ে তিনি কি করবেন।
যাকাত সমাজে দারিদ্র হ্রাস করছে কি না তা বুঝা যাবে যদি প্রতি বছর যাকাত গ্রহণকারীর সংখ্যা হ্রাস পায়। কিন্তু প্রতি বছর আমাদের দেশে যাকাত গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে না কমছে? নিশ্চয়ই বাড়ছে বহুগুণে । কিন্তু কেন বাড়বে? তবে কি মানুষ আরও বেশি ভিক্ষাবৃত্তিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে না? নিম্নমানের কাপড় যাকাত দেয়ার রীতি তারা কোথায় পেলেন? কারা শিখিয়েছে তাদের এ রকম যাকাতের পদ্ধতি? তারা কি জানে না যে, যাকাত দিতে হবে ইসলামের নির্দিষ্ট পন্থায়। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে যাকাতের হিসেব করতে হবে। যাকাতের টাকা এমন একজন বা খুব বেশি টাকা হলে একাধিক ব্যক্তিকে দিতে হবে যাতে করে তার দ্বিতীয়বার যাকাতের দরকার না হয়। অবশ্যই তা গোপনে প্রদান করতে হবে। এমন কি যাকে প্রদান করবে তাকেও বলা যাবে না যে, এই নাও যাকাত দিলাম।
প্রতি বছর নামমাত্র যাকাত প্রদান করা আমাদের সমাজে একটি প্রথা ও উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে প্রতি বার মানুষ মারা যাচ্ছে। এই রকম ঘটনার নিন্দা জানাবার ভাষা আমাদের নেই। আমাদের উচিত ব্যাপকভাবে প্রচার করা যে এইভাবে যাকাত দিলে কিয়ামতের দিন তাদের সম্পদকে গলিত করে তাদের পিঠে লাগিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু তাতেও সন্দেহ যে, তারা তা মানবে কিনা। কেননা তারা পরকাল নয়, বরং ইহকালে নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্যই যাকাত দিয়ে থাকেন। যাকাত এখন আমাদের দেশে একটি আনুষ্ঠানিক ভিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। তাই দারিদ্র কমার পরিবর্তে আরও বাড়ছে আর সুবিধাবাদীরা ট্যাক্স ফাকি দেয়ার পায়তারা করছে লোক দেখানো যাকাত প্রদান করে। অর্থাৎ যা যাকাত দিচ্ছে তাও আবার সরকারের প্রাপ্য টাকার অংশও হতে পারে কারো কারো ক্ষেত্রে।
সুতরাং যতদিন না ইসলামিক পন্থায় সুষ্ঠুভাবে যাকাত প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন যাকাতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোন সুবিধা তো দুরের কথা, যাকাতকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে এক শ্রেণীর শোষক শ্রেণী তাদের কার্যসিদ্ধি করে যেতে থাকবে যা দেশকে স্থায়ী দারিদ্রে দিকে নিয়ে যেতেই থাকবে। তাদের মনে রাখা উচিত যাকাত তাদের পক্ষ থেকে গরীবের জন্য ভিক্ষা নয়; অধিকার এবং এটা বান্দার অধিকার যা ক্ষমা করার ভার আল্লাহ ঐ বান্দার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। যারা এমনটি করেন তারা যদি আল্লাহকে ভয় করেন, তবে তাদের এখনই উচিত এই পথ থেকে সরে আসা। তা না হলে সম্পদ তাদের জাহান্নামের একমাত্র কারণ হবে। যে কাজটি আমাদের উপর ফরজ, আমাদের উচিত সেই বিষয়টি নিয়ে নিজে পড়াশুনা করা, কেবল অন্যের ফতওয়ার উপর নির্ভর করে নয়। মহান আল্লাহ আমাদের এই বিষয়ে সচেতন হওয়ার মন মানসিকতা সৃষ্টি করার তৌফিক দিন।