আল্লাহর অস্তিত্ব

আল্লাহর অস্তিত্ব

আল্লাহর অস্তিত্ব

আল্লাহর স্বত্বার স্বরূপ কি?
তিনি কেমন , কি তার পরিচয় ?
দার্শনিকরা এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অনুমান আন্দাজের প্রহেলিকায় সাঁতার দিয়ে তারা স্রষ্টার অপ্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছেন। সমগ্র সৃষ্টি যার ইচ্ছার সামান্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র, সীমিত জ্ঞানের দ্বারা তাঁর স্বত্বার স্বরূপ উদঘাটন করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআন আল্লাহর যে পরিচয় তুলে ধরেছে তা সর্বাঙ্গীন সুন্দর এক মহিমাময় স্রষ্টার প্রতিভাস। মৃত্যু তো দূরের কথা ঘুম এবং তন্দ্রা তাকে আচ্ছন্ন করে না। আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র আধিপত্য তাঁর।  পূর্বানুমতি ছাড়া তাঁর সামনে একটি শব্দও কেউ উচ্চারণ করতে পারবে না। অতীত বর্তমান ভবিষ্যত বলে তাঁর কিছু নেই। মহাকাল তাঁর আদেশের অপেক্ষায় স্থির এবং নতজানূ। জ্ঞান হল তাঁর রহস্যরাজ্যের ঈষৎ ঝলকানি মাত্র। তিনি যাকে তা দান করেন সেই মর্মমূলে প্রজ্ঞার বিকাশ অনুভব করে। আকাশ ও পৃথিবীর সীমাতিক্রম করে পরিব্যাপ্ত হয়েছে তাঁর আসন। সৃষ্টিলোকের পরিচর্যা তাকে কখনই পরিশ্রান্ত করেনা। তিনি পরিধান করে আছেন শ্রেষ্ঠত্বের মহান চাদর। কুরআন বলেঃ “আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, স্বাধিষ্ঠ-বিশ্বধাতা। তাকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করেনা। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাঁর। কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করবে? তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা  আয়ত্ত করতে পারেনা। তাঁর আসন আকাশ ও পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত। এদের রক্ষণাবেক্ষণ তাকে ক্লান্ত করেনা; তিনি মহান শ্রেষ্ঠ।” (সূরা বাকারা: ২৫৫)
আল্লাহপাক নিজ করুণায় তাঁর পরিচয় বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। মানবতার শিক্ষক নবী রাসূলদের শিক্ষার দায়িত্ব তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন। তাঁর স্বত্বার অখণ্ডতা এবং অনুপম ব্যবস্থাপনার ধারনা তিনি দান করেছেন জিব্রাইল ফিরিশতার মাধ্যমে। আল্লাহপাক ইবরাহীম (আ.)-কে আকাশ ও ধরাবক্ষের লালনসূত্র জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সামনে তুলে ধরেছেন বিশ্বলোকের রহস্য। একটি নিরীক্ষার দ্বারা আল্লাহপাক  ইবরাহীম (আ.)-র চেতনার উত্তরণ ঘটান। নক্ষত্রের স্থিতি এবং অস্তগমনের বিস্ময়কর অস্থিরতা তাঁর অন্তরে অগণিত প্রশ্নের উদ্রেক করল। আঁধার রাতে নক্ষত্রের মোহনাভা, চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, এবং সূর্যের উজ্জ্বল দ্বীপ্তি তাকে টেনে নিয়ে যায় এমন এক মহীয়ান স্বত্বার জাগ্রত অস্তিত্বের সমীপে যার নিকট থেকে নক্ষত্র, চাঁদ এবং গগনবিদারী সূর্য আলো ধার করে আনে। পবিত্র কুরআনের সূরা নূরে আল্লাহ তাঁর অস্তিত্বের যে উপমা তুলে ধরেছেন তা অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য এবং অনুপম। কুরআন বলেঃ ‘আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি। তাঁর জ্যোতির উদাহরণ যেন একটি দ্বীপাধার, যাতে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত। কাঁচপাত্রটি উজ্জ্বল নক্ষত্রসদৃশ। তাতে পবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তেল প্রজ্জ্বলিত হয়, যা পূর্বমুখী নয় এবং পশ্চিমমুখীও নয়। অগ্নি স্পর্শ না করলেও তা আলোকিত হওয়ার নিকটবর্তী। জ্যোতির উপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে। আল্লাহ মানুষের জন্য দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত।” (সূরা নূর: ৩৫)
উপরিউক্ত আয়াতে চমৎকার উপমার মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব বর্ণিত হয়েছে। তাঁর রহস্যময় স্বত্বাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতায় দৃষ্টিময় করার জন্য তিনি নিত্য ব্যবহার্য উপকরণ তুলে ধরেছেন। নূরের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী বলেন, যে বস্তু স্বপ্রভায় বিকশিত এবং যা অপর বস্তুকে দর্শণীয় হতে  সাহায্য করে তাই নূর। ইমাম রাজী তাঁর তাফসীর মাযহারীতে উল্লেখ করেন, নূর এমন এক শক্তি যা অপর বস্তুকে দর্শনযোগ্য করে। তিনি নূর শব্দটি আল্লাহর অস্তিত্বের সমার্থক নয় বলে যুক্তি প্রদর্শন করেন। কারণ আল্লাহ নিথর পদার্থ নন এবং তাঁর স্বত্বা দর্শনযোগ্য বস্তুকণা দ্বারা সৃষ্ট নয়। এই নূর হল হিদায়াত বা দিক নির্দেশনার আলোকসম্পাত। ইবনে কাসীর ইবনে আব্বাস থেকে তাফসীর করেছেন: ‘আল্লাহু হাদী আহলাস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদ’ আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের হিদায়াতকারী।’
আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে যেয়ে দার্শনিকরা অনেক তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দান করেছেন। সক্রেটিস প্রাকৃতিক নিয়মানুবর্তিতা এবং রূপবৈচিত্র্যের পশ্চাতে এক প্রজ্ঞাবান ঐশী স্বত্বার সন্ধান পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা নয়, ঈশ্বর দ্বারাই আমি পরিচালিত হব।’ ঈশ্বর বলতে তিনি এক সর্বব্যাপক পরিণামদর্শী আধ্যাত্মিক স্বত্বাকে বুঝেছেন, কোন জড়ীয় স্বত্বাকে নয়।
প্লেটো স্রষ্টাকে অনন্ত বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি হোমারীয় দেবতত্ত্ব বাতিল করে দিয়ে বলেছেন, ‘নক্ষত্রপুঞ্জ ও দেবতাগণ একই ঈশ্বরের সৃষ্টি।’ এরিষ্টটল ঈশ্বর বলতে বুঝেছেন অচালিত চালক জড়াতীত চেতনা বা উপাদানহীন পরমস্বত্বাকে, তা ঈশ্বর নিরপেক্ষ বা রূপ। আর রূপ মানেই সার্বিক বা অতিবর্তী উপাদানহীন রূপ।
ষ্টোয়িক দার্শনিকগণ ঈশ্বরকে সর্বদর্শী, সর্বশক্তিমান ও প্রেমময় বলে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে জগত এক পরম কল্যাণগুণনিদান স্বত্বা তথা এক মহান উদ্দেশ্যের অভিব্যক্তি স্বরূপ। মধ্যযুগের দার্শনিক অগাষ্টিন যুক্তিবুদ্ধির চেয়ে অনাবিল বিশ্বাসের উপর বেশি জোর দেন। তার মতে ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোন চূড়ান্ত বাস্তবস্বত্বা নেই। তার মতে শুধু ঈশ্বরকে জানাই যথেষ্ট নয়, ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য ঐশী প্রেম ও ভক্তি অপরিহার্য। প্লোটিনাসের মতে, ঈশ্বর দেহ ও মনের, রূপ ও উপাদানের তথা সব উপাদানের উৎস। তিনি পরম একক স্বত্বা এবং সবকিছুই তার মহা একত্বের অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বরে কোন গুণ আরোপ করা যায়না। কারণ সসীম গুণারোপ করা মানেই অসীম স্বত্বাকে সীমিত করে ফেলা। ভাববাদী দার্শনিক হেগেল ঈশ্বরকে পরম ধারনা বা সার্বিক প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলতেন,‘ ঈশ্বর জগতে নিমজ্জিত নন, আবার জগত ঈশ্বরে নিমজ্জিত নয়। জগতকে বাদ দিলে ঈশ্বর আর ঈশ্বর থাকেন না।’ একইভাবে বার্কলে, ব্রাডলি, রয়েস জেমস, প্রভৃতি ভাববাদী দার্শনিক আল্লাহকে পরম স্বত্বা , প্রান্তিক একত্ব , অনুত্তর পরম স্বত্বা, অসীম পরম স্বত্বা ইত্যাদি রূপে ব্যাখ্যা করে তাঁর একত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৮ অব্দে থেলিস নামক এক গ্রীক পন্ডিত প্রকৃতির মধ্যে পরম ঐক্যনীতি বা পরম একত্বের সন্ধান লাভ করেন। তার সূত্র ধরে এনাক সিমেনিস, পিথাগোরাস, এবং পরবর্তীতে ডিমোক্রিটাস, হিউম, লক ও বার্কলে ‘অবিভাজ্য পরমানু’ এর মধ্যে পরম ঐক্যের সন্ধান পান। এ ধারনা থেকেই মুসলিম দার্শনিকগণ আল্লাহ সম্পর্কে ঈধঁংব ড়ভ ধষষ পধঁংবং তত্ত্বের উন্নতি সাধন করেন। বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল অভিজ্ঞতাবাদী ও বাস্তববাদী হওয়া সত্ত্বেও জড়বাদ এবং একত্ববাদের মাঝামাঝি ‘নিরপেক্ষ একত্ববাদ’ এর প্রচারক ছিলেন। তিনি প্রেমকে মৌল নৈতিক প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্বমানবতাবাদের বাণী প্রচার করেন। মুসলিম দর্শনে আল্লাহতত্ত্ব কুরআন হতেই উদ্ভুত। সাহাবাদের মধ্যে হযরত আলী (রা.) ব্যতীত আর কেউ সৃষ্টিতত্ত্ব আল্লাহতত্ত্ব ইত্যাদি গুঢ় রহস্যাবৃত বিষয়গুলো নিয়ে দার্শনিক বর্ণনা প্রদান করেন নি।
আলী (রা.) এসব বিষয়ে অতি সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন। পরবর্তীতে তার শিষ্যরা এসব বিষয়ে চর্চা করতে লাগল এবং পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াতে কারীমার আধ্যাত্মিক ও ভাববাদী মর্মার্থ নিয়ে তাসাউফ জ্ঞানতত্ত্বে সূচনা করে। মরমী ভক্তবৃন্দের তালিম তালকিনের মাধ্যমে ক্ষীনবহা নদীর মত এই ধারা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে প্রবাহিত হতে থাকে। অষ্টম শতকের শেষদিকে জুন্নুন মিছরি ও জুনায়েদ বাগদাদী এসব বিক্ষিপ্ত ভাবধারাকে একত্রিত করে সুবিন্যস্ত করেন। নবম শতকের প্রথম দিকে বায়েজিদ বোস্তামী ও মনসুর হাল্লাজ সুফী দর্শনের উৎকর্ষ সাধন করেন। বায়েজিদের ফানাতত্ত্ব ও হাল্লাজের আনালহকতত্ত্ব সুফী জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
জালালুদ্দীন রুমী প্রেমতত্ত্বের মাধ্যমে সুফী দর্শনের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি জ্ঞানের পথ পরিত্যাগ করে প্রেমের পথে পরম স্বত্বার সন্ধান লাভ করেছেল। আল্লাহর অনন্ত প্রেম এবং সীমাহীন পনিত্রাণমানস উপলব্ধি করে তিনি বলেন, ‘যে মুহূর্তে এই নিম্নমানের পৃথিবী  তোমাকে দেয়া হয় সেই মুহূর্তেই তার নিকট একটি সিঁড়ি দাঁড় করে রাখা হয় যে সিঁড়ি বেয়ে তুমি অনন্তকে স্পর্শ করতে পার।’
মধ্যযুগে এ উপমহাদেশে খাজা মঈনউদ্দীন হাসান চিশতী প্রেমতত্ত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার বাকাতত্ত্ব প্রচার করেন। তার পরবর্তী সাধক কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী, ফরিদুদ্দীন গন্জে শকর, নিজামুদ্দীন মাহবুবে এলাহি, একই তত্ত্ব প্রচার করেন। বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক কবি ইকবাল আল্লাহকে বর্ণনা করেছেন অনন্ত আধ্যাত্মিক পরম অহং (বমড়) বলে। তার মতে আল্লাহ একাধারে পরমস্বত্বা ও পরম স্রষ্টা। আল্লাহ নিজেই পরিপূর্ণ অহং ও পরম আত্মস্বত্বা স্বরূপ। কবি ইকবাল সুফিদের আত্মবিলোপে বিশ্বাস করতেন না। স্বত্বা বিলোপের যে প্রকৃতির কথা তিনি বলেছেন সেটি হচ্ছে অজস্রকে আত্মবোধের মধ্যে বিনিশেষ করে এমন একটি অহংবোধের প্রকাশ ঘটানো, যে প্রকাশ হবে আল্লাহর যথার্থ প্রতিনিধির। ইকবাল কঠিন একটি দর্শনকে আনন্দবোধের দর্শনে পরিণত করেছেন। একটি অসাধারণ প্রজ্ঞাকে আবেগের উচ্চারণে সমৃদ্ধ করেছেন এবং মানুষের অস্তিত্বকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে সমুজ্জ্বল করেছেন।
মুজাদ্দেদে আলফেসানী তার সুফী সাধনার প্রতিটি স্তরের অনুভবকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাকচাতুর্যে বিন্যস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহর অস্তিত্ব রূহের সাহায্যে অনুধাবন করা যায় এবং রূহ হচ্ছে এমন একটি উপলব্ধি যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, অথচ যা একজন সুফীর বোধের আয়ত্তে। কেননা যিনি সুফী তিনি রহস্যকে ইন্দ্রিয়গোচরে আনতে চান, সে জন্য আপন শরীরের মধ্যে বিভিন্ন অধিষ্ঠানের স্থিতি নির্মাণ করে নিজের বোধের মধ্যে আনেন।
‘যিনি আল্লাহর পথের পথিক, তাকে সর্বতোভাবে আত্মচৈতন্য থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহকে অনুভব করতে হয়। একটি বৃক্ষ যেমন কোন রকম অহংকার নিয়ে বৃদ্ধি পায়না, কিন্তু নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় বৃদ্ধি পায়, তেমনি একজন সুফীকে আল্লাহর উপর চূড়ান্ত নির্ভরতায় অগ্রসর হতে হয়।’ এটি হচ্ছে নিরলস গবেষক এবং বিদগ্ধ অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের অভিমত।
শেখ মাহমুদ শাবিস্তারী নামক একজন সুফী তার একটি কবিতায় বলেছেন, যার আত্মা স্বর্গসুখের আস্বাদন পায় পৃথিবী তার কাছে একটি মহান সত্যের গ্রন্থ, আকস্মিক ঘটনাবলী হচ্ছে তার স্বরবর্ণ এবং মৌলিক উপাদান হচ্ছে তার ব্যঞ্জনবর্ণ আর সৃষ্ট পদার্থের বিভিন্ন স্বরূপ তার ছন্দ ও বিরাম চিহ্ন। এর অর্থ হচ্ছে যে পৃথিবী মানুষ পেয়েছে সে পৃথিবীর মধ্য থেকে মানুষ সত্যকে আবিষ্কার করবে।’
পারস্য কবি হাফিজ ছিলেন প্রেম ও সৌন্দর্যের রূপকার। তিনি বলেছেন , বহু বছর আমাদের হৃদয় জামশিদের পানপাত্র দাবী করেছিল। কিন্তু সে জানত না যে এ পাত্রটি অপরিচিত লোকের কাছে পাওয়া যাবেনা। এ পাত্রটি আমাদের চিত্তে রয়েছে। জামশিদের পানপাত্র পেতে হলে মানুষকে পার্থিব কামনা থেকে মুক্ত হতে হবে।’
আবুল ইয়াজিদ বোস্তামী একটু অন্যভাবে বলেছেনÑ‘ আমি পৃথিবীকে অস্বীকার করে মহান একাকীর সামনে দাঁড়ালাম, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম: ওহে আমার প্রভু! আমি আর কাউকেই চাইনা , আমি শুধু তোমাকেই চাই। যখন আমি তোমাকে পাব, তখন আমি সব কিছুই পাব।’
ফরিদউদ্দীন আত্তার বলেছেন ‘ যখন আল্লাহ আমার আন্তরিকতাকে স্বীকার করলেন, তখন তিনি অশেষ করুণায় আমার অস্তিত্ব থেকে অহং এর আবরণ সরিয়ে দিলেন।
ইসলামী ইজতিহাদের উজ্জ্বল সূর্য, সুফীতত্ত্বের নিবেদিত শিক্ষক ইমাম আবু হানিফা তার গবেষণার বিস্তৃত সৈকতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, দৃশ্যমান শরিয়ত পালনের মধ্য দিয়ে মানুষের যথার্থ বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়না, যথার্থ বিশ্বাস হচ্ছে অন্তরের গভীরের একটি অবস্থা।’
বাংলাদেশের দার্শনিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ভাষ্যে সুফীবিদ্যার চমৎকার আভাষ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, মানুষ সসীম জ্ঞানের মধ্য দিয়ে অসীমে আত্মসম্প্রসারণের জন্য বড়ই ব্যাকুল। একই বিদ্যুতপ্রবাহ যেভাবে নগরীর লক্ষ প্রদীপের ভেতর দিয়ে আপনাকে ব্যক্ত করে তেমনি এক মহাপ্রেরণা সমগ্র মানব সমষ্টির ভেতর দিয়ে দূর লক্ষ্যের পানে ছুটে চলছে। এই একই চেতনাসত্তা দেশ কালের প্রেক্ষিতে পরিগ্রহ করেছে বহু রূপ ও বিচিত্র প্রকাশ ভংগিমা। একেই নবী পয়গম্বর ও ভাবুক সাধকেরা সনাক্ত করেছে সবকিছুর আদি উৎস ও চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে।’
বোবা ও ভাষাহীন পৃথিবী যে সত্যকে প্রকাশ করার জন্য রুপ রঙ বৈচিত্র্যে বিন্যস্ত হয় তা অনুধাবন করার জন্য একটি গভীর বোধশক্তির প্রয়োজন।  চন্দ্র সূর্য এবং নক্ষত্রমালার জ্যোতিচ্ছন্দ যে রহস্যময় স্বত্বার অস্তিত্বের স্বাক্ষর তাকে তালাশ করার জন্য আলোকিত মানসিকতার প্রয়োজন যার যথার্থ উচ্চারণ করেছেন জ্ঞানী ও নিভৃতচারী মহামতি সেন্টপল। তিনি বলেছেন, আমরা জানি অনন্তকাল ধরে এ বিশ্ব সৃষ্টি বেদনার মধ্য দিয়ে বহমান।’ আল্লাহপাক শুধু সৃষ্টিই করেন না একটি সুষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক তাঁর সৃষ্টিকে অবস্থিতি দান করেন। যার যতটুকু পরিমাপ  এবং আকৃতি তদানুযায়ী প্রতিটি জীবের প্রজাতি পরম্পরায় তার সঠিক অঙ্গসংস্থান ও অবয়বে শক্তিমান করেন। পৃথিবীতে তাদেরকে টিকে রাখার জন্য একটি সহজাত জৈবিক আচারে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখেন। একটি সুসংবদ্ধ জীবনাচারের দূর্ভেদ্য বলয়ে আবর্তিত হওয়ার গুপ্ত নির্দেশনায় তাদেরকে বাধ্য করেন। উত্থান-ধ্বংস এবং জীবন-মৃত্যুর জাগতিক বন্ধনে অতিকায় দানবদেহী বস্তু থেকে ক্ষুদ্র তৃণলতা একই সূত্রে গাঁথা। কুরআন বলে: ‘যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন। এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও পথ নির্দেশ করেন ; এবং যিনি তৃণাদি উৎপন্ন করেন ও পরে তাকে ধূসর বিচালীতে রূপান্তরিত করেন।’ (সুরা আলা: ২-৫)

Related Post