আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সাক্ষাৎ

 আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সাক্ষাৎ

আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সাক্ষাৎ

আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সাক্ষাৎ

(প্রথম পর্ব)

আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় ও অকল্পনীয় সত্তা। তাঁর সৌন্দর্যের কোন তুলনা নেই। তাঁর অবয়বের বর্ণনা দেয়ার কোন ক্ষমতা কারো নেই। তাঁকে কেউ কোন দিন দেখেনি। তিনি একমাত্র মহাপবিত্র সত্তা, তাঁর সত্তার সঠিক বা আনুমানিক বর্ণনা দেয়ার কোন অবকাশ নেই। তাঁর সুন্দর সুন্দর নাম, সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রভৃতির বর্ণনা রয়েছে পবিত্র কুরআনে। এগুলো মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহর সত্তার সুনিশ্চিত প্রমাণ।
যারা আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে কিংবা আল্লাহর কোন আকার নেই (নিরাকার) বলে মনে করে, আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস করে, তারা মুমিন নয়। তাদের ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণার্থে মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাঁর পবিত্র সত্তার বর্ণনা দ্বারা মানুষের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটিয়েছেন। অপরদিকে যারা আল্লাহকে না দেখেই তাঁর সত্তায় বিশ্বাস স্থাপন করে তারা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ পূর্বক নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করে।
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে। এ বিষয়ে তিনি মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু আদেশ, উপদেশ ও জ্ঞান দান করেছেন এবং সেগুলি মেনে চলার কঠোর আদেশ দিয়েছেন। কোন কারণবশতঃ মানুষ ভুল করে ফেললে, তওবার মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। এরপরেও কেউ আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে সে শাস্তিযোগ্য অপরাধী হিসাবে গণ্য হবে। মহাজ্ঞানী আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতঃ বহু বান্দা আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করে এবং আল্লাহর কঠোর শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে আল্লাহর আদেশ পালনে ব্রতী হয়। আবার অনেকে ভুলবশতঃ বা অজ্ঞতাবশতঃ আদেশ পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি করে বা অন্যায় করে নিজের ভুল বুঝতে পারে। তখন অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ক্ষমাপ্রার্থী হয়। অতঃপর আল্লাহর প্রতি গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে সৎপথ অবলম্বন করে। কিন্তু শয়তানসহ মানুষের মধ্যে একটি বিরাট দল আল্লাহর সত্তা ও আদেশের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আল্লাহর বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অদৃশ্যের একমাত্র জ্ঞাতা, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মালিক মহান আল্লাহ তা‘আলা মানুষের এসব অকৃতজ্ঞতার কথা, অহংকারের কথা, ঔদ্ধত্য ও সীমালংঘনের কথা সৃষ্টির পূর্বেই জানতেন।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে কিয়ামতের মাধ্যমে ইহজগত হ’তে পরজগতে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিয়ামতের ময়দানে সমস্ত মানুষের কর্মের হিসাব হবে। পরকালে আল্লাহর সাথে বান্দার সাক্ষাৎ হবে। তিনি মানব জাতিকে তাঁর সাক্ষাতের কথা জানিয়েছেন। হতভাগ্য মানুষের একটি বড় দল আল্লাহর এ সাক্ষাতের সুসংবাদকে অবিশ্বাস করে। কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ত বান্দারা এ মহাসংবাদকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাঁর সাক্ষাতের প্রতীক্ষায় থাকে।মানুষের সঙ্গে আল্লাহর এ সাক্ষাৎকার তাঁর প্রিয় বান্দার জন্য কতটা মর্যাদাপূর্ণ ও আনন্দদায়ক তা ভাষায় প্রকাশ করা কখনই সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে তাঁর অপ্রিয় বান্দার জন্য যে কত অপমানজনক, লাঞ্ছনাকর, ভয়াবহ শাস্তিদায়ক সেটাও অবর্ণনীয়। উভয় প্রকারের বান্দার সঙ্গে সেদিন আল্লাহ তা‘আলা সাক্ষাৎ করবেন। আলোচ্য প্রবন্ধে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সেই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।-
মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তবে সব মানুষ সমান নয়, তিনি মানুষকে পরীক্ষা করেন। কেননা মানুষকে অবশ্যই চিন্তা ও বিবেচনা করতে হবে, কে তাদেরকে সুখ-শান্তি ও মান-সম্মান দিয়ে পৃথিবীর বড় আসনে বসিয়েছেন এবং অন্যদেরকে দরিদ্রতা ও দুঃখের মধ্য দিয়ে জীবন যাপনে অভ্যস্ত করেছেন। যিনি এসব সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের প্রতি কি ধরনের বিধি-বিধান জারি করেছেন তা ভেবে দেখতে হবে।
আল্লাহর নিকট প্রত্যাবর্তন বা সমবেত হওয়ার জন্য একটি সময় নির্ধারিত আছে। কোন মানুষ বা ফেরেশতা কূলের কেউ তা জানে না। নির্ধারিত সেই সময়েই কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং মানুষের অজান্তেই হঠাৎ তা এসে যাবে। কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা অবর্ণনীয়। আল্লাহর নিকট মানুষের সমবেত হওয়াও সেদিনের জন্য একটি কঠিন কাজ।
মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলার মহাপবিত্র সত্তার চিন্তা-গবেষণা করা অপেক্ষা তাঁর সত্তার প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাসই হল শ্রেষ্ঠ পথ ও পাথেয়। কারণ পবিত্র কুরআনে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ও তাঁর সাক্ষাতের মহাসত্য বাণী অবতীর্ণ হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, صِبْغَةَ اللهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ صِبْغَةً وَنَحْنُ لَهُ عَابِدوْنَ ‘তোমরা আল্লাহর রং (অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন) কবুল কর। আর আল্লাহর রঙের চাইতে উত্তম রং কার হ’তে পারে’ (বাক্বারাহ ২/১৩৮)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قُلِ ادْعُواْ اللهَ أَوِ ادْعُواْ الرَّحْمَـنَ أَيّاً مَّا تَدْعُواْ فَلَهُ الأَسْمَاء الْحُسْنَى ‘তুমি বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে ডাক বা ‘রহমান’ নামে ডাক, তোমরা যে নামেই ডাক না কেন, সকল সুন্দর নাম তো কেবল তাঁরই’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১১০)। একই মর্মার্থে তিনি ঘোষণা করেন,

اللهُ نُوْرُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ‘আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি’ (নূর ২৪/৩৫)। অপর এক প্রত্যাদেশে তিনি তাঁর প্রিয় হাবীব (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন,

فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُن مِّنَ السَّاجِدِيْنَ، وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ- ‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসা বর্ণনা কর এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। আর তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর, যতক্ষণ না মৃত্যু তোমার নিকট উপস্থিত হয়’ (হিজর ১৫/৯৮, ৯৯)। অতঃপর আল্লাহ তাঁর সত্তা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনায় বলেন,

وَاللهُ يُحْيِـي وَيُمِيتُ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ ‘আল্লাহ জীবন ও মৃত্যু দান করে থাকেন। আর আল্লাহ তোমরা যা কর সবই দেখেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ كَانَ سَمِيْعاً بَصِيْراً ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (নিসা ৪/৫৮)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, إِنَّ اللهَ سَمِيْعٌ بَصِيْرٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন’ (লোকমান ৩১/২৮; হজ্জ ২২/৭৫)। তাঁর শক্তির বর্ণনায় তিনি বলেন, وَالْأَرْضُ جَمِيْعاً قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِيْنِهِ ‘কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমান সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে’ (যুমার ৩৯/৬৭)। আল্লাহ তা‘আলা হ’লেন সর্বোত্তম সুন্দর সত্তা। উপরের আয়াত কয়টি তাঁর সুন্দরতম আকৃতির নমুনা স্বরূপ পবিত্র কুরআনে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তিনি সর্বশক্তির আধার। এসব আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
মহিমাময় আল্লাহর পক্ষ হতে আরও একটি মহাসুসংবাদ রয়েছে। তিনি বলেছেন, কিয়ামতে বিচারের দিনে কোন একক (সুনির্দিষ্ট) সময়ে তিনি প্রতিটি বান্দার বা ব্যক্তির সাথে পৃথক বা একাকী সাক্ষাৎ করবেন। তাঁর এই অমূল্য বাণীর অন্তরালে যে অসীম তাৎপর্য লুক্কায়িত আছে, তা একমাত্র তিনিই জানেন। আমরা শুধু তাঁর প্রচারিত ও ঘোষিত উপদেশ ভান্ডার হ’তে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোচনা করব। মহাবিজ্ঞ আল্লাহ তা‘আলা জানিয়েছেন বিচারের দিনে তিনি প্রতিটি বান্দার সাথে পৃথক পৃথকভাবে বা একাকী সাক্ষাৎ করবেন, তার সাথে কথাবার্তা বলে তার দোষগুণ জানতে চাইবেন। প্রকৃত ঈমানদার বান্দা অতীব ভীত ও বিনীত স্বরে আল্লাহর সম্মুখে সত্য কথা বলবে। এমনকি অনেক দোষ ও পাপের কথাও স্বীকার করবে এবং অনেক অপরাধের পরও জান্নাতে স্থান পাবে। কিন্তু যারা মিথ্যাবাদী তারা মিথ্যা কথা দ্বারা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে চাইবে, এতে অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে চরম শাস্তি দেয়ার জন্য জাহান্নামে প্রেরণ করবেন।
মহান আল্লাহ বলেন, وَاتَّقُواْ اللهَ وَاعْلَمُواْ أَنَّكُم مُّلاَقُوْهُ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রেখ তোমাদের সবাইকে তাঁর সম্মুখে হাযির হ’তে হবে। আর তুমি বিশ্বাসীদের সুসংবাদ দাও’ (বাক্বারাহ ২/২২৩)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَنِ عَبْداً، لَقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدّاً، وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْداً- ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের নিকটে উপস্থিত হবে না দাস রূপে। তিনি তাদেরকে গণনা করেছেন এবং তাদেরকে ভালভাবে গুনে রেখেছেন। আর কিয়ামত দিবসে তাদের সবাই তাঁর নিকটে আসবে একাকী অবস্থায়’ (মারিয়াম ১৯/৯৩-৯৫)।
এ বিষয়ের প্রতি আরও অধিক দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াসে সর্বজ্ঞ আল্লাহ বলেন,
اللهُ الَّذِيْ رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِيْ لأَجَلٍ مُّسَمًّى يُدَبِّرُ الأَمْرَ يُفَصِّلُ الآيَاتِ لَعَلَّكُم بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُوْنَ ‘আল্লাহ তিনি, যিনি ঊর্ধ্বদেশে স্তম্ভ ছাড়াই আকাশ মন্ডলীকে স্থাপন করেছেন যা তোমরা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নীত হন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে অনুগামী করেন। প্রতিটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সন্তরণ করবে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি নিদর্শন সমূহ ব্যাখ্যা করেন যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী হ’তে পার’ (রা‘দ ১৩/২)।
তিনি আরো বলেন, الم، أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوْا أَنْ يَقُوْلُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ، أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّئَاتِ أَن يَسْبِقُوْنَا سَاء مَا يَحْكُمُونَ، مَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء اللهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللهِ لَآتٍ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ- ‘মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নিবেন মিথ্যুকদেরকে। যারা মন্দ কাজ করে, তারা কি মনে করে যে, তারা আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে? তাদের ফায়ছালা খুবই মন্দ। যে আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে, আল্লাহর সেই নির্ধারিতকাল অবশ্যই আসবে। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী’ (আনকাবূত ২৯/১-৫)।

Related Post