আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?

আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?

আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? 

মুহতারম পরিচালক, উপস্থিত কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। ও ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার শিক্ষার্থী বন্ধুগণ! আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।

 আজকের দারসুল কুরআনের আলোচ্য বিষয়: আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?

আমি ভূমিকায় বিষয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে সূরা বাকার ২১৪ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করেছি। আয়াতটির অর্থ হলো তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনি ভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে,কখন আসবে আল্লাহর সাহায্যে! তোমরা শোনে নাও, আল্লাহর সাহায্যে একান্তই নিকটবর্তী।’

মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আত্মত্যাগ ও তাদের উপর নির্যাতনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করতে চাই।

তারও পূর্বে আজকের আলোচনা সারসংক্ষেপ বা কি কি থাকছে সংক্ষেপে বলে নিই।

আলোচনার বিষয়: আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?

  • মুমিনদের উপর বালা মুসীবত কেন আসে?
  • যেসব কারণে প্রকাশ্যে সাহায্য বিলম্বিত হয়,
  • আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার উপায়

যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আত্মত্যাগ ও তাদের উপর নির্যাতন

অতীতের বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা শুধু ইতিহাসের হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনাই নয়, বরং এক শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় বিষয়। যে আত্মত্যাগ বিশ্ব মুসলিম মননে শহিদী চেতনা উজ্জীবিত করে। জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের,অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের এবং জিল্লতির পরিবর্তে নাজাতের মহিমায় ভাস্বর এসব ঘটনা। প্রথমে নবীদের মাধ্যমেই এ ত্যাগের ধারা শুরু হয়েছে। জালিমেরা বহু নবীকে অন্যায়ভাবে শহীদ করেছে। হত্যা করার উদ্দেশ্যে অনেক নবীকে যেমন,ইব্রাহীম, ইফসুফ,মুছা, ঈসা (আ:)ও মুহাম্মাদ (সা:) কে অমানুষিক জুলুম-নির্যাতন করেছে,দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। নবীর অনুসারীদেরকে জীবন্ত আগুনে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। মাটির নিচে অর্ধেক পুঁতে মাথার উপর থেকে করাত দিয়ে দ্বিখন্ডিত করেছে। বিপরীত দিক থেকে হাত পা কেঁটে শুলে চঁড়ায়ে হত্যা করেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে তারা এমন অত্যাচার ও জুলুম করেছে। তার পরেও সত্য আন্দোলন থেকে তাদেরকে বিন্দু পরিমাণ টলাতে পারেনী। আল্লাহর বাণী,

وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا ۗ وَاللهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ ﴿١٤٦﴾

 এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছেন যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহ ওয়ালা লড়াই করেছেন। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি। এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন। (সূরা আল- ইমরান: ১৪৬)

  মুসলিমদের অনৈক্যের কারণে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ,অযুহাত দিয়ে স্পেন, বসনিয়,চেচনিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর দখল করে আছে। ছিনিয়ে নিয়েছে পূর্ব তীমুর ও সুদানের একাংশ। জবর দখল করে পুতুল সরকার বসিয়েছে ইরাক ও আফগানে। এসব করতে গিয়ে জালেমরা লক্ষ লক্ষ মুসলিমদের হত্যা করেছে। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অধিক সংখ্যক সাধারণ মুসলিমদের। মুসলিম মা বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করছে। জেল খানায় আবদ্ধ করে চালানো হচ্ছে পৈষাচিক নির্যাতন।

তারই ধারাবাহিকতা চলে এসেছে প্রিয় মাতৃভূতি বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলিদের ওপর। জেল-জুলুম, রিমান্ডের নামে অমানুষিক নির্যাতন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। ইসলামী রাজনীতি বন্ধ করার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ নামের নাটক সাজিয়ে ফাঁসীর রশিতে ঝুলানো হচ্ছে ইসলামী আন্দোনের নেতাদের।

 হামলা -মামলা,হত্যা -গুম করেও খ্যান্ত নয়, আহত মানুষ চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে গেলে সেখানেও ধর-পাকড়। ভিন্নমতের আলেম-ওলামা হলেতো কথাই নেই। তাদের অবস্থা হয়েছে শিকারী পাখির মত। বুলেটের আঁঘাতে তাদেরকে শহীদ করা হচ্ছে। মানুষের বাক স্বাধীনতা স্তদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ভিন্ন মতের মিডিয়া গুলোকে। এর জবাব কি কোন দিন দিতে হবে না? এর মাধ্যমেই কি স্তদ্ধ করে দিতে পারবে ইসলামের সুমহান আদর্শকে? ভুলে গেলে চলবে না,আমরা কেউ আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে নই। আল্লাহর তায়া‘লার কঠোর হুঁশিয়ারী রয়েছে জালেমদের জন্যে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ خَيْرٌ لِّأَنفُسِهِمْ ۚ إِنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ لِيَزْدَادُوا إِثْمًا ۚ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ ﴿ ١٧٨

কাফেররা যেন মনে না করে আমি যে, অবকাশ দান করি, তা তাদের পক্ষে কল্যাণকর। আমি তো তাদেরকে অবকাশ দেই যাতে করে তারা পাপে উন্নতি লাভ করতে পারে। বস্তুতঃ তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাজনক শাস্তি। আল ইমরান-১৭৮।

পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামের আলোকে সত্য প্রতিষ্ঠাকারীদের আদর্শে শাণিত এসব ঘটনা বাতিলের বিরুদ্ধে হকের চিরন্তণ সংগ্রামের এক নবতর অধ্যায় সূচনা করে। ত্যাগের এসব ঘটনা জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মনোবল নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে শেখায়। প্রয়োজনে বুকের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও জালিমদের ষড়যন্ত্র উৎখাত করে ইসলামের আদর্শিক সমাজ নির্মাণের প্রেরণা যোগায়। ইসলামী আন্দোলনের ওপর জুলুম-নির্যাতন অতীতে হয়েছে এখনও চলছে। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস ত্যাগ ও কুরবানী ইতিহাস। এ পথে সাহাবায়ে কেরামের (রা:) অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন,রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন কিন্তু বাতিলের কাছে মাথানত করেননি। তারা যে শিক্ষা ও ত্যাগের আদর্শ রেখে গেছেন তা-ই যুগে যুগে ইসলামের অনুসারীদের দুর্জয় শক্তিতে বলিয়ান করেছে। কালেমার ঝান্ডাধারী সত্যাশ্রয়ী সন্তানেরা যখনই প্রতিষ্ঠিত আল্লাহ দ্রোহী জালিম সরকার ও শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে, তখনই তাদের মনের আয়নায় উপস্থিত হয়েছে পূর্ব সূরিদের মত শাহাদাতের তামান্না।

 কবি নজরুলের ভাষায়;
যাতনা সহেছি, আগুনে পুড়েছি,ডুবেছি মোরা অতল নীরে + মরিয়া হয়ে লড়াই করেছি,অজেয় করেছি ইসলামেরে, লস নস, তুই হিন নস, আছেরে তোর অজেয় খ্যাতি + মুসলিম তুই বিশ্বাস কর দুনিয়া মাঝে তুই শ্রেষ্ঠ জাতি

সুতরাং আমরা মুসলিমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি আমাদের ভয় পেলে চলবে না।আল্লাহর এ অমীয় বাণীকে সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে।
আল্লাহর ভাষায়; وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ﴿١٣٩﴾

 মনমরা হয়ো না,দুঃখ করো না,তোমরাই বিজয়ী হবে,যদি তোমরা মুমিন হও। ইমরান ১৩৯।

 কেনো মুমিনদের উপর বালা মুসীবত আসে? এর কারণ অনেক, কিন্তু এখানে শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, এতে মুমিনদের ঈমান পরীক্ষা করা হয়, আসলে কে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ এবং রাসূলের আদর্শে বিশ্বাসী।  দুর্বল ঈমান ও মুনাফিকদের হতে প্রকৃত মুসলমানদেরকে পার্থক্য করার জন্যই মাঝে মধ্যে এমন পরীক্ষা করা হয়।  যেমন আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

اَحَسِبَ النَّاسُ اَنْ يُّتْرَكُوْآ اَنْ يَّقُوْلُوْآ امَنَّا وَهُمْ لاَ يُفْتَنُوْنَ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ

‘লোকেরা কি মনে করেছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এই কথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্ববর্তীদেরকে আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো জানতে হবে ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।’(আল আনকাবূত: ২-৩)

পরবর্তীকালে অবতীর্ণ সূরা মুহাম্মাদের ৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّىٰ نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ ﴿٣١﴾

“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো যাতে আমি জেনে নিতে পারি তোমাদের মধ্যে কারা ‘মুজাহিদীন’ এবং কারা ‘সাবেরিন’।”

সূরা আলে ইমরানের ১৪২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ ﴿١٤٢﴾

 “তোমরা কি ভেবেছো এমনিতেই জান্নাতে চলে যাবে, অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা জিহাদ করে এবং কারা সবর অবলম্বনকারী?”

সূরা আত্ তাওবা-র ১৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوا مِن دُونِ اللهِ وَلَا رَسُولِهِ وَلَا الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةً ۚ وَاللهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ﴿١٦﴾  

‘তোমরা কি ভেবেছো যে তোমাদেরকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি যে তোমাদের মধ্য থেকে কারা জিহাদে নিবেদিত হয় এবং আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদেরকে ছাড়া আর কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন না। আর তোমরা যা কিছু কর সেই সম্পর্কে আল্লাহ খবর রাখেন।’

সূরা আল বাকারার ২১৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ ) البقرة/ 214 )

 “তোমরা কি ভেবেছো যে এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ এখনো তোমাদের ঐরূপ অবস্থা আসেনি যেমনটি এসেছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর।” তাদের ওপর কঠিন অবস্থা আপতিত হয়েছে,মুসিবত এসেছে এবং তাদেরকে কাঁপিয়ে দেয়া হয়েছে যেই পর্যন্ত না রাসূল ও তাঁর সঙ্গীরা বলে উঠেছে, `কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য!’ তখন তাদেরকে বলা হয়েছে, ‘ওহে, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটেই।’

 ঈমানের দাবি হচ্ছে, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিত হওয়া এবং এই সংগ্রাম চালাতে গিয়ে যত প্রকারের বাধাই আসুক না কেন তার মোকাবেলায় দৃঢ়পদ থাকা।
এই সংগ্রাম চালাতে গিয়ে মুমিনদেরকে অনিবার্যভাবে ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, কখনো কখনো অবস্থা এমন সঙ্গিন হতে পারে যে অনাহারে থাকতে হবে, কখনো কখনো বাগ-বাগিচা, ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান, ঘরদোরের ওপর হামলা হতে পারে, কখনো কখনো ইসলাম বিদ্বেষীদের হাতে আপনজন ও সহকর্মীদের কেউ কেউ প্রাণ হারাতে পারেন এবং কখনো কখনো আয়-উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এমন সব কঠিন পরিস্থিতি পূর্বেকার নবী-রাসূলদের জীবনেও এসেছিলো, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকেও ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন: সূরা আল আহকাফের ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,

فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوْا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلاَ تَسْتَعْجِلْ لَّهُمْ

অতএব , হে নবী, দৃঢ়চেতা রসূলদের মত ধৈর্য ধারণ করো এবং তাদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করো না৷

অর্থাৎ তোমাদের পূর্ববর্তী নবী-রসূলগণ যেভাবে বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত ধৈর্য ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মাধ্যমে তাদের জাতির অসন্তষ্টি,বিরোধিতা,বাধা-বিপত্তি ও নানা রকম উৎপীড়নের মোকাবিলা করেছেন তুমিও সে রকম করো এবং কখনো মনে এরূপ ধারণাকে স্থান দিও না যে, হয় এসব লোক অনতিবিলম্বে ঈমান আনুক, নয়তো আল্লাহ তাদের ওপর আযাব নাযিল করুক।

আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?

 এই প্রশ্নটি কোন অপারগ মুসলিম বা দুর্বলচেতা ঈমানদারে পক্ষ থেকে হয়নি, বরং এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে, জাতির শ্রেষ্ঠ মানুষ ও মজবুত ঈমানদার আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সঙ্গীদের পক্ষ থেকে। তারা বলেন:  حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ

রাসূল ও তাঁর সঙ্গীরা বলে উঠেছে, `কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য!’

এর উত্তরে আল্লামা সায়্যেদ কুতুব (রহ.) বলেন: তাঁদের এই প্রশ্ন যে, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? অন্তরে জাগ্রত হয়েছে, যখন তাদেরকে সব ধরণের নির্যাতনে বেষ্টন করেছিলো, বাঁচার আর কোন পথ সামনে খুলা দেখতে পায়নি। এই কঠিন পরিস্থিতিতে যদি তাঁরা ঈমানের উপর অটল থাকতে পারে তখনই আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে। এর হকদারের জন্য সাহায্য আল্লাহর নিকট জমা করে রেখেছেন। আর হকদারদেরকে চেনা যায়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই। তাদের ওপর কঠিন অবস্থা আপতিত হয়েছে,মুসিবত এসেছে এবং তাদেরকে কাঁপিয়ে দেয়া হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে তারা বিশ্বাস করে যে, সাহায্য একমাত্র আল্লাহর পক্ষ  থেকে আসবে। এমন লোকদের উপরই আল্লাহর সাহায্য আসবে।

দ্বিতীয়ত: যখনই বান্দার প্রচেষ্টা শেষ হবে তখনই আল্লাহর সাহায্য শুরু হবে। অর্থাৎ যার যতটুকু শক্তি আছে, তার ততটুকু শক্তি ব্যয় করার পরই আল্লাহর সাহায্য শুরু হবে। যেমন হযরত মূছা (আ.) ফেরাউনের নির্যাতণে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন যে, হে আল্লাহ! বনীইসরাইলদের মধ্য যারা ঈমান এনেছে, তাদেরকে তুমি এই ফেরাউনের অত্যাচার হতে মুক্তি দাও। এমতাবস্থায় যে ফেরাউন মূছা (আ.) ও তার সঙ্গীদেরকে তিন দিক থেকেই বেষ্টন করে ফেলেছে,

جدهر جاؤ أدهر دريا جدهر بهرو أدهر دشمن ** كهان جاؤ كدهر بهرو  بتادي أى حبيب من

 আর অন্য দিকে সমুদ্র। মূছা (আ.) এর নিকট সমুদ্র পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি কিন্তু এখনও বাকী আছে, তাই তিনি সমুদ্র পর্যন্ত সঙ্গীদের নিয়ে গেলেন। আর তখনিই আল্লাহর সাহায্য শুরু হয়ে গেল। সমুদ্রের মধ্যে ১২ টি রাস্তা হয়ে গেল। মূছা (আ.) তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ফেরাউনের দেশ থেকে হিজরত করলেন।

তেমনিভাবে হযরত ইউসুফ (আ.)কে যখন জুলাইখা সাত দরজার ভেতরে আটক করে বলেছিলো, আমার যৌনক্ষুধা নিবারণ করো। তখন ইউসুফ (আ.) নিকট দরজা পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি ছিলো, তাই তিনি দরজার দিকে দৌড় দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে তালাবদ্ধ দরজাগুলো খুলে গেল।

﴿وَرَاوَدَتْهُ الَّتِي هُوَ فِي بَيْتِهَا عَن نَّفْسِهِ وَغَلَّقَتِ الْأَبْوَابَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ ۚ قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ ۖ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوَايَ ۖ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ﴾

যে মহিলাটির ঘরে সে ছিল সে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকলো এবং একদিন সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো, “চলে এসো”৷ ইউসুফ বললো, “আমি আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, আমার রব তো আমাকে ভালই মর্যাদা দিয়েছেন (আর আমি এ কাজ করবো!)৷ এ ধরনের জালেমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারে না৷

﴿وَاسْتَبَقَا الْبَابَ وَقَدَّتْ قَمِيصَهُ مِن دُبُرٍ وَأَلْفَيَا سَيِّدَهَا لَدَى الْبَابِ ۚ قَالَتْ مَا جَزَاءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوءًا إِلَّا أَن يُسْجَنَ أَوْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾  

শেষ পর্যন্ত ইউসুফ ও সে আগেপিছে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো এবং সে পেছন থেকে ইউসুফের জামা (টেনে ধরে) ছিঁড়ে ফেললো৷ উভয়েই দরজার ওপর তার ওপর তার স্বামীকে উপস্থিত পেলো৷ তাকে দেখতেই মহিলাটি বলতে লাগলো, “তোমার পরিবারের প্রতি যে অসৎ কামনা পোষণ করে তার কি শাস্তি হতে পারে ? তাকে কারগারে প্রেরণ করা অথবা কঠোর শাস্তি দেয়া ছাড়া আর কি শাস্তি দেয়া যেতে পারে ?”

এভাবে প্রত্যেক নবী ও রাসূলকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সাহায্য করেছেন। এখন আমরাও সেই আল্লাহর সাহায্য পেতে পারি, তবে সে জন্য আমাদেরকে পূর্বেকার মুসলমানদের মতো, দৃঢ় ঈমান ও আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখতে হবে।

তৃতীয়ত: আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসবে, তবে সাহায্যের জন্য সবর বা ধৈর্য থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলছেন:

وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَىٰ مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّىٰ أَتَاهُمْ نَصْرُنَا ۚ 

আপনার পূর্ববর্তী অনেক পয়গম্বরকে মিথ্যা বলা হয়েছে। তাঁরা এতে ছবর করেছেন। তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছা পর্যন্ত তারা নির্যাতিত হয়েছেন।

আর রাসূল (সা.) ইবনে আব্বাস (রা.)কে বললেন: واعلم أن النصر مع الصبر জেনে রেখ সাহায্য সবরের সাথে রয়েছে। (মুসনাদে আহমদ)

আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে সাহায্য করবে, আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করছেন: وَلَيَنصُرَنَّ اللهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ  আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর সাহায্য করে। (সূরা হজ্জ: ৪০)

মহান আল্লাহ সূরা মুহাম্মাদের ৭ নম্বর আয়াতে বলছেন: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن تَنصُرُوا اللهَ يَنصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ ﴿٧ হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন।

আল্লাহর সাহায্য ব্যক্তির অবস্থা অনুযায়ী হয়ে থাকে। ব্যক্তি যতটুকু দ্বীনের জন্য কুরবানী করবে, যতটুকু ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ আঞ্জাম দিবে, ততটুকু তার জীবনে প্রতিফলিত হবে। যখনই অন্তরে এই বিষয়টি বসে যাবে, তখনই আল্লাহর এই বাণী  أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ   সহজে বুঝে আসবে।

 সম্মানিত উপস্থিতি! পূর্বেও বলেছি যে, হক এবং বাতিলে দ্বন্দ্ব চিরন্তণ। হযরত আদম (আ.) হতে শুরু হয়েছে, এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বিজয় ও উত্তম প্রতিদান মুত্তাকীদের জনই। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন: ﴿كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ﴾

আল্লাহ লিখে দিয়েছেন যে, তিনি এবং তাঁর রাসূল অবশ্যই বিজয়ী হবেন৷ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মহা শক্তিমান ও পরাক্রমশালী৷(সূরা মুজাদালাহ: ২১)

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলছেন:

﴿وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِينَ﴾ ﴿إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنصُورُونَ﴾  ﴿وَإِنَّ جُندَنَا لَهُمُ الْغَالِبُونَ﴾

আমার প্রেরিত বান্দাদেরকে আমি আগেই,প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে,অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করা হবে৷ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করা হবে৷ এবং আমার সেনাদলই বিজয়ী হবে৷ (সূরার সাফফাত: ১৭১-১৭৩)

  وبشّر النبي صلى الله عليه وسلم أمته بذلك، فعن تميم الداري رضي الله عنه، قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: لَيَبْلُغَنَّ هَذَا الْأَمْرُ مَا بَلَغَ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَلَا يَتْرُكُ اللَّهُ بَيْتَ ‏ ‏مَدَرٍ ‏ ‏وَلَا ‏ ‏وَبَرٍ ‏ ‏إِلَّا أَدْخَلَهُ اللَّهُ هَذَا الدِّينَ بِعِزِّ عَزِيزٍ أَوْ بِذُلِّ ذَلِيلٍ عِزًّا يُعِزُّ اللَّهُ بِهِ الْإِسْلَامَ وَذُلًّا يُذِلُّ اللَّهُ بِهِ الْكُفْرَ  رواه أحمد  والبيهقي

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,‘ভূপৃষ্টে এমন কোন মাটির ঘর বা ঝুপড়ি ঘরও থাকবে না,যেখানে আল্লাহ ইসলামের কালেমা প্রবেশ করাবেন না। সম্মানীর ঘরে সম্মানের সাথে এবং অসম্মানীর ঘরে অসম্মানের সাথে। যাদেরকে আল্লাহ সম্মানিত করবেন,তাদেরকে তিনি মুসলিম হওয়ার তাওফীক দিবেন। আর যাদেরকে তিনি অসম্মানিত করবেন,তারা ইসলামের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করবে। রাবী বলেন,তাহলে তো দ্বীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যাবে (অর্থাৎ সকল দ্বীনের উপর ইসলাম বিজয়ী হবে) (আহমাদ)।

এবার আলোচনা করবো, যেসব কারণে প্রকাশ্য সাহায্য বিলম্বিত হয়

মানুষের মন সহজাতভাবেই ত্বরাপ্রবণ। তাই আল্লাহর দ্বীনের প্রকাশ্য বিজয় দ্রুত নিশ্চিত হলে স্বভাবতই সে খুশী হয়। আর কেনই বা হবে না- এ যে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়  এবং বাতিল ও বাতিলপন্থীদের ডিগবাজি। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيْبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ

‘অন্য যে লাভটি তোমরা ভালবাস, তাহল আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। সুতরাং আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দিন।’ (সূরা ছফ: ১৩)

অনেকে আল্লাহর সাহায্য ও দ্বীনের বিজয় সংঘটিত হওয়া অনেক দূরের ব্যাপার বলে মনে করেন। যার ফলে কখনও কখনও তারা হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন আবার কখনও কর্মপদ্ধতি বদলে ফেলেন। এই বিজয় ও সাহায্য কেন বিলম্বিত হচ্ছে তার কারণ তারা ভেবে দেখেন না। অথচ কারণগুলি জানা থাকলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব,কর্মী ও অনুসারীদের উপর পড়ত। সুতরাং এই কারণগুলি জানা থাকা অত্যাবশ্যক।

সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার কারণগুলিকে আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি।

(ক) নেতিবাচক কারণ ও

(খ) ইতিবাচক কারণ।

নেতিবাচক কারণগুলি জানা থাকলে কিভাবে ঘাটতিগুলি পূরণ করা যায় এবং কিভাবে এর প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তার উপায় অবলম্বন করা যায়। অপরদিকে ইতিবাচক কারণগুলি জানা থাকলে আল্লাহ প্রদত্ত কর্মপদ্ধতি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকতে সমর্থ হয়, এই বিজয় ও সাহায্য ত্বরাণ্বিত হোক কিংবা বিলম্বিত হোক। এ বিষয় নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধারা হল।

(১) সাহায্যের বৈধ কিছু উপকরণ সময় মত যোগাড় না হওয়া :

সাহায্য প্রদানের অনেক উপকরণ রয়েছে। যখন উপকরণগুলি কিংবা তার কিয়দংশ যোগাড় না থাকে তখনই সাহায্য পিছিয়ে যায়। কেননা নীতিশাস্ত্রকারদের মতে, উপকরণ তা-ই যার বিদ্যমানতায় কোন কিছু অস্তিত্ব পায় এবং অবিদ্যমানতায় তা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। হতে পারে উপকরণ উপস্থিত থাকলেও অন্য কোন কারণে সাহায্য পিছিয়ে যেতে পারে, কিন্তু উপকরণ সংগৃহীত না থাকলে যে সাহায্য পাওয়া যাবে না তা নিশ্চিত। যেমন সাহায্য প্রদানের একটি বিধিসম্মত উপকরণ হল সমর প্রস্তুতি। আল্লাহ বলেন,

 وَأَعِدُّواْ لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهِ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِيْنَ مِن دُوْنِهِمْ لاَ تَعْلَمُوْنَهُمُ اللهُ يَعْلَمُهُمْ

‘তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যথাসাধ্য সমর শক্তি ও অশ্ববহর প্রস্ত্তত রাখ, যদ্বারা তোমরা ভীত করে রাখবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং তাদের বাদে অন্যান্যদেরকেও, যাদের তোমরা জান না কিন্তু আল্লাহ জানেন’ (সূরা: আনফাল: ৬০)

(২) বাধাবিঘ্ন হেতু সাহায্য পিছিয়ে যাওয়া :

যে বিষয়ের উপস্থিতি ছাড়া উদ্দেশ্য হাছিল হয় না তাকে বলা হয় ‘বাধা’। বিজয় হাছিলে এরূপ কোন বাধা থাকলে বিজয় অর্জিত হবে না, যদিও বাধা না থাকলে সেই বিজয় অর্জিত হবে, এমন কোন কথা নেই। ইসলামের বিরুদ্ধে এরূপ বাধা-বিপত্তি একটা-দু’টা নয়; বরং অনেক। যেমন যুলুম-নিপীড়নে অস্থির করে তোলা, কাফেরদের জীবনযাত্রা ও পাপ-পঙ্কিলতার প্রতি মুসলমানদের মনে  ঝোঁক ও আগ্রহ তৈরী হওয়া, নেতার আদেশ অমান্য করা ইত্যাদি। সাহায্যের এসব বাধা-বিপত্তিও পরাজয়ের কারণ। এজন্য আমরা দেখতে পাই ওহোদ যুদ্ধে যখন বিজয়ের আলামত দেখা যাচ্ছিল, তখনই গিরিপথ মুখে নিয়োজিত তীরন্দাযরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদেশ লংঘন করে বসেন। ফলে আসন্ন বিজয় মোড় নেয় পরাজয়ের দিকে। যেমন আল্লাহ বলেন,

 أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُم مُّصِيْبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّىْ هَـذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ-

‘কি ব্যাপার! তোমাদের উপর যখন মুছীবত আসল তখন তোমরা বললে, এ কোথা হতে আসল? অথচ তোমরা এর দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বলুন, এ তোমাদের নিজেদেরই পক্ষ হতে’। (সূরা আলে ইমরান:১৬৫)

ইবনু ইসহাক, ইবনু জারীর, ইবনু আনাস ও সুদ্দী বলেন, আল্লাহর বাণী قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أنْفُسِكُمْ– এর অর্থ হল আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ হেতু তোমরা এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছ। তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা সর্বক্ষণ স্ব স্ব স্থানে অবস্থান করবে। কিন্তু তোমরা তাঁর আদেশ লংঘন করেছ। আল্লাহ এখানে ‘আইনাইন’ গিরিপথে নিযুক্ত তীরন্দাযদের কথা বুঝিয়েছেন। তারা নিজেদের স্থান ত্যাগ করে গনীমত সংগ্রহে লিপ্ত হলে পিছন থেকে কাফের বাহিনী মুসলমানদের উপর আক্রমণের সুযোগ পায় এবং তাদের উপর্যুপরি হামলায় মুসলমানরা পরাজিত হয়। এদিকে হুনাইন যুদ্ধে কেন সাহায্য বিলম্বিত হয়েছিল তার কারণ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ বলেন,

لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللّهُ فِيْ مَوَاطِنَ كَثِيْرَةٍ وَّيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئاً وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُم مُّدْبِرِيْنَ

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে বহু ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে হুনাইন দিবসে। সেদিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে’ (তওবা ৯/২৫)

হুনাইন যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্য ছিল ১২ হাযার। তাই কিছু মুসলমান বলে বসল, স্বল্প সংখ্যক কাফের আজ এত বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে পরাভূত করতে পারবে না। এই একটি মাত্র কথা তাদের সাহায্য লাভে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আল্লাহ তাদের সংখ্যাধিক্যের হাতে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সংখ্যাধিক্য তাদের কোন উপকার করতে পারেনি। তারপর যখন বাধা অপসারিত হল এবং বুঝে আসল সংখ্যাধিক্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না তখন কিন্তু সাহায্য ঠিকই এসেছিল। আসলে কাজের উপকরণ যোগাড় করার পর ভরসা রাখতে হবে আল্লাহর উপরই। তাহলেই অর্জিত হবে কাঙ্খিত লক্ষ্য।

(৩) আল্লাহর সাহায্য হতে নিরাশ না হওয়া:  ইয়াকুব (আ.)এর ছেলেরা অঙ্গীকার করে ছিলো, যে আমরা অবশ্য বিন ইয়ামীনকে মিশর থেকে সামগ্রীর সঙ্গে ফেরত নিয়ে আসবো। কিন্তু ইউসুফ (আ.) কৌশলে রেখে দিলেন। আর ছেলেরা বাবার কাছে গিয়ে তাদের অপারগতার কথা বললে, হযরত ইয়াকুব (আ.)বললেন:

يَا بَنِيَّ اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَيْأَسُوا مِن رَّوْحِ اللهِ ۖ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللَّـهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ

বৎসগণ! যাও,ইউসুফ ও তার ভাইকে তালাশ কর এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায়,ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না। (সূরা ইউসুফ: ৮৭)

(৪) উম্মতের পরিপক্কতা ও যোগ্যতার অভাব :

আল্লাহর দ্বীন এক বিরাট ব্যাপার। এর দায়িত্ব বহনের জন্য এমন একটি দল দরকার, যারা দ্বীনের উপর এতটা দীর্ঘ সময় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যে,উহার ভার বহন ও জনগণের মাঝে প্রচারে তারা যথাযথই সক্ষম। কত জাতিই তো সাহায্য লাভের আগেই কষ্ট ও বন্ধুর ঘাঁটি পার হয়ে গেছে বরং সাহায্য অর্জনের জন্যই তারা জীবন দিয়েছে। এভাবে ঘাত-প্রতিঘাত সয়েই পরিপক্কতা, দক্ষতা। আর পরিপক্কতার হাত ধরে আসে স্থায়ী সাহায্য। অদক্ষ মানুষ সাহায্য পেলে তা কাজে লাগাতে পারে না।

তারপরও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় একটি পরিপক্ক ক্ষুদ্র শক্তি যথেষ্ট নয়। এজন্য দরকার বিশাল জনবল এবং তারা হবে নানা রকম ত্যাগ স্বীকারে মানসিকতা সম্পন্ন ও বিশেষ বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন। এটা করতে সময় প্রয়োজন। স্বল্প সময়ে বা সহজে তা হবে না। সুতরাং লোক তৈরি ও তাদের ট্রেনিং প্রদান সবচেয়ে কঠিন ও দুষ্কর। এজন্য আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১৩ বছর ধরে এক একজন লোককে ট্রেনিং দিয়েছেন এবং গ্রুপ গ্রুপ করে রিসালাতের বোঝা বহন ও প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার উপযোগী করে তৈরি করেছেন। ফলে তাঁদের একদল থাকছেন আরকাম (রাঃ)-এর গৃহে তো আরেক দল হিজরত করছেন হাবশায়। একবার সবাইকে আবু ত্বালিব গিরিপথে অন্তরীণাবদ্ধ হতে হচ্ছে তো পুনর্বার তারা হিজরত করেছেন মদীনায়।

পূর্বের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, দ্বীনের পূর্ণতা ও তার প্রাসাদ বিনির্মাণের সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। সময় না হলে সাহায্য ও বিজয় আসবে না। দ্বীন যখন মানুষের উপর নযরদারী করতে পারবে, মানুষের মন যখন সেভাবে গঠিত হবে তখনই বিজয় আসবে। ইসলামের সৈনিকদের ততদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং সময় না হওয়াও সাহায্য ও বিজয় পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

(৫) সাহায্যের কদর অনুধাবনে অক্ষমতা :

 কোন বড় রকমের কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার ছাড়াই দ্রুত সাহায্য নিশ্চিত হলে সেই সাহায্যপ্রাপ্ত জাতি সাহায্যের কদর বা মূল্য বুঝতে পারে না। সেজন্য তারা ঐ সাহায্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিজয়কে ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় শ্রমদান ও  ত্যাগ স্বীকারে কুণ্ঠিত হয়। এই বাস্তবতা তুলে ধরতে আমি দু’টি উদাহরণ পেশ করছি।

প্রথমতঃ দারিদ্র্যের নিমর্ম কষাঘাতে জর্জরিত কোন ব্যক্তি যখন স্বীয় চেষ্টা ও শ্রম দ্বারা সম্পদশালী-ধনাঢ্য মানুষে পরিণত হয়, তখন আমরা দেখতে পাই কতই না প্রাণান্তকর চেষ্টা করে তার অর্থবিত্ত হেফাযত করে। কোনরূপ বিপদ বা ঝুঁকি দেখা দিলে উহা রক্ষার্থে সে সম্ভাব্য সকল উপায়ই অবলম্বন করে। তার কারণ সে দারিদ্র্যের স্বাদ ও লাঞ্ছনা উপভোগ করেছে। তারপর সম্পদ সঞ্চয় ও বর্ধনে কষ্ট-ক্লেশ স্বীকার করেছে। সুতরাং তার পক্ষে ঐ সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সহজ নয়। আল্লাহ তাকে দরিদ্রতা হতে উদ্ধার করার পর সে আবার উহার আবর্তে ফেঁসে যেতে ঠিক তদ্রূপ ঘৃণা করবে, যেমন সে আল্লাহর অনুগ্রহে কুফর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় তাতে ফিরে যেতে ঘৃণাবোধ করে।

কিন্তু তার সন্তানাদি ও উত্তরাধিকারীরা কি অত গুরুত্ব দিবে? তাদের অনেককেই দেখা যাবে তারা ঐ সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং কেউ কেউ তা অনর্থক উড়িয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত গরীব হয়ে যায়। তার কারণ, সে ঐ অর্থ-বিত্তের মূল্য কি তা জানেনি। তা উপার্জন ও সঞ্চয়ে কোন ক্লেশ ভোগ করেনি এবং তার পূর্বসূরীর মত অভাব-অভিযোগের স্বাদ আস্বাদনের সুযোগও তার হয়নি।

দ্বিতীয়তঃ অনুসদ্ধানে ধরা পড়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সাংঘাতিক রকম দুরূহ কাজ। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের শাসক ও খলীফাগণকে দেখা যায়, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং রাষ্ট্রের দুর্বল হওয়ার মত কারণ ঘটতে পারে এমন সব কিছুই সামাল দিতে তারা দ্বিগুণ চতুর্গুণ শ্রম ব্যয় করে যান। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা পিতৃ সম্পদের মালিক হওয়ার মতই রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিক হয়; তারা তখন রাষ্ট্র চালনা রেখে রাষ্ট্রের ফলভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র রক্ষায় যে ক্লেশ স্বীকার করা দরকার সে সম্বন্ধে তাদের কোন চেতনা থাকে না। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে দুর্বলতা ও ভাঙ্গন দেখা যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত উহা তার পতন ডেকে আনে।

এজন্যই কোন কষ্ট-ক্লেশ ছাড়া বিজয় এলে তা সময় বিশেষে স্থায়ী নাও হতে পারে এবং সে বিজয়েকে ধরে রাখাও কষ্টকর হতে পারে। এ কারণে আল্লাহর হিকমত বা কৌশল অনুসারে সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হয়, যাতে দ্বীনের কাজের গুরুত্ব সবার নিকট সমানভাবে অনুভূত হয় এবং এমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা বিজয়ের মূল্য কী ও তা কতটুকু দাম পাওয়ার উপযুক্ত তা জানতে পারে।

(৬) আল্লাহর মহাজ্ঞানে নিহিত হিকমত হেতু বিলম্ব :

কখনও মহান আল্লাহর জ্ঞানে রয়ে যায় যে, দ্বীনের বর্তমান আন্দোলনকারীরা জয়লাভ করলে বিজয়ের দাবী তথা অত্র ভূখন্ডে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, ছালাত কায়েম, যাকাত আদায় ইত্যাদি সম্ভব হবে না, তখন সাহায্য বিলম্বিত হয়। কেননা শুধু জয়লাভ তো কাম্য নয়; বরং জয় লাভের মাধ্যমে যা বাস্তবায়ন করতে হবে তার জন্যই উহা দরকার। সেটা হল ফিৎনা বা আল্লাহদ্রোহী আইনের মূলোৎপাটন এবং সর্বতোভাবে আল্লাহর দ্বীনের বাস্তবায়ন। একথাই আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী হতে বোঝা যায়ঃ

وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَن يَنْصُرُهُ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ، الَّذِيْنَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِيْ الْأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ

‘আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন,যারা তাঁকে সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিধর,মহাপরাক্রমশালী। তাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলে তারা ছালাত কায়েম করবে,যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করবে,সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর হাতে । (হজ্জ ৪০-৪১)

(৭) বাতিলের পরিচয় ফুটে না ওঠা :

যে বাতিলের বিরুদ্ধে দ্বীন প্রচারকগণ সংগ্রাম করছেন সেই বাতিল ও তার ধারক-বাহকরা অনেক সময় দ্বীন প্রচারকসহ অপরাপর মানুষের সম্পূর্ণ অগোচরে থেকে যায়। যারা কখনই বাতিলের পক্ষে যাবার নয় এবং বাতিলের আসল রূপ উদঘাটিত হলে যারা কখনই উহাকে মেনে নেবার নয়, তারাও বাতিল দ্বারা প্রতারিত হয়ে সময় বিশেষে উহার সহযোগী বনে যায়। এভাবে হক্বপন্থীদের মাঝে বাতিল ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে সুযোগমত তাদের ক্ষতি করে চলে। তাদের প্রভাবেও আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হয়। মুনাফিকদের ঘটনা-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক ছাহাবীই মুনাফেকীর অলিগলি সম্বন্ধে জানতেন না। মুনাফিক আছে জানলেও তারা মুনাফিকদের অনেক নাটের গুরুকে চিনতেন না। তারা বরং তাদের প্রতি সুধারণাই পোষণ করতেন।

বনী মুস্তালিক্ব যুদ্ধে মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুহাজির ছাহাবীগণের প্রসঙ্গে খুবই অশালীন উক্তি করেছিল। সূরা মুনাফিকূনের ৭ ও ৮ নং আয়াতে  তা উল্লেখ আছে। তার সেই কথা বালক ছাহাবী যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানালে ওমর (রাঃ) তাঁকে বলেন, ‘আপনি আব্বাস বিন বিশরকে হুকুম দিন, সে তাকে হত্যা করুক। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘ওমর! তা কী করে হয়? লোকেরা তখন বলবে, মুহাম্মাদ তার নিজের লোকদের হত্যা করছে। তার চেয়ে বরং তুমি যাত্রার ঘোষণা দাও। এ থেকে অনেক লোকের দৃষ্টিতে মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবী গণ্য হতে থাকে। তাদের আসল পরিচয় তাদের সামনে অনুদঘাটিত থেকে গেছে। ওদের মূল পরিচয় হল,

هُمُ الْعَدُوُّ فَاحْذَرْهُمْ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُوْنَ ‘ওরা শত্রু। সুতরাং ওদের সম্বন্ধে সাবধান থাকুন। আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন। ওরা উল্টো কোন দিকে যাচ্ছে? (সূরা মুনাফিকূন: ৪)

এজন্যেই যখন বহু সংখ্যক লোকের নিকট তাদের আসল ভেদ ও পরিচয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-কে ঘটনাচক্রে বলেছিলেন, ‘হে ওমর, আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের কথা কি তোমার মনে পড়ে? আল্লাহর কসম, যেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, ‘ওকে হত্যা করুন’, সেদিন যদি আমি তাকে হত্যা করতাম তাহলে অবশ্যই তার পক্ষ নিয়ে অনেক বাহাদুর মাঠ কাঁপিয়ে তুলত। অথচ আজকে তাদেরকে আমি আদেশ দিলে অবশ্যই তাকে হত্যা করবে, কোন সমস্যা করবে না। ওমর বললেন, আল্লাহর কসম, আমি বুঝতে পারলাম আমাদের সেদিনের কথা হতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গৃহীত ব্যবস্থা ছিল কল্যাণকর’।

এই হাদীছ সাহায্য ও বিজয় পিছিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত আমাদের বর্ণিত কারণের একটি অর্থবহ সূক্ষ্মচিত্র। তাই যাদের বাতিল চরিত্র সম্পূর্ণ উদঘাটিত হয়নি এমন লোকদের সাথে সংঘর্ষে জড়ালে মুসলিম উম্মাহর উপর তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। কেননা অনেক মুসলমান ওদের ভাল মনে করে ওদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে।

(৮) আল্লাহর দ্বীন গ্রহণে সাড়া না দেওয়া :

প্রচারকদের দিকে লক্ষ্য করলে তাদের সন্তোষজনক কর্মকান্ড হেতু সাহায্যের বিস্তর সম্ভাবনা কখনও কখনও দেখা দিলেও বাধা এসে দেখা দেয় যাদের মাঝে প্রচার চালান হচ্ছে তাদের কারণে। এ রকম একটি বাধা হল, আল্লাহর পরিকল্পনায় এসব জাতির জন্য হেদায়াত না রাখা। এরা এত কট্টর বিরোধী ও পাপাচারী যে, হেদায়াতকে মোটেও সহ্য করতে রাযী নয়। ফলে আল্লাহ তাদের হেদায়াত করার ইচ্ছা বাদ দিয়েছেন এবং তাদের ললাটে গুমরাহী লিখে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, أَفَلَمْ يَيْأَسِ الَّذِيْنَ آمَنُوْاْ أَن لَّوْ يَشَاءُ اللهُ لَهَدَى النَّاسَ جَمِيْعاً ‘তবে কি যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই সকল মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন’ (রা ১৩/৩১)

فَمِنْهُمْ مَّنْ هَدَى اللهُ وَمِنْهُمْ مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلالَةُ. ‘অতঃপর তাদের কিছু লোককে আল্লাহ সৎ পথে আনলেন এবং কিছু লোকের উপর গুমরাহী অবারিত হয়ে গেল’। (নাহল  ১৬/৩৬)

أُوْلَـئِكَ الَّذِيْنَ لَمْ يُرِدِ اللهُ أَن يُطَهِّرَ قُلُوْبَهُمْ ‘ওরাই (ইহুদীরাই) তারা, যাদের অন্তরকে আল্লাহ নিষ্কলুষ করতে চাননি’ (মায়েদাহ ৫/৪১)

(৯) প্রচারকের মৃত্যুর পরে বিজয় :

প্রচারকের মৃত্যুর পর বিজয় আসবে বলেও অনেক সময় আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হয়। তাছাড়া প্রচারকের জীবদ্দশায় যতটুকু বিজয় অর্জিত হয় তার মৃত্যুর পর তা থেকেও অনেক বড় মাপের বিজয় অর্জিত হয়। কেননা জয় মানে তো কর্মসূচির জয়, ব্যক্তির নিজের জয় নয়। ব্যক্তি বা মানুষকে তো তার প্রচার ও সততার প্রতিদানে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করার  দায়িত্ব মহান আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন, চাই সে জয়ী হোক কিংবা না হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَن يُقَاتِلْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَيُقْتَلْ أَو يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيْهِ أَجْراً عَظِيْماً  

‘যে আল্লাহর রাহে যু্দ্ধ করে সে নিহত কিংবা জয়ী হোক তাকে শ্রীঘ্রই আমি মহাপুরস্কার প্রদান করব’ (নিসা ৪/৭৪)

وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُواْ فِي سَبِيْلِ اللهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ-

‘যারা আল্লাহর রাহে যুদ্ধে নিহত হয় তাদের তুমি কখনই মৃত ভেব না। বরং তারা জীবিত; তারা তাদের প্রভুর নিকটে রিযিক প্রাপ্ত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)

قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِيْ يَعْلَمُوْنَ، بِمَا غَفَرَ لِيْ رَبِّي وَجَعَلَنِيْ مِنَ الْمُكْرَمِيْنَ

‘তিনি বললেন, হায়! আমার কওম যদি জানতে পারত, কেন আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে স্থান দিয়েছেন’ (ইয়াসীন ৩৬/২৬-২৭)

اُدْخُلُواْ الْجَنَّةَ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُوْنَ ‘তোমরা যে আমল করতে তার বদৌলতে (আজ) জান্নাতে প্রবেশ কর’ (নাহল ১৬/৩২)

إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبَّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِىْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ- نَحْنُ أَوْلِيَاءُكُمْ فِىْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِىْ الْأَخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِىْ أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ

‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর সে কথার উপর অবিচল  থেকেছে* (মৃত্যুকালে) তাদের নিকট ফিরিশতা এসে বলবে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তাও করো না। তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তোমার বন্ধু আছি ইহকালে ও পরকালে। সেখানে তোমাদের মন যা চাইবে মিলবে এবং তোমরা মুখ ফুটে যা চাইবে তাও পাবে’ (হা-মীম সিজদা ৪১/৩০-৩১)

কত প্রচারক অতীত হয়ে গেছেন যাদের জীবদ্দশায় দ্বীন জয়লাভ করেনি, অথচ তাদের মৃত্যুর পর তা বিশাল বিজয় লাভ করেছে। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-কে জেল খানাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি যে কর্মসূচি রেখে গিয়েছিলেন, কার্যক্রম  এঁকে দিয়েছিলেন তা তার মৃত্যুর অনেক অনেক পরে এসে চরম সাফল্য লাভ করেছিল। এমন ঘটনা দু’ একটা নয়, অসংখ্য।

(১০) প্রচারকদের পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধিকরণ :

প্রচারকদের পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধ করার মানসে সাহায্য পিছিয়ে যায়। আবার তাতে এমন অনেক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাও থাকে, যা পরবর্তীকালের মানুষের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনে। মহান আল্লাহ বলেন,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُواْ مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيْبٌ-

‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছে যে, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের মাঝে এখনও তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত অবস্থা উপস্থিত হয়নি। তাদেরকে দারিদ্র্য ও রোগ-শোক জাপটে ধরেছিল এবং তারা এমন (বিপদের) ঝাঁকুনি খেয়েছিল যে, স্বয়ং রাসূল এবং তার সঙ্গী মুমিনগণ পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটেই’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)

অন্যত্র আয়াতে এসেছে,

أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوْا أَن يَّقُولُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْن-

‘মানুষ কি মনে করে যে,‘আমরা ঈমান এনেছি’ একথা বললেই তারা ছাড়া পেয়ে যাবে,তাদের কোন পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্বেকার লোকদের আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো অবশ্যই নির্ধারণ করে নিতে হবে,কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী’।(আনকাবূত ২৯/১-৩)

প্রকাশ্য বিজয় ও সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার পিছনে এগুলি আমার নিকটে সুস্পষ্ট কারণ হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে। তবে বিজয় ও সাহায্য বিলম্বিত হওয়ার এসব কারণ কখনও আমাদের নযরে ধরা পড়ে, আবার কখনও ধরা পড়ে না। যাই হোক, আমাদের যেটা প্রত্যয় রাখা যরূরী তা হল, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যার্থে যত বৈধ উপায় আছে তা অবলম্বন করা। বিজয় বা সাহায্য কোনটাই হাতে ধরে বাস্তবে রূপায়িত করা আমাদের দায়িত্ব নয়। সেটা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ও তা‘আলার হাতে। وَماَ النَّصْرُ إلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ ‘সাহায্য কেবল আল্লাহর পক্ষ হতে। আর সাহায্য কখন নিশ্চিত হবে তাও আল্লাহর জ্ঞানে নির্ধারিত আছে। নির্ধারিত সেই সময় না আসা  পর্যন্ত কখনই সাহায্য আসবে না। আমাদের সীমিত ধারণা মত সাহায্য বাস্তবায়িত হবার নয়। আবার আল্লাহ যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হবেই এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে সাহায্য আসবে না। যারা সন্দেহের দোলায় দোদুল্যমান তারা সাহায্য লাভের যোগ্য নয়।

মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে..

فضائے بدر پيدا كر فرشتىـے تيري نصرت كو ** أتر سكتى هے گردوں سىـے قطرأندر قطر اب بهى

আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার উপায়:

যারা এই উপায় গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাইবে, তারাই আল্লাহর সাহায্য পাবে।

১) ঈমান ও আমলে সালেহ: আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

وَعَدَ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُم فِي الأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ النور/55

তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে,আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে,তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববতীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে,যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে,তারাই অবাধ্য। (সূরা নূর: ৫৫)

২) আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করা: আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য করতে হবে, অর্থাৎ এই দ্বীন বিজয়ের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে হবে। মহান আল্লাহর এরশাদ করছেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن تَنصُرُوا اللهَ يَنصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ . وَالَّذِينَ كَفَرُوا فَتَعْسًا لَّهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ  

 হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর,আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন। আর যারা কাফের, তাদের জন্যে আছে দুর্গতি এবং তিনি তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দিবেন। (সূরা মুহাম্মাদ: ৭-৮)

৩) তাওয়াক্কুল আল্লাহ তথা আল্লাহর উপর ভরসা করা;  আর তাওয়াক্কুল দুটি জিনিসের সমন্বয়ে হয়ে (ক) আল্লাহর উপর ভরসা রাখা, তাঁর অঙ্গীকারের উপর আস্থা রাখা; আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

(فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ ) آل عمران/ 159

তারপর যখন কোন মতের ভিত্তিতে তোমরা স্থির সংকল্প হবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো৷ আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর ভরসা করে কাজ করে৷

(খ) ইসলাম স্বীকৃত ওসীলা গ্রহণ করা: এই মর্মে মহান আল্লাহ এরশাদ করছেন:

وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدْوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِن دُونِهِمْ لاَ تَعْلَمُونَهُمُ اللهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنتُمْ لاَ تُظْلَمُونَ ) الأنفال/ 60

আর তোমরা নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সর্বাধিক পরিমাণ শক্তি ও সদাপ্রস্তুত ঘোড়া তাদের মোকাবিলার জন্য যোগাড় করে রাখো৷এর মাধ্যমে তোমরা ভীতসন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে,নিজের শত্রুকে এবং অন্য এমন সব শত্রুকে যাদেরকে তোমরা চিন না৷ কিন্তু আল্লাহ চেনেন৷ আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু খরচ করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হবে,এবং তোমাদের প্রতি কখনো জুলুম করা হবে না৷(সূরা আনফাল: ৬০)

৪) পরমর্শের ভিত্তিতে কার্যাবলী সম্পাদন করা: আল্লাহর রাসূল (সা.) একজন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি এবং সঠিক সিদ্ধান্তের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য পরামর্শ করতেন। কারণ আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন:  ( وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ ) الشورى/ 38

এবং নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়। (সূরা শূরা: ৩৮)

৫) শত্রুদের সঙ্গে মোকাবালার সময় অটল থাকা:

روى البخاري ومسلم عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنُ أَبِي أَوْفَى رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا فَقَرَأْتُهُ إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَعْضِ أَيَّامِهِ الَّتِي لَقِيَ فِيهَا انْتَظَرَ حَتَّى مَالَتْ الشَّمْسُ ثُمَّ قَامَ فِي النَّاسِ خَطِيبًا قَالَ : أَيُّهَا النَّاسُ لَا تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ، وَسَلُوا اللهَ الْعَافِيَةَ، فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاصْبِرُوا، وَاعْلَمُوا أَنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ ظِلَالِ السُّيُوفِ “، ثُمَّ قَالَ : ” اللهم مُنْزِلَ الْكِتَابِ وَمُجْرِيَ السَّحَابِ وَهَازِمَ الْأَحْزَابِ اهْزِمْهُمْ وَانْصُرْنَا عَلَيْهِمْ 

  আব্দুল্লাহ বিন আবী আওফা (রা.) বলেন, রাসূলে কারীম (সা.) উপস্থিত সাহাবাদের সম্মুখে বক্তৃতা প্রদান করেন: শত্রুদের মোকাবালা করার জন্য তোমরা আকাঙ্খিত হয়ও না, আল্লাহর কাছে এ বিষয়ে পরিত্রাণ কামনা করো। তবে হ্যাঁ যুদ্ধ বেধে গেলে, ধৈর্যের সাথে যুদ্ধে অবিচল থাকবে, জেনে রেখো, জান্নাত তরবারির ছায়া তলে। অতঃপর বললেন: হে কিতাব অবতীর্ণকারী মহান আল্লাহ, মেঘমালা পরিচালনাকারী, বাতিলকে ধ্বংসকারী, তাদেরকে ধ্বংস করে দাও, এবং আমাদেরকে তাদের উপর বিজয় দান করো। (বুখারী ও মুসলিম)

৬) আল্লাহর সাহায্য পেতে ত্যাগ, কুরবানী, বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রয়োজন: অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করা, এমন ধারণা না করা যে, জিহাদ মৃত্যুর সময় এগিয়ে আসে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন: أَيْنَمَا تَكُونُواْ يُدْرِككُّمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنتُمْ فِي بُرُوجٍ مُّشَيَّدَةٍ ) النسا 78

আর মৃত্যু, সে তোমরা যেখানেই থাকো না কেন সেখানে তোমাদের লাগাল পাবেই, তোমরা কোন মজবুত প্রসাদে অবস্থান করলেও৷(সূরা নিসা: ৭৮)

৭) দোয়া এবং আল্লাহর ‍যিকর: আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার বড় উপায় হলো, তাঁর নিকট দোয়া করা, এবং তাঁর যিকর করা: আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

 وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُواْ لِي وَلْيُؤْمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ البقرة

আর হে নবী! আমার বান্দা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে,তাহলে তাদেরকে বলে দাও ,আমি তাদের কাছেই আছি ৷ যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত একথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে ৷ (সূরা বাকারা: ১৮৬)

৮) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা:

 কেননা আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্য সাহায্য পাওয়ার বিরাট সুযোগ করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন: وَمَن يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ  

আর সফলকাম তারাই যারা আল্লাহ ও রসূলের হুকুম মেনে চলে এবং আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকে ৷(সূরা নূর: ৫২)

৯) ঐক্যবদ্ধ হওয়া: ইসলামের সৈনিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে থাকতে হবে, এবং আল্লাহর রজ্জুকে মজবুতভাবে ধারণ করতে হবে, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। এই বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

  وَأَطِيعُواْ اللهَ وَرَسُولَهُ وَلاَ تَنَازَعُواْ فَتَفْشَلُواْ وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُواْ إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ –  الأنفال/ 46

আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না, তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে যাবে৷ সবরের পথ অবলম্বন করো,অবশ্যি আল্লাহ সবরকারীদের সাথে রয়েছেন৷ (সূরা আনফাল: ৪৬)

১০) ধৈর্য ধারণ করা: সমস্ত কাজই ধৈর্যের সাথে সমাধান করা উচিত। বিশেষ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রুদের মোকাবালায় তো অবশ্যই অবিচল থাকতে হবে। মহান আল্লাহ এরশাদ করছেন:  يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اصْبِرُواْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَاتَّقُواْ اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ  آل عمران/ 200

হে ঈমানদানগণ! সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবলায় দৃঢ়তা দেখাও, হকের খেদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো৷ আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে৷ (সূরা আলে ইমরান: ২০০)

১১) ইখলাস তথা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য করা: জীবন বাজি রেখে জিহাদকারী একজন মুজাহিদের সমস্ত চেষ্টা প্রচেষ্টা হবে আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

( وَلاَ تَكُونُواْ كَالَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَارِهِم بَطَراً وَرِئَاءَ النَّاسِ ) الأنفال/ 47   

আর তোমরা এমন লোকদের মত আচরণ করো না,যারা অহংকার করতে করতে ও লোকদেরকে নিজেদের মাহাত্ম্যা দেখাতে দেখাতে ঘর থেকে বের হয়েছে ৷(সূরা আনফাল: ৪৭)

এতক্ষণ যা  আলোচনা করা হলো তার  সারসংক্ষেপ হলো:

আলোচনার বিষয় ছিলো: আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?

  • মুমিনদের উপর বালা মুসীবত কেন আসে?
  • যেসব কারণে প্রকাশ্যে সাহায্য বিলম্বিত হয়, (১০টি পয়েন্ট)
  • আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার উপায় (১১টি পয়েন্ট)

মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে ‍দুনিয়ার যাবতীয় বালা মুসীবতে ধৈর্যধারণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন

Related Post