রাসূল (সা.) এর রাজনৈতিক জীবন ও পর্যালোচনা

পূর্বের পর্ব এখানে

পর্ব ৬

ইসলামী রাজনীতি ফরয

ইসলামী রাজনীতি ফরয

ইসলামী রাজনীতি ফরয
কুরআন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে যে রাজনীতি পরিচালিত তাই ইসলামী রাজনীতি।  জনগণের মাঝে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, তাদের সবধরণের চাহিদা পূরণ ও তাদের যাবতীয় ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করাই ইসলামের দাবী। জীবনের সকল স্তরে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর রেজামন্দি হাসিল করাই এ রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ জাতীয় রাজনৈতিক  কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরয। কুরআনী রাজনীতিতে অংশ না নিলে প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়না। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে যারা বলেন, ইসলামে কোন রাজনীতি নেই, দ্বীনের সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই, তাদের এসব কথার ভিত্তি কি? নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তাদের এসব কথার কোন ভিত্তি নেই। ইসলামী শরী‘য়াহ মুসলিম, অমুসলিম, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য নিবেদিত। ইসলামী রাষ্ট্রে সকল শ্রেণী-পেশা মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় রয়েছে ন্যায় ও ইনসাফ পূর্ণ সমাধান। জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ কামনায় প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকদের এই রাজনীতির আওতায় রাষ্ট্র পরিচালনা করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা, মুসলমানদের দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে এর উপর ভিত্তি করে।
দুর্নীতি মুক্ত, সৎ ও যোগ্য লোকের নের্তৃত্ব ছাড়া দেশের সার্বিক কল্যাণ আসা করা যায়না। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে সৎ ও যোগ্য নের্তৃত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। সূরা আম্বিয়ায় ১০৫ নং আয়াতে তিনি বলেছেন, “নিঃসন্দেহে, আমার সৎ কর্মশীল বান্দারাই পৃথিবীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পেয়ে থাকে।” প্রশ্ন হচ্ছে, শাসন কর্তৃত্ব যদি কোন খারাপ জিনিসই হবে তাহলে আল্লাহ তায়ালা কি সৎ কর্মশীল বান্দাদের জন্য তা ঘোষণা করতেন?  প্রকৃত পক্ষে ইসলামী রাজনীতির বাইরে অন্য কোন রাজনীতিই মানুষকে দুর্নীতিমুক্ত ও সৎকর্মশীল বানাতে পারেনা। তিনি আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করছেন যে, তাদেরকে তিনি পৃথিবীর শাসন কতৃত্ব দান করবেন।” সূরা নূর ৫৫। শাসন কর্তৃত্ব কোন নাপাক জিনিস হলে আল্লাহ তায়ালা সৎ ঈমানদারদের জন্য তা ওয়াদা করতেন না। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে বর্তমানে কেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মনিরপেক্ষ, ও ইসলাম নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কারীদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত আছে? এর উত্তর, আমরা পেতে পারি সূরা রা‘দ এর এগারোতম আয়াতাংশে, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আসলে আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে”। আল্লাহর এ নির্দেশ বাস্তবায়নে যে পর্যন্ত সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সৎনের্তৃত্বের ক্ষমতায়ণ হবে না।
ক্ষমতা হচ্ছে আল্লাহর দেয়া আমানত। ক্ষমতার পালাবদল হয় ভোটের মাধ্যমে। আর ভোট হচ্ছে বান্দার হাতে আল্লাহর দেয়া আর একটি আমানত। গুরুত্বপূর্ণ এই আমানতদ্বয়ের ব্যাপারে উভয় পক্ষ সৎলোক না হলে এর গুরুত্ব বুঝবেনা। এ নেয়ামতের গুরুত্ব এতটাই যে, এর মাধ্যমে একটি জাতির উত্থান-পতন নির্ভর করে। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা; “জনপদের লোকেরা যদি ঈমান আনতো এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতসমূহের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই তারা যে অসৎকাজ করে যাচ্ছিলো তার জন্যে আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি”। (সূরা আ‘রাফ: ৯৬)
এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা ক্ষমতা অর্পণের ব্যাপারে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের কথা বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে কতইনা সুন্দর উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।  তিনি আরো হুকুম করেছেন, হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর”। (সূরা নিসা: ৫৮-৫৯) আল্লাহ তায়ালার এ হুকুম লংঘন করলে দুনিয়া ও আখেরাতে তার কি পরিণতি হতে পারে তা অবশ্যই ভাবতে হবে। সকল স্তরের মুসলিম জনগণ, মুসলিম নের্তৃত্ব এবং যাদের হাতে বর্তমানে ক্ষমতা রয়েছে তাদেরকে আল্লাহর এই আদেশ মেনে চলা ফরয নয় কি? এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, যারা ধর্মহীন, ধর্মনিরপেক্ষ বা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনীতি করেন তাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা যাবে কিনা?  উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে একথা  স্পষ্ট যে, এধরণের লোকদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা না জায়েয। যেসব লোক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বা ইসলামকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও উপহাস করে, বা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বা যারা ইসলামকে শুধু ধর্ম হিসেবে মনে করে, বা নামে মাত্র মুসলমান দাবী করে, তাদেরকেও নির্বাচিত করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালার বাণী, “তোমরা পাবে না আল্লাহ ও আখেরাতের বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায়; যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এর বিরোধিতা-কারীদেরকে, হোক না এই বিরোধিতাকারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতী-গোত্র। আল্লাহ এসব লোকদের হৃদয়-মনে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি ‘রূহ’ দান করে তাদের শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রেখো আল্লাহর দলের লোকেরাই সফলকাম। (সূরা মুজাদালাহ্ ২২)
আল্লাহকে যারা ভালবাসে তারা আল্লাহর দ্বীনের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা একই হৃদয়ে একত্রি করতে পারে না। অতএব কেউ যদি ঈমানের দাবী করে এবং একই সাথে ইসলাম বিরোধী লোকদের সাথে আল্লাহর হুকুম লংঘন করে বন্ধুত্ব করে, তাদেরকে ক্ষমতায়ও বাসাতে চায়, তাহলে সে ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী হয় কি করে? আল্লাহর সাথে সম্পর্কের চেয়ে অন্য কোন সম্পর্ক যদি প্রিয়তর হয়, তাহলে সে মুনাফিক ও জালেমের কাতারে শামীল হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালার বাণী, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পিতা ও ভাইয়েরা যদি ঈমান অপেক্ষা কুফরীকে প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদেরকের নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেব গ্রহণ করবে তারাই বড় জালেম”। (সূরা তাওবা: ২৩)
এদেরকে নির্বাচিত করার অর্থই হলো আপনিও তাদের এসব কাজে সন্তুষ্ট ও তাদের এসব অন্যায় কাজের সহযোগী। এর ফলে একদিকে তারা তাদের বিরোধী ইসলামপন্থীদের উপর নানারকম উপহাস, নির্যাতন, নীপিড়ন ও অধিকারহরণ করবে। অপরদিকে এরা আল্লাহর আইনের পরিবর্তে তাদের মনগড়া আইন ও পশ্চিমা আইন প্রতিষ্ঠা করবে। যা কুফরী ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহর বাণী, “আাল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের”। (সূরা মায়েদা: ৪৪) দীর্ঘ সময় কুফরী আইন বলবৎ থাকলে মুসলমানরা আল্লাহর আইনের প্রতি অনীহা প্রকাশ করবে। যা মুসলমানদের জন্য হবে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে আত্মঘাতী কাজ। সত্যিকারে মুসলমান হওয়ার জন্য বাস্তব উদাহরণ বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম আজমাঈন। আদর্শের ক্ষেত্রে তারা আপোষহীন থেকে ঈমানের দাবী পুরণে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় এসেছিলেন। তারা সবকিছু ত্যাগ করে শুধু মদীনায়ই আসেননী, আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত রাখতে নিজের গোত্র, দল ও নিকট আত্মীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বদর ও ওহুদ যুদ্ধের সময় হত্যা করতে হয়েছে কলিজার টুকরা পিতা, ভাই ও সন্তানদেরকে। আবু উবাদা (রা.) তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে জাররাহকে, মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.) আপন ভাই উবাদাহ ইবনে উমায়েরকে, উমর (রা.) তাঁর মামা আস ইবনে হিশামকে হত্যা করেন। আবু বকর (রা.) তাঁর পুত্র আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হয়েছিলেন। হযরত আলী, হামযা এবং উবায়দা ইবনুল হারেস (রা.) তাদের নিকটাত্মীয়  উতবা, শায়বা এবং ওয়ালীদ ইবনে উতবাকে হত্যা করতে দ্বিধা করেননি। ইসলামী রাজনীতি যদি ফরযই না হতো তাহলে তারা এত কঠিন কাজ করলেন কেন?  মুসলমানদেরকে ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী প্রমাণ করতে, মাঝ পথে যে ধরনেরই প্রতিবন্ধকতা আসবে তা প্রতিহত করেই ঈমানের দাবীকে সত্যে পরিণত করে দেখাতে হবে। আর সাহাবায়ে কেরাম সেই কাজটি বাস্তবে দেখিয়েছেন, যার কারণেই আল্লাহ পাক তাদেরকে জান্নাতী বলে ঘোষণা করেছেন। তাদের এ মহা সফলতা শুধু ভাবাবেগ ও মেকী ভালবাসা দিয়ে অর্জিত হয়নি। ইসলামের দৃষ্টিতে সত্যিকারে কে আপন আর কে পর তা নির্ণয় হবে তাওহীদের পতাকা সমুন্নত রাখার ময়দানে। বদর যুদ্ধে বন্দীদের ব্যাপারে হযরত উমর (রা.) তাদের সবাইকে হত্যার আবেদন করেছিলেন। মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)-এর আপন ভাই আবু আযীযকে শক্ত করে রশি দিয়ে বাঁধা হচ্ছিলো। তা দেখে মুসআব (রা.) চিৎকার করে বললেনঃ ওকে বেশ শক্ত করে বাঁধো। একথা শুনে আবু আযীয বললোঃ তুমি আমার আপন ভাই হয়ে একথা বলছো? জবাবে মুসআব (রা.) বলেছিলেন, এ মুহূর্তে তুমি আমার ভাই নও, বরং যে আনসারী তোমাকে পাকড়াও করছে সে আমার ভাই। এমন কি বন্দীদের ভিতর রাসূল (সা.) এর আপন আত্মীয়-স্বজনদের সাথেও অন্য সব বন্দীদের থেকে স্পেশাল কোন সৌজন্যমূলক আচরণ পর্যন্ত করা হয়নি। ঈমানের দাবীতে সত্যিকারে মুসলমান কাকে বলে এবং আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের মানদণ্ড কি হবে তা তারা বাস্তবে দুনিয়াবাসীকে  দেখিয়েছেন। এমনিতেই তাদেরকে জান্নাতের সু সংবাদ দেয়া হয়নি। (এ অধ্যায়ের বাকী অংশ ইনশাল্লাহ আগামী পর্বে )

Related Post