ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্ববোধ

 ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্ববোধ

ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্ববোধ

প্রারম্ভিকা:- দেশপ্রেম মানুষের একটি স্বভাবজাত গুণ। আশরাফুল মাখলুক্বাত হিসেবে মানুষের যেসমস্ত গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তন্মধ্যে দেশপ্রেম অন্যতম। স্বদেশের প্রতি ভালবাসা মানব চরিত্রের একটি মহৎ দিক। দেশকে ভালোবেসে এ দেশের লক্ষ লক্ষ লোক নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা ধর্মপ্রাণ মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি। তাইতো ভাষা বিজ্ঞানী ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন মাতা মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এ তিনটি পরম শ্রদ্ধার বস্তু। আর মাতৃভূমি তথা জন্মস্থানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বা ভালবাসা, গভীর অনুভূতি ও মমত্ববোধকে দেশপ্রেম বলে। প্রাবন্ধিক সাকী মাহবুব বলেন- “যে ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং বড় হয়ে ওঠে, সেই পরিবেশ ও সেখানকার মানুষের প্রতি তার একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ গড়ে ওঠে। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি এ আজন্ম আকর্ষণই দেশপ্রেম’’। দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে মানুষের মনের মণিকোঠায় যে চেতনবোধ জাগ্রত হয় তাকেই দেশাত্ববোধ বলে। মাতৃভূমি আল্লাহ তাআ’লার পক্ষথেকে বিশেষ নিআ’মত। যিনি দেশের প্রতি তার উপর অর্পিত কর্তব্য যথাযথ সম্পাদন করেন তিনি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এবং তিনিই বাস্তবতার নিরিখে আল্লাহর নিআ’মতের শুকরিয়া আদায়কারী। মাতৃভূমি নামক নিআ’মতের শুকরিয়া আদায় যে করে না সে প্রকৃত মুমিন নয়। আরবী একটি প্রবাদ খুবই প্রসিদ্ধ – حب الوطن من الإيمان “ দেশকে ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ ’’।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেশের প্রতি ভালবাসা:- একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় দেশপ্রেম অত্যাবশ্যক।কোন দেশ বা ভূখন্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মান সম্মান, স্বাধিকার, ঈমান ও আ’মল হিফাজত করা অসম্ভ। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিতে স্বদেশ প্রেমের গুরুত্ব অত্যাধিক। যেমন দেশ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারিমে এসেছে;
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّـهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللَّـهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
“আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতেমানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাযিল করেছি লৌহ,যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ওতাঁর রসূলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর,পরাক্রমশালী ’’ (সূরা আল হাদীদ: ২৫)
দেশপ্রেমিক শাসকের কর্তব্য:
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
“তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ? দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত ’’। (সূরা আল হজ্জ্ব: ৪১)
উপরিউক্ত আয়াতে একজন দেশপ্রেমিক শাসকের জন্য প্রধান চারটি কাজ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সালাত কায়েম, যাকাত আদায়, সত্য ও ন্যায়ের নির্দেশ এবং অসত্য ও অন্যায় থেকে নিজে বিরত থাকা এবং অন্যকে বিরত রাখা। দেশের কোন শাসক যদি আল্লাহর নির্ধারিত এই চার কর্মসূচি আঞ্জাম দিতে না পারেন তাকে সত্যিকার দেশপ্রেমিক শাসক বলা যাবে না।
স্বদেশ প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাসূল (সা.) নিজে:- বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এর উপর কুরআন নাযিল করার মাধ্যমে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হলে তিনি তার স্বদেশ মক্কার জনগণকে এ দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকলেন। অথচ তার সে দাওয়াতে স্বদেশের জনগণের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া বাকীরা তার দাওয়াত প্রত্যাখান করে উল্টো এ মহৎ কাজে বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে স্বদেশী বরবর জাহেলরা নবী (সা.) এবং তার দাওয়াত কবুলকারী নওমুসলিম সাহাবীদের উপর অত্যাচার শুরু করে এমনকি তার প্রাণনাশে বদ্ধপরিকর হয়। মক্কাবাসীর অত্যাচার অতিষ্ট হয়ে সেখান থেকে মদীনায় হিজরতের সময় স্বীয় জন্মভূমির প্রতি তিনি বার বার ফিরে তাকান এবং কাতর কন্ঠে আফসোস করে বলেন;

مكة أحب البلاد إلى لولا أخرجت لما خرجت

  “মক্কা আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় দেশ, যদি সে আমাকে বের করে না দিত তবে আমি বের হতাম না’’। এজন্য কোন এক বাঙ্গালী শিল্পী গেয়েছেন “মক্কা ছেড়ে দ্বীনের নবী মদীনাতে যায় / জন্মভূমির মায়ায় নবী ফিরে ফিরে চায়’’।
সাহাবায়ে কিরামের দেশপ্রেম:- সাহাবায়ে কিরাম ও স্বদেশকে ভালবাসতেন। হিজরেতর সময় মদীনায় যাওয়ার পর আবু বকর (রা.) এবং বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তখন তাদের মনে প্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতি চিত্র ভেসে উঠেছিল। সে সময় তারা মক্কার দৃশ্যাবলী স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে রাসূল (সা.) সাহাবীদের মনের এ দূরবস্থা দেখে প্রাণ ভরে দুআ’ করেন: “হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালবাসী তেমনি তার চেয়ে বেশি মদীনার ভালবাসা আমাদের অন্তরে দান কর ” (বুখারী)। ষষ্ঠ হিজরিতে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাসূল (সা.) যখন ওমরা পালনের জন্য মক্কায় রওয়ানা দেন তখন সাহাবীরা স্বদেশের কথা স্মরণ করে আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিলেন ।
দেশের জনগণকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেশপ্রেমের অনন্য নিদর্শন:- নবুয়ত লাভের পর মহানবী (সা.) মক্কায় ১৩ বৎসর ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে তার সাহাবীগণসহ নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শেষপর্যন্ত স্বদেশ মক্কা ত্যাগকরতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর অষ্টম হিজরী সালে বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং অতীত অত্যাচার ও নির্যাতনের কথা ভুলেগিয়ে দেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন এবং বিশ্বে দেশপ্রেমের উদারতা আর মহানুভবতার নিদর্শন রাখলেন। আল্লাহর নবী ইউসুফ (আঃ) তার ভাইদের ক্ষেত্রে যা করেছিলেন তিনিও তাই বললেন

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- لا تثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم

“রাসূল (সা.) বলেন আজ তোমাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’’ (সূরা ইউসুফ: ৯২) দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ব প্রচেষ্টা চালানো উচিত।
কাব্যিক ছন্দে দেশপ্রেম:- ১৭৫৭ সালের বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ভেতর দিয়ে বাংলার শেষ স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। উদ্ভব ঘটে পশ্চিমা ইউরোপীয় ইংরেজ শাসনের। ইংরেজরা এ দেশে শাসনের নামে শোষণ শুরু করে। তাদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে গোটা দেশবাসী। তাদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দেশপ্রেমিকগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কবি সাহিত্যিকগণ তাঁদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে দেশবাসীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জোগান। তারপর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এ দেশের স্বাধীনতার চেতনা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং ৭১- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। এর বহু কাল আগে থেকেই এ দেশের কবিদের ভেতর দেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটেছিল। বাংলাদেশ যেহেতু কবির দেশ, কবিতার দেশ, গানের দেশ, সুরের দেশ, সেই কারণে এ দেশের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও গীতিকারের কলমে দেশপ্রেমের গান ও কবিতা উঠে এসেছে বারবার।
মধ্যযুগের অন্যতম কবি আব্দুল হাকিমের কবিতায় মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমত্ববোধের পরিচয় মেলে। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে যারা বাংলাভাষাকে ঘৃণা করেন তারা কেন এ দেশ ত্যাগ করছেন না- এ প্রশ্ন তিনি করেছেন তাঁর এ কবিতায়-
“যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়”।
কবি মোশাররফ হোসেন খান তাঁর ‘দেশের জন্য’ কবিতায় দেশপ্রেমের এক চমৎকার নিটোল ছবি এঁকেছেন এভাবে-
“আকাশ ভরা তারার মেলা বাওড়ি বাউল সুর
বাতাস ফুঁড়ে যাচ্ছে ছুটে সামনে বহু দূর
মাথার পরে আছড়ে পড়ে আপন করা হাসি
যে হাসিটা অনেক দামী- জোসনা রাশি রাশি
ভুবন জোড়া খুশির মায়া জড়িয়ে আছে মা-কে
সাত সমুদ্দুর ওপার থেকে মা- যে আমার ডাকে
স্বদেশ আমার সূর্য হাজার রাজ্যিসেরা সুখ
সবুজ-সোনা আলপনাতে ভাসে তারই মুখ/
স্বদেশ আমার ব্যাকুল হৃদয় আকুল করা গান
দেশের জন্য ভালোবাসা বান ডেকেছে বান॥ ”
কবি জসিম বিন আখতার তার “নেই কি দেশের মায়া?” কবিতায় আক্ষেপ করে বলেন-
বিনয় লাজে সকল কাজে
শান্তিকামী মানুষ বলে
বিশ্বে যারা খ্যাত
সকাল সাঁঝে তাদের মাঝে
প্রতিহিংসার রাজনীতিটা
বাড়ছে কেন এত
গ্রন্থশালা পান্থশালা
রাস্তাঘাটে শান্তছিল
যাদের চলার গতি
কিসের লোভে কিসের ক্ষোভে
দিবারাতি ব্যস্ত ওরা
করতে পরের ক্ষতি
অচীনপুরে গানের সুরে
ভাল কেন লাগছে তাদের
ভিনদেশীদের ছায়া
দেশের পণ্য কিসের জন্য
কেনা কাটা ছাড়ল তারা
নেই কি দেশের মায়া?
বাংলাসাহিত্যের কবিতার শাখাটি দেশপ্রেমের কবিতায় সমৃদ্ধ। কবি-সাহিত্যিকগণ দেশপ্রেম গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন বলে যুগে যুগে যত কবি-সাহিত্যিকগণ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই লিখেছেন ভালোবাসার স্বদেশকে নিয়ে। আমাদের বাংলা কবিতা – সাহিত্যেও দেশপ্রেমের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে দেশের সীমান্ত প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা উচিত:- জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় দেশপ্রেম, কেননা এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বাণী –

عن إبن عباس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم عينان لا تمساهما النار عين بكت من خشية الله و عين باتت تحرس فى سبيل الله – –

“আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (সা.) বলেন দুটি চোখ কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না, ঐ চোখ যে চোখ আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে; ঐ চোখ যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় (সীমান্ত পাহারায় বা মুসলিম বাহিনীর জানমাল রক্ষায়) বিনিদ্র রজনী কাটায়’’ (তিরমিযী)।

عن فضالة بن عبيد رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال كل ميت يختم على عمله إلا الذى مات مرابطا فى سبيل الله فإنه ينمى له عمله إلى يوم القيامة و يأمن من فتنة القبر- –

“ ফুযালাহ ইবনে উবাইদ (রা.) নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেছেন আল্লাহর রাস্তায় (সীমান্ত পাহারায় বা মুসলিম বাহিনীর জানমাল রক্ষায় এবং জিহাদের ময়দানে) পাহারারত মুজাহিদ ব্যতীত প্রত্যেক মৃতের আমল পরিসমাপ্তি ঘটে, আর মুজাহিদের আমল কিয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকে এবং তাকে কবরের পরীক্ষা থেকেও নিরাপত্তা দেয়া হয়’’ (তিরমিযী, আবু দাউদ ও দারেমী)।

و قال رسول الله صلى الله عليه وسلم رباط يوم فى سبيل الله خير من الدنيا وما عليها- –

“রাসূল (সা.) বলেছেন আল্লাহর রাস্তায় একদিন পাহারায় নিয়োজিত থাকা দুনিয়া এবং তার উপরে যা কিছু আছে সবকিছু থেকে উত্তম’’ (বুখারী ও মুসলিম)।

عن سلمان فارسى رضي الله عنه قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول رباط يوم و ليلة خير من صيام شهر و قيامه و إن مات فيه جرى عليه عمله الذى كان يعمل و أجرى عليه رزقه وأمن الفتان

– – “সালমান ফারসী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি; তিনি বলেছেন: আল্লাহর রাস্তায় একদিন এবং একরাত পাহারায় নিয়োজিত থাকা একমাস (নফল) রোযা রাখা এবং ক্বিয়ামুল্লাইল (তাহাজ্জুদের সালাত) থেকেও উত্তম, আর যদি সে ঐ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তার নেক আমল চলমান থাকে যা সে আমল করত এবং রিযিকও চলমান থাকে, আর কবরের ফিতনা থেকে সে থাকবে নিরাপদ’’ (তাফসীরে বাগভী ও মাজহারী)
দেশপ্রেম সফলতার চাবিকাঠি:- জীবনে সফলতা অর্জন প্রত্যেকেরই লক্ষ্য থাকে, আর সে সফলতা বিভিন্ন উপায়ে অর্জন করা যায়, তন্মধ্যে দেশপ্রেম একটি সফলতা অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন –

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّـهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ –

“হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় (সীমান্ত প্রহরা এবং যুদ্ধের প্রস্তুতিতে) দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে (সফলতা অর্জনে) সমর্থ হতে পার’’। (সূরা আলে ইমরান: ২০০)

দেশ রক্ষা কল্পে সদা প্রস্তুত থাকা আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ:- আল্লাহ তাআ’লার বাণী –

وَأَعِدّوا لَهُم مَا استَطَعتُم مِن قُوَّةٍ وَمِن رِباطِ الخَيلِ تُرهِبونَ بِهِ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُم وَآخَرينَ مِن دونِهِم لا تَعلَمونَهُمُ اللهُ يَعلَمُهُم وَما تُنفِقوا مِن شَيءٍ في سَبيلِ اللهِ يُوَفَّ إِلَيكُم وَأَنتُم لا تُظلَمونَ

“আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুতঃ যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না।’’(সূরা আল আনফাল: ৬০)
এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন

عن عقبة بن عامر رضي الله عنه قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم على المنبر يقول (وَأَعِدّوا لَهُم مَا استَطَعتُم مِن قُوَّةٍ) ألا أن القوة الرمى ألا أن القوة الرمى ألا أن القوة الرمى (رواه مسلم)

“উক্ববাহ ইবনে আমের (রা.) বলেন আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি তিনি মিম্বরের উপরে বলেন: (তোমরা তোমাদের সাধ্যানুসারে শক্তি সঞ্চয় কর) সাবধান নিশ্চয়ই তীরন্দাজী/গুলিনিক্ষেপ/পারমানবিক বোমা নিক্ষেপই শক্তি, সাবধান নিশ্চয়ই তীরন্দাজী / গুলিনিক্ষেপ / পারমানবিক বোমা নিক্ষেপই শক্তি, সাবধান নিশ্চয়ই তীরন্দাজী / গুলিনিক্ষেপ / পারমানবিক বোমা নিক্ষেপই শক্তি’’ (রাসূল (সা.) কোন কথা বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলে সেটা তিনবার উচ্চারণ করতেন) (মুসলিম) ।
দেশপ্রেম ও সেনাবাহিনী:- এক জন সৈনিকের নিকট দেশ তথা মাতৃভূমি সর্বাধিক মূল্যবান বস্তু দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় সে তার নিজের জীবনটুকু বিসর্জন দিতে ও কুণ্ঠাবোধ করে না। এ ক্ষেত্রে আমরা বীরশ্রেষ্ঠ শহীদগণসহ অনেক সেনা সদস্যের কথা স্মরণ করতে পারি যারা দেশকে শত্রু মুক্ত করার লক্ষ্যে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। আর এ জন্যই বলা হয়- “আমার দেশ আমার প্রাণ / বাঁচলে দেশ বাঁচবে মান’’। সেনাবহিনীর প্রতিটি সদস্য এই মর্মে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ স্পর্শকরে শপথ করেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে কেউ কেউ সেই শপথের কথা ভুলে যান, যা মোটেই উচিত নয়। দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে করা এই শপথ সম্পর্কে ক্বিয়ামতের ময়দানে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন –

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ

“হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর’’। (সূরা আল মায়েদা: ১)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআ’লা বলেন –

وَأَوفوا بِالعَهدِ إِنَّ العَهدَ كانَ مَسئولًا

“এবং অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’’। (সূরা আল ইসরা: ৩৪ )
হাদীস শরীফে আছে রাসূল (সা.) বলেন:

لا إيمان لمن لا أمانة له ولا دين لمن لا عهد له

“যার মধ্যে আমানতদারী নাই তার ঈমান নাই এবং যে অঙ্গীকার পূরণ করে না তার কোন দ্বীন নাই’’।
দেশপ্রেমের জন্য অপরিহার্য শর্ত মানবতাবাদী হওয়া:- একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে পারেন একজন প্রকৃত মানবতাবাদী। আর মানবতা ছাড়া মাতৃভূমির মূল্য নেই। তাই একজন দেশপ্রমিকের আহজারী জিস বাগীচা মে ফুল নেহী উনসে কিয়া কাম হায় / জিস ওয়াতান সে ইনসানিয়াত নেহী উস সে কিয়া কাম হায় – “যে বাগানে ফুল নেই সে বাগানের কী প্রয়োজন / যে মাতৃভূমিতে মানবতা নেই সে মাতৃভূমি কী প্রয়োজন’’?
অপরদিকে বহুকাল পিঞ্জিরাবদ্ধ বুলবুল বহু আকাঙ্খিত মুক্তি পেয়ে পুরোনো আবাস স্থলে ফিরে এসে শোকে দুঃখে বেদনায় ডানা ঝাঁপটিয়ে আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো আর বুক ফাটা আর্তনাদে গেয়ে উঠলো – জবে ছুটে আশীরতো বদলা হো যামানা থা / না ফুল থা, না চমন থা, না আশিয়া না থা – “যখন মাতৃভূমিতে ছুটে আসি তখন যুগ পরিবর্তন হয়েগেছে / ফুলের বাগানে ফুল নেই, ফুলের কলিও নেই, কোন কিছুই নেই’’ (কারণ হুতোম পেঁচার দল সব লুটেপুটে নিয়ে গেছে)। একটি ফুলের বাগান ধ্বংস করার জন্য একটা হুতোম পেঁচাই যেখানে যথেষ্ট সেখানে হুতোম পেঁচা বসেগেছে গাছের প্রত্যেক ডালে ডালে, ফুল বাগানের অবস্থা কি হবে আল্লাহই জানে। এজন্যই কবি আক্ষেপ করে বলেন: রাজ্য যখন স্বাধীন হলো হুতোম পেঁচার দল / লুটে নিল সকল প্রকার স্বাধীনতার ফল। এখানে হুতোম পেঁচার সাথে দেশদ্রোহীকে তুলনা করা হয়েছে যে স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাই নিজের স্বার্থে আঘাত হলে যে বিদেশ গিয়ে স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ায় নিঃসন্দেহে সে দেশদ্রোহী। দেশপ্রেমিক জনতার উচিত তাদের প্রত্যাখ্যান করা।
যবনিকা:- একজন প্রকৃত ধর্মানুসারী ব্যতীত সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হওয়া অসম্ভব। তাই ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্ববোধ মানুষকে স্বদেশ রক্ষায় উদ্ধুদ্ধ করে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক যিনি স্বদেশের কল্যাণে সদা নিজেকে নিয়োজিত রাখেনে এর ব্যতিক্রম লোককে জনৈক কবি পশুর সঙ্গে তুলনা করে বলেন: “স্বদেশের উপকারে নেই যার মন / কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন’’। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে দেশপ্রেমিক জনতা নিজের জান মাল উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করে না। কারণ স্বদেশকে হেফাজত করতে না পারলে ধর্মকে হেফাজত করা যায় না, দেশের মানুষ ও তাদের স্বার্থকে সংরক্ষণ করা যায় না। একজন ধর্মভীরু দেশপ্রেমিক দেশের সাধারণ মানুষকে স্বদেশের উন্নতি সাধনে সজাগ রাখে, দেশের জাতীয় সম্পদ অপচয় রোধে উদ্ধুদ্ধ করে। আর দেশাত্ববোধ ব্যতীত কোন দেশের স্বাধীনতা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। তাই মহান আল্লাহর দরবারে আমাদের প্রার্থনা তিনি যেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটি থেকে সন্ত্রাস-দুর্নীতি, চাদাবাজী-বোমাবাজী, জঙ্গীবাদী-চরমপন্থী, চোরাকারবারী-অবৈধ মজুদদারী, সুদখোর-ঘুষখোর, মদ্যপায়ী-ভেজাল ব্যবসায়ী এবং দেশের মান মর্যাদা বিনষ্টকারী দেশের স্বার্থবিরোধী অপশক্তির মূলোৎপাটন করে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী শোষণমুক্ত স্বাবলম্বী সোনার বাংলাদেশ গঠনের তাওফিক দেন (আমীন)।

Related Post