কবূল কর হে আল্লাহ

কবূল কর হে আল্লাহ

কবূল কর হে আল্লাহ

মহান আল্লাহ তা’য়ালাই এ ধরণীর একমাত্র স্রষ্টা। তার এ গুলশানে যা কিছু আছে, সবই তাঁর মাখলুক, গুণগ্রাহী। আর বনী আদম মানুষ এ গুলশানের মধ্যমণি, আল্লাহর পেয়ারা ও নয়নমণি। এ বসুন্ধারার কুল-মাখলুক যেন এ মানব জাতির সৌরভে মাতোয়ারা। মানবীয় যাদুর ছোঁয়ায় সব যেন আভোলা। যেন মানুষ বেহেশতী দূত, সবাই তার খিদমতে সদাপ্রস্তুত। সবাই যেন তার গোলাম-বাঁদী, চোখের ইশারা পেলে কে আগে কাজটি করে দিবে-এ প্রতিযোগিতায় মত্ত। বাস্তবেও তাই। ধরাপৃষ্ঠে যত মাখলুক আছে, মানুষ হল এদের রাজা- আশরাফুল মাখলুকাত। সবাই তার বশীভূত, কর আদায় করে। আর তাই রাজত্ব পরিচালনার জন্য তাকে দেয়া হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, কলা-কৌশল ও প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে সে রাজত্ব পরিচালনা করে, এরই সৌরভে সবাই উন্মত্ত, এ যাদুর ছোঁয়ায় সবাই আভোলা।

তাই বলে কি মানুষের কোন শত্রু নেই? নিশ্চয় আছে। তার ভয়ানক দু’টো গোপন শত্রু আছে, একটা তার মন-রিপু , অন্যটি আল্লাহর রহমত হতে বিতাড়িত শয়তান। উভয়ের বিষাক্ত দংশনে মানুষ মোহগ্রস্ত নির্বোধ হয়ে পড়ে। জৈবিক উন্মাদনায় তার মনুষত্ব লোপ পায়। নেমে আসে পশুত্বের কাতারে। অতঃপর সে কখনো হিংস্র-হায়েনার রূপ ধারণ করে, কখনো বিষাক্ত বিচ্ছুর রূপ নেয়। আবার কখনো সে বিষাক্ত সাপের রূপ নেয়। তার হিংস্র থাবায় আর বিষাক্ত ছোবলে শুধু মানুষ নয়, কুল মাখলুক নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে।

কিন্তু মানুষ তো মানুষই। সে তো বেহেশতী দূত। আর তাই তার মোহগ্রস্ত উন্মাদনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। মোহ কেটে যাওয়ার সাথে সাথে তার মানবিক গুণাগুণ জীবন ফিরে পায়। অমনি সে অনুশোচনার জ্বলন্ত অগ্নি-স্ফুলিঙ্গে দগ্ধ হতে থাকে। বুকের ভিতরের মর্মবেদনা তার পেশানীতে ঘন মেঘের আবরণ ফেলে। অতঃপর তার দু’চোখ বেয়ে আষাঢ়ী ঢল নামে। এ ঢলে নিভে যায় জাহান্নামের জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। এদিকে ইঙ্গিত করেই প্রিয় নবী (সা:) ইরশাদ করেন- ‘‘গুনাহ থেকে সত্যিকার তাওবাকারীর উদাহরণ এমন- যেন তার কোন গুনাহই নেই।’’ (তিরমিযী: ২৪৯৯, ইবনে মাযাহ : ৪২৫১)

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,‘‘অবশ্যই আল্লাহ তা’য়ালা তাওবাকারী এবং পবিত্রতা অর্জকারীকে ভালবাসেন।’’ (সূরা বাকারা: ২২২)

 প্রিয় নবী (সা:) ইরশাদ করেন,‘‘আল্লাহ তা’য়ালা তাওবা করাতে এত অধিক খুশি হন- যা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। আমি প্রতিদিন সত্তর থেকে একশতবার তাওবা করি। সুতরাং তোমরাও তাওবা কর। আল্লাহ তা’য়ালা মৃত্যুর আগমূহূর্ত পর্যন্ত তাওবা কবুল করেন।’’ (নাসাঈ)

এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা:) একটি ঘটনা বায়ান করেন। ঘটনাটি অনেক বছর আগের।
কোন এক এলাকাতে একজন পাপী লোক বাস করত। সে নিরানব্বইটি হত্যার আসামী। এক সময় সে তার কৃত অপরাধের উপর অনুতপ্ত হয়। অতঃপর সে একজন আলেমের কাছে বিষয়টি বলে তাওবার পদ্ধতি জিজ্ঞেস করে। আলেম সাহেব একজন রাহেবের (আহলে কিতাবের আলেম) নিকট যেতে বললেন। রাহেব না ভেবেই বলে ফেলেন- তোমার তাওবা কবুল হওয়ার নয়। অমনি সে তাকে হত্যা করে সেঞ্চুরী পূর্ণ করে। এতেও সে নিরাশ হল না। তার অনুশোচনা ও অনুতাপ আরো বেড়ে যায়। সে ভাবতে ভাবতে অন্য এলাকাতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে একজন আলেমকে পূর্বের সেই একই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল (গভীরভাবে চিন্তা করে) উত্তরে তিনি বলেন-তোমার তাওবা কবুল হবে। তোমার এলাকা পাপে কলুষিত। তাই তুমি তোমার এলাকা ছেড়ে অমুক এলাকাতে চলে যাও। সেখানকার লোকজন সদা ইবাদতে মশগুল থাকে। তাওবা করে সেখানে গিয়ে তাদের সাথে তুমিও ইবাদতে মশগুল থাকবে। তাতে আল্লাহ পাক তোমার তাওবা কবুল করবেন। এ কথা শুনে পাপী ব্যক্তিটি ঐ এলাকার পথ ধরল। কিন্তু সে ঐ এলাকাতে না পৌঁছতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। এবার তার জন্য আযাবের ফেরেশতা আসলেন, আবার রহমতের ফেরেশতাও আসলেন। রহমতের ফেরেশতা বললেন, তাকে আমি গ্রহণ করব এবং আরাম ও শান্তি দিব। কেননা, সে তাওবার পথে রয়েছে। আযাবের ফেরেশতা বললেন, না, তাকে আমি গ্রহণ করব। কেননা সে সারা জীবন আল্লাহর নাফরমানী করেছে এবং ১০০ জনকে হত্যা করেছে। আর তাওবার গন্তব্যে সে এখনও পৌঁছতে পারেনি।

উভয়য়ের বাদানুবাদের শেষে ফয়সালা হল- দেখতে হবে তার মৃত্যুর স্থান থেকে নাফরমানীর স্থানের দূরত্ব নিকটবর্তী, নাকি তাওবার স্থানের দূরত্ব নিকটবর্তী। যে স্থানের সে নিকটবর্তী হবে, তাদের দলে গণ্য হবে। ওদিকে তাওবার পথে মাত্র অল্প কিছু রাস্তা সে অতিক্রম করেছিল, ফলে মেপে দেখা গেল-তার তাওবার স্থানই নিকটবর্তী। সুতরাং তাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে রহমতের ফেরেশতা তাকে গ্রহণ করলেন। (কেসাসুন নববী আস সহীহ)

তাওবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-‘‘হে আমার পাপী বান্দারা। তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি অতিশয় দয়ালু ও ক্ষমাশীল।’’ (সূরায়ে যুমার: ৫৩)

প্রিয় নবী (সা:) আমাদের মত পাপী বান্দাদেরকে নিরুৎসাহিত না করে তাওবার পথ দেখিয়েছেন। কারণ, পাপ থেকে তাওবা করার কারণে মানুষ পশুত্বের স্তর থেকে উঠে ফেরেশতাদের ঊর্ধ্বে সম্মানজনক স্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয়। সক্ষম হয় দিলের তাজা খুন দিয়ে ইসলাম রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে। যেমনটি সাহাবায়ে কিরামদের জীবনে ঘটেছিল। তাই তিনি পাপকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন। আর পাপীকে বুকে তুলে হিদায়াত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-‘‘বনী আদম মানুষ মাত্রই ভুল করে। তবে উত্তম ভুলকারী সেই-যে ভুল থেকে তাওবা করে। (তিরমিজী শরীফ)

তাওবা কবুলের শর্ত: আল্লাহর হুকুমের নাফরমানী হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করতে হবে। তাওবা কবুল হওয়ার শর্ত তিনটি যথা

(১) অপরাধ ছেড়ে দেয়া এবং সৎকর্ম পালন করা।

(২) কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।

(৩) ভবিষ্যতে নাফরমানী না করার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।

আর যদি অপরাধের সম্পর্ক মানুষের হকের সাথে হয়, তাহলে উল্লেখিত তিনটিসহ বাড়তি একটি শর্ত হল-ঐ হকদার ব্যক্তি থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তার প্রাপ্য হক তাকে পৌঁছিয়ে দেয়া।

সে সাথে অপরাধ যদি প্রকাশ্য হয়, তাহলে প্রকাশ্য তাওবা করতে হবে, আর গোপনে হলে গোপনে তাওবা করবে।

উল্লেখিত শর্তসমূহ আদায়ের দ্বারাই হবে খাঁটি তাওবা। সেগুলোর কোন একটি না পাওয়া গেলে, তাওবা কবুল হবে না। তাই শর্তসমূহ পূর্ণরূপে আদায় করে তাওবা করা অপরিহার্য।

তাওবা-ইস্তিগফার দ্বারা যেমন গুনাহ মাফ হয়, তেমনি তাওবা-ইস্তিগফার দ্বারা আল্লাহর দরবারে মর্তবা বুলন্দ হয়। তাই কোন গুনাহ না হলেও আল্লাহ পাকের শান অনুযায়ী ইবাদতের হক পরিপূর্ণরূপে আদায়ে অক্ষমতার কথা ভেবেও সকলের সদা-সর্বদা তাওবা-ইস্তিগফার করা কর্তব্য। আল্লাহ পাক বান্দার তাওবা-ইস্তিগফারে বড়ই খুশী হন। এ জন্যই তো হযরত রাসূলে কারীম (সা) বে-গুনাহ মা’সূম হওয়া সত্ত্বেও দৈনিক সত্তর বারেরও বেশি তাওবা ইস্তিগফার করতেন বলে হাদীসে রয়েছে।
তাওবার মাধ্যমে বান্দা নিজেকে আল্লাহ পাকের নিকট নতরূপ প্রকাশ করে। তাওবার দ্বারা মানুষ নিজেদের ক্ষুদ্রত্ব এবং আল্লাহ পাকের বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করে থাকে। আর যে নিজেকে ছোট মনে করে তাওয়াজু করে, আল্লাহ তার সম্মান বৃদ্ধি করে দেন। সুতরাং তাওবা মু’মিনের মর্যদার প্রতীক, মু’মিনের সাফল্যের সম্পদ।

Related Post