গরীব ‍মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতি

গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতি

গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতি

اَلْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ جَعَلَ الْقُلُوْبَ مَوَاطِنَ لِلْحُبِّ وَالْإِخَاءَ *وَالْكُرْهِ وَالْجَفَاءِ * أَحْمَدُهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى وَأَشْكُرُهُ*  وَهُوَ أَهْلٌ لِلشُّكْرِ وَالتَّقْدِيْسِ وَالثَّنَاءِ * وَأَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ * حَثَّنَا عَلَى العَطَاءِ والسَّخَاءِ * والمَحَبَّةِ والتَّعَاونِ والإِخَاءِ * ووَعَدَنا عَلَى ذَلِكَ الخَيْرَ والسَّعادةَ والرَّخَاءَ * وَأَشْهَدُ أَنَّ سَيِّدَنَا وَنَبِيَّنَا مُحَمَّدًا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ ومُصْطَفاهُ  * خَيْرُ مَنْ تَرَحَّمَ عَلَى الْفُقَرَاءِ وَ الْمَسَاكِيْنَ فَيَرْحَمَهُ * ووَهَبَهُ مِنْ مَخْزَنِهِ حَتَّى  أَكْمَلَ كَنْزَهُ وأَوْفَاهُ *  صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ  وعَلَى آلِهِ وصَحبِهِ أَجمَعينَ * والتَّابِعينَ لَهُم بِإِحسَانٍ إِلى يَومِ الدِّينِ*

أَمَّا بَعْدُ: فَيَا عِبَادَ اللهِ ! اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلا تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ *  وَقَالَ تَعَالَى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُولُوا قَوْلاً سَدِيداً * يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ * وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزاً عَظِيمًا*

ثم أما بعد: يَقُولُ اللهُ تَعَالَى فِيْ مُحْكَمِ: كِتَابِه فَأَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ  بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ – (لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ *

কুয়েতিয়া ফিকাহ বিশ্বকোষ الموسوعة الفقهية الكويتية ফকীর শব্দের অর্থ করা হয়েছে; যা ধনীর বিপরীত। অর্থাৎ যার নিকট সম্পদ অনেক কম।

আর পরিভাষায়: ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমদ (রহ.)-এর মতে যার নিকট কোন প্রকারের সম্পদ নেই সেই গরীব বা ফকীর। অথবা সামান্য আছে, যা তার জন্য যথেষ্ট নয়।

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতে যে ব্যক্তি যাকাতের নেসাবের চেয়ে কম সম্পদের মালিক। অথবা নেসাব পরিমাণ কিন্তু তার সংসারের খরচের জন্য যথেষ্ট নয়।

ইমাম মালেক (রহ.) এর মতে: যে ব্যক্তি এতটুকু সম্পদের মালিক যা তার এক বৎসেরর খরচের জন্য যথেষ্ট হয় না।

আর মিসকীন:

ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালেকের মতে মিসকীন বলা হয়, যার নিকট কোন সম্পদ নাই। আবু ইমাম শাফেঈর মতে মিসকীন হলো, যে এতটুকু সম্পদের মালিক যা তার জন্য যথেষ্ট হয় না।

আরেক সম্প্রদায় বলেছেন: যে ফকীর ও মিসকীন একই।

আর ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন: যার নিকট সাংসারিক খচরের জন্য মাল রয়েছে, কিন্তু যথেষ্ট নয়।এক কথায় এরা উভয়ই যাকাতের নেসাবের অন্তর্ভুক্ত।

 সম্মানিত মুসাল্লিয়ানে কেরাম! সহানুভূতি ও দান খয়রাত করা উত্তম চরিত্রে বহিঃপ্রকাশ: স্বাভাবিকভাবে এটি উত্তম গুণ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আম্বিয়াকেরামদেরকে এই বিষয়ে অসিয়ত করেছেন। এবং আমাদেরকেও পবিত্র কুরআন উদ্ভুদ্ধ করেছেন। এবং এটি ঈমানদার হওয়ার একটি প্রমাণও। দান ও সহানুভূমি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:

 قال اللهُ تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لا بَيْعٌ فِيهِ وَلا خُلَّةٌ وَلا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ

হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম। (সূরা বাকারা: ২৫৪)

দান  ও সহানুভূতি গরীবকে ধনী লোকের বন্ধু বানিয়ে দেয়। এবং দানবীরকে মহান আল্লাহ ভালোবাসেন: রাসূলে কারীম (সা.) বলেন:

إنَّ اللهَ تعالى جَوَّادٌ يُحِبُّ الْجُوْدَ، ويُحِبُّ مَعَالِيْ الْأَخْلَاقِ وَيَكْرَهُ سِفْسَافَهَا

নিশ্চয় আল্লাহ দাতা, তিনি দাতাকে ভালোবাসেন। এবং উন্নত চরিত্রকে ভালোবাসেন। এবং মন্দ চরিত্রকে ঘৃণা করেন।

কতটুকু আপনার সম্পদ?

قِيْلَ: مَا جَمَعْتَ مِنَ الْمَالِ فَوْقَ قُوتِكَ فَإنَّمَا أَنْتَ فِيْهِ خَازِنٌ لِغَيْرِكَ،

তোমার কাছে সংসারের অতিরিক্ত সম্পদ রয়েছে, সেগুলো অন্যের তুমি পাহারাদার মাত্র।

 وَيُرْوَى أنَّ عَبْدَ اللهِ بْنِ أَبِيْ بَكْرٍ -رَضِيَ اللهُ عَنْه- كَانَ يُنْفِقُ عَلَى أَرْبَعِيْنَ دَاراً مِنْ جِيْرَانِهِ عَنْ يَمِيْنِهِ، وَأَرْبَعِيْنَ عَنْ يَسَارِهِ، وَأَرْبَعِيْنَ أَمَامَهُ، وَأَرْبَعِيْنَ خَلْفَهُ، وَيَبْعَثُ إِلَيْهِمْ بِالْأَضَاحِيْ وَالْكِسْوَةِ فِيْ الْأَعْيَادِ

আব্দুল্লাহ বিন আবু বকর (রা.) বলেন: আবু বকর (রা.) তাঁর ডান দিকে চল্লিশ ঘর বাম দিকে চল্লিশ ঘর, সামনের চল্লিশ ঘর, পেছনের চল্লিশ ঘর পর্যন্ত প্রতিবেশি মনে করে তাদের পেছনে দান করতেন এবং ঈদের দিনে তাদের ঘরে কুরবানীর গোশত ও কাপড় পাঠাতেন।

গরীব ও অভাবীদের অধিকার : হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِي اللَّه عَنْه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهم عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَيْسَ الْمِسْكِينُ الَّذِي يَطُوفُ عَلَى النَّاسِ تَرُدُّهُ اللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ وَالتَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ وَلَكِنِ الْمِسْكِينُ الَّذِي لَا يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ وَلَا يُفْطَنُ بِهِ فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ وَلَا يَقُومُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ صحيح البخاري

সে ব্যক্তি প্রকৃত অভাবী নয়, যে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে এবং এক মুষ্টি খাবার কিংবা দুমুষ্টি বা একটি বা দুটো খেজুর নিয়ে ফিরে। প্রকৃত অভাবী হল সে ব্যক্তি, যার প্রয়োজন নির্বাহের মত সামর্থ নাই। অথচ সে তার অভাবের কথা মানুষকে ব্যক্ত করে না যে, তাকে কেউ দান করবে এবং ভিক্ষা করতেও বের হয় না। (বুখারি)

সম্মানিত মুসাল্লিয়ানে কেরাম! সুতরাং আমাদেরকে সমাজের সেসব সম্মানীত লোকদের খুঁজে বের করতে বলে যারা তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ থেকে বঞ্চিত; কিন্তু তারা তাদের অভাবের কথা কারও কাছে ব্যক্ত করে না। তাদের সম্ভ্রম ও লজ্জার কারণে।

গরীবদের সাহায্য করলে হৃদয় নরম হয়

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ  رَضِي اللَّه عَنْه أَنَّ رَجُلًا شَكَا إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَسْوَةَ قَلْبِهِ، فَقَالَ لَهُ:  إِنْ أَرَدْتَ أَنْ يَلِينَ قَلْبُكَ، فَأَطْعِمِ الْمِسْكِينَ، وَامْسَحْ رَأْسَ الْيَتِيمِ  (رواه أحمد)

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার অন্তরের কঠোরতার অভিযোগ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, ইয়াতিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হও এবং গরীবদের আহার করাও।’ (আহমাদ)

দান বা সহানুভূতি জাহান্নামের পর্দা হবে:

হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ  رَضِي اللَّه عَنْه ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : يَا عَائِشَةُ تَصَدَّقِي وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ ، فَإِنَّهَا تَحْجُبُ قَدْرَهَا مِنَ النَّارِ ”

হে আয়েশা! অভাবীদের কিছু না দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ো না,যদিও তা কেবল খেজুরের একটি টুকরা হয়। হে আয়েশা! গরীবদের ভালবাস এবং তাদেরকে তোমার কাছে সাহায্যের জন্য আসতে দাও। তখন আল্লাহ তাআলা অবশ্যই কিয়ামতের দিন তাঁর কাছে স্থান দিবেন। (ইবনে মাজাহ, তিরমিযি)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ , عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ , قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لِكُلِّ شَيْءٍ مِفْتَاحٌ وَمِفْتَاحُ الْجَنَّةِ حُبُّ الْمَسَاكِينِ ، وَالْفُقَرَاءُ الصَّبْرُ هُمْ جُلَسَاءُ اللَّهِ تَعَالَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ .

রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক কিছুরই একটি চাবি রয়েছে এবং জান্নাতের (একটি) চাবি হল গরীবদের ভালবাসা, আর এই ফকীরি ও গরীবি অবস্থায় ধৈর্যধারণ করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে বসার সুযোগ হবে । (দারে কুতনী)

 উত্তম দান হলো গরীবকে খাবারের ব্যবস্থা করা: 

হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

 عَنْ أَنَسٍ بْنِ مَالِكٍ  رَضِي اللَّه عَنْه ، يقول : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَفْضَلُ الصَّدَقَةِ أَنْ تُشْبِعَ كَبِدًا جَائِعًا

সর্বোত্তম দান হল একটি ক্ষুধার্ত উদরকে পরিতৃপ্ত করা। (বায়হাকি)

গরীবদের খাবারের ব্যবস্থা করা জান্নাতে প্রবেশের কারণ হবে:

عن عبد الله بن سلام  رَضِي اللَّه عَنْه أن النبي  صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ  قال : أَفْشُوا السَّلَامَ ،  وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ،  وَصِلُوا الأَرْحَامَ ، وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ ، تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلامٍ. (رواه الترمذي)

আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, গরীব দুঃখীদের খাবারের ব্যবস্থা করো। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়। (এগুলো করে) তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (তিরমিযী)

কোন ঋণগ্রস্থকে অবকাশ দিলে সদকার সাওয়াব পাওয়া যায়:

عَنْ بُرَيْدَةَ رضي الله عنه قَالَ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلِهِ صَدَقَةٌ  قَالَ ثُمَّ سَمِعْتُهُ يَقُولُ : مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلَيْهِ صَدَقَةٌ  قُلْتُ : سَمِعْتُكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ تَقُولُ مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلِهِ صَدَقَةٌ ، ثُمَّ سَمِعْتُكَ تَقُولُ مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلَيْهِ صَدَقَةٌ ؟ قَالَ : لَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ صَدَقَةٌ قَبْلَ أَنْ يَحِلَّ الدَّيْنُ ، فَإِذَا حَلَّ الدَّيْنُ فَأَنْظَرَهُ فَلَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ مِثْلَيْهِ صَدَقَةٌ روى الإمام أحمد (22537) 

 

হযরত বুরায়দা সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন আমি রাসূলে কারীম (সা.) বলতে শুনেছি: যে ব্যক্তি কোন অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে। তার বিনিময়ে প্রতি দিন সকদার সাওয়াব পাবে। বুরায়দা বলেন আমি রাসূল হতে আরো শুনলাম যে, যে ব্যক্তি কোন অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে। সে প্রতি দিন দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে।অতঃপর হযরতবুরায়দা বলেন,হে আল্লাহর রাসূল!আপনি কি এমন কথা বলেছেন,যে ব্যক্তি কোন অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে।তাকে প্রতি দিন দ্বিগুণ সাওয়াব দেওয়া হবে? রাসূল (সা.)বললেন;ঋণ পরিশোধের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন সাদকার সাওয়াব পাবে,আর মাফ করে দেওয়া হয়,তাহলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে।

মিসকীনদের আল্লাহর রাসূলও ভালোবাসতেন: 

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ رضي الله عنه فَقَالَ فِيْ بِدَايَةِ الْحَدِيْثِ أَحِبُّوْا الْمَسَاكِيْنَ فَإِنِّيْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ: اللَّهُمَّ أَحْيِنِي مِسْكِينًا، وَأَمِتْنِي مِسْكِينًا، وَاحْشُرْنِي فِي زُمْرَةِ الْمَسَاكِينِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ – رواه عبد بن حميد في مسنده وابن ماجه في سننه، بإسناد صحيح

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَحِبُّوا الْمَسَاكِيْنَ ‘তোমরা মিসকীনদের ভালবাস’। কেননা আমি রাসূল (ছাঃ)-কে তাঁর দো‘আয় বলতে শুনেছি,اللَّهُمَّ أَحْيِنِى مِسْكِينًا وَأَمِتْنِى مِسْكِينًا وَاحْشُرْنِى فِى زُمْرَةِ الْمَسَاكِينِ হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীন রূপে জীবিত রাখ, মিসকীন রূপে মৃত্যুদান কর এবং মিসকীনদের দলভুক্ত করে হাশরের ময়দানে উত্থিত কর। ইবনু মাজাহ হা/৪১২৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩০৮

গরীব ও দুর্বলদের মর্যাদা

১. গরীব ও দুর্বলদের কারণে রিযিক প্রদান করা হয় :

আল্লাহভীরু গরীব ও দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা সমাজিকভাবে হেয় হলেও মহান আল্লাহর নিকটে মর্যাদাশীল এ শ্রেণীর কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের রিযিক দিয়ে থাকেন। সা‘দ (রাঃ) নিজেকে নিম্নশ্রেণীর লোকদের চাইতে অধিক মর্যাদাশীল মনে করলে রাসূল (ছাঃ) বললেন,هَلْ تُنْصَرُوْنَ وَتُرْزَقُوْنَ إِلاَّ بِضُعَفَائِكُمْ ‘তোমাদের দুর্বল লোকদের দো‘আয় তোমাদেরকে সাহায্য করা হয় ও রিযিক দেওয়া হয়’। বুখারী, মিশকাত হা/৫২৩২।

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেছেন,ابْغُوْنِىْ ضُعَفَاءَكُمْ فَإِنَّمَا تُرْزَقُوْنَ وَتُنْصَرُوْنَ بِضُعَفَائِكُمْ ‘তোমরা দুর্বলদের মাঝে আমাকে অন্বেষণ কর। কেননা দুর্বলদের দো‘আর কারণেই তোমাদেরকে রিযিক প্রদান করা হয় এবং সাহায্য করা হয়’। আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫২৪৬, সনদ ছহীহ।

২. জান্নাতের অধিবাসীদের অধিকাংশ সম্পদহীন গরীব :

সাধারণত সম্পদশালীদের কমসংখ্যকই আল্লাহভীরু হয়ে থাকে। বরং এদের অধিকাংশই হয় উদ্ধত অহংকারী। ধরাকে করে সরা জ্ঞান। আখেরাতে পুনরুত্থান,হিসাব-নিকাশ, পুলছিরাত ও জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে তাদের কোন ভাবনা-চিন্তা নেই। দুনিয়া নিয়েই এরা মহাব্যস্ত। অথচ এই সাধারণ জ্ঞানটুকু তাদের ঠিকই আছে যে,দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়। যেকোন সময় এখানে বিদায়ের ঘণ্টা বেজে যাবে। তারপরও আখেরাতের প্রস্তুতি নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।ফলে চূড়ান্ত বিচারে তারা হবে চরমভাবে ব্যর্থ। জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়বে যুগ যুগ ধরে।

অপরদিকে আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্যশীল ব্যক্তি দুনিয়াতে গরীব ও দুর্বল হলেও আখেরাতের চূড়ান্ত পরীক্ষায় সে হবে সফলকাম। প্রবেশ করবে চির শান্তির আবাস জান্নাতে। ভোগ করবে অসংখ্য নাজ ও নে‘মত। উল্লেখ্য যে,সমাজের এই গরীব-মিসকীন ও দুর্বল শ্রেণীই অধিকহারে আল্লাহর বিধানের প্রতি আনুগত্যশীল হয়। ফলে জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসীও হবে তারাই। ডান হাতে আমলনামা পেয়ে আনন্দচিত্তে সেদিন বলে উঠবে,

فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَيَقُولُ هَاؤُمُ اقْرَءُوا كِتَابِيَهْ ﴿١٩﴾ إِنِّي ظَنَنتُ أَنِّي مُلَاقٍ حِسَابِيَهْ ﴿٢٠﴾ فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَّاضِيَةٍ ﴿٢١﴾ فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ ﴿٢٢﴾ قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ ﴿٢٣﴾ كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ ﴿٢٤

‘পড়ে দেখ আমলনামা। নিশ্চয়ই আমি জানতাম যে, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। অতঃপর সে সুখী জীবন যাপন করবে। সুউচ্চ জান্নাতে। যার ফলসমূহ থাকবে অবনমিত। (বলা হবে) বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে তার প্রতিদানে তৃপ্তি সহকারে খাও এবং পান কর’ (হাক্কাহ ৬৯/১৯-২৪)।

পক্ষান্তরে দুনিয়ার দাম্ভিক অহংকারী যালেম শ্রেণী বাম হাতে আমলনামা পেয়ে বিমর্ষচিত্তে আফসোস করে বলবে,

وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيَهْ ﴿٢٥﴾ وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِيَهْ ﴿٢٦﴾ يَا لَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ ﴿٢٧﴾ مَا أَغْنَىٰ عَنِّي مَالِيَهْ ۜ ﴿٢٨﴾ هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيَهْ ﴿٢٩﴾ خُذُوهُ فَغُلُّوهُ ﴿٣٠﴾ ثُمَّ الْجَحِيمَ صَلُّوهُ ﴿٣١﴾ ثُمَّ فِي سِلْسِلَةٍ ذَرْعُهَا سَبْعُونَ ذِرَاعًا فَاسْلُكُوهُ ﴿٣٢﴾ إِنَّهُ كَانَ لَا يُؤْمِنُ بِاللَّـهِ الْعَظِيمِ ﴿٣٣﴾ وَلَا يَحُضُّ عَلَىٰ طَعَامِ الْمِسْكِينِ ﴿٣٤

 ‘হায়, আমার আমলনামা যদি আমাকে না দেওয়া হ’ত। আমি যদি আমার হিসাব না জানতাম। হায়, আমার মৃত্যুই যদি আমার জন্য চূড়ান্ত হ’ত। আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারে আসল না। আমার ক্ষমতাও আজ ধ্বংস হয়ে গেল। (ফেরেশতাদের বলা হবে) ধর একে, গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও। অতঃপর জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। অতঃপর তাকে বেড়িবদ্ধ কর সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে। কেননা নিশ্চয়ই সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না এবং মিসকীনকে খাদ্যদানে উৎসাহিত করত না’ (হাক্কাহ ৬৯/২৫-৩৪)।

রাসূল (ছাঃ) বলেন,

أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ، كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَاعِفٍ، لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ

‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতীদের সম্পর্কে অবহিত করব না? (তারা হল) প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি এবং এমন ব্যক্তি যাকে দুর্বল মনে করা হয়। সে যদি আল্লাহর নামে কসম করে তাহ’লে তা তিনি পূর্ণ করে দেন। (তিনি আরো বলেন) আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সম্পর্কে অবহিত করব না? (তারা হল) প্রত্যেক রূঢ় স্বভাব,কঠিন হৃদয় ও দাম্ভিক ব্যক্তি’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১০৬

 অন্যত্র তিনি বলেন,

قُمْتُ عَلَى بَابِ الْجَنَّةِ فَكَانَ عَامَّةَ مَنْ دَخَلَهَا الْمَسَاكِينُ، وَأَصْحَابُ الْجَدِّ مَحْبُوسُونَ، غَيْرَ أَنَّ أَصْحَابَ النَّارِ قَدْ أُمِرَ بِهِمْ إِلَى النَّارِ، وَقُمْتُ عَلَى بَابِ النَّارِ فَإِذَا عَامَّةُ مَنْ دَخَلَهَا النِّسَاءُ  

‘আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম। দেখলাম, যারা জান্নাতে প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশই গরীব-মিসকীন। আর ধনীদেরকে (হিসাবের জন্য) আটকে রাখা হয়েছে। এছাড়া জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর জাহান্নামের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, তাতে যারা প্রবেশ করছে তাদের বেশীরভাগই নারী’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৩

জান্নাত ও জাহান্নামের বিতর্ক

রাসূল (ছাঃ) বলেন,

احْتَجَّتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ فَقَالَتِ النَّارُ فِىَّ الْجَبَّارُونَ وَالْمُتَكَبِّرُونَ. وَقَالَتِ الْجَنَّةُ فِىَّ ضُعَفَاءُ النَّاسِ وَمَسَاكِينُهُمْ. قَالَ فَقَضَى بَيْنَهُمَا إِنَّكِ الْجَنَّةُ رَحْمَتِى أَرْحَمُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ وَإِنَّكِ النَّارُ عَذَابِى أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ وَلِكِلاَكُمَا عَلَىَّ مِلْؤُهَا

‘জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যে বিবাদ হ’ল। জাহান্নাম বলল, আমার মধ্যে উদ্ধত অহংকারী লোকেরা থাকবে। আর জান্নাত বলল, আমার মধ্যে দুর্বল ও দরিদ্র ব্যক্তিরা থাকবে। অতঃপর আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ফায়ছালা করলেন এইভাবে যে, তুমি জান্নাত আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। আর তুমি জাহান্নাম আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিব। তোমাদের উভয়কেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব’। আহমাদ হা/১১৭৫৪; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬১৫, সনদ ছহীহ

রাসূল (ছাঃ) বলেন,

اطَّلَعْتُ فِي الجَنَّةِ فَرَأَيْتُ أَكْثَرَ أَهْلِهَا الفُقَرَاءَ، وَاطَّلَعْتُ فِي النَّارِ فَرَأَيْتُ أَكْثَرَ أَهْلِهَا النِّسَاءَ

‘আমি জান্নাতে উঁকি মেরে দেখলাম যে,এর অধিকাংশ অধিবাসী হল গরীব-মিসকীন। আর জাহান্নামে দেখলাম যে,এর অধিকাংশই হল নারী’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৪

যারা দারিদ্র্যকে নিজের দুর্ভাগ্যের কারণ মনে করেন, আশা করি হাদীছগুলো তাদের লালিত বিশ্বাসে চির ধরাতে পারবে। দুনিয়াতে সম্পদের দীনতাই আপনাকে অগ্রগামী জান্নাতী হ’তে সহায়তা করবে ইনশাআল্লাহ।

৩. গরীবরা ধনীদের পাঁচশত বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে:

দুনিয়া বঞ্চিত এই গরীব অসহায়দের জন্য সুখের বিষয় হ’ল যে, ধনীদের আগেই এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে মূল্যহীন থাকলেও আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে সবার আগে জান্নাতে প্রবেশের মহা সম্মানে ভূষিত হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,فُقَرَاءُ الْمُهَاجِرِينَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ قَبْلَ أَغْنِيَائِهِمْ بِخَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ  ‘দরিদ্র মুহাজিরগণ তাদের ধনীদের চাইতে পাঁচ শত বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে’। তিরমিযী হা/২৩৫১, সনদ ছহীহ

তিনি আরো বলেন,

وَعَنْ أَبي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَدْخُلُ فُقَرَاءُ المُسْلِمِينَ الجَنَّةَ قَبْلَ أَغْنِيَائِهِمْ بنِصْفِ يَوْمٍ وَهُوَ خَمْسُ مِائَةِ عَامٍ  أخرجه أحمد والترمذي

  রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: গরীব লোক ধনীদের থেকে অর্ধ দিবস আগে জান্নাতে যাবে। অর্থাৎ দুনিয়ার পাঁচ শত বছর আগে জান্নাতে যাবে গরীবরা ধনীদের থেকে। এখানে ধনীদের উপর তাদের উঁচু মাকামের কথা বলা হয় নাই;শুধু আগে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এ কথা বলা হয়েছে। আর ধনী এবং ন্যায় পরায়ণ বাদশাহগণ তাদের নিজ নিজ অর্থ-সম্পদের হিসেব দিতে বেশ সময় লেগে যাবে। তবে তারা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন তাদের স্থান অনেক ঊর্ধ্বে হবে।

মুমিনদের করণীয়

১. গরীব বলে কাউকে অবজ্ঞা না করা :

গরীব ও অসহায় মুসলমানদের অবজ্ঞা-অবহেলা না করতে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন,

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلاَ تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

‘তুমি নিজেকে তাদেরই সংসর্গে রাখ যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং তুমি পর্থিব জীবনের শোভা কামনা করে তাদের দিক হ’তে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না’ (কাহফ ১৮/২৮)।

অন্যত্র তিনি বলেন,

وَلَا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِمْ مِنْ شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُونَ مِنَ الظَّالِمِينَ   

‘আর তাদেরকে বিতাড়িত করবে না, যারা সকাল-বিকাল স্বীয় পালনকর্তার ইবাদত করে তাঁর সন্তুষ্টি কামনায়। তাদের হিসাব বিন্দুমাত্রও তোমার দায়িত্বে নেই এবং তোমার হিসাবও বিন্দুমাত্র তাদের দায়িত্বে নেই যে, তুমি তাদেরকে বিতাড়িত করবে। অন্যথা তুমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/৫২)।

উক্ত আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হযরত খাববাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আক্বরা বিন হাবেস আত-তামীমী ও উয়ায়না বিন হিছন আল-ফাজারী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে তাঁকে ছুহায়ব, বিলাল, আম্মার, খাববাব (রাঃ) প্রমুখ দরিদ্র অসহায় মুমিনদের সাথে বসা দেখে হেয় জ্ঞান করল। অতঃপর তাঁর নিকটে এসে একাকী বলল, আমরা চাই যে, আপনি আপনার সাথে আমাদের বিশেষ বৈঠকের ব্যবস্থা করবেন, যাতে আরবরা আমাদের মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারে। কেননা আপনার নিকটে আরবের প্রতিনিধি দলসমূহ আসে। এই ক্রীতদাসদের সাথে আরবরা আমাদের উপবিষ্ট দেখলে আমরা লজ্জাবোধ করি। অতএব আমরা যখন আপনার নিকটে আসব তখন আপনি এদেরকে আপনার নিকট থেকে উঠিয়ে দিবেন। আর আমরা বিদায় নেওয়ার পর আপনি ইচ্ছা করলে তাদের সাথে বসতে পারেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আচ্ছা দেখা যাক। তারা বলল, আপনি আমাদের জন্য একটি চুক্তিপত্র লিখে দেন। রাবী বলেন, তিনি কাগজ আনালেন এবং আলী (রাঃ)-কে লেখার জন্য ডাকলেন। আমরা এক পাশে বসা ছিলাম। ইত্যবসরে জিবরীল (আঃ) উপরোক্ত আয়াত নিয়ে অবতরণ করলেন’। ইবনু মাজাহ হা/৪১২৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৯৭

 অতএব কোন অবস্থাতেই গরীব ও দুর্বল ভেবে কাউকে হেয় ও অবজ্ঞা করা যাবে না এবং তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করাও সমীচীন নয়।

২. নিম্ন স্তরের মানুষের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা :

মুমিনদের উচিত নিজ অবস্থানের চেয়ে উচ্চ স্তরের কোন ব্যক্তি বা তার সম্পদের দিকে আক্ষেপের দৃষ্টিতে না তাকিয়ে বরং নিম্নস্তরের মানুষের দিকে তাকিয়ে নিজের অবস্থার জন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,

 إِذَا نَظَرَ أَحَدُكُمْ إِلَى مَنْ فُضِّلَ عَلَيْهِ فِي الْمَالِ وَالْخَلْقِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْهُ   

‘যখন তোমাদের কেউ এমন ব্যক্তির দিকে দেখে যাকে ধন-সম্পদে, স্বাস্থ্য-সামর্থ্যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে, তখন সে যেন নিজের চাইতে নিম্ন মানের ব্যক্তির দিকে তাকায়’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৪২

 ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

اُنْظُرُوْا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوْا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تُزْدِرُوْا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ  

‘তোমরা নিজেদের অপেক্ষা নিম্ন অবস্থার লোকের দিকে তাকাও। এমন ব্যক্তির দিকে তাকাবে না, যে তোমাদের চাইতে উচ্চ পর্যায়ের। যদি এই নীতি অবলম্বন কর, তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে যে নে‘মত দান করেছেন, তাকে তুমি ক্ষুদ্র বা হীন মনে করবে না’।[33]

৩. অল্পে তুষ্ট থাকা :

মুমিন মাত্রেরই করণীয় হচ্ছে অল্পে তুষ্ট থাকা। আল্লাহ প্রদত্ত হালাল রূযী যত অল্পই হৌক না কেন তাতে সন্তোষ প্রকাশ করতঃ শুকরিয়া আদায় করলে দুনিয়ার ধন-সম্পদের মোহ তাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। অল্পে তুষ্ট থাকা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন

,قَدْ أَفْلَحَ مَنْ هُدِىَ إِلَى الإِسْلاَمِ وَرُزِقَ الْكَفَافَ وَقَنِعَ بِهِ

‘সফলকাম হয়েছে সেই ব্যক্তি, যাকে ইসলামের দিকে হেদায়াত দেয়া হয়েছে, প্রয়োজন মাফিক রিযিক দান করা হয়েছে এবং তাতেই সে পরিতুষ্ট থাকে’। বনু মাজাহ হা/৪১৩৮, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫০৬

উল্লেখ্য যে, নিম্ন অবস্থানের দিকে গভীর দৃষ্টিতে দেখলে নিজের অবস্থার জন্য সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর উপরের দিকে তাকালে নিজের দৈন্যদশার জন্য কেবল আফসোস বাড়বে এবং নিজেকে হতভাগ্য মনে হবে। পরিণামে মনের অজান্তেই আল্লাহর অকৃতজ্ঞ বান্দার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। যা মুমিনকে ব্যর্থতার অতলে ডুবিয়ে দিতে পারে।

শোকর আদায়কারী ধনী এবং সহনশীল গরীব এদের মধ্যে কে উত্তম? উত্তম হল যে বেশী পরহেজগার, উভয়ে যদি পরহেজগার হয় তবে কে বেশী মর্যাদাশীল। এখানে ধনী-গরীবের মর্যাদার কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে পরহেজগার ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট সম্মানিত। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন ঃ  إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ  অর্থ: তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত যে অধিক তাক্বওয়াবান। (সূরা আল হুজুরাতঃ১৩)

সুতরাং সবুর এবং শোকরের মূল ভিত্তিই হল তাকওয়া। এ জন্য ধনী-গরীব উভয়ের মধ্যে  পরহেজগারি থাকাটা জরুরী ।

ধনীরা অবশ্যই তার  অর্থ-সম্পদের  শুকরিয়া আদায় করবে আর গরীবরা অবশ্যই ধৈর্যের পরিচয় দিবে। কখনো এভাবে বলা ঠিক হবেনা যে ধনী গরীবের উপর মর্যাদাশীল অথবা গরীব ধনীর উপর মর্যাদাশীল ।

উপসংহার :

পরিশেষে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অর্থের লোভ আজ মানুষকে পশুত্বের স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। সম্পদশালীর ঔদ্ধত্য আর সীমাহীন অহংকারে পর্যুদস্ত হচ্ছে ক্ষমতাহীন গরীব ও অসহায় মানুষ। অর্থনৈতিক বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানবতা। অর্থ-বিত্তের মাঝে হাবুডুবু খাওয়া মানুষগুলো যেন একটি বারের জন্যও চিন্তা করার সময় পায় না আখেরাতের অন্তহীন জীবনের কথা। এলাহী বিধানের নির্দেশ মেনে বের করে না যাকাত ও ওশর। পাশে দাঁড়ায় না হতদরিদ্র ইয়াতীম ও অসহায় মানুষের। বরং সম্পদ বৃদ্ধির পিছনে এরা এতটাই ব্যস্ত যে, এদের জীবনের লক্ষ্যই যেন অর্থোপার্জন। রাসূল (ছাঃ) তাই আক্ষেপ করে বলেছেন,

تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ وَالدِّرْهَمِ وَالْقَطِيفَةِ وَالْخَمِيصَةِ إِنْ أُعْطِىَ رَضِىَ وَإِنْ لَمْ يُعْطَ لَمْ يَرْضَ

‘লাঞ্ছিত হোক দীনার ও দিরহামের গোলাম এবং চাদর ও শালের গোলাম। তাকে দেয়া হলে সন্তুষ্ট হয়, না দেয়া হ’লে অসন্তুষ্ট হয়’। বুখারী হা/১৮৮৬; মিশকাত হা/৫১৬১

  রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ، وَلَكِنَّ الْغِنَىْ غِنَى النَّفْسِ ‘ধনের আধিক্য হলেই ধনী হয় না, বরং অন্তরের ধনীই হ’ল প্রকৃত ধনী’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১৭০

পক্ষান্তরে গরীব-মিসকীন সমাজে উপেক্ষিত হলেও মহান আল্লাহর বিধান মেনে যত কষ্টেই সে দিনাতিপাত করুক না কেন বিচার দিবসে সে-ই হবে মহা সম্মানিত। সবার আগেই প্রবেশ করবে অনন্ত সুখের অনিন্দ্যসুন্দর বাগান জান্নাতে। অতএব আমাদের সকলের উচিত রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে যে যতটুকু সম্পদের অধিকারী হয়েছি তাতে তুষ্ট থেকে আখেরাতের অফুরন্ত জীবনের জন্য পাথেয় সঞ্চয় করা। হে আল্লাহ! ইবাদতকে আমাদের জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে দাও। আর সম্পদকে করো শুধু পার্থিব জীবনে চলার উপকরণ। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে বিচার দিবসে তোমার সফলকাম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর-আমীন!

Related Post