জীবনে সাফল্য আনে শিরকমুক্ত নেক আমল

imagesCASI1IOG

পাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ এবং জুলুমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে শিরক। এটা ব্যক্তি মনের উদ্ভট ধারণা-কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যার পেছনে কোনো ধরনের প্রামাণ্য আসমানি সনদ কিংবা বুদ্ধিভিত্তিক দলিল নেই। যারা এ অপরাধে অপরাধী, কস্মিনকালেও আল্লাহপাক তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শন করবেন না, ক্ষমাও করবেন না। কেননা, এটা আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বড় অপবাদ, বড় নাফরমানি। শিরকমুক্ত আকিদা-বিশ্বাসই পরকালে সত্কর্মের প্রতিদান পাওয়ার পূর্বশর্ত। আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয়ভাজন হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে   অনেকটা কড়া ভাষায় সম্বোধন করে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন।                    

তুমি যদি শিরক কর, তাহলে তোমার আমল নিষম্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’(সূরা যুমার : ৬৫)।
যুগে যুগে মানুষ শয়তানের কবলে পড়ে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, দেব-দেবী, গাছ, পাথর প্রভৃতির পূজা করতে শুরু করে দিত। তারা তাদের হৃদয়-মনের সব আবেগ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আকুতি-মিনতি দিয়ে এদের ডাকত। কবির ভাষায়—
‘পূর্বে তোমার বিশ্ব ছিল, দৃশ্য অতি চমত্কার,
কেউ পূজিত গরু-বানর, কেউ পূজিত গাছ-পাথর।
সাকার পূজায় বিশ্বরত, নিখিল বিশ্ব চরাচর,
কে পূজিত কে মানিত, আকার বিহীন একেশ্বর। ’
এ পথহারা পাপিষ্ঠ বনি আদমগুলোকে সরল-সঠিক দ্বীন তথা তাওহিদি জিন্দেগিতে নিয়ে আসার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছে অসংখ্য নবী-রাসুল। তারা প্রত্যেকেই শিরকের পথ পরিহার করে খাঁটি ঈমানের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতেন।
শিরক হলো আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থসমকক্ষ করা, মিলানো, সংমিশ্রণ করা, একত্রীকরণ, অংশীদার, ভাগাভাগি, সমান করা, সম্পৃক্ত করা আর ইংরেজিতে বলা হয় চড়ুঃযবরংস, ঝযধত্বত্, চধত্ঃহবত্, অংংড়পরধঃব ইত্যাদি। শিরক মানে বিশ্বপ্রভু আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার বা সমকক্ষ বানানো। এটা এমনসব বিশ্বাস, কাজ, কথা বা অভ্যাসকে বোঝায় যা দ্বারা মহান আল্লাহর রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত এবং সিফাতে অপর কারও অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়। আল্লাহর ‘রুবুবিয়াতে’ কাউকে শরিক বানানোর অর্থ লালন-পালন, সৃষ্টি, জীবন-জীবিকা, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদিতে অন্যকে অংশীদার করা। তাঁর ‘উলুহিয়াত’ বৈশিষ্ট্যে কাউকে সমকক্ষ করার অর্থ—সালাত, সাওম, কোরবানি, মান্নত প্রভৃতিতে অন্য কারও উপাস্য মেনে নেয়া। আর আল্লাহর ‘সিফাতে’ কাউকে শরিক বানানোর অর্থ হচ্ছে—কোনো ব্যক্তির গায়েব জানা, নিজকে অমুখাপেক্ষী ভাবা, অভাবমুক্ত মনে করা প্রভৃতি। ইমাম ইযযাহাবী তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘আল-কাবায়ের’ (কবীরা গোনাহ) নামক গ্রন্থে লিখেছেন—শিরক দুই প্রকার : (১) আকিদাগত শিরক অর্থাত্ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা এবং তার ইবাদত করা। (২) লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সত্ কাজ করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা ছোট শিরক থেকে দূরে থাক। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন : ছোট শিরক কী? তিনি বললেন : রিয়া অর্থাত্ লোক দেখিয়ে সত্ কাজ করা। যেদিন আল্লাহ বান্দাদের কর্মফল দেবেন সেদিন তাদের বলবেন, যাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তোমরা নেক কাজ করতে, তাদের কাছে চলে যাও। দেখ তারা তোমাদের কী প্রতিদান দেয়? (আহমাদ ও বায়হাকী)। ফজল ইবনে ইয়াজ বলেন : ‘লোকের ভয়ে খারাপ কাজ বর্জনকারী রিয়াকারী এবং মানুষকে খুশি করার জন্য ভালো কাজ করা শিরক। আর ইখলাস হচ্ছে এই উভয় রোগ থেকে মুক্ত থাকার নাম’।
দুনিয়ার সফলতা এবং পরকালের অনাবিল শান্তি পাওয়ার আশা প্রত্যেকটি বনিআদমের হৃদয়ের গহিনে লুকিয়ে আছে। কিন্তু ইবলিস কি এমনিতেই তাদের ছেড়ে দেবে? সে আদম-সন্তানকে বিপথে নেয়ার জন্য সব সময় সরল পথে ওঁত্ পেতে বসে থাকে। যখনই কোনো মানুষ সত্কর্ম করতে করতে নাজাতের দারপ্রান্তে উপনীত হয়, ঠিক তখনই ইবলিস খপ করে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যায় আপন ভুবনে, শয়তানি রাজ্যে। তাকে দিয়ে শিরক নামক মারাত্মক অপরাধটি পর্যন্ত করিয়ে ছাড়ে। শিরক এমন এক অপরাধ, যা মানুষের ইবাদতের প্রাসাদকে ভেঙে খান খান করে দেয়। ইহা মানুষকে নিক্ষেপ করে গোমরাহীর অতল গহিন অন্ধকারে।
বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত, আমাদের জানা-শোনার মধ্যে যেসব জগত রয়েছে এবং আমাদের জ্ঞানসীমার বাইরেও যে লক্ষ-কোটি জগত থাকতে পারে, এসবের নিরঙ্কুশ মালিক এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। তাঁর ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের মধ্যে অন্য কারও বিন্দুমাত্র অংশ নেই। আমরা সর্বদাই তাঁর করুণার পাত্র এবং অনুগ্রহের প্রত্যাশী। তিনি যখন, যেভাবে এবং যা চান তাই হয়ে থাকে। তিনি বলেন—‘তবু কি তারা কর্ণপাত করবে না? আর আল্লাহ যদি দিনকে কিয়ামত পর্যন্ত বর্ধিত করে দেন আর কে আছে তোমাদের বিশ্রামের জন্য রাতকে নিয়ে আসতে পারে?’ (আল-কাসাস : ৭১-৭২)
মানব প্রকৃতি বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় সার্থকতা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর সমীপে মাথা নত করা, অন্য কারও কাছে নয়। কিন্তু কেউ যখন আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কারও কাছে মাথা নুইয়ে দেয় কিংবা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের হকদার আছে, তখন সে মানবীয় সত্ত্বা থেকে বহুদূরে অবস্থান করে। ফলে তার অবস্থা হয়ে যায় একটি জীবন্ত লাশের ন্যায়। শয়তান তাকে অধঃপতনের গহিন সমুদ্রে ফেলে দেয়, সেখানে সে হাবুডুবু খেতে থাকে। তার উন্নত নেকআমল বরবাদ হয়ে যায়, ফলে তার সর্বশেষ ঠিকানা হয়ে যায় জাহান্নাম। আল্লাহতায়ালা বলেন :

﴾‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থির করে আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নামে।’ (আল-মায়িদা : ৭২)।
যারা শিরক করে আরবিতে তাদের মুশরিক বলা হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তাদের করুণ পরিণতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন।তন্মধ্যে কতিপয় চিত্র এমন :
* তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা তাদের অপকার করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। এটাই চরম বিভ্রান্তি যে, তারা এমন কিছুকে ডাকে, যার অপকার উপকারের আগে এসে পৌঁছে। কত নিকৃষ্ট এ বন্ধু কত নিকৃষ্ট এ সঙ্গী। (সূরা হজ্ব : ১২-১৩)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর প্রিয় উম্মতকে শিরকের ভয়াবহতা থেকে বাঁচানোর উদ্দেশে বহু মূল্যবান বাণী রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন—
* যে ব্যক্তি শিরকমুক্ত অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত্ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি শিরক করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত্ করবে সে জাহান্নামে যাবে। (বুখারি)
মানুষ নানাবিধ কারণে শিরকে লিপ্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ যে কত মহান, কত ক্ষমতাধর, তার কর্তৃত্বের পরিধি যে কত বিশাল বিস্তৃত ও প্রসারিত, তিনি যে কত নিকটতম; তার যথার্থ মূল্যায়নের অভাবে মানুষ শিরকে লিপ্ত হয়। আবার অনেকে তাদের বাপ-দাদার কৃষ্টি রেওয়াজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে ফেলে। কখনও কখনও অতি ভক্তি কিংবা অতি আবেগের বশীভূত হয়ে মানুষ মানুষের পায়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে, চুমু খায়, পায়ের ধুলা গায়ে মাখে যা সুস্পষ্ট শিরকের শামিল।
আমাদের দেশে প্রচলিত শিরকগুলোর মধ্যে পীরপূজা, মাজারপূজা, কবরপূজা, মাজারের পার্শ্ববর্তী গাছের শিকড়, ছাল-বাকল ইত্যাদিতে রোগ আরোগ্য হয় বলে বিশ্বাস, মাজার থেকে আনা সুতা, তাগা, দড়ি প্রভৃতি আরোগ্য দান করে, মাজার পুকুরের পানি, কুমির, কাছিম, গজার মাছ, কবুতর প্রভৃতিকে খাবার দিলে মনের আশা পূর্ণ হয়, মৃত ওলিরা জীবিতদের সাহায্য করতে পারেন, দুর্ঘটনা রোধের জন্য মাজারে টাকা দেয়া, নবী-ওলিরা গায়েব (অদৃশ্য) জানেন, নানাবিধ ফায়েজ-বরকত হাসিলের জন্য মাজারের গিলাপে চুমু খাওয়া, টিয়া পাখি কিংবা বানরের মাধ্যমে ভাগ্য গণনা করা, কোনো বুযুর্গ একই সময় অনেক স্থানে অবস্থান করতে পারা প্রভৃতি। এগুলো সবই অজ্ঞতা ও বাড়াবাড়িরই নামান্তর। মানুষ অজ্ঞতা ও ভুল বিশ্বাসের কারণে তার যবান, বিশ্বাস, অভ্যাস, আচার-আচরণ প্রভৃতি দ্বারা শিরক করে থাকে। সতর্ক থাকার পরেও কখনও কখনও মনের অজান্তে এ মারাত্মক পাপ কর্মটি সংঘটিত হয়ে যায়। আখেরি জামানার দুর্বল মুমিন হিসেবে আমাদের যত্সামান্য নেক আমলগুলো সংরক্ষণের জন্য শিরক ও তাওহিদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করা সময়ের অনিবার্য দাবি। শিরক নেক আমলকে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে দেয় এবং ব্যক্তিকে নিশ্চিত জাহান্নামের উপযোগী করে গড়ে তোলে। মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও কল্যাণকর জীবনযাপনের মহত্ শক্তি হলো ঈমান। ঈমান এক অচলায়তন পর্বতের ন্যায়, যা চির অবিচল, সদা সমুন্নত। ইহা একটি দিগন্ত উজ্জ্বলকারী সূর্যশক্তি, যা জীবনের সবগুলো দিক ও আনাচ-কানাচ আলোকমণ্ডিত ও উজ্জ্বল করে দেয়। শিরক এমন একটি অন্ধকার জগত, যেখান থেকে আল্লাহর আক্রোশ আর গজবের হাওয়াই নির্গত হয়ে থাকে। আল্লাহ আমাদের শিরকমুক্ত তাওহিদী জিন্দেগি আর উন্নত নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। (সমাপ্ত)

Related Post