দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার

122109_19_1396941312
ইসলামে স্ত্রীর অধিকারের প্রতীক এবং তার মর্যাদার প্রথম স্বীকৃতি হলো তার দেনমোহর। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময় স্বামীর ওপর যে সম্পদ স্ত্রীকে দেয়া ওয়াজিব বা আবশ্যক ,সে সম্পদকে মোহর বলা হয়। মোহরের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ পাক কুরআনে ইরশাদ করেন‘এদের ছাড়া তোমাদের জন্য সব নারী হালাল করা হয়েছে। শর্ত হলো, তোমরা তাদের স্বীয় অর্থের বিনিময়ে গ্রহণ করবে’ (সূরা নিসা২৪) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা স্ত্রীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে’ (সূরা নিসা৪)
এ আয়াতে বলা হয়েছে, স্ত্রীদের মোহর অবশ্যই পরিশোধ্য একটি ঋণবিশেষ। এটি পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যান্য ওয়াজিব ঋণ যেমন সন্তুষ্টচিত্তে পরিশোধ করা হয়, স্ত্রীর মোহরের ঋণও তেমনি হৃষ্টচিত্তে উদার মনে পরিশোধ করা কর্তব্য (মাআরেফুল কুরআন, ২/২৯৭) এ মোহর মূলত একটি সম্মানী, যা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেয়া হয়। এর উদ্দেশ্য কেবল স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন। এটি স্ত্রীর মূল্য নয় যে, এর কারণে স্ত্রী স্বামীর হাতে বিক্রি হয়ে যাবে। তার দাসীতে পরিণত হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এমন ধারণা পোষণের মোটেও সুযোগ নেই।
শরিয়তে স্বামীর দায়িত্বে স্ত্রীর মোহর আবশ্যক করার উদ্দেশ্য হলো, যখন কোনো ব্যক্তি স্ত্রীকে নিজ গৃহে নিয়ে আসবেন, তখন তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং তাকে যুতসই উপঢৌকন পেশ করবেন। অতএব, শরিয়তের দাবি হলো, মোহরের পরিমাণ এত অল্পও নির্ধারণ না করা যে, তাতে সম্মানের বিষয়টি একেবারেই প্রকাশ পাবে না। তেমনি এত অধিক পরিমাণও নির্ধারণ না করা যে, স্বামী তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে না। ফলে মোহর আদায় না করেই সে ইন্তেকাল করে কিংবা পরিশেষে স্ত্রীর নিকট মাফ চেয়ে নিতে বাধ্য হয় ।
মোহরের প্রকারভেদ : (ক) মোহরে মুসাম্মা বিয়ের সময় বর ও কনে প পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে যে সম্পদ নির্ধারণ করে, তাকে মোহরে মুসাম্মা বলা হয়। তবে শর্ত হচ্ছে, নির্ধারণকৃত সম্পদ ১০ দিরহামের কম না হয়।
(খ) মোহরে মিসিল যদি পারস্পরিক আলোচনায় মোহর নির্ধারণ না করে অথবা মোহরের উল্লেখ ছাড়াই বিয়ে সম্পন্ন হয়, তাহলে সে েেত্র সক্রিয়ভাবে মোহরে মিসিল ওয়াজিব হয়ে যায়। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী তখন স্বামীর দায়িত্বে মোহরে মিসিল আদায় করা আবশ্যক হয়ে যায়। মোহরে মিসিল দ্বারা মোহরের ওই পরিমাণ উদ্দেশ্য, যা সে মহিলার বংশীয় অন্য নারীদের বিয়েতে সাধারণত নির্ধারণ করা হয়েছে। আর যদি সে মহিলার বংশে তার মতো নারী না থাকে, তাহলে অন্য বংশে তার সমপর্যায়ের নারীদের সাধারণত যে মোহর নির্ধারণ করা হয়, তা সে মহিলার মোহরে মিসিল ।
(গ) মোহরে ফাতেমি মোহরে ফাতেমি বলা হয় ওই পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা, যা রাসূলুল্লাহ সা:-এর মেয়ে হজরত ফাতেমা রা:-এর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। হজরত ফাতেমা রা:-এর মোহর ৫০০ দিরহাম নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ১৩১ তোলা তিন মাশা রুপার সমান। অর্থাৎ ১৩১.২৫ তোলা রুপা বর্তমান পরিমাপ অনুযায়ী ১৫৩০.৯ গ্রাম (জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া, ৪/৩৫০)
মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ : শরিয়ত মোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করেনি। তবে স্বামী যে পরিমাণ নির্ধারণ করে আদায় করতে সম হন, এ ব্যাপারে শরিয়তের কোনো বাধা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে, মোহর কমই নির্ধারণ করা বা মোহরে ফাতেমি নির্ধারণ করা। এতে কেনো সন্দেহ নেই যে, যদি উভয় প পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মোহরে ফাতেমির পরিমাণ নির্ধারণ করে আর তাদের মাঝে এই নিয়ত বিদ্যমান থাকে যে, রাসূল সা: কর্তৃক নির্ধারণকৃত পরিমাণটি বরকতপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ। তা ছাড়া এতে ইত্তেবায়ে সুন্নতের সাওয়াবও আশা করা যায়। তাহলে এ আবেগ ও মনোবৃত্তি অবশ্যই বরকতপূর্ণ ও পছন্দনীয়। কিন্তু এমনটা মনে করা আদৌ ঠিক হবে না যে, এর চেয়ে কম বা বেশি মোহর শরিয়তের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় নয়। কেননা এর চেয়ে কম বা বেশি মোহর নির্ধারণ করাও শরীয়তের দৃষ্টিতে মোটেও দোষণীয় নয়। তবে এ মূলনীতির প্রতি অবশ্যই ল করা উচিত যে, মোহর এই পরিমাণ হতে হবে যার দ্বারা স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনও হয় এবং তা স্বামীর সামর্থ্যরে বাইরেও না হয়। বর্তমানে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ বিয়েতে অধিক মোহর নির্ধারণ করতে দেখা যায়। যার পেছনে সাধারণত লোক দেখানোর মনোভাব কাজ করে থাকে। এমন করা শরিয়তের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়। হজরত ওমর রা: মোহর নির্ধারণের েেত্র মানুষ দেখানো মনোভাব থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, সাবধান! তোমরা নারীদের মোহর বেশি করিও না। কেননা এটি যদি দুনিয়াতে সম্মানের এবং আখেরাতে আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় বিষয় হতো, তাহলে তোমাদের অপো এ ব্যাপারে মহানবী সা: অধিক উপযোগী ছিলেন (মিশকাত শরিফ, ১/২৭৭)। আবার অনেক সময় অত্যধিক মোহর নির্ধারণ করে আর অন্তরে এমন ধারণা রাখে যে, তা কখনো আদায় করবে না। এ ব্যাপারেও হাদিস শরিফে কঠোর বাণী বর্ণিত হয়েছে। তাই অন্তরে এরূপ ধারণা রাখা শরিয়তের দৃষ্টিতে কাম্য নয় (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া, ১৭/২৬৮)। তবে হ্যাঁ, যদি লোক দেখানো উদ্দেশ্য না হয়, পরিশোধের ইচ্ছা থাকে এবং সামর্থ্যও থাকে তাহলে অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করার েেত্র শরয়ি দৃষ্টিকোণে কোনো বাধা নেই। তবে শরিয়ত মোহরের সর্বনি¤œ পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা হানাফি মাজহাবের মতে ১০ দিরহাম। অর্থাৎ দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা রুপা (৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা) অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য নির্ধারণ করা। এর চেয়ে কম পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা স্ত্রী রাজি হলেও তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ১০ দিরহামের কম কোনো মোহর নেই (বায়হাকি শরীফ, ৭/২৪০)
মোদ্দাকথা, সবার কাছে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়া উচিত যে, মোহর নির্ধারণ করা কেবল প্রথাগত কাজ নয় যে, তা চিন্তাভাবনা ছাড়াই নির্ধারণ করা হবে এবং কার্যত তার বাস্তবায়ন হবে না বরং তা একটি শরয়ি কর্তব্য যা পূর্ণ আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। আর যেহেতু এটি একটি দ্বিপীয় মুয়ামালা, তাই এর সর্বদিক সুস্পষ্ট হওয়া চাই এবং সে অনুযায়ী তা আদায়ের চেষ্টা করাও জরুরি। এটি চরম অন্যায়, অবিচার যে, সারা জীবন এই হক আদায়ের ব্যাপারে উদাসীন থেকে মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীর নিকট মা চেয়ে নেয়া হয়। অথচ এ কথা সুস্পষ্ট যে, যদি কেউ স্বেচ্ছায় হৃষ্টচিত্তে তার প্রাপ্য মাফ না করে তাহলে তা মাফ হবে না। মৌখিকভাবে বলার পরও তার এ হক যথারীতি বহাল থাকবে। সমাপ্ত

Related Post