ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারীদের জন্য জান্নাতের দোয়া করা যাবে কি না?

ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারীদের জন্য জান্নাতের দোয়া করা যাবে কি না?

ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারীদের জন্য জান্নাতের দোয়া করা যাবে কি না?

ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের পরিচয়

আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় বিধানকে মানুষের ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে আল্লাহ ও রাসূলের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার নামই ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মকে পরিত্যাগ করাই এর লক্ষ্য। ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) মানব রচিত একটি জীবন দর্শন বা বিধান। এ জীবন দর্শনে বিশ্ব স্রষ্টার বিধান ও আদেশ-নিষেধ প্রত্যাখান করে মানব রচিত জীবনাচার পালন করাই এর উদ্দেশ্য। তবে ব্যক্তি জীবনে কেউ যদি আস্তিক বা আল্লাহতে বিশ্বাসী হয় তাহলে সে তার ব্যক্তি জীবনে ধর্মের কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র তৎসম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে স্রষ্টার আইন বা ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকবে না। এ ক্ষেত্রে সমাজ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আল্লাহ ও ধর্মের কর্তৃত্ব মুক্ত বা স্বাধীন রাখার নামই ধর্মনিরপেক্ষতা। অর্থাৎ ব্যক্তিজীবনে কেউ ধর্মের মূলনীতি মানলে মানতেও পারে কিংবা না মানলেও রাষ্ট্রের কিছু করার নেই। তাদের মতে আল্লাহ এ বিশ্বটা শুধু সৃষ্টি করেছেন, বড়জোর তিনি এ জগতের নিয়ম-কানুন রচয়িতা। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে উন্নতি, শান্তি ও প্রগতির জন্য আল্লাহ্ বা রাসূলের কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা গোটা সমাজ জীবনকেই আল্লাহ এবং ধর্মের অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখাকে আদর্শ বলে মনে করে। এমন আকিদা বিশ্বাস নিয়ে বিচরণকারী ব্যক্তি ইসলামে গণ্ডি হতে বহিস্কৃত। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলছেন: হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা: ২০৮) মহান আল্লাহ অন্যত্র বলছেন: তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। (সূরা শূরা: ১৩) সূরা আলে ইমরানের ৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতি গ্রস্ত।
দ্বীন বা জীবন বিধান হলো; মানব জাতির দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করার নিয়ম বা পদ্ধতি। তা হবে ইবাদতের ক্ষেত্রে, চারিত্রিক ক্ষেত্রে, মুয়ামালাত-মুয়াশারাত তথা সর্বক্ষেত্রে। যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর বান্দা মনে করে, আর আল্লাহকে তার প্রতিপালক মনে করে, তার জানা উচিত; যে আল্লাহই তাকে কোন কিছু করার এবং কিছু না করার আদেশ বা নিষেধ করে থাকেন। বান্দা আদেশগুলো পালন করবে, নিষেধগুলো প্রত্যাখ্যান করবে।
পক্ষান্তরে ইসলামের সঠিক সংজ্ঞা পরিস্কার দাওয়াত পাবার পরও যারা ধর্মরিপেক্ষতাকেই পালন করবে, তাদের সম্পর্কে কুরআনের উপরে বর্ণিত কয়েকটি আয়াতে আলোকে বলা যায় যে, ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত নেই। যদিও তারা মাঝে মধ্যে নামায রোযা, হজ্জ ইত্যাদি আদায় করে না কেনো। রাসূলে কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন; আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি। ১। জামায়াতে শামিল হওয়া, ২। নেতার কথা শুনা ও ৩। তার আনুগত্য করা, ৪। (প্রয়োজন বোধে) হিজরত করা এবং ৫। আল্লাহর পথে জিহাদ করা। আর যে ব্যক্তি জামায়াত হতে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে যাবে, সে পুনরায় জামায়াতভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যেন ইসলামের রজ্জু তার গ্রীবাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। আর যদি কোন ব্যক্তি জাহেলিয়াতের নিয়ম-নীতির দিকে লোককে আহ্বান করে, সে যতই নামায-রোযা করুক এবং নিজেকে মুসলমান মনে করুক সে জাহান্নামীদের দলভুক্ত হবে। (আহমদ, তিরমিযী)
উপরোল্লিখিত হাদীসের আলোকে বুঝা যায় যে, সর্বক্ষেত্রে ইসলাম পালন না করলে তথা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারী হয়ে নামায রোযা হজ্জ যাকাত ইত্যাদি আদায় করলেও তার ঠিকানা জাহান্নাম। কারণ রাসূল (সা.)-এর যুগে তাঁর পেছনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামায়াতে পড়েছে বহু মুনাফিক রয়েছে, কিন্তু আল্লাহ নামায রোযা কিছুই কবূল করেন নি। তাদের ঠিকানা জাহান্নাম।

এমন মতের লোকদের জন্য জান্নাতের দোয়া করা যাবে কি?

এই বিষয়ে সূরা তাওবার ৮০ ও ৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন: তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর আর না কর। যদি তুমি তাদের জন্য ৭০ বারও ক্ষমাপ্রার্থনা কর, তথাপি কখনোই তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তা এজন্য যে, তারা আল্লাহকে এবং তাঁর রসূলকে অস্বীকার (ইসলামের আইন-কুনূন মানেনি) করেছে। বস্তুতঃ আল্লাহ না-ফারমানদেরকে পথ দেখান না।
আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও নামায পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না। তারা তো আল্লাহর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে এবং রাসূলের প্রতিও। বস্তুতঃ তারা না ফরমান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে।
মুনাফিকদের নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই মারা গেলে রাসূল (সা.) তার জন্য দোয়া করেন, এবং জানাযার নামায পড়ান তার কবরে অবতরণ করে লাশ দাফন করেন। হযরত উমার (রা.) পেছন থেকে এগুলো করতে নিষেধ করেছেন, রাসূল (সা.) মুনাফিকদের মন জয় করার জন্য এমনটি করেছেন, যেন এমন উদারতা দেখে তারা ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু হযরত উমরের পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে জানিয়ে দিলেন যে, এই শ্রেণীর লোক মারা গেলে আপনি তাদের জন্য ক্ষমা চাইবেন না, জানাযার নামায পড়াবেন না, এবং কবরেও অবতরণ করে লাশ দাফন করবেন না। কুরআনের এই বিধান কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আয়াতের এই অংশ থেকে বুঝা গেলো যে, ইসলামী মতবাদ ছেড়ে অন্য কোন মতবাদরে অনুসারী হয়ে মারা গেলে তাদের জন্য জান্নাত লাভের দোয়া করা যাবে না।

ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের পরকালীন পরিণামঃ-

মহান আল্লাহ বলেন “হে আমার জাতি! এ দুনিয়ার জীবন তো মাত্র কয়েক দিনের উপভোগের বস্তু। আখেরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস।” (মু‘মিন-৩৯) মৃত্যু আমাদের পিছনে, কবর সামনে, কেয়ামত আমাদের প্রতিশ্রুত সময়সীমা, জাহান্নামের উপর দিয়ে রাস্তা (পুলসিরাত) এবং আল্লাহর সামনে আমাদেরকে দাড়াঁতে হবে জবাবদিহির জন্য। আখেরাতের প্রথম ঘাটি হচ্ছে কবর। সেখানে যে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন করা হবে তার অন্যতম হচ্ছে তোমার ধর্ম কি? আমরা যদি বলি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলাম সেটা কি গ্রহণ করা হবে? কিভাবে গ্রহণ করা হবে, তাতেতো রাসূল (সা.)-এর অনুমোদন নেই। গ্রহণ করা না হলে সাথে সাথেই শুরু হবে ভয়ংকর শাস্তি। মাটির চাপে হাড়গুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে থাকবে। নিরানব্বইটি বিষধর সাপ এসে পালাক্রমে দংশন করতে থাকবে। এমন বিষাক্ত সাপ যার নিঃশ্বাস দুনিয়ায় আসলে কোন সবুজ ঘাস হতো না। এমন হাতুড়ি দিয়ে অনবরত আঘাত করবে যা দিয়ে পাহাড়কে আঘাত করলে তা মাটিতে মিশে যাবে। কবরের পর আখেরাত। আখেরাত তো আরো ভয়াবহ জায়গা। সেখানে একদল হবে জান্নাতী আর একদল জাহান্নামী। আর জাহান্নামের আগুনের ৭০ ভাগের এক ভাগ শক্তি হচ্ছে দুনিয়ার আগুনের। (মুসলিম)। তাহলে সেই আগুনের ভয়াবহতা কত মারাত্মক! “অতএব যারা দুর্ভাগা হবে তারা তো দোযখে এইরূপ অবস্থায় থাকবে যে, তাতে তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ হতে থাকবে।” (সূরা হুদ-১০৬) “হে মু‘মিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।”তাহরীম-৬। অতএব সাবধান, সময় খুবই কম। তাই সাবধান হবার সময় এখনই। সাবধানতা মানুষকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দেয়। ধরা খেতে হয় বা হবে এমন নীতি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ পাক মুসলিম বিশ্বসহ সকল মানুষকেই তাঁর নিয়ম বিধান মেনে চলার তাওফিক দিন এবং জাহান্নাম থেকে হেফাজত করুন। আমীন ॥

Related Post