মাতৃভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব

মাতৃভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব

মাতৃভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব

মানুষের প্রতি আল্লাহর যেসব নিয়ামত ও দানের কথা সবসময় স্মরণীয়, ভাষা তার অন্যতম। বৈচিত্র্যময় ভাষা আর নিরূপম বাক প্রতিভার গুণে মানুষ অন্য সব প্রাণী থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। গণমাধ্যমের (সুশ্যাল মিডিয়া) চরমোৎকর্ষের এ যুগে নিত্যনতুন যোগাযোগ প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হচ্ছে। বাকপ্রতিভা থাকাতেই মানুষ সেসব কাজে লাগিয়ে লাভবান হতে পারছে। আল্লাহ মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন বলেই এত সব আবিষ্কার স্বার্থক হচ্ছে। বাকশক্তির বদৌলতে মানুষ গান গেয়ে আমোদিত হয়। কবিতা আবৃত্তি করে নিজে তৃপ্ত হয়। খুতবা বা বক্তৃতা দিয়ে শ্রোতাকে মুগ্ধ ও বিনোদিত করে। তাই ভাষার এ নেয়ামতের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,

﴿ ٱلرَّحْمَٰنُ ١ عَلَّمَ ٱلْقُرْءَانَ ٢ خَلَقَ ٱلْإِنسَٰنَ ٣ عَلَّمَهُ ٱلْبَيَانَ ٤ ﴾ [الرحمن: ١، ٤

‘পরম করুণাময়,তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন,তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ,তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা। {সূরা আর-রহমান : ১-৪}

মানুষকে আল্লাহ নানা বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক বানিয়েছেন:

নিপুণ শিল্পকুশলতায় আল্লাহ যেমন অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বসুন্ধরা সৃষ্টি করেছেন, তেমনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনি নানা বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক বানিয়ে। মানুষের গোত্র ও গাত্রবর্ণ, স্বরের রুক্ষ্মতা-কোমলতা, দৈহিক উচ্চতা-খর্বতা আর রুচি-অভিরুচির ভিন্নতার মতো তার ভাষায়ও দিয়েছেন নান্দনিক বিভিন্নতা। আল-কুরআনুল কারীমে তাই মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি আর রকমারি সৃষ্টির মতো ভাষার বিভিন্নতাকেও আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمِنْ ءَايَٰتِهِۦ خَلقُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلأَرْضِ وَٱخْتِلَٰفُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلوَٰنِكُمْۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتِ لِّلعَٰلِمِينَ الروم: ٢٢

“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।(সূরা আর-রূম: ২২)

সম্মানিত মুসাল্লিয়ানে কেরাম! পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা কত? পৃথিবীতে ঠিক কতগুলো ভাষা রয়েছে তা অনুমান করা খুব কঠিন। তবে ধারণা করা হয় এর সংখ্যা প্রায় ৩০০০ থেকে ৮০০০ হবে। ঈথনোলোগ (Ethnology) নামের ভাষা বিশ্বকোষের ২০০৯ সালে প্রকাশিত ১৬তম সংস্করণের হিসেব মতে জীবিত ভাষার সংখ্যা প্রায় ৬৯০৯। ইউকিপিডিয়ার তথ্যমতে, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ৭৩৩০টি ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এতগুলো ভাষার মধ্যে প্রত্যেক জাতির কাছেই নিজ মাতৃভাষা অতুলনীয়। মাতৃভাষার গুরুত্ব সব জাতির কাছেই আলাদা। মাতৃভাষার প্রতি আবেগই অন্যরকম। মাতৃভাষায় যেভাবে মানুষ মনের কথা তুলে ধরতে পারে অন্য ভাষায় তা পারে না। আমাদের হাসি-কান্না আর আনন্দ-বেদনা কিংবা বৈরিতা-মিত্রতা আর আশা-হতাশার সবই প্রকাশ করে মাতৃভাষা। শিশুর প্রতি মা জননীর স্নেহ, মায়ের প্রতি শিশুর অস্ফূট ভালোবাসা আর তরুণ-তরুণীর নন্দিত-নিন্দিত সব ভালোবাসারই দূতিয়ালি করে এই মাতৃভাষা। পৃথিবীর প্রত্যেক জাত-বর্ণের লোকই তাই মায়ের মতোই ভালোবাসে তার মাতৃভাষাকে।

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব:

মাতৃভাষার গুরুত্ব শুধু ভৌগলিক বা ঐতিহাসিক কারণ অবধি সীমিত নয়; ধর্মীয়ভাবেও মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যুগে যুগে মানুষকে সুপথ দেখাতে আসা সব মহামানবই গুরুত্ব দিয়েছেন মাতৃভাষার প্রতি; কেননা স্বজাতির হৃদয় স্পর্শ করতে এরচে উত্তম ভাষা আর হয় না। সেহেতু তাঁরা আল্লাহর দেয়া নবুওয়তের দায়িত্ব পালনে মাতৃভাষাকেই বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,

وَمَآ أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْۖ فَيُضِلُّ ٱللَّهُ مَن يَشَآءُ وَيَهْدِي مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ   (ابراهيم: ٤)

‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার কওমের ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়, সুতরাং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ {সূরা ইবরাহীম: ০৪}

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ পয়গম্বর তথা আল্লাহর দূত মুহাম্মদ রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাই মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করেন নি। আল্লাহর বিশেষ হিকমতের কারণে উম্মী তথা নিরক্ষর থাকা এই নবীও দেখা যায় দাওয়াত তথা স্বজাতির কাছে রবের বার্তা প্রচারে মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বের ইঙ্গিত করেছেন। অন্যসব ক্ষেত্রের মতো তিনি বরং মাতৃভাষায়ও শ্রেষ্ঠ আরব ছিলেন। এ কোনো কবি-সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিকের দাবি নয়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী লোকটিই ভাষা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি নিজে আরবদের মধ্যে সবচে শুদ্ধভাষী ব্যক্তি ছিলেন;কারণ,তিনি কুরাইশ বংশীয় সন্তান আর তিনি বেড়ে উঠেছিলেন ভাষার দিক থেকে প্রসিদ্ধ আরবের তৎকালীন সা‘দ ইবন বকর গোত্রে।

শুদ্ধভাবে কথা বলা ও লিখা: যত্নসহ ভাষা লালন তথা শুদ্ধভাবে জানা এবং চর্চা করা মাতৃভাষার গুরুত্বের অপরিহার্য দাবি। শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা বলতে ও লিখতে পারা যে কোনো দায়িত্বসচেতন নাগরিকের কর্তব্য। আর মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানকারী মুবাল্লিগ ও দ্বীন প্রচারক আলিমদের জন্য এর গুরুত্ব আর সবার চেয়ে বেশি। সব ভাষাই আল্লাহর নেয়ামত বা দান হিসেবে কোনোটাই অকারণ পূজনীয় বা বর্জনীয় নয়। কেবল পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ভাষা এবং ইসলামী জ্ঞানের সবচে বড় ও বিশ্বস্ত ভাণ্ডার হিসেবে আরবিই যা আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদার অধিকারী সকল মুসলিমের কাছে। কিন্তু আরবীর গুরুত্ব যদি হয় ইসলামী জ্ঞান আহরণের স্বনির্ভর ঠিকানা বলে তবে সেই জ্ঞান প্রচারের অপরিহার্য দায়িত্ব ও দাওয়াতে দ্বীনের জিম্মাদারির কারণে অনন্য গুরুত্বের দাবি রাখে মাতৃভাষা। আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক ফেরাউনের কাছে অমোঘ সত্যের বাণী পৌঁছানোর দায়িত্ব পেয়ে তাই মুসা আলাইহিস সালাম আপন ভাই হারুনকে চাইলেন সহযোগী হিসেবে। নিজের ভাষায় কিছুটা জড়তা আর ভাইয়ের ভাষা উন্নততর হওয়ায় তিনি এ আবেদন জানান। চলুন কুরআন খুলে দেখি :

وَأَخِي هَارُ‌ونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْ‌سِلْهُ مَعِيَ رِ‌دْءًا يُصَدِّقُنِي ۖ إِنِّي أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ ﴿٣٤

‘আর আমার ভাই হারূন,সে আমার চেয়ে স্পষ্টভাষী,তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন,সে আমাকে সমর্থন করবে।’ আমি অবশ্য আশংকা করছি যে তারা আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে। {সূরা আল-কাসাস : ৩৪}

কোন কিতাব কোন ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে?

আল্লাহর প্রেরিত প্রধান চার কিতাবও অবতীর্ণ হয়েছে প্রেরিত রাসূল ও জাতির মাতৃভাষায়।

হযরত মুসা আঃ এবং তার জাতি ইহুদিদের মাতৃভাষা হিব্রু ছিল বলে তার প্রতি অবতীর্ণ তাওরাতের ভাষা ছিল ইবরানি বা হিব্রু।

হযরত ঈসা আঃ ও তার জাতি খ্রিষ্টানদের মাতৃভাষা গ্রিক ছিল বলে তার প্রতি অবতীর্ণ ইনজিলের ভাষা ছিল সুরইয়ানি বা গ্রিক।

হযরত দাউদ আঃ-এর ওপর অবতীর্ণ জবুরের ভাষা ছিল ইউনানী।

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাঃ-এর মাতৃভাষা আরবি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর প্রতি যে কুরআন অবতীর্ণ হয় তার ভাষা আরবি।

কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল হওয়ার কারণ উল্লেখ করে আল্লাহ বলেনঃ

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ قُرْ‌آنًا عَرَ‌بِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ ﴿٢﴾

নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে আরবি ভাষায় নাজিল করেছি এ জন্য যে যাতে তোমরা তা বুঝতে পারো। (সূরা ইউসুফঃ ২ আয়াত)।

একজন রাসূল হিসেবে মুহাম্মাদ সাঃ-এর সর্বপ্রথম কর্তব্য ছিল তাঁর নিজস্ব পরিবার ও নিজস্ব জাতির কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। তাঁর জাতি আরবদের মাতৃভাষা আরবি ছিল বলে তাঁর জাতির কাছে তার দাওয়াত আরবিতেই হওয়া যুক্তিসঙ্গত। আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় তিনি দাওয়াত দিলে কিংবা কোনো অনারব ভাষায় কুরআন নাজিল হলে তারা কিছুই বুঝত না। তাদের হিদায়াত করা সম্ভব ছিল না। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

وَلَوْ جَعَلْنَاهُ قُرْ‌آنًا أَعْجَمِيًّا لَّقَالُوا لَوْلَا فُصِّلَتْ آيَاتُهُ ۖ أَأَعْجَمِيٌّ وَعَرَ‌بِيٌّ ۗ

আমি যদি আরবি ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায় কুরআন পাঠাতাম তাহলে তারা বলতঃ এর বাক্যগুলো ভালো করে বুঝিয়ে বলা হলো না কেন? সেকি! কিতাব আরবিতে নয় অথচ পয়গম্বর আরব। (সূরা হামিম আস্‌ সাজদাহ: ৪৪)

সব ভাষার মান আল্লাহর নিকট সমান:

আরবিতে কুরআন নাজিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আরবি ভাষা মহিমান্বিত হলেও কোনো ভাষাই ইসলামে উপেক্ষিত বা অবহেলিত নয়। মূলত সব ভাষা নিরপেক্ষ। কোনো ভাষার ভাষা হিসেবে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে ওই ভাষায় অমর-অবিস্মরণীয় কীর্তির বদৌলতে। আরবদের আরবি ভাষা একদা লাত-মানাত-উজ্জা প্রভৃতি প্রতিমার স্তুতিগান, শিরক-কুফর ও অশ্লীলতায় পূর্ণ ছিল। মহানবী সাঃ ও কুরআনের আবির্ভাবে তা ইসলামের প্রধান ভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। কাজেই ভাষার জন্য ইসলাম নয় বরং ইসলামের জন্যই ভাষা। ইসলাম কোনোভাবেই আরবি ভাষার কাছে ঋণী নয় বরং আরবি ভাষাই ইসলামের কাছে ঋণী। ঋণী ফার্সি, উর্দু, বাংলা প্রভৃতি ইসলামসমৃদ্ধ ভাষাও।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস: ভাষার জন্য জীবন দান করে আমরা সারা বিশ্বে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছি। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ এখন আর কেবল আমাদের শহীদ দিবস নয়; বিগত কয়েক বছর যাবৎ তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে এ ব্যতিক্রমী ভাষার লড়াইয়ে অভূতপূর্ব বিজয়কে স্মৃতিবহ করে রাখতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে ঘোষণা করে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ

উল্লেখ্য,বাংলা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিহার প্রদেশের পূর্ণায়া জেলার পূর্বাংশ, রাঁচি, হাজারিবাগ, সাঁওতাল, পরগনা, সিংহভূম ও মানভূমের ভাষাও বাংলা। আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলার ভাষা বাংলা। বার্মার আরাকানের চলিত ভাষা বাংলা। এ ভাষাভাষীর সংখ্যা হিসেবে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ স্থানে রয়েছে।

সম্মানিত মুসল্লিয়ানে কেরাম! শুদ্ধভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতে হবে:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাতৃভাষা ভাষা ছিল আরবী। তিনি সারা জীবনে নিজ মাতৃভাষায় একটি অশুদ্ধ বাক্যও উচ্চারণ করেন নি;বরং অন্যদের মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের পথ উন্মুক্ত করেছেন। আবার কখনও কখনও তিনি যুদ্ধবন্দীদেরকে ভবিষ্যত প্রজন্ম সন্তান-সন্তুতিদের জন্য নিছক ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে,ভাষা শিক্ষা প্রদানের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তও করে দিয়েছেন। [তাবাকাতে ইবন সা‘দ]

অথচ আমাদের দেশে এখন কোনো পরিবারে মাতৃভাষা না জানা কৃতিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেরা অশুদ্ধ ইংরেজি বলার বদ অভ্যাসের সঙ্গে নিজেদের সন্তানদেরও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দিয়ে মাতৃভাষা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আরও দুঃখের বিষয় হলো, এমন অনেক শিক্ষিত লোক আছেন, যারা মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা তো দূরের কথা, শুদ্ধ উচ্চারণে মাতৃভাষায় কথা বলতে পর্যন্ত পারেন না।

ভাষা একটি যাদু: দয়াময় আল্লাহ যার মুখে লালিত্যপূর্ণ ভাষা দিয়েছেন, মনের ভাব শব্দে প্রকাশে বাকশক্তি দিয়েছেন সে বড় ভাগ্যবান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই বলেছেন,

إِنَّ مِنَ البَيَانِ لَسِحْرًا

নিশ্চয় ভাষাশৈলিতে জাদু রয়েছে [বুখারী, ৫১৪৬] অর্থাৎ ভাষার যে জাদুকরি প্রভাব রয়েছে তা অনস্বীকার্য।

তাই মানুষকে আল্লাহর সব নেয়ামতের সঙ্গে ভাষার নেয়ামতেরও যথার্থ মূল্যায়ন করা উচিত। ভাষার নেয়ামতের কদর করা মানে অশুদ্ধ শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ না করা, মিথ্যা বাক্য ব্যবহার না করা, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা, মাতৃভাষায় সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজে নিষেধ করা এবং ভাষার অপপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা। মাতৃভাষায় সুন্দর ও শুদ্ধ উচ্চারণে মার্জিতভাবে কথা বলাকে যদি বলা হয় স্বর্ণ, আর সে কথাই যদি হয় সৎ কাজের আদেশ, অসৎকাজের বারণ এবং অপরের কল্যাণ কামনা, তবে তা হয় হীরের চেয়েও দামি।
রাসূল (সা.) শুদ্ধভাষায় কথা বলতেন এবং উপস্থিত সকলে শুনতে পেতেন:

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুকাল থেকেই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন। তিনি জীবনে একটি মিথ্যা বাক্যও উচ্চারণ করেন নি। বচনে, আচরণে, পোশাকে, আখলাকে পবিত্র,পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ থাকাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর ভাষা ছিল শুদ্ধ এবং উচ্চারণ ছিল সুস্পষ্ট। তিনি দ্রুত বাক্য বলতেন না। তাঁর প্রতিটি বাক্যই শুধু নয়, প্রতিটি অক্ষরও অন্যরা বুঝতে পারতেন। তাঁর ভাষণ পদ্ধতি এমন ছিল যে, যত বড় মাহফিল হতো, তাঁর স্বর তত উচ্চ হতো। যার ফলে বিদায় হজে আরাফার ময়দানে (মাইক ছাড়া) লাখ লাখ মানুষের তাঁর ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় নি।

স্থানীয় ভাষায় জুমুয়ার খুতবা প্রসঙ্গ: ইসলাম মাতৃভাষার অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করে বলে, জুমুয়ার নামাজের খুতবা মাতৃভাষায় হলে ইসলামের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আপত্তি নেইও মূলত। ইসলাম-বিশেষজ্ঞ বহু আলিম মনে করেন, জুমুয়ার খুতবা যদি আরবিতে দেয়া হয় এবং মুসল্লিরা যদি আরবি বুঝতে অক্ষম হন তবে মুসল্লিদের মাতৃভাষায় জুমুয়ার খুতবা দেয়া বিধিসম্মত। আর এ জন্যই বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে জুমুয়ার খুতবা আরবিসমেত বাংলাভাষায় প্রদান করা হয়। কারণ খুতবা বা বক্তৃতার উদ্দেশ্য হলো­ শ্রোতাদের উপদেশ দেয়া, শরীয়তের হুকুম-আহকাম বলা, তাদের সমস্যার সমাধান দেয়া। ফলে শ্রোতারা যদি বুঝতেই না পারে কী উপদেশ দেয়া হলো কিংবা সমস্যার কী সমাধান করা হলো তাহলে খুতবার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে বাধ্য।

সৌদি আরবের ইসলামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দারুল ইফতার কাছে স্থানীয় ভাষায় (মাতৃভাষায়) জুমুয়ার খুতবা দেয়া যাবে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে দারুল ইফতা জবাব দেয়ঃ
যে জুমুয়ার মুসল্লিরা আরবি ভাষা বুঝেন না তাদের আরবিতে খুতবা দেয়া হলে তাদের কোনোই লাভ হবে না। না বোঝার কারণে তখন অনেক মুসল্লি অন্যমনস্ক কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারেন, এ ক্ষেত্রে আরবির পাশাপাশি মুসল্লিদের মাতৃভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেয়া বাঞ্ছনীয়। ইমাম আবু হানিফা রহঃ এই কাজটি করতেন। তিনি তার প্রদত্ত জুমুয়ার আরবি খুতবা একই সাথে ফার্সিতে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন। কারণ মুসল্লিদের মাতৃভাষা ছিল ফার্সি। বাংলাদেশেও বেশ কিছু মসজিদে বাংলায় জুমুয়ার খুতবা দেয়া হয়, ইউরোপ ও আমেরিকার মসজিদগুলোতেও আরবি সমেত ইংরেজিতে খুতবা দেয়া হয়।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মাতৃভাষা মতো নেয়ামতের যথার্থ কদর করার তাওফীক দান করুন। ভাষার অপপ্রয়োগ ও অপভাষা থেকে বেঁচে বলার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

Related Post