মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম

Preaching Authentic Islam in Bangla
ঝড়ঝঞ্ঝা, সমস্যা-সংক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত পৃথিবীকে মানুষের বাস উপযোগী ও মৌলিক মানবিক অধিকারসহ বেঁচে থাকার গ্যারান্টি দিতে পারে একমাত্র আল্লাহর বিধান ও রাসূলের [সা:] জীবনাদর্শ। কারণ আল্লাহর বিধানে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। তাঁর বিশাল সৃষ্টি কারখানাটি যেমন ভারসাম্যপূর্ণ, তেমনি বৈষম্যহীন। সর্বশেষ ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহানায়ক। তিনি যে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ছিল ভারসাম্যপূর্ণ ও সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য কল্যাণকর। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানবতার মহান বন্ধু। মানবাধিকার বলতে যতগুলো বিষয়কে গণ্য করা হয়, ইসলামি জীবনব্যবস্থায় এর প্রতিটির ব্যাপারেই অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

মানবাধিকারের প্রধান বিষয়গুলো হলো, ‘জীবনধারণের অধিকার, সম্পদের অধিকার, মানমর্যাদা ও ইজ্জত আব্র“ রার অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা রার অধিকার, বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা, আর্থিক নিরাপত্তালাভের অধিকার, বসবাস, যাতায়াত ও স্থানান্তরের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, নারীর অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও শ্রমিকের অধিকার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত প্রতিটি বিষয়ে রাসূল সা: মর্মস্পর্শী ভাষায় শুধু গুরুত্বারোপই করেননি বরং ২৩টি বছরের সংগ্রাম করে মদিনা নামক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা দেখিয়ে গেছেন। তিনি মানুষের প্রতিটি অধিকারের ব্যাপারে শরয়ি সীমারেখা বা আইনগত বাধ্যবাধকতা এঁকে দিয়ে গেছেন। যাতে কেউ কারো সীমারেখা অতিক্রম না করে বা কেউ কারো সীমারেখায় অতিক্রম করে কারো অধিকারকে ক্ষুন্ন না করে। রাসূলের [সা:] বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ ও মদিনা সনদটি ছিল মানবাধিকারের উজ্জ্বল নক্ষত্র। নিচে মহানবীর সা: মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কিছু নমুনা পেশ করা হলো।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার অধিকার দিয়ে মহানবী সা: বলেছেন, ‘অমুসলিমদের জীবন আমাদের জীবনের এবং তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মতোই।’ তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি অধিকার রাসূল সা: নিশ্চিত করেছেন। মদিনা সনদ অমুসলিমদের মদিনায় বসবাসের অধিকার দিয়েছিল। এমনকি তাদের একটি অংশ বিশ্বাসঘাতকতা করা সত্ত্বেও বাকি অংশের প্রতি কোনোরূপ অন্যায় আচরণ করা হয়নি। তিনি একজন অমুসলিম শ্রমিককে একজন মুসলিম শ্রমিকের মতোই সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা: বলেছেন, ‘সতর্ক থাকো সেই ব্যক্তি সম্পর্কে যে ব্যক্তি অমুসলিমদের ওপর জুলুম করে অথবা তাদের হক নষ্ট করে অথবা তাদের সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি কাজের বোঝা চাপাতে চেষ্টা করে অথবা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের থেকে কিছু জোরপূর্বক নেয়, আমি কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব।’ (আবু দাউদ) এই আলোচনার প্রেক্ষিতে বর্তমান বিশ্বের দেশে দেশে সংখ্যালঘুদের দিকে একটু দৃষ্টি নিপে করুন। সংখ্যালঘুদের করুণ অবস্থার দিকে তাকালে মনে হয় যেন তারা সে দেশে জন্ম গ্রহণ করে আজন্মের পাপ করেছে।
মহানবীর সা: বৈচিত্র্যময় কার্যাবলির মধ্যে অন্য একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ঘৃণ্য দাসপ্রথার বিলুপ্তীকরণ। দাসদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি বিপ্লবাত্মক ভূমিকা রেখেছেন। তিনি দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘তিন ধরনের লোক আছে তাদের বিরুদ্ধে আমি শেষ বিচারের দিন অভিযোগ উত্থাপন করব। একজন সে ব্যক্তি যে মুক্ত মানুষকে দাসে পরিণত করে, আরেকজন সেই ব্যক্তি, যে তাকে বিক্রয় করে, অন্যজন সেই ব্যক্তি, যে দাস বিক্রির অর্থ খায়।’ দাসপ্রথার বিলোপসাধনে মহানবী সা: সাহাবিদের উৎসাহিত করেছেন। কিছু পাপের প্রায়শ্চিত্যের উপায় হিসেবে দাসমুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল স্বয়ং ৬৩ জন দাসকে মুক্তি দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: ৬৭ জন, হজরত ওমর রা: ১০০০ দাস ক্রয় করে মুক্ত করেন, এমনিভাবে বিত্তবান সাহাবি হজরত আবদুর রহমান রা: ৩০ হাজার দাস ক্রয় করে মুক্ত করেন। এভাবে ৩০-৪০ বছরের মধ্যে আরবের দাস সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। দাসদের মর্যাদা প্রদানের উদাহরণ রাসূলের [সা:] জীবন থেকেই আমাদের শিখতে হবে। তিনি আবিসিনিয়ার ক্রীতদাস হজরত বেলালকে মসজিদে নববীর মোয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, আপন ফুফাতো বোনকে ক্রীতদাস জায়েদের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে হুবহু সেই আকারে দাসপ্রথা না থাকলেও ভিন্ন আকারে দাসপ্রথা রয়েছে এবং তাদেরকে বিভিন্নভাবে দলন-পীড়ন করা হয়।
নবী করীমের [সা:] আরেকটি যুগান্তরকারী অবদান হলো, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তিনি উৎপাদিত পণ্যে শ্রমিকের অংশীদারিত্বের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কর্মচারীদের তাদের কাজের লভ্যাংশ দাও।’ (মুসনাদে আহমাদ) আমাদের সমাজব্যবস্থায় শ্রমিকের সামান্য পারিশ্রমিকটুকু সময়মতো পরিশোধ করা হয় না। সে ব্যাপারে মহানবী সা: বলেছেন, ‘শ্রমিকের মজুরি তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজাহ) তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমরা তাদের ওপর বাড়তি দায়িত্ব চাপালে সে হিসেবে তাদেরকে বাড়তি মজুরি দিয়ে দাও।’ শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা: যে মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা অনুসরণ করলে উৎপাদন খাতে কাক্সিত শান্তি ও কল্যাণ লাভ করা সম্ভব হতো। আমাদের শ্রম আইনে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হচ্ছে প্রভু-ভৃত্যের সমতুল্য। কিন্তু মহানবী প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক গুঁড়িয়ে দিয়ে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন, তাকে তাই খাওয়াতে হবেÑ যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরতে দিতে হবে যা সে নিজে পরিধান করে।’ (বুখারি-মুসলিম)
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা: থেকে অধিক কৃতিত্ব পৃথিবীর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দাবি করতে পারবে না। রাসূল সা: এর আগমনপূর্ব নারীর সম্মান ও মর্যাদা ছিল ধুলায় মিশ্রিত। মহানবী সা: তাঁদের মহা সম্মানের আসনে বসিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নারীরা মায়ের জাত। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত।’ যে কন্যাসন্তানকে মর্যাদাহানিকর মনে করা হতো এবং মেয়েদের জীবিত কবর দেয়া হতো। সে মেয়েদের লালনপালনকে আল্লাহর রাসূল জান্নাত পাওয়ার কারণ বানিয়ে দিলেন। সুতরাং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূলই সা: শুধু কৃতিত্বের একক হকদার। কবি বলেছেন, ‘নারী যেথা ছিল দাসী/তুমি তারে করে দিলে রানী/বসাইলে একাসনে/পুরুষের পাশাপাশি আনি।’
দুনিয়া জোড়া মানবতার ফেরিওয়ালা বা প্রগতির নামে যারা ফাঁকা বুলি ফেরি করে বেড়ায়, তারা কি নারীদের এ ধরনের মর্যাদা দিতে পেরেছে? কখনো না, বরং বর্তমান পাশ্চাত্য নারীকে পণ্যের মতো ভোগের সামগ্রী মনে করে। তারা নারী স্বাধীনতার নাম করে নারীর মর্যাদাকে সর্বাঙ্গে ভূলুণ্ঠিতই করেছে।
জীবনের অধিকার সম্পর্কে রাসূলে করীম সা: তাঁর বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, ‘তোমাদের জীবন ও সম্পত্তি তোমাদের পরস্পরের কাছে পবিত্র।’ সম্পদের অধিকার রার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ রা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ।’ (বুখারী) রাসূলে করীম সা: কোনো মানুষের মর্যাদাহানিকে ঘৃণ্যতম জুলুম বলে উল্লেখ করেছেন। এমনিভাবে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক সব বিষয়ে অধিকার সম্পর্কিত পারস্পরিক দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রে রাসূল সা: প্রদত্ত মূলনীতি শাশ্বত। এই মূলনীতি অনুসরণের মাধ্যমেই অধিকারবঞ্চিত ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত বর্তমানের এ অশান্ত পৃথিবীটি শান্তি ও কল্যাণের পথে প্রবেশ করতে পারে

Related Post