মিরাজ ও বিজ্ঞান

মিরাজ ও বিজ্ঞান

মিরাজ ও বিজ্ঞান

মিরাজ অর্থ: সিঁড়ি বা সোপান। মিরাজ শব্দটি আরবি ‘উরুজ’ শব্দ থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ উপরে আরোহণ করা। হযরত মুহাম্মাদ সাঃ-এর বোরাকযোগে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা ভ্রমণ এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বে এবং ‘রফরফ’ যোগে ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টির অনন্ত রহস্য ও অলৌকিক নিদর্শনাবলি অবলোকন, আল্লাহপাকের সান্নিধ্য অর্জন এবং উভয় বন্ধুর বাক্যালাপকে মূলত মিরাজ বলা হয়।
যে সালে মিরাজ হয়: একাদশ বা দ্বাদশ নববী সালের ২৭ রজব তারিখ রাতের এক শুভ মুহূর্তে মিরাজের ঘটনা ঘটে।
আল কুরআন জ্ঞানবিজ্ঞানের অনুপম বিশ্বকোষ। চাই তা পদার্থ বিজ্ঞান, রাসায়ন বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব বিজ্ঞান হোক আর মহাকাশ বিজ্ঞানই হোক।
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মহাকাশ অভিযান শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। এ অভিযানে প্রথম সফলতা আসে ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই। প্রায় ২ লাখ ৩৯ হাজার মাইল পথ ভ্রমণ শেষে (এপোলো-১১ নভোযানে) নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখেন। অথচ আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই রাসূল পাক সাঃ-এর মিরাজ বা মহাকাশ বিজয়ের কথা আল কুরআনে ঘোষিত হয়েছে।

নিল আর্মস্ট্রংদের চন্দ্র বিজয় সেদিনের কথা, তারও ১৪০০ বছর আগে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মিরাজ মহাকাশ বিজ্ঞানীদের জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বিজ্ঞান আজ যে জ্ঞানের কাছে মাথা নত করেছে অবশ্যই তা মানবীয় জ্ঞান নয় বরং ওহির জ্ঞান এবং মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান।
বোরাককে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণের কারণ: আল্লাহ ইচ্ছে করলে কোনোরূপ অবলম্বন ছাড়াই মুহূর্তের মধ্যে তাঁর প্রিয় বন্ধুকে সপ্ত আকাশ পরিভ্রমণ করাতে পারতেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছুই ছিল না। তবুও ‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’ যোগে তাঁকে ভ্রমণ করিয়েছেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’ কী জাতীয় বাহন? ‘বোরাক’ আরবি ‘বরকুন’ ধাতু হতে নির্গত, যার অর্থ বিদ্যুৎ (Electricity)। এটা নূরের তৈরি জান্নাতি বাহন। বিদ্যুতের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন। আলোর গতি অপেক্ষাও এর গতি অনেক বেশি। ‘রফরফ’-এর আভিধানিক অর্থ বিছানা, নরম তুলতুলে, সবুজ। সূর্যরশ্মির চেয়েও ক্ষিপ্র তার গতিবেগ, উল্লেখ্য আলোর গতি প্রতি সেকেণ্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল।
‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’ ব্যবহার করার কারণ; এর তিনটি কারণ হতে পারে।
প্রথমতঃ বাহনে করে অতি যত্নে নেয়ায় মর্যাদাবান রাসূল সাঃ-এর মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ জাগতিক অর্থে মিরাজকে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে।
তৃতীয়তঃ এ বিশিষ্ট বাহনের ব্যবস্থা দ্বারা আল্লাহপাক মানুষকে বুঝাতে চেয়েছেন নবীজি সাঃ-এর মিরাজ স্বজ্ঞানে-স্বশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছে।

ইসরা ও মিরাজের ব্যাখ্যা: কাবা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত অংশকে ইসরা বা রাতের সফর এবং এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণকে ‘মিরাজ’ বলেছেন।

ভারী দেহ নিয়ে মিরাজে কিভাবে গেলেন?
বিরুদ্ধবাদীরা বলেন, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি থাকায় শূন্য মণ্ডলের যেকোনো স্থূল বস্তুকে সে নিচের দিকে টেনে নামায়। কোনো স্থূলদেহী মানুষের দ্বারা মহাকাশ ভ্রমণ সম্ভব নয়, বিরুদ্ধবাদীদের সে নীতিকে আধুনিক বিজ্ঞানীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। শূন্যে অবস্থিত যেকোনো স্থূল বস্তুকে পৃথিবী যে সব সময় সমানভাবে আকর্ষণ করতে পারে না আজ তা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাদের মতে, প্রত্যেক গ্রহেরই নিজস্ব আকর্ষণ শক্তি রয়েছে। সূর্য ও পৃথিবী একে অন্যকে টেনে রাখছে। এ টানাটানির ফলে উভয়ের মাঝখানে এমন একটা স্থান আছে যেখানে কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই। যার ফলে পৃথিবীর কোনো বস্তু যদি সেই সীমানায় পৌঁছায় বা পার হয়ে সূর্যের সীমানায় যেতে পারে, তাহলে তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না।
গতিবিজ্ঞানের মতে, পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুকে প্রতি সেকেন্ডে ৬.৯০ অর্থাৎ সাত মাইল বেগে ঊর্ধ্বলোকে ছুড়ে দেয়া হলে তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। আবার পৃথিবী থেকে কোনো বস্তু যতই ওপরে উঠবে ততই তার ওজন কমবে। যার ফলে অগ্রগতি ক্রমেই সহজ হয়ে যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানীগণ বলেন, ‘পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুর দূরত্ব যতই বাড়ে, ততই তার ওজন কমে, পৃথিবীর এক পাউন্ড ওজনের কোনো বস্তু ১২ হাজার মাইল ঊর্ধ্বে মাত্র এক আউন্স হয়ে যায়। এ থেকে বলা যায়, পৃথিবী থেকে যে যত ঊর্ধ্বে গমন করবে, তার ততই অগ্রগতি হবে।’
(The Exploration of Space, P-15) বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন, ঘণ্টায় ২৫ হাজার মাইল বেগে ঊর্ধ্বলোকে ছুটতে পারলে পৃথিবী থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। একেই মুক্তিগতি (Escape velocity) বলে। গতি বিজ্ঞানের এসব নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ চাঁদে যেতে পেরেছে এবং মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। তাই মাধ্যাকর্ষণের যুক্তি দিয়ে মিরাজের সত্যকে কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না।

পদার্থের ব্যবধান:
বিরুদ্ধবাদীদের মতে, রাসূল সাঃ-এর দেহ জড়দেহ, তাই তা নভোলোকে পৌঁছতে পারে না। আল্লাহর সৃষ্টিজগতে দেখা যায়, বুনিয়াদ এক হলেও প্রতিটি বস্তুরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন কয়লা থেকে হীরক প্রস্তুত হয়। উভয়ই পদার্থ। কিন্তু তাই বলে এ দু’টি পদার্থ এক নয়। তা ছাড়া সব পদার্থের সবখানেই ধর্ম এক নয়। যেমন কাচ জড় পদার্থ, বাধা দেয়া তার ধর্ম। এ জন্য একটা কাঠ ভেদ করে তার মধ্য দিয়ে আলোক রশ্মি যেতে পারে না। কিন্তু কাচ জড় পদার্থ, তার বুকের ভেতর ভেদ করে আলোক রশ্মি চলে যায়, বাধা দিতে পারে না। এমন অনেক অস্বচ্ছ পদার্থ রয়েছে যার ভেতরে সাধারণ আলো প্রবেশ করতে পারে না কিন্তু রঞ্জন রশ্মি বা এক্সরে তা ভেদ করে চলে যায়।
বিজ্ঞানীদের মতে, আমরা যে পদার্থকে দেখি তা-ই যে তার একমাত্র সত্য রূপ, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবীজিকে কুদরতীভাবে এই বিশাল পথ অতিক্রম করান। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

অল্প সময়ে কিভাবে মিরাজ সম্ভব?
সন্দেহবাদীদের ধারণা এত অল্প সময়ের মধ্যে রাসূল সাঃ বাইতুল মুকাদ্দাস হয়ে সাত আসমানের ওপর সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে আল্লাহর সাথে কথাবার্তা বলে আবার মক্কায় ফিরে এলেন, তা কী করে সম্ভব!? মূলত আল্লাহর সময়ের সাথে পৃথিবীর সময়ের মিল হবে না।
বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের ঘড়ি অন্য গ্রহে অচল। এ বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞানীদের মত, স্বভাবের প্রকৃত সময় (True Time of Nature) সম্পর্কে আজো আমরা জানি না। বিজ্ঞানীরা জানান, আলোর গতির যত কাছে যাওয়া যায়, ততই সময় শ্লথ হয়ে আসে। আলোর গতি অপেক্ষা বেশি দ্রুত গতিতে গেলে সময় উল্টো দিকে বয়। মিরাজের বেলায়ও তা হয়েছিল। রাসূল সাঃ-এর বাহনের গতি আলোর গতি অপেক্ষা বেশি ছিল। তাই মিরাজ থেকে ফিরে এসে বিছানা উষ্ণ পাওয়ার বিষয়টিও সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা।

স্ট্যান্ডার্ড টাইম বলে কোনো টাইম নেই
বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভাষায় স্ট্যান্ডার্ড টাইম বলে কোনো টাইম নেই, সব টাইমই লোকাল অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহর কাছে স্থান, কাল, গতি ও সময়ের কোনো বন্ধন নেই। তিনি যখন যা ইচ্ছা করেন মুহূর্তের মধ্যেই তা ঘটিয়ে থাকেন। তাঁর রহস্য সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান অক্ষম।
সীনা চাক করার কারণ:
আধুনিক বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যে যাওয়ার আগে নভোচারীদের দেহ খুব সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপযুক্ততা যাচাই-বাছাই করে থাকেন। বোরাকে সওয়ার হওয়ার আগেও মহাবিজ্ঞানী আল্লাহর নির্দেশে জিবরাঈল আঃ রাসূলপাক সাঃ-এর বক্ষ সযত্নে বিদীর্ণপূর্বক জড়ধর্মী স্বভাব দূর করে আলোর স্বভাব স্থাপন করেন। গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে টিকে থাকার জন্য কুদরতি ওষুধ তাঁর শরীরে প্রয়োগ করেন। কল্ব মোবারকের মধ্যেও বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, যাতে মহাকাশ গমনের সময় তার মধ্যে কোনো প্রকার ক্লান্তি না আসে, মহাকাশের নিদর্শনাবলি দেখে কোনো ভয়ভীতি সঞ্চার না হয় এবং আল্লাহর সাক্ষাত লাভের সময় যেন সৃষ্টি না হয় কোনো প্রকার বাধাবিপত্তি। এক কথায় ঊর্ধ্বজগতের বিভিন্ন কুদরত প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা লাভে তাঁকে সক্ষম করে নেন আল্লাহপাক। তাই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মিরাজকে অবৈজ্ঞানিক রূহানিক বা কাল্পনিক বলার প্রশ্নই আসে না। নবীজি সাঃ-এর মিরাজ হয়েছিল স্বশরীরে, স্বজ্ঞানে ও জাগ্রতাবস্থায়।
উপর্যুক্ত বিষয়টি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা হতে সংগৃহীত করা হয়েছে। আশা করি সম্মানিত পাঠকও পাঠিকাগণ! এ আলোচনা থেকে অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন। সম্মানিত দাঈ ও বক্তাগণের প্রতি আহ্বান থাকবে, আমরা যেন গতানুগতিকভাবে শুধু মিরাজের কিচ্ছা-কাহিনী বয়ান না করি, বরং মিরাজের মূল উদ্দেশ্যগুলো পর্যালোচান করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সহীহ জ্ঞান দান করুন। আমীন

Related Post