মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মাদানী জীবন ও পর্যালোচনা

দ্বিতীয় বৃহত্তম যুদ্ধ ওহুদ

দ্বিতীয় বৃহত্তম যুদ্ধ ওহুদ

প্রকাশিরে পর- ৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

দ্বিতীয় বৃহত্তম যুদ্ধ ওহুদ

জাহেলী উন্মাদনাঃ যদিও বদর যুদ্ধে রাসূল সা: কোরায়শদের পরাজিত করে সমুচিত জবাব দিয়েছেন, কিন্তু এঘটনায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমগ্র আরব জনগোষ্ঠীকে ভীষণভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুললো। আরবের যে কোন এক ব্যক্তির রক্ত যেখানে পুরুষানুক্রমে যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতো সেখানে তাদের বড় বড় অনেক নেতাকে হারানোর প্রতিষোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলবে তাতো বলার অপেক্ষাই রাখে না। প্রত্যেক গোত্রের মনের ভিতরই জাহেলী উন্মাদনা, ক্রোধ ও উত্তেজনা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। কুরাইশদের একটি দল আবু সুফিয়ানের কাছে গিয়ে বললো, মুহাম্মাদ তোমাদের বিরাটক্ষতি সাধন করেছে এবং তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। এবার তার প্রতিশোধ গ্রহণে সবার সক্রিয় সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকলে তার প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব। এতে সবাই সম্মতি দিলো। অপর দিকে ইহুদীদের যেসব গোত্র ইতিপূর্বে মুসলমানদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেছিলো, তারা চুক্তির কোন শর্তই রক্ষা করলো না। বরং তারা প্রকশ্যভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে কুরাইশদের উত্তেজিত করতে শুরু করলো। চারদিকেই ঝড়ের আলামত দেখা দিলো। ফলে বদর যুদ্ধের পর একটি বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই মদীনায় এই মর্মে খবর আসলো যে, মক্কার মুশরিকগণ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমণের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একদিকে কুরাইশদের হুংকার অপরদিকে ইহুদী-খৃষ্টানদের আষ্ফালন। এরফলে ইহুদী -খৃষ্টানদের সাথে মুসলমানদেরকে কোন ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখতে আল্লাহ তা‘য়ালা কঠোরভাবে নিষেধ করে দিলেন। যা সূরা মায়েদায়ে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদের কখনো বন্ধু ও মিত্র হিসেবে গ্রহণ করোনা। ওরা পরস্পরের মিত্র। তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি তাদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে তাদেরই দলভুক্ত গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যালিমদেরকে সুপথ দেখান না। যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তাদেরকে তুমি দেখতে পাবে ইহুদী ও খৃষ্টানদের ব্যাপার নিয়ে ছুটোছুটি করে আর বলেঃ আমাদের আশংকা হয় আমাদের ওপর বিপদ-মুসিবত এসে পড়ে কিনা। আল্লাহ তো বিজয় দিতে পারেন কিংবা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোন ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারেন। তখন তারা তাদের মনের ভেতরে লুকানো ব্যাপার নিয়ে অনুতপ্ত হবে। মুমিনরা বলেঃ এই নাকি কসম খেয়ে লম্বা লম্বা বুলি আওড়ানো সেই লোকদের অবস্থা যারা বলে যে, তারা তোমাদের সাথেই রয়েছে। তাদের সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে গেছে। ফলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। হে মু‘মিনগণ, তোমাদের মধ্য হতে যদি কেউ তার দীন ত্যাগ করে, তাহলে সেদিন বেশী দূরে নয় যখন আল্লাহ এমন একটি দলের আবির্ভাব ঘটাবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, যারা মু‘মিনদের প্রতি বিনয়ী এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কারো নিন্দা বা তিরস্কারের পরোয়া করবেনা। এরূপ দৃঢ় হতে পারাটা আল্লাহর অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুতঃ আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান সর্বজ্ঞ। তোমাদের বন্ধু ও মিত্র তো একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই সব মু‘মিন যারা নামাযী,যাকাত দাতা ও আল্লাহর অনুগত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু‘মিনদের মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে আল্লাহর দলভুক্ত হবে এবং তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহর দলই চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে থাকে।” (মায়েদা ৫১-৫৬।)
যুদ্ধের প্রস্তুতি
বদর যুদ্ধ থেকে পরাজয়ের কলংক মাথায় নিয়ে কুরাইশগণ মক্কায় পৌঁছালো। অপরদিকে আবু সুফিয়ান ও তার বাণিজ্য কাফেলায় অর্জিত বিপুল পরিমান মুনাফাসহ নিরাপদে মক্কায় পৌঁছালো। বাণিজ্য কাফেলায় অর্জিত সমুদয় মুনাফা নতুন যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ তহবিলে জমা দেয়া হলো। এবারের যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর সাথে তাদের বড় বড় অভিজাত পরিবারের বিশিষ্ট মহিলারা রণাঙ্গনে যেতে প্রস্তুত হলো। বড় বড় কবিরাও সাথে যোগ দিলো। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীসহ সাতশো বর্মপরিহিত ও দু‘শো অশ্বারোহীর সমন্বয় তিন হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী ও বিপুল পরিমান যুদ্ধের সামান পত্র সহ মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। রাসূল সা: এর চাচা আব্বাস (রা:) সময় নষ্ট না করে দূত পাঠিয়ে কুরাইশদের এসব বিষয় খবর রাসূল সা:কে জানালেন। তদুপরি রাসূল সা:নিজস্ব বিশেষ গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তৃতীয় হিজরীর ৫ই শাওয়াল জানতে পারলেন যে, কুরাইশ বাহিনী মদীনার কাছে পৌঁছে গেছে। এপরিস্থিতি মুকাবেলার জন্য রাসূল সা: সাহাবীদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তিনি বললেন,আমরা কি মদীনার বাইরে গিয়ে মুকাবেলা করবো নাকি মদীনার ভিতরে বসে মুকাবিলা করবো? সাহাবীদের অনেকেই মত দিলেন মদীনার ভিতরে মুকাবেলা করার জন্য। কিন্তু যে সকল সাহাবীগণ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণে সুযোগ পায়নী তারা বললেন মদীনার বাহিরে গিয়ে মুকাবেলা করা হোক। পরামর্শের ভিত্তিতে রাসূল সা: মদীনার বাহিরে গিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। শুক্রবার জুময়ার নামাযের পর রাসূল সা: একহাজার মুসলিম সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হলেন। এদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং তার সমর্থকরাও ছিলো। মদীনা থেকে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে শওত নামক স্থানে পৌঁছে আব্দুল্লাহ বিন উবাই ‘যুদ্ধ হবে না’ ধূঁয়া তুলে তার গোত্রের মুনাফিক ও সংশয়মনা তিনশো অনুসারীদের নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বাকি সাতশো সৈন্য নিয়ে রাসূল সা: আল্লাহর ওপর ভরসা করে ময়দানের দিকে অগ্রসর হলেন। এদের মধ্যে মাত্র একশোজন ছিল বর্মধারী, মাত্র দু‘জন অশ্বারোহী। নিজেদের চেয়ে অনেকগুণ বেশী সৈন্য ও সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছেন নিছক ঈমানী শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে।
জেহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত মহিলা ও কিশোরগণ
প্রতারণা ও কাপুরুষতার ধারকবাহক তিনশো লোক ময়দান থেকে ভেগে গেল। আর ঈমানী পরিবেশ ও নির্মল সততায় লালিত পালিত নতুন প্রজন্মের একাধিক কিশোর জেহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধে রওনা হলো। রাসূল সা: তাদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা যুদ্দে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটোল। কিশোর রাফে বিন খাদীজ পায়ের পাতার সামনের অংশের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলো, সে যুদ্ধ করার যোগ্য। তার এ কৌশল ফলপ্রসূ হলো এবং অনুমতি পেল। সে ছিল ভালো তীরন্দাজ। রাফে যখন অনুমতি পেলো তখন আর এক কিশোর সামারাহও প্রস্তুত। তার যুক্তি রাফে যদি অনুমতি পায় তাহলে আমাকেও অনুমতি দেয়া উচিত। কারণ আমি রাফেকে কুস্তি-প্রতিযোগিতায় পরাজিত করতে সক্ষম। উপযুক্ততা প্রমাণের জন্যে উভয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হলো। অবশেষে সে রাফেকে পরাজিত করলো এবং যুদ্ধে যাবার অনুমতি পেল। এছাড়াও বেশকিছু কিশোর ছিলো যারা অনুমতি লাভের চেষ্টা করেও যুদ্ধে যাবার অনুমতি পায়নি। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলো উসামা, আব্দুল্লাহ, যায়েদ, বারা, আমর ও উসাইদ সহ বেশ কিছু অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণ । অপরদিকে মুসলিম নারীদের ওপর যদিও জেহাদ ফরয ছিলনা। কিন্তু পরিস্থিতির তাগিদে তারাও যুদ্ধে যাবার দাবী জানালো। অবশেষে আয়শা রা:,উম্মে সালীত,উম্মে সুলাইম ও উম্মে আম্মারা সহ বেশ কয়েকজন মহিলা মুসলিম বাহিনীর সাথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তারা রণাঙ্গনে আহত মুসলিম সৈনিকদের সেবাদান সহ যুদ্ধে আনুষাঙ্গিক কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন।
যুদ্ধ শুরু
রাসূল সা: ওহুদ পাহাড়কে পেছনে রেখে রণাঙ্গনে নকশা তৈরী করলেন। মুসয়াব বিন উমাইয়ের হাতে দিলেন ইসলামী পতাকা। যুবাইর বিন আওয়ামকে একদল সৈন্যের সেনাপতি নিয়োগ করা হলো। হামযা রা: কে বর্মহীন সৈন্যদের দায়িত্ব দেয় হলো। পেছন দিকে আইনাইন পাহাড়ের সুড়ঙ্গে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের নেতৃত্বে পঞ্চাশজন তীরন্দাজ বাহিনী মোতায়েন করলেন। তাঁকে বলে দিলেন ময়দানের অবস্থা যাই হোক এ সুড়ঙ্গে পথ যেন কোন অবস্থাই অরক্ষিত না হয়। অন্যদিকে কুরাইশরা তাদের সৈন্যদল ডানে-বামে সামনে আলাদা আলাদা সেনাপতির অধীনে সংঘবদ্ধ করলো। যুদ্ধের সূচনা হিসেবে হিন্দার নেতৃত্বে কুরাইশ মহিলারা দফ বাজিয়ে আবেগ ও উদ্দীপনার সামরিক গান গাইতে লাগলো। তারা যোদ্ধাদের বদর যুদ্ধে নিহতদের রক্তের বদলা নেবার জন্যে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় উৎসাহ যোগালো। এরপর যুদ্ধ শুরু হলো।
মুসলমানদের গোটা বাহিনী নিজেদের সংখ্যা ও সাজ সরাঞ্জামের ঘাটতি ঈমানী জযবা ও শহীদি তামান্না দ্বারা পুরণ করেছিল। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বার্তা বাহকরা জাহেলিয়তের অন্ধকারের সাথে এভাবেই লড়াই করে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে হযরত হামযা, আলী ও আবু দুজনার প্রাণপণ লড়াই ছিল সবচেয়ে বেশী দর্শনীয়। শেষ পর্যন্ত জাহেলিয়ত পুজারীদের পরাজয় ঘটলো এবং তাদের গায়িকারা পালিয়ে চলে গেল। মুসলিম বাহিনী মনে করলো, তারা বিজয়ী হয়েছে। তাই তারা শত্রুদের ভবিষ্যতের জন্য নিসম্বল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের যুদ্ধ সরাঞ্জাম রসদপত্র ও অন্যান্য জিনিস দখল করা শুরু করলো। এর ফলে রণাঙ্গনের শৃংখলা ভেঙ্গে গেল। সৈন্যরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়লো। সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হলো, সর্বাধিক নাযুক পাহাড়ী সুড়ঙ্গ পথটাকেও তীরন্দাজরা কেউ কেউ ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। অথচ তাদেরকে এটা না ছাড়ার জন্য কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মুসলমানদের কিছু অংশ এ সব নির্দেশ ভুলে গিয়ে বিজয়ের ফসল ঘরে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এর ফলে তাদেরকে অত্যন্ত ভয়ংকর ফলাফল ভোগ করতে হলো। কুরাইশ বাহিনীতে তখনো খালেদ বিন ওলীদের ন্যায় বিচক্ষণ ও দুর্ধর্ষ বীর ছিল। সে দূর থেকে রণাঙ্গনের এলোমেলো পরিবেশ দেখতে পেয়ে কয়েকজন অশ্বারোহীকে নিয়ে পাহাড়ের পিছন থেকে সেই সুড়ঙ্গের পথ দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বসলো। বিজয়ের আনন্দের ভেতর থেকে সহসা মাথার ওপর তরবারী দেখে মুসলমানরা দিশেহারা হয়ে পড়লো। ফলে সে দিনটা হয়ে দাঁড়ালো এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা ও আত্মশুদ্ধির দিন। বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমানকে আল্লাহ তা‘য়ালা শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাসূল সা:এর চাচা হামযা (রা:)। যুবাইর বিন মুতয়িমের গোলাম ওয়াহশী বলেন, ভয়ংকর যুদ্ধের এ অবস্থায় আমি হামযার প্রতি আমার বর্শা তাক করলাম। লক্ষ্য ঠিক হয়েছে বলে যখন নিশ্চিত হলাম, তখন ছুঁড়ে মারলাম তাঁর প্রতি। বর্শা তাঁর তলপেটে বিদ্ধ হয়ে দুই উরুর মাঝখান দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর তিনি মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়লেন। আমি বর্শা টেনে বের করার সাথেই তাঁর পেটের নাড়ী-ভুঁড়ী বেরিয়ে পড়লো। শত্রুরা স্বয়ং রাসূল সা:কে আক্রমণ করার জন্যে সৈন্য সমাবেশ করলো। রাসূল সা:মুসলমানদের ডাকতে লাগলেনঃ ‘ওহে আল্লাহর বান্দারা! আমার কাছে এস।’ কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা কিছুই শুনতে পাচ্ছিলো না। আবু সাঈদ খুদরী রা:বর্ণনা মতে উতবা বিন আবি ওয়াক্কাসের বর্শার আঘাতে রাসূল সা:এর ডান দিকের নীচের দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং তাঁর নীচের ঠোঁট আহত হয়। আব্দুল্লাহ বিন শিহাব জুহরী তাঁর কপাল জখম করে দেয়। ইবনে কুমাইয়া তাঁর চোয়ালের উপরিভাগে আঘাত হানে। ফলে রাসূলুল্লাহর শিরস্ত্রাণের দুটো অংশ ভেঙ্গে তার চোয়ালের ভেতরে ঢুকে যায়। এসময় তিনি একটি গর্তের ভিতর পড়ে যান।
অবশেষে আল্লাহর সাহায্য
“ আল্লাহ তোমাদের কাছে (সাহায্য ও সমর্থদানের) যে ওয়াদা করেছিলেন, তা পূর্ণ করেছেন। শুরুতে তাঁর হুকুমে তোমরাই তাদেরকে হত্যা করেছিলে। কিন্তু যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে এবং নিজেদের কাজে পারস্পারিক মতবিরোধে লিপ্ত হলে আর যখনই আল্লাহ তোমাদের সেই জিনিস দেখালেন যার ভালোবাসায় তোমরা বাঁধা ছিলে ( অর্থাৎ গনীমাতের মাল), তোমরা নিজেদের নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে, কারণ তোমাদের কিছু লোক ছিল দুনিয়ার প্রত্যাশী আর কিছু লোকের কামনা ছিল আখেরাত। তখনই আল্লাহ কফেরদের মোকাবেলায় তোমাদেরকে পিছিয়ে দিলেন। তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। তবে যথার্থই আল্লাহ এরপরও তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন। কারণ মুমিনদের প্রতি আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহের দৃষ্টি রাখেন”। আল- ইমরান, ১৫২।
শত্রুরা যখন দলে দলে হানা দিতে লাগলো, তখন রাসূল সা: বললেন, এমন কে আছ যে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত?এ আওয়াজ শুনে যিয়াদ বিন সাকানসহ বেশ কয়েকজন সাহাবী উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসূল সা:এর হেফাজতের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে শহীদ হতে লাগলেন। আব্দুল্লাহ বিন কুমাইয়া যখন তরবারী দিয়ে রাসূল সা: কে আঘাত করলো, তখন মহিলা সাহাবী উম্মে আম্মারা রাসূলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজে আঘাত খেলেন। এরফলে রাসূল সা: এর জীবন হেফজত হলো। আবু দুজানা রা: নিজের দেহকে ঢাল বানিয়ে রাসূলুল্লাহকে সা: কে রক্ষা করতে লাগলেন। অসংখ্য তীর এসে তার শরীরে বিদ্ধ হতে লাগলো। তালহা রা: শত্রুর তরবারী হাত দিয়ে ঠেকালেন। এতে তার একটি হাত কেটে নীচে পড়ে গেল। সা‘দ বিন রবী মুমূর্ষ অবস্থায় সাথীদেরকে ওসিয়াত করলেন ‘তোমরা সবাই বেঁচে থাকতে যেন শত্রুরা রাসূলের শরীরে আঘাত করার সুযোগ না পায়। তাহলে আল্লাহর নিকট তোমাদের কোন ওজর গ্রহনীয় হবে না।’ হযরত আনাস আনসারীর পিতা ইবনে নযর তার কথা শুনে বললেন, রাসূল সা:ই যদি বেঁচে না থাকেন তাহলে আমরা বেঁচে থেকে কি করবো? এই বলে তিনি প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু করলেন এবং শহীদ হয়ে গেলেন। তাঁর শরীরে ৮০টি আঘাত পাওয়া যায়। রাসূল সা: এর সাথে চেহারায় সাদৃশ্য সাহাবী জুময়ার বিন উমায়েরর শহীদ হওয়ার কারণে বিরোধীরা রাসূল সা: নিহত হয়েছেন বলে গুজব রটায়। ওমর রা: একথা শুনে নিজের অস্ত্র ফেলে দিয়ে বললেন, রাসূল যখন শহীদ হয়ে গেছেন, তখন আর যুদ্ধ করে কি লাভ? এরপর কা‘ব ইবনে মালিক সর্ব প্রথম রাসূল সা: জীবিত আছেন দেখতে পান এবং চিৎকার করে বললেন, ‘হে মুসলমানগণ, সুসংবাদ! রাসূলুল্লাহ বেঁচে আছেন।’ এরপর পরিস্থিতি পাল্টাতে লাগলো। সাহাবাগণ রাসূল সা: এর নিকট একত্রিত হতে লাগলেন। তিনি অবশ্য আহত হয়েছিলেন। সাহাবীরা তাঁকে একটি পাহাড়ের উপর নিয়ে এলেন। অন্য মুসলমানরা দলে দলে তাঁর কাছে আসলেন। শত্রুরা বিজয়কে সুসংহত না করেই যুদ্ধের ময়দান থেকে চলে গেল। কিছুদূর যাওয়ার পরই তারা বুঝতে পারলো যে, তারা বিরাট ভুল করে ফেলেছে। মুসলমানদেরকে সম্পূর্ণ খতম করে দেবার সুযোগটা তারা হাত ছাড়া করে ফেলেছে। এদিকে রাসূল সা: সতর্কতামুলক ব্যবস্থা হিসেবে মুসলমানদেরকে দুশমনদের পশ্চাদ্ধাবন করার নির্দেশ দিলেন। নবী করীম সা: হামরা উল আসাদ নামক স্থান পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করলেন। এখানে পৌঁছে জানা গেলো যে, কুরাইশরা মক্কায় ফিরে গেছে। তাই তিনিও মুসলমানদের নিয়ে মদীনায় ফিরে এলেন। এ যুদ্ধে সত্তর জন সাহাবী শহীদ হলেন। যাদের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিলেন আনসার। আর কুরাইদেরও অনেক যোদ্ধা মারা যায়।
এ যুদ্ধে মুসলমানদের জয় না পরাজয়?
“স্মরণ কর, যখন তোমরা পালিয়ে যাচ্ছিলে, কারো দিকে ফিরে তাকানোর হুঁশ পর্যন্ত তোমাদের ছিলনা এবং রাসূল সা: পেছন থেকে তোমাদের আহ্বান করছিল। তখন আল্লাহ তোমাদের এই কাজের প্রতিফল এভাবে দিলেন যে, তোমাদেরকে দুঃখের পর দুঃখ দিলেন, যাতে ভবিষ্যতের জন্য তোমরা শিক্ষা পাও এবং তোমরা যা হারাও বা তোমাদের ওপর যা কিছু বিপদ আসে, তাতে তোমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হও। আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।” আল্ ইমরান – ১৫৩। ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের জয় না পরাজয় হয়েছে তা উল্লেখিত আয়াতেই ইংগিত পাওয়া যায়। রাসূল সা: এর জীবনে যতগুলি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার প্রত্যেকটির মূলেই রয়েছে আল্লাহ তা‘য়ালার একটা প্রচ্ছন্ন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের প্রেরণা। রাসূল সা:এর জীবনে সংঘটিত কোনও ঘটনাই বিফলে যায়নি। প্রত্যেকটি ঘটনার দ্বারাই আল্লাহ তা‘য়ালা রাসূল সা:কে সফলতার দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। কাজেই, কোন ঘটনাকে সম্পূর্ণ পৃথক বা বিচ্ছিন্ন করে দেখার উপায় নেই। সেই সফলতার দিকে সম্পর্ক রেখেই প্রতিটি ঘটনার ফলাফল বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তাহলেই ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের জয় না পরাজয় হয়েছে তা সহজে অনুধাবন করা যাবে। রাসূল সা: এর সমগ্র জীবন ব্যাপী সত্যের সাথে মিথ্যার- আলোর সাথে অন্ধকারের ধারাবাহিক সংগ্রাম চলেছে। এর পিছনে রয়েছে এক কাল জয়ী সুমহান আদর্শ বাস্তবায়নের মহা পরিকল্পনা। সেই কাল জয়ী আদর্শ জমিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি না- ইহাই হলো বিচারের মাপকাঠি। এ আদর্শ বাস্তবায়নের ধারক বাহকদের সমূলে শেষ করে দেয়ার জন্য প্রথম আঘাঁত আসে বদর যুদ্ধে। আর বদর যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এরপর সংঘটিত হয় ওহুদ যুদ্ধ। আর ওহুদ যুদ্ধে শত্রুজয় অপেক্ষা মুসলিমগণ আত্মজয় করতে পারে কি না, কঠিন বিপদের সময় ধৈর্য ধরে নিজ কর্তব্য পালনে সক্ষম কি না। জয়ের সঙ্গে পরাজয়কেও তারা সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে কি না। সত্যের জন্য তারা মৃত্যুকে আপন করে নিতে প্রস্তুত কি না। ইত্যাদি পরীক্ষা করাই ছিলো এ যুদ্ধের অন্যতম মূল বিষয়সমূহ। এ ছাড়াও এ যুদ্ধে মুসলমানদের ভুলত্রুটি সংশোধনের প্রয়োজন ছিল, যাতে পরবর্তীতে তাদের আর বিপদে পড়তে না হয়। বস্তুতঃ এ যুদ্ধ মুসলমানদের বিফলে যায়নী। এর মধ্যে লুকায়িত ছিল মুসলমানদের জাতীয় জীবন গঠনের যথেষ্ট উপকরণ। বহু মাত্রিক নৈতিক শিক্ষা পেয়েছিল এ যুদ্ধ থেকে। কাজেই, ওহুদ যুদ্ধে যাত্রা করার সময় তারা যেরূপ মুসলমান ছিলেন, ফেরার সময় তার চেয়েও উন্নত ও শক্তিশালী মুসলমান হয়ে ফিরছিলেন। অপর দিকে আল্লাহ তা‘য়ালা স্বয়ং মুসলমাদেরকে এই বলে আশ্বাস দিলেন যে, “আর তোমরা দুর্বল হয়ো না ও বিষণœ হয়ো না এবং যদি তোমরা বিশ্বাসী হও, তবে তোমারাই বিজয়ী হবে। যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তবে নিশ্চয়ই সেই সম্প্রদায়েরও তদ্রুপ আঘাত লেগেছে এবং এ দিবসসমূহকে আমি মানুষের মধ্যে পরিবর্তন করাই; এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাদেরকে যাতে আল্লাহ এরূপে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য হতে কতক লোককে  শহীদরূপে গ্রহণ করবেন। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। এবং তিনি এই পরীক্ষার মাধ্যমে সলিট মুমিনদের বাছাই করেন এবং অবিশ্বাসীদেরকে নিপাত করেন। তোমরা কি ধারণা করেছো যে,এমনিই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের মধ্য হতে কে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করেছে আর কে তাঁর জন্যে প্রতিকুল অবস্থায়ও ধৈর্য ধারণ করেছে, আল্লাহ তা এখনো যাচাই করেননি।” আল-ইমরান ১৩৯-১৪২।
মানুষের যাবতীয় দুর্বলতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মৃত্যুর ভয়। যাদেরকে বিশ্ব নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাছাই করা হয়েছে সেই মুসলমানরা তো ভয়ে থমকে গেলে চলবে না। তাই এ সময় মুসলমানদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয় হলো যে, তোমাদের মৃত্যুর ভয়ে হীনবল হওয়া বা পলায়ন করা নিতান্তই অর্থহীন। মুসলমানদের প্রকৃত সফলতা আখেরাতে। আর এর জন্য শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে শহীদি তামান্না নিয়ে আল্লাহর দ্বীন কায়েমে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এই জন্য মুসলমানদেরকে যে কোন অবস্থায়ই সমুন্নত রাখতে হবে। কাজেই যারা আল্লাহর দ্বীনকে কবুল করেছে, এর উপর কায়েম থাকার এবং একে কায়েম করার চেষ্টা সাধনার সুযোগ পেয়েছে। তাদের পক্ষেই এই মহা মূল্যবান নিয়ামতটির জন্য নিজেদের সবকিছু নিয়োজিত করতে পারলেই তারা এর ফলাফল অবশ্যই অর্জন করবে। অতএব ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কোন প্রশ্নই আসে না। বরং আগামী দিনের জন্য তাদের বিজয়ের দ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে।
চতুর্থ হিজরীর কতিপয় ঘটনা
ওহুদ যুদ্ধের সাময়িক বিপর্যয়ের পর বিদ্রোহী অপশক্তিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো। বিভিন্ন গোত্রের বিশ্বাস ঘাতকতা চরমে আকার ধারণ করলো যার কিছু ঘটনা সংক্ষেপে ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করা হলো।
যেমন চতুর্থ হিজরীর মুহাররম মাসে কুতবা এলাকায় জোফায়দ নামক গোত্রটি মদীনা আক্রমণের চেষ্টা করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সালামার নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠিয়ে তাদের আক্রমণ প্রতিরোধে আব্দুল্লাহ বিন আনীস (রা.)-এর অধীনে একদল সৈন্য প্রেরণ করে তাদের প্রতিরোধ করেন। এবছর সফর মাসে আযাল ও কারা গোত্রের লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তাদের গোত্রের লোকদের ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার জন্য কতিপয় লোক পাঠানোর আবেদন করে। আসলে এটা ছিলো তাদের ষড়যন্ত্র। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ জন জ্ঞানী-গুণী সাহাবী পাঠালেন, যা বুখারীর বর্ণনায় পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন ৭ জন। এদের আমীর ছিলেন, মুরসাদ ইবনে আবুল মুরসাদ। তারা হুযায়েলের আবাস স্থলে রাতে পৌাঁ মাত্রই তারা খুবায়েব ও যায়েদ ছাড়া বাকীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। খুবায়েব ও যায়েদ কে তারা কোরাইশদের নিকট বিক্রি করে দেয়। কুরাইশরা এ দুজনকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মনে কত বড় আঘাত পেয়েছিলেন, তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য।
একই মাসের মধ্যে এর চেয়েও বড় ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলো বীরে মাউনায়। আগামী পর্বে  বীরে মাউনার ঘটনার অবতারণা করা হবে ইনশা আল্লাহ। (চলবে)

Related Post