মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচান

মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচান

মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচান

পূর্বে প্রকাশিতের পর 
ইসলামের গতিরোধ করার অপচেষ্টা
ইসলামের প্রচারকার্য যখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর প্রসার ব্যাপকতা ছড়ায় তখন বিপক্ষ শক্তির মাথার ওপর দিয়ে ঝড় বইতে থাকে, তখন বিরোধীরা বেশামাল হয়ে তার নেতা ও কর্মীদেরকে সমাজের সব ধরনের কার্যকর সমর্থন ও পৃষ্টপোষকতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চালায়। কুরাইশগণ ইসলামের দাওয়াতী কাজে নানা ধরনের বাধা এবং চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এমন কি তারা রাসূল (সাঃ)-কে শেষ করে দিতে চাইত। জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখার লক্ষ্যে কিছু কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করতো। যেমন, তারা বলতো মুহাম্মদ তোমাদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে, তোমাদের দেবদেবীকে গালি দিচ্ছে। সে চিরাচরিত ও পৈত্রিক ধর্মের দোষ প্রচার করে বেড়াচ্ছে এবং পূর্ব পুরুষদের অবমাননা করছে। এসব কথা প্রচার করে তারা মোশরেকদের উত্তেজিত করতো। অথচ কখনো তাদের দেবদেবী এবং ধর্মকে গালি দেয়া বা অপমান করা হয়নী বরং নিষেধ করা হয়েছে। তিনি সত্য কথাটাই স্পষ্ট করে বলেছেন যে, কোন জিনিস সত্য-মিথ্যার যাচাই না করে শুধু পুরুষানুক্রমে চলে আসছে এ অজুহাতে ধারণ করে চলা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর ধর্মীয় ব্যাপারে র্শিক বেদ’আত মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে বলা হয়েছে। এটাকেই তারা প্রচার করেছে ধর্মের অবমাননা বলে। এ ব্যাপারে তারা বার বার রাসূল (সাঃ)- এর চাচা আবু তালেবের নিকট অভিযোগ করে আসছেলো। এ বার তারা সরাসরি বলে দিলো যে, আপনি যদি ওকে না ঠেকান তাহলে আমরা ওকে এবং আপনাকেও দেখে নেব!। হয় আমরা বেঁচে থাকবো, না হয় মুহাম্মদ ও তার সমর্থকরা বেঁচে থাকবে। চাচা আবু তালেব এবার রাসূল (সাঃ) কে অনুনয় করে বললেনঃ ভাতিজা আমার ওপর এমন বোঝা চাপিওনা যা, বহন করতে পারি না। রাসূল (সাঃ) পরিস্কার জানিয়ে দিলেন চাচাজান, যে কোন মূল্যেই হোক আমাকে এ কাজ থেকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না। তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এনে দেয় তবুও আমি দাওয়াতী কাজ পরিত্যাগ করতে পারবোনা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার চেষ্টা সাধনা চলবে। তাতে যে কোন কঠিন পরিস্থিতিরই মোকাবেলা করতে হোক না কেন। এ কথায় আমরা সে আসল শক্তির কন্ঠস্বর শুনতে পাই. যে শক্তি ইতিহাসকে পরিবর্তন করে দেয় এবং বাতিলের সকল ষড়যন্ত্র ও প্রতিরোধকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আপন লক্ষ্যে উপনীত হয়। কিন্তু বাতেলের ধারক বাহকরা সে শক্তি টের পায়না। পরিতাপের বিষয় হলো আজকের বিশ্বেও সে ধরনেরই কাজ চলছে আর কতিপয় নামধারী মুসলমানরা সে কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। বিশ্ব মোড়লরা নানা অজুহাতে মহাসত্যের ধারক বাহকদের উপর জুলুম-নির্যাতন করে চলেছে আর বিভিন্ন মিথ্যা কাল্পনিক অপবাদের মাধ্যমে মুসলিম দেশসমূহে অরাজকতা সৃষ্টি করে তা দখল করে নিচ্ছে। কোরেশদের শত জুলুম-নির্যাতন নিষ্পেষণ ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সে সময় যেমন ইসলামের গতি প্রতিরোধ করা যায়নি, আজো ইসলামের গতিরোধ করার মত কোন ক্ষমতা বিশ্বে কারো নেই।
নেতিবাচক (বাম ) ফ্রন্ট গঠন
শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ (সাঃ) মানবজাতির যে বৃহত্তম সেবায় নিয়োজিত ছিলেন, তাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য ইসলামের শত্রুরা হরেক রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর দাওয়াতী কাজ অব্যাহত ছিল এবং তার সুফলও কিছু না কিছু পাওয়া যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় বিরুদ্ধবাদী প্রচারণার একটা সক্রিয় সেল গঠন করা হলো। এই সেলের আওতায় মক্কার কতিপয় শীর্ষস্থানীয় নেতা রাসূল (সাঃ)-এর কাছাকাছি অবস্থান করতে লাগলো। তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি ছিলো ওলীদ বিন মুগীরা এবং তার বাড়িতেই ছিল এর সদর দপ্তর। তাদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক সময় ছিল হজ্জের মওসুম। আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা দলে দলে তাদের সরদারদের নেতৃত্বে মক্কায় সমবেত হতো। এ সময় রাসূল (সাঃ) ঐ সব দলের সদস্য ও নেতাদের সাথে তাঁবুতে তাঁবুতে গিয়ে সাক্ষাৎ করতেন এবং দাওয়াত দিতেন। প্রতিক্রিয়াশীল নেতিবাচক আন্দোলনের নেতারা তা দেখে তেলে বেগুনে জ্বলতো। একবার হজ্জের মওসম সমাগত হলে কোরায়েশ নেতারা ওলীদের বাড়িতে সমবেত হয়ে কিভাবে এর প্রতিরোধ করা যায় সে জন্য তারা জনগণের মতামত চাইলো। বিভিন্ন গ্র“পের মতামত শোনার পর ওলীদ তার মত ব্যক্ত করলো এবং সে বললোঃ আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদের কথাবর্তা বড়ই মধুর। তাঁর কথার শেকড় অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং তার শাখা-প্রশাখায় অনেক ফল ধরে। এ দাওয়াত বিজয়ী হবেই। একে পরাভূত করা যাবেনা। এ দাওয়াত অন্য সব কিছুকে পর্যুদস্তু করে দেবে। তোমরা যেটাই বলবে, নিরর্থক ও বৃথা হয়ে যাবে। তবে তোমরা যা যা বলেছ, তার মধ্যে মানানসই হলো সে একজন যাদুকর এটাই বলবে। তাঁর কথায় সমাজের বিভেদ ও বিচ্ছেদ ঘটায়। আর সে জন্যই তাঁকে মানুষেরা বয়কট করে রেখেছে। লক্ষ্য করার বিষয়, কিভাবে ইসলামের ধারক-বাহকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। যে কথা বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়না, সে কথাই জোর করে চালু করার চক্রান্ত করা হয়। আধুনিক কালে এসেও আমরা ইসলাম ও এর ধারক বাহকদের বিরুদ্ধে সেই একই ধরণের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। ঐ মজলিসেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, মক্কা অভিমুখী প্রত্যেক রাস্তার মুখে এক একটা দল বসে থাকবে এবং প্রত্যেক প্রতিনিধি দলকে মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর দাওয়াত সম্পর্কে সতর্ক করে দেবে। বিরুদ্ধবাদী প্রচারণার এই জোরদার অভিযানের খবরাদি শুনে আবু তালেব শংকিত হন যে, আরবের জনগণ সংঘবদ্ধভাবে বিরোধিতা শুরু করে না দেয়। যদিও তিনি ইসলাম কবুল করেন নী কিন্তু তিনি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কিছু হোক এটা বরদাশত করবেন না, প্রয়োজনে তাঁর পক্ষে জীবন দিতেও প্রস্তুত বলে প্রকাশ্যভাবে জানিয়ে দিলেন। অপরদিকে আবু জাহেল ইসলামের বিপক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো এবং রাসূল (সাঃ) কে ভীষণ কষ্ট দিত। পরিকল্পনা অনুসারে কাজ এগিয়ে চললো, কিন্তু আশানুরুপ ফল হলো না।
সাহিত্য ও গান বাজনার ফ্রন্ট
মক্কার কাফেরদের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যখন এ দাওয়াত সম্প্রসারিত হয়েই চলছিল তখন নযর বিন হারেস কুরাইশ নেতাদেরকে বললো, তোমরা যেভাবে এ ব্যক্তির মোকাবিলা করছো, তাতে কোন কাজ হবে না। এ ব্যক্তি তোমাদের মধ্যেই জীবন যাপন করে শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে। আজ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে সে ছিল তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো, সত্যবাদী, আমানতদার ও বিশ্বস্ত লোক। তোমরাই তাঁকে আল্-আমীন উপাধি দিয়েছিলে। অথচ আজ যখন সে তাঁর দাওয়াত পেশ করলো, অমনি তোমরা বলতে আরম্ভ করলে, সে গণক, যাদুকর, কবি, উম্মাদ, পাগল ইত্যাদি। এ দোষগুলোর মধ্য থেকে কোন্টি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওপর প্রযোজ্য হয় যে, সেটি বিশ্বাস করার জন্য তোমরা লোকদেরকে আহবান জানাতে পারবে? থামো, এ রোগের চিকিৎসা আমিই করবো। এরপর সে বিভিন্ন দেশ থেকে অনারব রাজা-বাদশাহ্দের কিস্সা কাহিনী এবং রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের গল্পকথা সংগ্রহ করে এনে গল্প বলার আসর জমিয়ে তুলতে লাগলো। তার উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে লোকেরা কুরআনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং এসব গল্প-কাহিনীর মধ্যে ডুবে যাবে। এজন্যে সে গায়িকা বাঁদীদেরকেও কিনে এনেছিল। কোন ব্যক্তি সম্পর্কে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথায় প্রভাবিত হতে চলেছে বলে তার কাছে খবর এলেই সে তার জন্য একজন বাঁদী নিযুক্ত করতো এবং তাকে বলে দিতো ওকে খুব ভালো করে পানাহার করাও ও গান শুনাও এবং সবসময় তোমার সাথে জড়িয়ে রেখে ওদিক থেকে ওর মন ফিরিয়ে আনো। সত্যের বিপক্ষে সবসময়ই বড় বড় ধুর্তবাজ অপরাধীরা এ চালবাজীর আশ্রয় নিয়ে তারা জনগণকে খেল-তামাশা ও নাচগানে (কালচার) মশগুল করতে থাকে। এতে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের খানা-পিনার ব্যবস্থাসহ একাজে পারদর্শী লোকদেরকে মোটা অংকের উপঢৌকন দেয়ার ব্যবস্থাও থাকে। এভাবে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি নজর দেবার চেতনাই থাকে না এবং অস্তিত্ব জগতের মধ্যে তারা একথা অনুভবই করতে পারে না যে, তাদেরকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইসলামের মূল প্রাণশক্তি হলো আল্লাহর আনুগত্য ও নৈতিকতা। নর-নারীর অবাধ মেলামেশা ও অশ্লীলতার পরিবেশে ঐ প্রাণশক্তির মৃত্যু ঘটে। যে পরিবেশে খাওয়া দাওয়া, গান বাজনা, বিনোদন, ললিত কলা ও যৌনতার প্রতি সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়, সে পরিবেশ ইসলামী দাওয়াতের উপযোগী হতে পারেনা। এ কারণেই নযর বিন হারেস একদিকে বিনোদনমূলক কিচ্ছাকাহিনী পরিবেশন করা শুরু করে আর অপর দিকে গান বাজনা, নারী-পুরুষের সম্মিলন ও অশ্লীলতার সমাবেশ ঘটায়। যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত আছে। তথাকথিত নারীর ক্ষমতায়নের নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা ও অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। যার ফলে আজ মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এমন কি কতিপয় মুুসলিম নযর বিন হারেসের সহযোগী হয়ে আল্লাহর পথ থেকে মানুষদেরকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নযর বিন হারেস ও তার দোসররা এ কাজের মাধ্যমে নিজেদের ঘাড়ে কত বড় যুলুমের দায়ভাগ চাপিয়ে নিচ্ছে, তা তারা জানে না। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক সূরা লোকমানের ৬ নং আয়াতে বর্ণনা  করেছেন এভাবে; “মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহর পথ হতে (মানুষকে) বিচ্যুত করবার জন্যে অসার বাক্য ক্রয় করে নেয় এবং আল্লাহ প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে; তাদেরই জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।” আর রাসূল (সাঃ)-এর বাণী হচ্ছে, “যে ব্যক্তি গায়িকা বাঁদীর মাহফিলে বসে তার গান শুনবে, কিয়ামতের দিন তার কানে গরম শীসা ঢেলে দেয়া হবে।” এ শাস্তি তাদের অপরাধের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নির্ধারিত। তারা আল্লাহর দ্বীন, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে লাঞ্ছিত করতে চায়। এর বদলায় আল্লাহ তাদেরকে কঠিন লাঞ্ছনাকর আযাব দেবেন। অপরদিকে তারা আল্লাহর দ্বীনকে নিভিয়ে দিতে পারবে না। যেমন পারেনি নযর বিন হারেস ও তার দলবলেরা। নযর বিন হারেসের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর সে কোরায়েশ বুদ্ধিজীবিদের পরামর্শক্রমে মদীনায় ইহুদী ধর্মযাজকদের কাছে গেল ইসলামী আন্দোলনকে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে পরামর্শের জন্যে। আজকের পৃথিবীর মুসলিম মিল্লাত ও সেই ইহুদীদের চক্রান্তের কবলে পড়েছে। সে সময় যেমন ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা যায়নি, আজও তা প্রতিরোধ করা কারোরই পক্ষে সম্ভব নয়।  (চলবে)

Related Post