১ম পর্ব
মুহাম্মদ (সা.) জীবনের এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েও সমাজে পরিপূর্ণভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। অথচ তাঁর জীবনের কোন অংশেই ব্যর্থতা ছিলনা। অবশেষে তিনি তাঁর সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় অধ:পতন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবতে লাগলেন: তাঁর বংশের লোকেরা কিভাবে হাতে-গড়া মূর্তিকে নিজেদের মা’বুদ বা উপাস্য বানিয়েছে! নৈতিক দিক থেকে তারা কতো অধ:পতনে গিয়ে পৌঁছেছে। তাদের এ সব ভ্রান্তি কি করে দূরীভূত হবে? আল্লাহর নির্ভুল পথ কিভাবে তাদের দেখানো যাবে? এ বিশ্বজাহানের প্রকৃত স্র্রষ্টা ও মালিকের ইবাদত কিভাবে করা উচিত? এমনি অসংখ্য রকমের চিন্তা ও প্রশ্ন তাঁর মনের ভেতর তোলপাড় করতে লাগল। এসব বিষয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন।
নবুয়্যাত ও রেসালাতের সূচনা: মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ পাক সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য করুণা স্বরূপ এবং গোটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদ দাতা করে পাঠাবেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে যত নবী রাসূল এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে আল্লাহ তা’আলা এ মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, তাঁরা মুহাম্মদ (সা.) -এর ওপর ঈমান আনবেন, তাঁকে সমর্থন করবেন এবং তাঁর বিরোধীদের মুকাবিলায় তাঁকে সাহায্য করবেন। আর তাঁদের প্রতি যারা ঈমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদেরকেও এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন। সে অঙ্গীকার অনুসারে প্রত্যেক নবী নিজ নিজ অনুসারীদেরকে মুহাম্মদ (সা.) -কে মেনে নেয়া ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে যান।
আল্লাহ তা’আলা যখন মুহাম্মদ (সা.) -কে সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করতে মনস্থ করলেন ও নবুয়্যাতের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোন প্রয়োজনে বাইরে বেরুলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যেকোন পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই তিনি অতিক্রম করতেন ঐ পাথর বা গাছ বলে উঠতো, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি সালাম।” এ কথা শোনা মাত্রই মুহাম্মদ (সা.) আশে পাশে ডানে বামে ও পেছনে ফিরে তাকাতেন। কিন্তু গাছ বা পাথর ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতেন না। আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা’আলা যখন মুহাম্মদ (সা.) -কে সম্মানিত করতে ও মানবজাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে মনস্থ করলেন, তখন মুহাম্মদ (সা.) নবুয়্যাতের অংশ হিসেবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের মতই বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এ সময় আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নির্জনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করে দেন। একাকী নিভৃতে অবস্থান তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে।
হেরা গুহায়: মক্কা-মুয়াজ্জমা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত জাবালুন নূর- ‘হেরা’ নামে একটি পর্বত। মুহাম্মদ (সা.) প্রায়ই সেখানে গিয়ে অবস্থান করতেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে চিন্তা-ভাবনা ও আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। সাধারণত খানা-পিনার দ্রব্যাদি তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন, শেষ হয়ে গেলে আবার নিয়ে আসতেন। কখনো কখনো খাদিজা (রাঃ) পৌঁছে দিতেন।
সর্ব প্রথম ওহী: এভাবে দীর্ঘ ছয়টি মাস কেটে গেল। মুহাম্মদ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করলেন। তিনি হেরা গুহায় যথারীতি আল্লাহর ধ্যানে মশগুল আছেন। সময়টি তখন রমযান মাসের শেষ দশক। সহসা তাঁর সামনে আল্লাহর প্রেরিত জিবরাইল ফেরেশ্তা এক খন্ড রেশমী কাপড় নিয়ে আভির্ভূত হলেন। ইনি ফেরেশতা-শ্রেষ্ঠ জিবরাইল (আঃ)। ইনিই যুগ-যুগ ধরে আল্লাহর রাসূলদের কাছে তাঁর বাণী নিয়ে আসতেন। ঐ রেশমী বস্ত্রখন্ডে কিছু লেখা ছিল। জিবরাইল আমাকে বললেন, “পড়”। আমি বললাম “আমি পড়তে জানি না।” তখন তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এমনি জোরে চাপ দিলেন যে, আমি ভাবলাম মরে যাচ্ছি। অতঃপর মুহাম্মদ (সা.) -কে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, “পড়”। কিন্তু তিনি আগের জবাবেরই পূণরুক্তি করলেন। জিবরাইল (আঃ) আবার তাঁকে আলিঙ্গন করে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, “পড়”। এবারও মুহাম্মদ (সা.) জবাব দিলেন, “আমি পড়তে জানি না।” পূণর্বার জিবরাইল (আঃ) মুহাম্মদ (সা.) -কে বুকে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন: “পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাঁধা রক্ত থেকে। পড় এবং তোমার প্রতিপালক অতীব সম্মানিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন জিনিস শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।” (সূরা: আ’লাক ১-৫)। এই হচ্ছে সর্বপ্রথম ওহী। কত সুন্দর, কত মধুর! যুগ-যুগ ধরে যে-মহাসত্যের জন্য পৃথিবী প্রতীক্ষা করে আসছিল, বিশ্ব শান্তির জন্য সে বাণী অবতীর্ণ হতে শুরু করল। ওহীর প্রথম কথাই হল: পাঠ কর-অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন কর। কুরআনের সর্বপ্রথম বিষয়বস্তুই হল “জ্ঞান”। জ্ঞানের প্রসঙ্গ নিয়ে সূচিত হল মুহাম্মদ (সা.) -এর নবুয়্যাতের জীবন, আর ইসলামের নতুন জয়যাত্রা। এ বিজ্ঞানের যুগে ইসলাম বিশ্বের সম্মুখে গর্ব করে বলতে পারে: জ্ঞান-সাধনাই হচ্ছে মুহাম্মদ (সা.) -এর প্রথম ও প্রধান পয়গাম। কী গভীর দার্শনিক তাৎপর্যই না নিহিত আছে এই প্রথম অবতীর্ণ ক্ষুদ্র আয়াত কয়টির মধ্যে।
এ আয়াত কয়টিতে তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে: আল্লাহ, মানুষ ও জ্ঞান। প্রথমে আল্লাহর আত্মপরিচয় পেশ করা হয়েছে এ-ভাবে: তিনিই বিশ্বনিখিলের একমাত্র রব (প্রভু)। তিনিই সৃজনকারী, পালনকারী, যাবতীয় বিষয়ের পর্যবেক্ষণকারী ও ক্ষমতাশালী। তিনি একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন অংশীদার নেই। এ ঘোষণার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণা যেমন, কারো ধারণা আল্লাহ বলতে কেউ নেই, পৃথিবী স্বয়ংসৃষ্ট, যা- কিছু হবার তা এমনিই হয় অথবা একাধিক ঈশ্বর ও দেবদেবীর দ্বারা বিশ্ব রচিত ও পরিচালিত-ইত্যাদি ধরনের যাবতীয় মতবাদকে আল্লাহ এখানে বাতিল করে দিয়েছেন এবং স্পষ্ট ঘোষণা করছেন যে, একমাত্র তিনিই ইহার স্রষ্টা ও নিয়ামক।
তারপর আসলো মানুষের পরিচয়। মানুষ কোথা হতে আসল? কে সৃষ্টি করল? সে পরিচয়ও আল্লাহ্ দিয়েছেন: মানুষকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন সামান্য রক্ত কণিকা হতে। চিন্তার বিষয়, ক্ষুদ্র এক রক্তবিন্দুর মধ্যে আল্লাহ্ মানুষের সমস্ত শক্তি ও সম্ভাবনাকে গোপন রেখেছেন, তারপর ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে রক্তবিন্দুকে তিনি জ্ঞান, বিবেক সম্পন্ন শক্তিশালী মানুষে পরিণত করেছেন।
অবশেষে জ্ঞানের কথা; এটা কোথা থেকে আসল? এটাও আল্লাহ দান করেছেন। জ্ঞান অর্জনের দু’পদ্ধতি: ১. লিখনীলব্ধ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য) জ্ঞান এবং ২. প্রত্যক্ষ জ্ঞান। জ্ঞান বিহীন মানুষ অন্ধের মত। আর অন্ধত্ব কখনো মানুষের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। রিসালাত মানুষের জীবন থেকে প্রথমে অন্ধত্ব দূর করে, এরপর তাকে আলোর সন্ধান দেয়। ফলে মানুষের ইহ ও পরকালীন কল্যাণের পথ সুগম হয়। প্রথম ওহী মানুষকে তিনটি কথা উপলদ্ধি করতে বলেছে। এ তিনটি সত্য বুঝতে পারলে মানুষ “সিরাতুল মুস্তাকীম” (সরল পথ) দিয়ে চলতে পারবে পথ ভ্রষ্ট হবে না। মানুষ যদি জানে এবং মানে যে, এ বিশ্ব নিখিলের সৃজনকারী, রক্ষাকারী ও ধ্বংসকারী একমাত্র আল্লাহ-তিনিই আমাদের জীবন মরণের প্রভু, তিনি ছাড়া আমাদের আর কোন উপাস্য নেই, উপায় নেই: তিনি আদি, তিনি অন্ত, তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তবে কেমন করে সে আল্লাহকে ছেড়ে অপর কারো উপাসনা করবে? নতমস্তকে তাকে বলতেই হবে: প্রভু হে! একমাত্র তুমিই আমাদের ‘রব’ তুমি ছাড়া আমাদের আর কোন উপাস্য নেই, আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সাহায্য চাই। এরপর নিজের দিকে খেয়াল করে সে যদি বুঝতে পারে যে, কত নি:সহায় অবস্থা হতে আল্লাহ্ তাকে জ্ঞান-বিবেক সম্পন্ন মানুষে পরিণত করেছেন, তাহলে আল্লাহর অসীম করুণা ও কুদরতের কথা ভেবে কৃতজ্ঞতায় তার মাথা সে ‘রবের’ উদ্দেশ্যে নত না হয়ে পারে না। আবার সে যদি বুঝতে পারে যে, আল্লাহই সকল জ্ঞানের উৎস এবং সে জ্ঞান অর্জন ছাড়া সৃষ্টিলীলার কোন রহস্যই সে বুঝতে পারবে না, তবে আল্লাহর নামে জ্ঞান সাধনায় প্রবৃত্ত হবেই। রাষ্ট্র , সমাজ ও জীবনে অন্যান্য সমস্যা এ তিনটি উপলব্ধি হতেই আসবে এবং তার চিন্তা ও কর্ম নতুন নতুন পথে প্রভাবিত হবেই। আল্লাহর সহিত জ্ঞানের সংযোগ সাধিত হলে সে জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করবে এবং সে জ্ঞানই অশেষ কল্যাণের উৎস হবে।
রাসূল (সা.) বলেন, অতঃপর আমি শোনানো আয়াত কয়টি পড়লাম। এ পর্যন্ত পড়ার পর জিবরাইল থামলেন এবং তারপর চলে গেলেন। আমি হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। পর্বতের মধ্যবর্তী এক স্থানে পৌঁছে হঠাৎ ওপর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, “হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল আর আমি জিবরাইল।” আমি আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, জিবরাইল আকাশের দূর দিগন্তে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে আছেন এবং বলছেন, “হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরাইল।” আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আকাশের অন্যান্য প্রান্তে তাকিয়ে দেখি, সর্বত্রই তিনি একই আকৃতিতে বিরাজমান। এরপর জিবরাইল অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এ ঘটনার পর মুহাম্মদ (সা.) নিজ গৃহে চলে গেলেন। তখন তাঁর পবিত্র অন্তঃকরণে এক প্রকার অস্থিরতা বিরাজ করছিল। তিনি কাঁপতে কাঁপতে খাদীজা (রাঃ)-কে বললেন, ‘আমাকে শীঘ্র কম্বল দ্বারা ঢেকে দাও।’ খাদীজা (রাঃ) তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। অতঃপর কিছুটা শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলে তিনি খাদীজা (রাঃ)-এর কাছে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘আমার নিজের জীবন সম্পর্কে ভয় হচ্ছে।’ খাদীজা (রাঃ) বললেনঃ ‘না, কখনোই নয়। আপনার জীবনের কোনো ভয় নেই। আল্লাহ আপনার প্রতি বিমুখ হবেন না। “এ ঘটনাকে আপনি পরম শুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করুন এবং অবিচল থাকুন। কেননা আপনি আত্মীয়দের হক আদায় করেন, অক্ষম লোকদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। গরীব-মিসকিনদের সাহায্য, পথিক মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। মোট কথা ইনসাফের খাতিরে বিপদ-মুসিবতের সময় আপনিই লোকদের উপকার করে থাকেন। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, আপনি এ যুগের মানবজাতির জন্য নবী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
সহধর্মিণীর উপযুক্ত কথাই বটে! হৃদয় যাঁর পবিত্র, সত্যের উপলব্ধি তাঁর কাছে এমনই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। খাদীজা (রাঃ) যথাসাধ্য সান্ত¡না দিলেন। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মানবতার কল্যাণে কাজ করা একটি মহৎ গুণ ও ইবাদত। সে সাথে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার মাধ্যম। অপর দিকে মানুষের প্রতি জুলুম করা হারাম এবং ধ্বংসের কারণ। বিপদে কেউ তার সাহায্যকারী হবে না। এরপর খাদীজা (রাঃ) মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে প্রবীণ খৃষ্টান ধর্মবেত্তা অরাকা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। অরাকা ছিলেন খাদীজা (রাঃ) এর চাচাতো ভাই। তিনি খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আসমানী কিতাবের জ্ঞানে সুপন্ডিত ছিলেন। বিশেষত: তাওরাত ও ইন্জীল বিশ্বাসীদের নিকট থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। খাদীজা রাসূল (সা.) এর দেখা ও শুনা সমস্ত ঘটনা তাঁর কাছে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন। সব শুনে অরাকা বলে উঠলেন, “কুদ্দুসুন কুদ্দুসুন” মহা পবিত্র ফেরেশ্তা! মহা পবিত্র ফেরেশ্তা!। আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে খাদীজা, তুমি বিশ্বাস কর, মুহাম্মদের নিকট সেই মহান দূতই এসেছেন যিনি মূসার নিকট আসতেন।
বস্তুতঃ মুহাম্মদ বর্তমান মানব জাতির জন্য নবী মনোনীত হয়েছেন। তাঁকে বল, তিনি যেন অবিচল থাকেন।” তিনি আরো বললেন, হায়! তোমার বংশের লোকেরা যখন তোমাকে বের করে দেবে, তখন পর্যন্ত যদি আমি জীবিত থাকতাম!’ মুহাম্মাদ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বংশের লোকেরা কী আমাকে বের করে দেবে? অরাকা বললেনঃ ‘তুমি যা কিছু নিয়ে এসেছো তা নিয়ে ইতিপূর্বে যে-ই এসেছে, তার বংশের লোকেরা তাঁর সঙ্গে দুশমনী করেছে। তুমি এটাও নিশ্চিত জেনে রেখো যে, তোমার বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে, নির্যাতন করা হবে। তোমার বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে। আমি যদি তখন পর্যন্ত জীবিত থাকি, তাহলে অবশ্যই আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় প্রকাশ্যভাবে সাহায্য করবো।” এর কিছু দিন পরই অরাকার মৃত্যু ঘটে। শিক্ষনীয় বিষয় হলো অরাকা নিশ্চিত জানেন যে, হক পন্থিদের ওপর বাতেলের পক্ষ থেকে জুলুম নির্যাতনের ষ্টীম রোলার নেমে আসে, হক কে ময়দান থেকে মুছে ফেলার জন্যে। তা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে শামীল করার আশা ব্যক্ত করলেন, এর কারণ কী? কেনইবা তিনি জেনে শুনে এ বিপদের পথে ঝুঁকি নিতে চাইলেন? এর কারণ হচ্ছে, জীবনে প্রকৃত সফলতা অর্জনের একমাত্র পথই হলো আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ। আর এ পথে জান ও মালের ঝুঁকি থাকবে এটাই আল্লাহর পরীক্ষা। যারা বুঝে শুনে ঈমানের সাথে এ পথে অংশগ্রহণ করবে তারাই সফলতা অর্জন করবে। দ্বিতীয়ত: এমন কোন নবী ও রাসূল আসেননী যাদের সাথে শক্রতা করা হয়নী। প্রত্যেক যুগেই একদল লোক নবীদের প্রতি জুলুম নির্যাতন করেছে। সে সাথে যারাই নবীদেরকে সঠিকভাবে অনুসরণ করেছেন তাদের উপরও চলতো জুলুম নির্যাতন, যা এখনো অব্যাহত আছে এবং কিয়ামতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
ওহীর বিরতি: প্রথম ওহী নাযিলের পর কিছুদিন ওহী বন্ধ থাকে। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) যথারীতি হেরা-গুহায় যেতে থাকলেন। এ অবস্থা অন্তত ছয়মাস চলতে থাকলো। বিষয়টি একদিকে তাঁর জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে উঠলো। অপরদিকে এ বিরতির ফলে কিছুটা উপকার ও হলো। মানবীয় প্রকৃতির দরুণ তাঁর অন্তঃকরণে এখন ওহী নাযিলের প্রেরণা সঞ্চারিত হলো। এ অবস্থা কিছুটা বিলম্বিত হলে তাঁকে সান্ত¡না দেবার জন্যে জিবরীলের আগমন শুরু হলো। জিবরীল তাঁর কাছে সূরা “আদ্ দুহা” নিয়ে আবির্ভূত হলেন। যে মহান প্রতিপালক তাঁকে নবুওয়াত দ্বারা সম্মানিত করেছেন তিনি ঐ সূরাতে শপথ করে বলেছেন যে, তিনি তাঁকে ত্যাগ করেননি এবং তাঁর প্রতি বৈরীও হননি। মহান আল্লাহ বলেন, “ উজ্জ্বল দিনের কসম এবং রাতের কসম যখন তা নিঝুম হয়ে যায়। তোমার রব তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও হননি। অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, আর তোমার প্রতি শত্রুতা পোষণ করার পর পূণরায় ভালো বেসেছেন এমনও হয়নি। নিঃসন্দেহে তোমার জন্য পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো। অর্থাৎ আমার নিকট তোমার প্রত্যাবর্তনের পর তোমার জন্য যা প্রস্তুত করে রেখেছি তা দুনিয়াতে তোমাকে যা দিয়েছি তার চেয়ে উত্তম। আর শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এত দেবেন যে, তুমি খুশী হয়ে যাবে। অর্থাৎ দুনিয়ায় সাফল্য ও বিজয় এবং আখিরাতে প্রতিদান। তিনি কী তোমাকে এতিম হিসেবে পাননি? তারপর তোমাকে আশ্রয় দেননি? তিনি তোমাকে পথ না পাওয়া অবস্থায় পান, তারপর তিনিই পথ দেখান। তিনি তোমাকে নিঃস্ব অবস্থায় পান, তারপর তোমাকে ধনী করেন। এ আয়াত ক‘টিতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রথম জীবনে প্রাপ্ত সম্মান এবং তাঁর মাতৃ-পিতৃহীন, সহায় সম্বলহীন ও দিশেহারা অবস্থায় আল্লাহ তাঁর প্রতি যে করুণা ও অনুকম্পা দেখিয়েছেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাঁকে যে শোচনীয় দুরাবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কাজেই তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না এবং সাহায্য প্রার্থীকে তিরস্কার করো না। অর্থাৎ আল্লাহর দূর্বল বান্দাদের ওপর ঔদ্ধত্য ও অহংকার প্রদর্শন করোনা এবং নিষ্ঠুর ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করোনা। আর তোমার প্রতিপালকের দেয়া নিয়ামতের কথা প্রচার করো।” অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে নবুওয়াত প্রাপ্তির মাধ্যমে যে অতুলনীয় সম্পদ ও অনুপম মর্যাদা তুমি লাভ করেছ, তার কথা মানুষকে জানাও ও তাদেরকে সেদিকে দাওয়াত দাও। এরপর রাসূল (সা.) অতি গোপনে তাঁর নিকটতম লোকদের মধ্য হতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে প্রচারে আত্মনিয়োগ করলেন। আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দান করে স্বয়ং তাঁর ওপর ও সমগ্র মানব জাতির ওপর যে মহা অনুগ্রহ করেছেন তার কথা ব্যক্ত করতে লাগলেন।
মাক্কী জীবনের চার স্তর: নবুওয়াত ও রিসালাত প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ পাক রাসূল (সা.)-এর ওপর এক বিরাট দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিলেন। এখান থেকে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের সংগ্রামী পর্যায় শুরু হলো। এ পর্যায়কে ঐতিহাসিকগণ দু‘টি বড়ো -বড়ো অংশে ভাগ করেছেন। হিজরতের পূর্বে মক্কায় অতিবাহিত অংশ; যাকে বলা হয় মাক্কী পর্যায়। আর হিজরতের পর মদীনায় অতিক্রান্ত অংশ; একে বলা হয় মাদানী পর্যায়। প্রথম পর্যায় ১৩ বছর এবং দ্বিতীয় পর্যায় প্রায় ১০ বছরকাল ছিলো। মক্কী পর্যায় মুহাম্মদ (সঃ)-এর সংগ্রামী জীবনের নিজস্ব পরিণতির দিক দিয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে এই পর্যায়েই ইসলামের ক্ষেত্র কর্ষিত হয়। এ পর্যায়ে মাবনবতার এমন সব উন্নত নমুনা তৈরী হয়, যাদের কল্যাণে উত্তরকালে ইসলামী আন্দোলন সারা দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ পর্যায়ের গুরুত্ব এবং এর শিক্ষামূলক ঘটনাবলী অনুধাবন করতে হলে কুরআনের মাক্কী অংশ গভীরভাবে অধ্যয়ন করা দরকার। প্রকৃতপক্ষে এ পর্যায়ের সঠিক গুরুত্ব ঠিক তখন উপলব্ধি করা সম্ভব, যখন মাক্কী সূরাসমূহের প্রকাশ-ভঙ্গী, তখনকার পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর বর্ণনা, তাওহীদ ও আখিরাতের প্রমাণাদি, জীবন ও চরিত্র গঠনের নির্দেশাবলী এবং হক ও বাতিলের চরম সংঘাতকালে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে মুষ্টিমেয় কর্মিদের আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনার বিবরণ সামনে আসবে। হিজরতের পূর্বে মুহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গীদের জন্যে অত্যন্ত কঠিন সংকটকাল ছিলো। (চলবে)