মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচান

মুহাম্মাদ রাসূল

মুহাম্মাদ রাসূল

পূর্বে প্রকাশিতের পর

আবিসিনিয়ায় হিজরত
প্রতিটি বিপদ মুসিবতেরই একটা সহ্য সীমা থাকে। ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহীরা কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছিল, এবং তাতে তারা ধৈর্যের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তা অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু যুলুম নির্যাতনের বিরতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলনা। বরং ক্রমেই তা জোরদার হচ্ছিল। রাসূল (সাঃ) তাঁর সঙ্গীদের দুরবস্থা দেখে মর্মাহত হতেন। কিন্তু তাঁর কিছুই করার ক্ষমতা ছিলনা। তাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল আল্লাহর প্রতি আস্থা, আখেরাতে অবিচল ঈমান, সত্যের চূড়ান্ত বিজয়ের দৃঢ় আশা এবং আবেগভরা দোয়া। রাসূল (সাঃ) তাঁর সাথীদের এই বলে আশ্বাস দিতেন যে, আল্লাহ কোন না কোন পথ অবশ্যই বের করবেন। বাহ্যত মক্কার পরিবেশ হতাশাব্যঞ্জক হয়ে উঠছিল এবং এমন কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না যে, ঐ অনুর্বর ভূমিতে ইসলামী আন্দোলনের পবিত্র বৃক্ষে কোন ফল জন্মাবে। পরিস্থিতি দেখে স্পষ্টতই মনে হচ্ছিল, মক্কায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের সম্ভাবনা নেই, এ সৌভাগ্য হয়তো অন্য কোন ভূখন্ডের কপালে লেখা রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে আগেও হিজরতের অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই অনুমিত হচ্ছিল যে, রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদেরকেও হয়তো মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট অনুমতি বা নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত দাওয়াতের কেন্দ্রীয় ভূমিকে পরিত্যাগ করা নবীদের নীতি নয়। তা সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) যুলুম ও ধৈর্যের সঙ্ঘাতকে এমন এক পর্যায়ের দিকে ধাবমান হতে দেখছিলেন, যেখানে সহনশীলতার মানবীয় ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। মুসলমানগণ ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছিলেন আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে। এরূপ পরিস্থিতে তিনি সাহাবীদের পরামর্শ দিলেন কিছু মুসলমানকে হিজরত করে আবিসিনিয়ায় যেতে হবে। আবিসিনিয়া আফ্রিকার পূর্ব উপকুলবর্তী একটি দেশ। এখানকার বাদশাহ নাজ্জাশী ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচারক খৃষ্টান। এই হিজরতের উদ্দেশ্য ছিলো অবস্থা অনুকুল না হওয়া পর্যন্ত কিছুসংখ্যক মুসলমান অন্তত কুরাইশদের জোর-যুলুম থেকে রেহাই পাবে এবং ইসলামের দাওয়াত দূর এলাকায় বিস্তৃত হবার সুযোগ পাবে। সুতরাং নবুয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে প্রথম দফায় এগারো জন পুরুষ ও চার জন মহিলা হযরত উসমান বিন আফফানের নেতৃত্বে রাতের অন্ধকারে আবিসিনিয়া অভিমুখে রওনা হলেন। হযরত উসমানের সাথে তাঁর মহীয়সী স্ত্রী, রাসূল (সঃ)-এর কন্যা রুকাইয়াও হিজরতের এই প্রথম সফরে সঙ্গিনী হন। এই কাফেলার গৃহত্যাগের খবর যখন কোরাইশরা জানতে পারলো, তৎখণাত তারা তাদের পিছু ধাওয়া করতে লোক পাঠালো। কিন্তু তারা জেদ্দা বন্দরে পৌঁছে জানতে পারলো, তাৎক্ষণিকভাবে নৌকা পেয়ে যাওয়ায় তারা এখন নাগালের বাইরে। এরপর আরেকটা বড় কাফেলা আবিসিনিয়ায় হিজরত করলো। এ কাফেলায় ৮৫ জন পুরুষ ও ১৭ জন মহিলা ছিল। আবিসিনিয়ায় তারা নিরাপদ পরিবেশ পেলেন এবং নিশ্চিন্তে ইসলামী জীবন যাপন করতে লাগলেন। এ খবর কুরাইশদের কাছে পৌঁছলে তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, আবিসিনিয়ায় লোক পাঠিয়ে মুসলমানদের ফিরত আনার জন্য বাদশাহ নাজ্জাশীকে বলতে হবে যে, এ লোকগুলো আমাদের দেশ থেকে পলাতক অপরাধী, এদেরকে আপনার দেশ থেকে বের করে দিন। আব্দুল্লাহ বিন রাবিয়া ও আমর বিন আসকে এ কাজের জন্যে মনোনীত করলো। তারা নাজ্জাশীর দরবারে গিয়ে বললো এরা আমাদের দেশ থেকে পলাতক অপরাধী; এদেরকে আমাদের হাতে প্রত্যর্পণ করুন। এবার লক্ষ্য করুন, ইসলামের শক্রুদের আক্রোশ কত সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে।
মুহাজিরদের ফিরিয়ে আনার জন্য আবিসিনিয়ায় কুরাইশদের দূত প্রেরণ:
আবিসিনিয়ায় মুসলমানরা বেশ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে লাগলেন। কিন্তু কুরাইশদের তা মোটেই ভালো লাগলোনা। তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, নাজ্জাশীর নিকট দু‘জন যোগ্য দূত পাঠাবে, সাথে দেয়া হবে বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা আবদুল্লাহ বিন রাবিয়া ও আমর বিন আসকে বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন দিয়ে পাঠালো এবং তাদের করণীয় কাজ তাদেরকে বুঝিয়ে দিলো। তারা তাদেরকে বুঝিয়ে দিলো, “মুহাজিরদের’ সম্পর্কে নাজ্জাশীর সাথে কথা বলার আগে তোমরা প্রত্যেক দরবারী, উপদেষ্টা ও রাজ কর্মচারীকে উপঢৌকন দেবে। অতঃপর নাজ্জাশীকে উপঢৌকন দিয়ে অনুরোধ করবে, তিনি যেন “মুহাজির’দেরকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করেন এবং সমর্পণ করার আগে নাজ্জাশী যেন মুহাজিরদের সাথে কোন কথা না বলেন সে দিকে খেয়াল রাখবে। এ উদ্দেশ্যেই উপঢৌকন (ঘুষ) ও গোপন যোগসাজশের পথ অবলম্বন করা হয়। কারণ, মুসলমানদের সাথে কথা বললে তাদের প্রতি তিনি সদয় হবেন এবং আমাদের অবস্থা জেনে ফেলবেন।” তারা অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে রওয়ানা করলো এবং নাজ্জাশীর দরবারে এসে উপস্থিত হলো। নাজ্জাশীর সাথে কথাবার্তা বলার আগে তারা নাজ্জাশীর প্রতিটি উপদেষ্টা, দরবারী ও রাজ কর্মচারীদের সাথে আঁতাত করে তাদের উপঢৌকন (ঘুষ) দিলো। (এটা ছিলো বিবেক ধোলাইর একটা কৌশল, যা আজও প্রয়োগ করা হচ্ছে মুসলিম দেশ গুলোর এক শ্রেণীর উপদেষ্টা, আমলা, মন্ত্রী ও সুশীলদের (?)ক্ষেত্রে। বিদেশীরা মগজ ধোলাইর মাধ্যমে এ সকল চাটুকারদের দ্বারা দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে)। উপঢৌকন দেয়ার পর তাদের প্রত্যেককে তারা বললো “ আমাদের দেশ থেকে কতগুলো বেকুব যুবক বাদশাহর রাজ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা নিজ জাতির ধর্ম ত্যাগ করেছে অথচ আপনাদের ধর্মও গ্রহণ করেনি। তারা এক নতুন উদ্ভট ধর্ম তৈরী করেছে। সে ধর্ম আপনাদের ও আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। জাতির সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত লোকেরা আমাদেরকে বাদশাহর কাছে পাঠিয়েছেন যেন তিনি ওদেরকে ওদের স্ব জাতির কাছে ফেরত পাঠান। আমরা যখন বাদশাহর সাথে কথা বলবো তখন আপনারা বাদশাহকে ওদের ফেরত পাঠাতে ও ওদের সাথে কোন কথা না বলতে পরামর্শ দেবেন। কেননা তাদের দোষত্র“টি সম্পর্কে তাদের জাতিই সবচেয়ে ভাল জানে। তারা চেষ্টা চালিয়েছিল যাতে দরবারে পুরো ঘটনা নিয়ে আলোচনাই না হতে পারে, মুহাজেররা আদৌ কথা বলারই সুযোগ না পায় এবং রাজা কুরাইশ দূত দ্বয়ের এক তরফা কথা শুনেই যেন মুহাজিরদেরকে তাদের হাতে সমর্পণ করে। দরবারীরা সবাই এতে সম্মতি জানালো। এরপর তারা নাজ্জাশীকে উপঢৌকন দিয়ে তাদের দাবী-দাওয়া পেশ করলো। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজদরবারীরাও তাদের দাবীর প্রতি সমর্থন জানালো। কিন্তু এতে নাজ্জাশী ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি বললেন, “না, এ পরিস্থিতিতে আমি তাদেরকে এই দূত দ্বয়ের হাতে সমর্পণ করবো না। এক দল লোক আমার দেশে অতিথি হয়েছে। তারা অন্য কোথাও না গিয়ে আমার কাছে আসাকে ভাল মনে করেছে। তাই আমি মুসলমানদের বক্তব্য শুনে ভাল-মন্দ বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত দিবো। তিনি মুসলমানদের সাথে কথা বলতে চাইলেন। (চলবে)

Related Post