মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচনা

মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচনা

মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচনা

পূর্বে প্রকাশিতের পর 
মক্কার বাইরে ইসলামের আলো
ইসলামের আলো যেমন আরবের বিভিন্ন দূর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিলো, তেমনি সে আওয়াজ মদীনায় গিয়েও উপনীত হলো। মদীনায় তখন বেশ কিছু ইহুদী জনবসতি ছিলো। তারা বহু প্রাচীনকাল থেকে সেখানে এসে বসবাস করতো। তারা মদীনার আশপাশে ছোট ছোট দুর্গ বানিয়ে নিয়েছিলো। এছাড়াও সেখানে ছিলো বড় বড় দু’টি গোত্র। আওস ও খাজরাজ নামে মদীনায় দুই ভাই ছিলো। এদের আদি নিবাস ছিলো ইয়ামেন; কোন এক সময় মদীনায় এসে বসবাস শুরু করে। এদেরই সন্তান-সন্ততি থেকে সেখানে ‘আাওস’ ও ‘খাজরাজ’ নামে দু‘টি বড়ো খান্দান গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এরাই ‘আনসার’ উপাধিতে ভূষিত হয়। ধর্ম-বিশ্বাসের দিক দিয়ে এরাও মূর্তিপূজক ছিলো, কিন্তু ইহুদীদের সাথে মেলামেশার ফলে অহী, নবুয়্যত, আসমানী কিতাব এবং আখিরাত সম্পর্কিত আকীদা-বিশ্বাসের সঙ্গেও অনেকটা পরিচিত ছিলো। যেহেতু এদের নিজেদের কাছেই এ ধরনের কোনো জিনিস বর্তমান ছিলো না, এজন্যে ধর্মীয় ব্যাপারে এরা কিছুটা প্রভাবিত ছিলো। তাদের কথার ওপর এরা যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করতো। এরা ইহুদী আলেমদের কাছ থেকে এ-ও জানতে পেরেছিলো যে, দুনিয়ায় আরো একজন পয়গম্বর আসবেন। যারা তাঁর অনুসরণ করবে, তারাই সফলকাম হবে। এমনকি এ নবীর অনুসারীরাই সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। হজ্ব উপলক্ষে মক্কায় আগত গোত্র প্রধানদের কাছে গমন করে তাদেরকে ইসলামে শামিল হবার আহবান জানানো রাসূল (সাঃ)-এর একটা নিয়ম ছিলো। নবুয়্যতের দশম বছরের কোন এক সময়ে রাসূল (সাঃ) মক্কার দূরবর্তী এলাকা ‘আকাবা’ নামক স্থানে খাজরাজ বংশের কতিপয় লোকের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং তাদেরকে কুরআন মাজীদের কিছু আয়াত পড়ে শোনান। কুরআনের বাণী শুনে তারা প্রভাবিত হলো এবং বুঝতে পারলো: ইহুদী আলেমরা যে নবী আসার কথা বলে থাকে, ইনিই সেই নবী। তারা একে অপরের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, “ আল্লাহর শপথ, ইনিই তো সেই নবী যাঁর কথা বলে ইহুদীরা আমাদেরকে হুমকি দেয় ও শাসায়। এখন ইহুদীদেরকে কিছুতেই আমাদের আগে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে না।” এ চিন্তা করেই তারা ইসলাম কবুল করলো। তারা বললো, “আমরা আশা করি আল্লাহ আমাদের গোটা সম্প্রদায়কেই আপনার সমর্থক করে দিবেন। আমরা তাদের কাছে ফিরে গিয়ে আপনার দাওয়াত তাদের কাছেও পৌঁছে দিবো। আজ যে, জীবন ব্যবস্থাকে আমরা গ্রহণ করলাম সেটা তাদের কাছেও তুলে ধরবো। আল্লাহ যদি তাদেরকে আপনার সমর্থক বানিয়ে দেন তা হলে আপনার চেয়ে সম্মানিত আর কেউ থাকবে না।” এভাবে তারা ঈমান আনা ও ইসলামকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর নিজ এলাকায় ফিরে গেলেন। মদীনায় পৌঁছে তাঁরা রাসূল (সাঃ)-এর বক্তব্য, গোত্রের কাছে পেশ করলেন এবং তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। আর এভাবেই মদীনায় ইসলামের আলো প্রবেশ করলো। এদের দলে মোট ছয়জন সদস্য ছিলো। এভাবে মদীনার আনসারদের মধ্যে ইসলামের সূচনা হলো এবং সে জনপদটিই পরবর্তীকালে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছিলো।

বিরোধিতার তীব্রতা
যে কোন আন্দোলনের বিস্তৃতির সাথে সাথে বিরোধিতা এবং দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতও স্বভাবত বাড়তে থাকে, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের বিস্তৃতির সঙ্গে বিরোধিতা ও দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতের যে প্রচন্ডতা দেখা দেয়, তা তার অনুসারীদেরকে অধিকতর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়। দশম নববী সাল পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন যেমন ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করছিল, তেমনি সত্যের আহবায়ক এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কুরাইশ প্রধানগণ চূড়ান্তভাবে স্থির করলো যে, তারা খোদ মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ওপর এতোটা উৎপীড়ন চালাবে, যাতে তিনি নিজেই বাধ্য হয়ে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত হন। কুরাইশদের বড়ো বড়ো নেতারা ছিলো তাঁর প্রতিবেশী এবং এরাই ছিলো তাঁর সবচেয়ে বড় দুশমন। এরা যে কায়দায় তীব্রবিরোধীতা আর নির্যাতন করতো তার বর্ণনা পূর্বের কিছু অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা অশালীন ভাষায় গালি-গালাজ করতো। কোথাও তিনি বক্তৃতা শুরু করলে সভার মাঝখানে তারা গোলযোগের সৃষ্টি করতো এবং বলতো, এ সবই মিথ্যা কথা। মোটকথা, হয়রানি ও উৎপীড়নের যতো ন্যাক্কারজনক পন্থা ছিলো, তা সবই তারা ব্যবহার করছিলো। এ পর্যায়ে সকল প্রতিকুলতার মোকাবেলার জন্যে আল্লাহ তা‘য়ালা প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা মূলক অহী নাযিল করছিলেন। মুসলমানদের স্পষ্ট ভাষায় জানানো হলো যে, বর্তমানে সত্যের ওপর দৃশ্যত যে জুলুমের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে, তাকে কোন স্থায়ী ব্যাপার মনে করা উচিত নয়। দুনিয়ার জীবনে সত্যের পথে এ ধরনের বিপদ এসেই থাকে। তাছাড়া সফলতার আসল ক্ষেত্র এ দুনিয়ার জীবনে নয়, বরং পরকালীন জীবনে। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, যারা তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করে, পরকাল তাদের জন্যেই উত্তম। আর রাসূল (সাঃ)-কে বলা হলো “আমি জানি তোমার সাথে যা কিছু করা হচ্ছে তা খুবই বেদনাদায়ক। এরূপ ব্যবহার পূর্বের নবী রাসূলদের সাথেও করা হয়েছে। তাঁরা ধৈর্য ও সংযমের সাথে পরিস্থিতির মোকাবালা করেছেন এবং আমার সাহায্য না পৌঁছা পর্যন্ত সব দুঃখ-মুছিবত হাসিমুখে সহ্য করেছেন। তুমিও এমনি পরিস্থিতি অতিক্রম করছো।” সাহাবায়ে কিরামকে বার বার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘য়ালার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, যাকে বদলে দেয়ার সাধ্য কারো নেই। ঈমানের দাবী পুরনে কে সত্য আর কে অপারগ সেটা যাচাই করে সবাইকে দেখিয়ে দেয়াই আল্লাহর এ কৌশল। সে নিয়ম অনুসারে হকপন্থীদেরকে এক সুদীর্ঘকালব্যাপী যাচাই করা এবং তাদের ধৈর্য, সততা, আত্মত্যাগ, আনুগত্য, আত্মসমর্পণ ও ঈমানী দৃঢ়তার পরীক্ষা নেয়া একান্ত অপরিহার্য। সেই সাথে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা এবং তাঁর প্রতি ঈমানের ব্যাপারে তারা কতখানি মজবুত তা-ও নিরূপণ করা প্রয়োজন। কারণ এরূপ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমে তাদের মধ্যে এমন সব গুণাবলীর সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীকালে আল্লাহর দ্বীনের খাঁটি অনুবর্তী হবার পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক হয়ে থাকে। আর লোকেরা যখন এরূপ পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য প্রতিপন্ন হয়, কেবল তখনই আল্লাহর সাহায্যে বিজয় আসে।
আকাবার প্রথম বাই‘য়াত
বাই‘য়াত (শপথ, অঙ্গীকার) ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সাঃ)-এর নিকট বাই‘য়াত হয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর নিকট বাই‘য়াত হয়েছেন। মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনের পরিচালনার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত হয়েছে তার নিকট বাই‘য়াত হওয়ার এ পদ্ধতি ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং বিষয়টি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবুয়্যতের একাদ্বশ বছর মদীনার বারোজন অধিবাসী আকাবা নামক স্থানে রাসূল (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলেন। তারা রাসূল (সাঃ)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ পূর্বক অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিত্যাগ করার উদ্দেশ্যে রাসূলের হাতে হাত দিয়ে আনুগত্যের (বাই‘য়াত) অঙ্গীকার করলেন। উবাদা ইবনে ছামিত (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, “আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবো না, চুরী-ডাকাতি করবো না, ব্যভিচার করবো না, সন্তান হত্যা করবো না, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ (গীবত) রটাবো না এবং রাসূল (সাঃ)-এর দেয়া ন্যায় সঙ্গত আদেশ কখনো অমান্য করবো না।” রাসূল (সাঃ) বললেন, “এসব অঙ্গীকার পূরণ করলে তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।” মদীনার এই দলটি যখন নিজ সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল, তখন রাসূল (সাঃ) তাদের সাথে মুসয়াব ইবনে উমায়েরকে পাঠিয়ে দিলেন তাদেরকে কুরআন পড়ানো, ইসলাম শিক্ষা দেয়া ও ইসলামী বিধানের তত্ত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। তিনি মদীনার শিক্ষক রূপে অভিহিত হতেন। তিনি মদীনার ঘরে ঘরে গিয়ে লোকদেরকে কুরআন পড়ে শোনাতেন এবং ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। এভাবে দু-একজন করে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। ক্রমান্বয়ে মদীনার বাইরেও ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। (চলবে…)

Related Post