মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচান

রাসূলের জীবন মক্কী জীবনী

বক্ষমান প্রবন্ধে, রাসূলের জীবন মক্কী জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

পূর্বে প্রকাশিতের পর
তৃতীয় স্তর ঃ ঈমানের পরীক্ষা
ইসলামের শত্রুরা চিরকালই উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে অসৎ এবং যুক্তির দিক দিয়ে অসার ও দেউলে হয়ে থাকে। তাদের আসল সমস্যা হয়ে থাকে স্বার্থপরতা ও গদির নেশা। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কেউ ময়দানে নামলেই তারা সর্বশক্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং যুক্তি-প্রমাণের জবাব দেয় সহিংসতা সন্ত্রাস ও গুণ্ডামী দিয়ে। ইসলামী আন্দোলন মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির বলে কাজ করে। কিন্তু ইসলাম বিরোধীরা ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আবেগ উত্তেজনা দিয়ে এর গতি রোধে সচেষ্ট হয়। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য কোন শক্তি যদি সামান্যতম তৎপরতাও চালায়, তবে তাকে সমাজ ব্যবস্থার ধারক-বাহকদের হাতে মার খেতে হয়। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত যে সুদূর প্রসারী ও সর্বাত্মক পরিবর্তনের আহবান জানায়, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রচলিত রাষ্ট্র ও সমাজের কর্ণধাররা এক ধরনের তীব্র উন্মত্ততায় ভোগে। মক্কায় এই অবস্থাটাই দেখা দিয়েছিল। যদিও প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনার সাথে সাথেই সহিংসতাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে জাহেলিয়াতের হিংস্রতা ও মুসলিম নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাঁচ ছয় বছরের মধ্যেই মক্কায় ইসলাম গ্রহণকারীদের জন্য একটা জ্বলন্ত চুলোয় পরিণত হলো। হযরত খাদীজা ও জনাব আবু তালেবের ইন্তিকালের পর এই চুলোর দহনশক্তি আরো তীব্র ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। কম হোক, বেশি হোক, এই চুলোয় দগ্ধ হওয়া থেকে কেউ রেহাই পায়নি। এই চুলোয় দগ্ধ হয়ে তপ্ত হয়ে ও গলে গলে তাঁরা খাঁটি সোনায় পরিণত হন। এ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের কাজ যেটুকু অগ্রসর হয়েছিলো, তার প্রতিক্রিয়া তিন ভাবে প্রকাশ পেলোঃ

(১) কিছু সৎ ও ভালো লোক ইসলামকে কবুল করলো। তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ইসলামী আন্দোলনকে যে কোন মূল্যে এগিয়ে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলো।

(২) অজ্ঞতা, ব্যক্তি স্বার্থ কিংবা বাপ-দাদার অনুসৃত ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসহেতু বহু লোক এ আন্দোলনের বিরোধিতার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

(৩) মক্কা ও কুরাইশদের গণ্ডী অতিক্রম করে এ আন্দোলন অপেক্ষাকৃত বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে এই নতুন আন্দোলন এবং পুরনো জাহিলিয়াতের মধ্যে এক কঠিন দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত শুরু হলো। রাসূলসহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামের ওপর পরিচালিত হতে লাগলো ভয়ঙ্কর নির্যাতন যার ইতিহাস আমরা খুব কমই জানতে পারি। ইসলামের দুশমনদের পরিচালিত এই নির্যাতনের যৎসামান্য তুলে ধরা হলো। নির্যাতন চালানো হতো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে। ইসলাম গ্রহণকারী যদি ভালো পদমর্যাদাধারী ব্যক্তি হতো তাহলেও তাঁকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতো এবং বলতো, তুমি তোমার বাপের ধর্ম ত্যাগ করেছ। কাজেই আমরা তোমাকে বেকুফ প্রতিপন্ন করবো, তোমার মতামত যে খারাপ ও ভুল, তা আমরা প্রমাণ করে ছাড়বো, তোমার মান-সম্মান ভূ-লণ্ঠিত করে তবে ক্ষান্ত হবো। আর যদি তিনি ব্যবসায়ী হতেন  তবে তাঁকে বলতো, আমরা তোমার ব্যবসায়ের সর্বনাশ ঘটাবো এবং তোমার মালপত্র নষ্ট করে দেবো। আর যদি দুর্বল কেউ হতো তাহলেতো আর কথাই নেই, নির্যাতনের সীমা ছাড়িয়ে যেত। বস্তুত কুরাইশদের এ পর্যায়ের যুলুম-নিপিড়নের ঘটনাবলী ছিলো খুবই নির্মম ও হৃদয়বিদারক। যেমন, হযরত খাব্বাব (রা.) উম্মে আম্মারের গোলাম ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে কুরাইশরা তাঁকে মাটির ওপর কয়লা জ্বালিয়ে তার ওপর তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিত এবং তিনি যাতে নড়াচড়া করতে না পারেন, সেজন্যে এক ব্যক্তি তাকে পা দিয়ে সজোরে চেপে ধরতো। শেষ পর্যন্ত পিঠের নিচেই জ্বলন্ত কয়লা নিভে ঠাণ্ডা হয়ে যেত। পরবর্তীকালে খাব্বাব (রা.) হযরত ওমর (রা.) কে একবার নিজের পিঠ দেখালে তিনি কুষ্ঠের ন্যায় সাদা সাদা দাগ দেখতে পান।
কৃষ্ণাঙ্গ হযরত বিলাল (রা.) ছিলেন উমাইয়া বিন খালফের ক্রীতদাস। উমাইয়া তাঁকে দুপুরে উত্তপ্ত মরুভূমির বালুর ওপর তাকে শুইয়ে দিতো এবং বুকের ওপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে বলতো, ইসলামকে অস্বীকার কর, নচেত এভাবেই ধুঁকে ধুঁকে মরে যাবি। কিন্তু সেই নিদারূণ কষ্টের মধ্যেও তাঁর মুখে শুধু ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ (আল্লাহ এক আল্লাহ এক) শব্দ উচ্চারিত হতো। উমাইয়া তাঁর গলায় রশি বেঁধে শিশু-কিশোরদের হাতে দিতো। ওরা তাঁকে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে টেনে নিয়ে যেতো।
হযরত ওমর (রা.)-এর পরিবারে লুবানিয়া নামে একজন বাঁদী ছিল। মুসলমান হবার আগে ওমর (রা.) তাঁকে এত মারধোর করতেন যে, তিনি নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু এ মুসলিম মহিলা শুধু বলতেন, যদি ইসলাম গ্রহণ না করো তো আল্লাহ তোমার কাছ থেকে এর বদলা গ্রহণ করবেন। মোটকথা পুরুষ ও নারীদের মধ্যে এমন কেউ ছিল না যাকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়নি।  (যার ধারাবাহিকতা আজও চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে। তবে সেসময় নির্যাতন করতো কাফিররা, আর আজ তাদের সাথে যোগ দিয়েছে কতিপয় নামধারী মুসলমান। যারা সামনের কাতারে থেকেই নির্যাতনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা কি জানে কি আগুন নিয়ে খেলা করছে তারা?)। সে সময়ের  যুলুম-নিপীড়ন একজন মুসলমানকেও ইসলাম ত্যাগে সম্মত করাতে পারেনি। আজও নির্যাতন যতই করা হোক ইসলামের গতিরোধ করা সম্ভব নয়। এইসব বেকসুর ও নিরপরাধ মুসলমানদের ওপর যখন যুলুম-পীড়ন চলছিলো, তখন লোকেরা স্বভাবতই তাদের প্রতি কৌতহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে লাগলো। তারা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো-এত মুসিবত সত্ত্বেও এই লোকগুলো কিসের মোহে ইসলামকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে? কোন্ প্রলোভনের হাতছানি এদেরকে এতখানি কষ্ট-সহিঞ্চু করে তুলেছে? একথা সবাই জানতো যে, নৈতিক চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং মানবীয় গুণাবলীর দিক দিয়ে এরা নিঃসন্দেহে উত্তম মানুষ। এদের অপরাধ শুধু এই যে, এরা  আল্লাহর হুকুম পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করতে চায়। অব্যাহত যুলুম-পীড়ন সত্ত্বেও নও-মুসলিমদের এহেন দৃঢ়তাব্যঞ্জক উক্তি অনেক লোকের সামনেই প্রশ্নের সৃষ্টি হলো এবং তাদের হৃদয়-মনে নম্রতার সৃষ্টি হলো। তারা এই নতুন আন্দোলনকে নিকট থেকে দেখবার ও বুঝবার জন্যে আগ্রহান্বিত হলো। সত্যাশ্রয়ী ও ন্যায়নিষ্ঠদের ওপর যুলুম-পীড়ন চিরকালই সত্যের কামিয়াবীর পক্ষে সহায়ক হয়ে থাকে। তাই একদিকে যেমন কুরাইশদের অত্যাচার বেড়ে চলছিলো, অন্যদিকে তেমনি ইসলামী আন্দোলনের পরিধিও সম্প্রসারিত হতে লাগলো। এমনকি গোটা পরিবার বা খান্দানের কোনো একটি লোক ইসলাম কবুল করেনি-মক্কায় এমন কোনো খান্দান বা পরিবারই আর রইলো না। একারণেই তারা ইসলামের বিরুদ্ধে আরো বেশি ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তারা দেখতে লাগলো ; তাদেরই আপন ভাই-ভাতিজা, বোন-ভগ্নিপতি, পুত্র-কন্যা ইসলামের ছায়াতলে সমবেত হচ্ছে এবং ইসলামের জন্যে সবকিছু ত্যাগ করে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। তাদের কাছে এটা ছিলো অত্যন্ত কঠিন ও দুঃসহ আঘাতের শামিল। অপরদিকে যারা এ আন্দোলনে যোগ দিলো, তাদের নৈতিক চরিত্র এবং সাধারণ মানবীয় গুণাবলী সবার কাছেই স্পষ্ট ও সুবিদিত ছিলো। এ অবস্থায় সাধারণ লোকেরা হতবাক হয়ে ভাবলোঃ ইসলামী আন্দোলনে এমন কী আকর্ষণ রয়েছে, যা লোকদেরকে এরূপ আত্মোৎসর্গের জন্যে অনুপ্রাণিত করছে? তাছাড়া লোকেরা এ-ও দেখতে লাগলো যে, ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করার পর এসব লোক অধিকতর ন্যায়ানুগ, সত্যবাদী, চরিত্রবান এবং আচার-ব্যবহারে উত্তম ও পুত-পবিত্র মানুষে পরিণত হচ্ছে। ইসলামের আহবানে যে-ই একবার সাড়া দিত, তার ভেতরে সম্পূর্ণ নতুন একটা মানুষ জন্ম নিত এবং তার বুকে নতুন শক্তি সঞ্চারিত হতো। এসব বিষয় প্রতিটি দর্শকের মনে অনির্বচনীয় এক ভাবধারার সঞ্চার করতে লাগলো এবং এর ফলে ইসলামী দাওয়াতকে কবুল করুক আর না-ই করুক, তার শ্রেষ্ঠত্বকে তারা কিছুতেই উপলব্ধি না করে পারলো না। (চলবে-)

Related Post