Main Menu
أكاديمية سبيلي Sabeeli Academy

যাকাত কী ও কেন?

যাকাত কী ও কেন?

যাকাত কী ও কেন?

যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম। কোনো ব্যক্তি যখন কালেমা পড়ে ইসলামের সীমার মধ্যে দাখিল হয়, তখন থেকেই ইসলামের যাবতীয় বিধি-নির্দেশ মেনে চলা তার জন্যে অপরিহার্য। যাকাত আদায় করা সচ্ছল মুসলমানের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ। কোনো মুসলমানের স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে এ নির্দেশ অমান্য করার অর্থই হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে মুনাফেকি করা।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই যারা সত্যে বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তাদের প্রতিফল তাদের প্রতিপালকের কাছে সংরক্ষিত। তাদের কোনো ভয় বা পেরেশানি থাকবে না। (বাকারা : ২৭৭)
সূরা তওবার ৭১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর বিশ্বাসী নর হোক বা নারী, তারা একে অপরের সাথী। এরা পরস্পরকে সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করে আর পাপ-অন্যায় থেকে বিরত রাখে। তারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এরাই আল্লাহর রহমতের ছায়ায় থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে মানুষ তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করবে। নামাজ কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রোযা রাখবে, হজ্জ করবে আর সঙ্ঘবদ্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করবে, তাহলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
যাকাত শব্দের অর্থ: পবিত্র করা, পরিশুদ্ধ করা বা প্রবৃদ্ধি দান করা। শরিয়তের ভাষায়, সুনির্ধারিত সম্পদ সুনির্ধারিত শর্তে তার হকদারকে অর্পণ করা। এক কথায় কোনো মুসলমান আল্লাহ নির্ধারিত (নিসাব) পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে এবং তা এক বছর পর্যন্ত তার কাছে থাকলে তার নির্ধারিত পরিমাণ অংশ হকদারের কাছে পৌঁছে দেয়াকে যাকাত বলা হয়। সুনির্ধারিত অংশটি শরিয়তসম্মতভাবে আদায় না করলে গোটা সম্পদই মুমিনের জন্যে হারাম হয়ে যায়।
যাকাত একটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা:
২য় হিজরীতে যাকাত ফরজ হওয়ার পর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহানবী (সা.) যাকাত ব্যবস্থা চালু করেন। যাকাত আদায়ে যাকাতের নিসাব এবং খরচের খাত নির্ধারণ করে একে একটি সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলেন। হযরত মাআজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দান করে রাসূল (সা.) ঘোষণা দেন- তাদের জানিয়ে দাও যে, তাদের ধন-মালে আল্লাহ তায়ালা সদকা-যাকাত ফরজ করে দিয়েছেন যা তাদের ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে ও গরীব বা ফকিরদের মাঝে বণ্টন করা হবে। (বুখারী, মুসলিম)
এসব সুস্পষ্ট নির্দেশের আলোকেই ইসলামের প্রখ্যাত ভাষ্যকারগণ বলেছেন, যে লোক কোরআন ও সুন্নাহর সরাসরি নিন্দেশ অস্বীকার করবে, তার ফরজ হওয়াকে অমান্য করবে, সে নির্ঘাত কাফির বলে গণ্য হবে। (আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভীকৃত ইসলামের যাকাত বিধান, ১ম খ-, পৃ- ১০১)
যখন আপনি যাকাতদাতা
নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সাড়ে ৭ তোলা সোনা (৮৫ গ্রাম) বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপা (৫৯৫ গ্রাম) বা সমমানের নগদ অর্থ এক চান্দ্র বছর জমা থাকলে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কের ওপর যাকাত ফরজ হয়। এ বছর (২০১৫ সালে) রূপার বাজার দাম হিসাবে এর পরিমাণ হলো প্রায় ২৩ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে আরো জানতে পড়–ন নিচের পয়েন্টগুলো-
জমি, বাড়ি-ঘর, দালান, দোকান, কারখানা, যন্ত্রপাতি বা কাজের হাতিয়ার, অফিস ও ঘরের আসবাবপত্র-সরঞ্জামাদি, ব্যবহারিক যানবাহন ও চলাচলের পশু, নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহপালিত পশু-পাখি ইত্যাদির যাকাত হয় না।
সোনা বা রূপার তৈরি গয়না, তৈজসপত্র, ফার্নিচার ইত্যাদির ওপর নিসাব (নির্ধারিত) পরিমাণ যাকাত ফরজ; তা ব্যবহারে থাকুক বা না থাকুক। তবে গয়নার ক্রয়মূল্য নয়, বিক্রয়মূল্যের ওপর যাকাত দিতে হবে।
ব্যবসার মালের ওপরও যাকাত ফরজ, যদি এর মূল্য সাড়ে ৭ তোলা সোনা বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপার সমান হয়। এছাড়া খামারে পালিত গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মাছ, পোনা, নার্সারির বীজ, চারা, হাউজিং ব্যবসার জমি, প্লট, ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট বা প্রাপ্ত বাড়ি-ভাড়ার ওপরও যাকাত দিতে হবে।
ব্যবসার দেনা (যেমন বাকিতে মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয় করলে কিংবা বেতন/মজুরি, ভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস ইত্যাদি) পরিশোধিত না থাকলে সেই পরিমাণ অর্থ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।
দেশে প্রচলিত মুদ্রা (টাকা, পয়সা, নোট) ও বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার, পাউন্ড, দিনার, রিয়াল, দিরহাম) ইত্যাদি যেহেতু বিনিময়ের জন্যেই নির্দিষ্ট এবং সোনা-রূপার স্থানেই ব্যবহƒত; এর পরিমাণ সাড়ে ৫২ তোলা খাদহীন রূপার দামের সমান হলে যাকাত দিতে হবে। (শামী ও ১৩৮৫ হি. কায়রোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনের সিদ্ধান্ত, বায়্যিনাত, করাচি)
মুদ্রা ও গয়না ইত্যাদি যে সকল জিনিসে সোনা বা রূপার পরিমাণ অধিক সে সকল জিনিস সোনা বা রূপা হিসেবেই গণ্য। এতে ব্যবহƒত সোনা-রূপা থেকে খাদ বাদ দিয়ে যাকাত দেয়া কর্তব্য। (দুররে মুখতার ও শামী)
অন্যের কাছ থেকে পাওনা টাকার ওপর যাকাত ফরজ, যদি দেনাদার তা স্বীকার করে এবং আদায়ের অঙ্গীকার করে অথবা নিজের কাছে তা উসুলের উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ থাকে। (শামী)
প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা যখন উসুল হবে কেবল তখন থেকেই তার যাকাত দিতে হবে। (এমদাদুল ফতোয়া, ২য় খণ্ড- ৬৪৫ পৃ)
কোনো কারখানা বা কোম্পানিতে আপনার শেয়ার মূল্যের যাকাত দেয়া ফরজ। তবে এর যে অংশ কলকব্জা ইত্যাদি উপকরণ বাবদ খরচ হয়েছে তার যাকাত দিতে হবে না। (নেজামে যাকাত)
যাকাতযোগ্য বিভিন্ন প্রকারের সামগ্রী আছে (সোনা, রূপা, নগদ টাকা, পণ্যদ্রব্য বা শেয়ার ইত্যাদি) কিন্তু এককভাবে কোনোটিই যাকাতযোগ্য পরিমাণে নয়- এক্ষেত্রেও সব মিলিয়ে যদি নিসাব (নির্ধারিত) পরিমাণ হয় তাহলে যাকাত ফরজ হবে।
যাদের ২৮ মন ৫ সের ফসল হাতে আসবে, তাদেরকে ওশর বা এক দশমাংশ ফসল যাকাত হিসেবে দিতে হবে। যেসব জমি প্রাকৃতিক উপায়েই (বৃষ্টি, নদী-নালা বা খাল, ঝর্না ইত্যাদির পানিতে বা প্রকৃতিগতভাবে) সিক্ত ও চাষোপযোগী হয়ে থাকে, কেবল সেসব জমির ফসলের এক দশমাংশ যাকাত দিতে হবে। আর যে জমিতে কৃত্রিম উপায়ে (পশু বা যন্ত্র ব্যবহার করে; শ্রম বা মজুরির বিনিময়ে) পানি সেচ করতে হয়, সে জমির ফসলের বিশ ভাগের একভাগ যাকাত আদায় করতে হবে।
যাদের ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট বাবদ টাকা রয়েছে, তাদেরকেও নিসাব (নির্ধারিত) পরিমাণে পৌঁছলে যাকাত দিতে হবে।
ঋণের তুলনায় নগদ টাকা বেশি থাকলে ঋণ পরিশোধ করার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ বাদ দিয়ে বাকি টাকার ওপর যাকাত দিতে হবে।
যাকাতযোগ্য অলংকার রয়েছে কিন্তু নগদ অর্থ নেই, তাহলে যাকাত হিসেবে নির্ধারিত পরিমাণ অলংকার অথবা তা বিক্রি করে সেই অর্থ দিতে হবে।
কারো কাছে কাফফারা বা মানত আদায় অথবা হজ্জ আদায় করার টাকা আছে, যদি তা নিসাব (নির্ধারিত) পরিমাণ হয় তবে তাতে যাকাত ফরজ। এগুলো আল্লাহর দেনা, যা যাকাতের প্রতিবন্ধক নয়। (দূব-৬)
স্ত্রীর মোহরের জমাকৃত টাকা এবং কোরবানির জন্যে জমাকৃত টাকার ওপরেও যাকাত দিতে হবে।
সরকারকে ট্যাক্স বা আয়কর দেয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করলে তাতে যাকাত আদায় হবে না। কারণ সরকার তা যাকাত হিসেবে বা শরীয়ত নির্ধারিত খাতেও ব্যয় করে না। (কায়রো ওলামা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত)
শিল্প স্থাপন বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরও যদি যাকাতযোগ্য পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ থাকে তাহলে যাকাত দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি ব্যাংক থেকে ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা শুরু করলেন। এখন যদি আপনার কাছে যাকাতযোগ্য পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ জমা থাকে তাহলে ঋণ থাকা সত্ত্বেও আপনাকে যাকাত দিতে হবে, যেহেতু ঋণের বিপরীতে আপনার শিল্প বা ব্যবসা চালু রয়েছে।
নিয়ত না করে নিজের সকল সম্পদ দান করলেও যাকাত আদায় হবে না। তাই যাকাত ফরজ হয়েছে- এমন সব সম্পদের মূল্য হিসেব করে সর্বমোট মূল্যের শতকরা আড়াই ভাগ অর্থ যাকাত দিতে হবে।

Related Post