রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পরবর্তী অবস্থা

 রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পরবর্তী অবস্থা

রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পরবর্তী অবস্থা

রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের হৃদয়বিদারক এ শোক সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়লো। মদীনার জনগণ শোকে কাতর হয়ে গেলেন। সবার মনে ছেয়ে গেল শোকের কালো ছায়া। রাসূল (সা.) যেদিন পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, সেদিন ছিলো বিশ্ববাসীর জন্য মহা আনন্দ ও খুশীর দিন। আর তাঁর ইন্তেকালের দিন ছিলো বিশ্ববাসীর জন্য দুর্ভোগ ও শোকের দিন। হযরত ফাতেমা (রা.) শোকে কাতর হয়ে বলেছিলেন, “হায় আব্বাজান! যিনি আল্লাহর আহ্বানে লাব্বায়েক বলেছিলেন। হায় আব্বাজান, যাঁর ঠিকানা হচ্ছে জান্নাতুল ফেরদাউস। হায় আব্বাজান, আমি জিব্রিল (আ.)-কে আপনার ইন্তেকালের খবর জানাচ্ছি।”
মুয়ান ইবনে আদী (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, যেদিন রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকাল হয় সেদিন মুসলমানরা ব্যাপকভাবে কান্নাকাটি করছিলেন। সে সাথে তারা একথাও বলছিলেন যে, “রাসূল (সা.)-এর আগেই আমাদের মারা যাওয়া উচিত ছিল। তাঁর ইন্তেকালের পর আমাদের ঈমানের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।” কিন্তু একমাত্র মুয়ান ইবনে আদী বলছিলেন, “রাসূল (সা.)-এর আগে মারা যাওয়া আমি পছন্দ করিনা। কেননা আমি রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় যেমন তাঁর ওপর ঈমান এনেছি, তেমনি তাঁর ইন্তেকালের পরও আবার নতুন করে ঈমান আনার সুযোগ পেয়েছি।”
রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের খবর জানতে পেরে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “কতগুলো মুনাফেক বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসূল (সা.) মারা গেছেন। আল্লাহর কসম, তিনি মারা যাননি। তিনি কেবল মূসা (আ.)-এর মত সাময়িকভাবে আল্লাহর কাছে গেছেন। মূসা (আ.) চল্লিশ দিনের জন্য আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন। তখন প্রচার করা হয়েছিল যে, তিনি মারা গেছেন। অথচ তার পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহর কসম, মূসা (আ.)-এর মত রাসূল (সা.) আবার ফিরে আসবেন। এখন যারা বলছে যে, তিনি মারা গেছেন তাদের হাত পা কেটে দেয়া হবে।”
হযরত আবু বকর (রা.) রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের সংবাদ জানতে পেরে দ্রুত ছুটে এলেন। উমার (রা.) তখনও ঐ কথাগুলো ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন। আবু বকর (রা.) সেদিকে কর্ণপাত না করে তিনি সরাসরি আয়শা (রা.)-এর ঘরেচলে গেলেন। তখন রাসূল (সা.)-এর দেহ মুবারক ঘরের এক কোণে ইয়ামানী কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিলো। তিনি রাসূলের (সা.) মুখের কাপড় সরিয়ে চুমু খেলেন। অতঃপর বললেন, “আপনার জন্য আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক ! আল্লাহ আপনার জন্য যে মৃত্যু নির্ধারিত রেখেছিলেন, তা আপনি পেয়েছেন। এরপর আর আপনার কাছে কখনো মৃত্যু আসবেনা।” إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ “(হে নবী!) তুমিতো মরণশীল এবং তারাও মরণশীল।” সূরা যুমার – ৩০। একদিন সবাইকে মরতেই হবে। তখন যার যার পরিণাম জানতে পারবে।
এরপর তিনি বাইরে এসে দেখেন উমার (রা.) সেই একই কথা বলে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, “উমার! তুমি ক্ষান্ত হও! চুপ কর।” উমার (রা.) কিছুতেই থামতে রাজী হচ্ছিলেন না। এ অবস্থা দেখে আবু বকর (রা.) জনগণকে লক্ষ্য করে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথা শুনে জনতা উমার (রা.)-কে রেখে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করার পর বললেন, “হে জনম-লী, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের পূজা করতো সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ (সা.) মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করতো সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর।” তারপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন, “মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বৈ আর কিছুই নন। তার পূর্বে বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান কিংবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা ইসলাম থেকে ফিরে যাবে? যে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কৃতজ্ঞ লোকদের আল্লাহ যথোচিত পুরস্কার দেবেন।” (আল ইমরান ১৪৪)
মানসিক যন্ত্রণায় দিশেহারা এবং অস্থির সাহাবায়ে কেরাম আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর বক্তব্য শুনে বিশ্বাস করলেন যে, রাসূল (সা.) প্রকৃতই ইন্তেকাল করেছেন। এরপর মানুষের মধ্যে এমন ভাবান্তর ঘটলো যে, মনে হচ্ছিল তারা যেন আবু বকরের মুখে শোনার আগে এ আয়াত কখনো শোনেইনি। তারা আয়াতটি আবু বকর (রা.)-এর নিকট থেকে মুখস্ত করে অনবরত তেলাওয়াত করতে থাকলেন। অতঃপর উমার (রা.) বললেন, “আবু বকরের মুখে এ আয়াত শোনার পর আমি হতবাক ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে গেলাম। পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমি তখনই অনুভব করলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সত্যিই ইন্তেকাল করেছেন।”

রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালে ইসলামী দুনিয়ায় শোকাবহ ও সংশয়পূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। রাসূল (সা.)-এর কোন পুত্র সন্তান জীবিত ছিলেন না এবং নিজেও কাউকে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করে যান নাই। উত্তরাধীকারী কোন আইন প্রণয়ন বা এ ব্যাপারে কোন নির্দেশ প্রদান ও করেন নাই। তাঁর জীবদ্দশায় অসুস্থতা বা অনুপস্থিতির জন্য আবু বকর (রা.) কয়েক বার নামাজে ইমামতি করেছিলেন। এতকিছুর পরেও খলিফা নির্বাচনের প্রশ্নে কয়েকটি দলের উদ্ভব হয়েছিল। তারা ছিলেন – আনসার, মোহাজের, কুরাইশ ও অন্যান্য সমর্থকবৃন্দ। আনসারদের দাবী ছিলো যে, শত বিপদ আপদ উপেক্ষা করে তারা রাসূল (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের আশ্রয় দিয়েছেন। মোহাজেরদের দাবী ছিলো রাসূল (সা.)-এর আহ্বানে সারা দিয়ে জীবনের বিনিময় তারাই প্রথম ইসলামে প্রবেশ করেছিলেন। কুরাইশদের দাবি ছিল তারাই আরবের অভিজাত বংশ। মহানবী (সা.) এই কুরাইশ বংশেরই লোক। মুসলমানদের সেই সঙ্কটপূর্ণ সময়ে হযরত আবু বকর ও উমর (রা.) শান্তভাবে এ জটিল বিষয়কে পরামর্শের ভিত্তিতে সুরাহা করেন। উমর (রা.) আবু বকর (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “রাসূল (সা.) আপনাকে নামাজে তাঁর ইমামতি নিয়োগ করেছেন যা ইসলামের ভিত্তিস্তম্ভ। তিনি আপনাকে আমাদের সামনে মর্যাদা দিয়ে আমাদের সামনে স্থান দিয়েছেন। কাজেই আমরা আপনার হাতেই বায়াত হতে চাই। উমর, আবু ওবায়দাসহ (রা.), প্রথম সারীর সাহাবায়ে কেরাম বায়াত হওয়ার সাথেই সকল গোত্রের লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বায়াত গ্রহণ করেন। পরে মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের সাধারণ সমাবেশে সর্বসম্মতভাবে ঐ ফায়সালাকে অনুমোদন করা হলো। জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতেই খলীফা নির্বাচন সম্পন্ন হলো। খলীফা নির্বাচনে যে বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিয়েছিলেন তা হলো মুসলমান গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা। রাষ্ট্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় যত অধিক সংখ্যক লোক সম্পৃক্ত হবে, সরকার ততোই শক্তিশালী হবে। সে জন্য নির্বাচিত ব্যক্তি শুধু গোত্রীয় পরিচয় ও বংশ মর্যাদায় হলে চলবে না, তাকে ইসলামের দৃষ্টিতে জনগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে।
সর্বসম্মতিক্রমে আবু বকর (রা.) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর সমবেত জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন, তা চিরকাল শাসকদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (সা.)-এর ওপর দরূদ পাঠ করলেন। তারপর বললেন, “আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে খলীফা নির্বাচিত করা হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি চেয়েছিলাম, আপনাদের মধ্য থেকে অন্য কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক। হে জনম-লী! আমাকে তোমাদের দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে। আসলে আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। আমি যদি ভাল কাজ করি তাহলে আমাকে সাহায্য করবে। আর যদি অন্যায় করি তাহলে আমাকে সংশোধন করে দেবে। সত্যবাদিতাই বিশ্বস্ততা। আর মিথ্যাবাদিতা হলো বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের মধ্যে যে দুর্বল বিবেচিত হয়ে থাকে যতক্ষণ আমি আল্লাহর ইচ্ছায় তার প্রাপ্য হক না দিতে পারবো ততক্ষণ সে আমার কাছে শক্তিশালী। আর তোমাদের মধ্যে যে শক্তিশালী বিবেচিত হয়ে থাকে তার কাছ থেকে যতক্ষণ আমি হক আদায় না করবো ততক্ষণ সে আমার কাছে দুর্বল। মনে রেখ মুসলমান জাতি আল্লাহর পথে জেহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছনা, অপমান ও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবেন। আর অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নোংরামি যে সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করে সে সমাজকে আল্লাহ বিপদ ও দুর্যোগ দিয়ে ভরে দেবেন। যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবো ততক্ষণ তোমরা আমার আনুগত্য করবে। এর ব্যতিক্রম হলে তোমরা আমার আনুগত্য করবে না। তোমরা নামাজের প্রতি যতœবান থেকো। আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত নাযিল করুন।”
আবু বকর (রা.)-এর বায়াত সুসম্পন্ন হওয়ার পর মঙ্গলবার দিন জনগণ রাসূল (সা.)-এর দাফনের আয়োজন করতে লাগলেন। তাকে গোসল দেয়ার পর তিন টুকরা সাদা কাপড় দিয়ে কাফন দেয়া হলো। অতঃপর সিদ্ধান্ত হলো যে, যে স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেছেন সে স্থানেই তাকে দাফন করা হবে। এরপর দলে দলে সাহাবায়ে কেরামগণ হুজরায় প্রবেশ করে পর্যায়ক্রমে জানাযার নামাজ আদায় করেন। এতে কেউ ইমামতি করেননি। সর্বপ্রথম বনু হাশেম গোত্র। অতঃপর মুহাজের, আনসার, অন্যান্য পুরুষ, এর পর মহিলা ও সর্বশেষ শিশুরা জানাযার নামাজ আদায় করেন। এতে মঙ্গলবার পুরো দিন অতিবাহিত হয়। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাসূল (সা.)-কে দাফন করা হয়। আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.)-কে ঠিক কখন দাফন করা হয় আমরা জানতে পারিনি। তবে বুধবার রাতের মাঝামাঝি সময় কবর খননের কিছু শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। আয়শা (রা.) আরো বলেছেন যে, রাসূল (সা.)-এর সর্বশেষ অছিয়ত ছিল এই যে, “আরব উপদ্বীপে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন যেন না থাকে।”
রাসূল (সা.) মুসলিম মিল্লাত ও সমগ্র মানব জাতির কল্যাণার্থে নিজেকে চরম শত্রুর সামনে উপস্থিত করেছেন। বাতেলরা তাকেসহ ইসলামের উত্থানকে খতম করার নীল নকশা করেছে। তিনি বাতেলের প্রতিটি ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছেন। এ জন্য তাঁকে সীমাহিন কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বিনিময় তিনি জাগতিক কোন কিছুই গ্রহণ করেননি। তাঁর এ ত্যাগের বিনিময় বিশ্ব পেয়েছে এক নতুন ঠিকানা, নতুন ইতিহাস। একটি সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল সমাহার, নিত্যনতুন চিন্তার জগতের সন্ধান। মানবজাতি যদি নৈতিক মূল্যবোধ এবং সাফল্যের শাশ্বত মূলনীতি শিখতে চায় তাহলে তা রাসূল (সা.)-এর থেকেই শিখতে হবে। তাঁর মত নেতা যদি দুনিয়ায় না আসতেন, তাহলে জাহেলিয়াতের মূর্খতা ও অজ্ঞতার ঘোর তমস্যা থেকে পৃথিবী কোন দিন আলো খুঁজে পেতনা।  মানবজাতি যতই তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ থেকে দূরে অবস্থান করবে ততোই পৃথিবীতে পুনরায় অন্ধকার নেমে আসবে। সে অন্ধকার প্রতিরোধে বিশ্ব মুসলিমকে অবশ্যই তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালনে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে সে দায়িত্ব পালনের সংগ্রামে যথাযথ ভূমিকা রাখার সৌভাগ্য দান করুন। কেননা, দায়িত্ব পালনই তাঁর উম্মত হওয়ার সর্বোত্তম পন্থা।

Related Post