রাসূল (সা.) এর রাজনৈতিক জীবন ও পর্যালোচনা

রাসূল (সা.) এর রাজনৈতিক জীবন ও পর্যালোচনা

রাসূল (সা.) এর রাজনৈতিক জীবন ও পর্যালোচনা

পূর্বের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পর্ব ৩

ইসলামী রাজনীতির অপরিহার্যতা
ইসলামে রাজনীতি আছে কি না? এটা নিয়ে আজ মুসলমানরা সংশয়-সন্দেহের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে এক শ্রেণীর ওলামায়ে কেরাম পর্যন্ত দ্বিধা- দ্বন্দ্বে আছেন। আবার কেউ কেউ এর বিপক্ষে জনমত সৃষ্টি করতেও পিছপা হচ্ছেন না। যারা জায়েয মনে করেন তাদের মধ্যে আবার কিছু আছেন এটাকে ঐচ্ছিক বিষয় বানিয়ে হালকা করে দেখেন। তাদের বিবেকের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। ইসলামী রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন রাজনীতি মুসলমানদের জন্য জায়েয আছে কি? ইসলামী রাজনীতি থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার কোন সুযোগ মুসলমানদের আছে কি?  কুরআন-সুন্নাহ থেকে কেউ কি কোন দলিল দেখাতে পারবেন? বরং ধর্ম যার যার রাজনীতি হতে হবে আল্লাহর। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রে রাসূল (সা.) এর শাসনের অধীন সকল ধর্মের লোকেরাই তাদের স্ব-স্ব ধর্মে থেকেই কুরআনের আইন মেনে ন্যায্য অধীকার ভোগ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের বা বিদ্রোহ কেউ করেনী। রাসূল (সা.) এর পরে চার খলিফার শাসনকালেও সবাই শান্তিতে বসবাস করেছে। কাজেই ধর্ম যার যার রাজনীতি আল্লাহর, এটাই আল্লাহ সুবহানাহু অতায়ালার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তবে পশ্চিমা রাজনীতির সাথে ইসলামী রাজনীতির কোন সামঞ্জস্য বা মিল নেই। এখানে সার্বভৌমত্বের মালিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা যে আল্লাহর তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যা মোটেই গ্রহণ যোগ্য নয়। আল্লাহর ঘোষণা, “ইসলাম ছাড়া যে ব্যক্তি অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে চায় তার সে পদ্ধতি কখনোই গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ব্যর্থ, আশাহত ও ক্ষতি গ্রস্ত। (সূরা ইমরান-৮৫)। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজ যেমন ইবাদত, ইসলামী রাজনীতিও ঠিক তেমনি ইবাদত। আর ইবাদত আল্লাহ ছাড়া কারো জন্যে হতে পারেনা। সেটা যে নামেই হোক না কেন। “তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের ইবাদত করছো তারা শুধুমাত্র কতগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ-পুরুষরা রেখেছো, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোন প্রমাণ পাঠাননি। শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই। তাঁর হুকুম-তোমরা তাঁকে ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না।” (সূরা ইউসুফ: ৪০) সৃষ্টি যার হুকুম চলবে তাঁর, এ ঘোষণা স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু অতায়ালার এ ঘোষণাটির বাস্তবায়ন আসমানের ফেরেশতাগণ এসে করবে না। এটা মানুষেরই করতে হবে, কারণ মানুষকেই জমিনের খলিফা (প্রতিনিধি)  বানানো হয়েছে। তা ছাড়া রাসূল (সা.) বলেছেন, “ দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা করা। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন হে আল্লাহর রাসূল! কার জন্যে? তিনি বললেন: আল্লাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রাসূলের জন্য, মুসলিম নেতাদের জন্য এবং সকল মুসলমানের জন্য।” (মুসলিম) কাজেই যে ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও মুসলমানদের সুখ-শান্তি নিয়ে ভাবে না সে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয় কি করে? বিষয়টি শুধু দুনিয়ায়ই সীমাদ্ধ নয়, আখেরাতের সাথেও সংশ্লিষ্ট। কেয়ামতের ভয়াবহ দিনে যে সাত শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া পাবেন তার মধ্যে প্রথমেই থাকবেন ন্যায়পরায়ণ শাসক। অপরদিকে “দুনিয়ায় কেউ যদি দশজনের ও নেতা নির্বাচিত হয় তাহলে তাকে সে দশজনের ও জবাবদিহি করতে হবে। জবাবদিহি করার জন্য তাকে ঘাড়ের সাথে দু‘হাত বেঁধে আনা হবে।” (মুসনাদে আহমদ) তাহলে মেম্বার, চেয়ারম্যান, মেয়র, এমপি, মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিসহ সকলেরই জবাবদিহি করতে হবে, যদি তারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন। আর এদেরকে যারা নির্বাচিত করেন এবং যারা নিরপেক্ষ থেকে বুজর্গী দেখাতে চান তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে। কেননা, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে  প্রশ্ন করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
তার মানে আল্লাহর নীতিতে সকলকেই আসতে হবে, না হলে কেউ বাঁচতে পারবে না। কাজেই কারো জীবন যদি সফল করতে চায় তাহলে তাকে ইসলামী রাজনীতির বাইরে অবস্থান করা সম্ভব নয়। ঈসা (আ.) যখন এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আগমন করবেন, তখন গোটা পৃথিবী তিনি কোন নিয়মে পরিচালনা করবেন? এখন তো যে যার মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছি তখন কি কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ইসলামী রাজনীতির বাইরে কেউ অবস্থান করতে পারবে? তখন ইচ্ছায়ই হোক আর অনিচ্ছায়ই হোক পৃথিবীর সকল মানুষকে আল্লাহর রাজনীতি অনুযায়ী চলতেই হবে। আল্লাহর রাজনীতি মেনে নেয়ার ফলেই তখন গোটা দুনিয়ায় শান্তি বিরাজ করবে।
কাজেই রাজনীতির অর্থ যদি হয় কল্যাণময় জীবন-যাপন এবং একমাত্র আল্লাহ পাকের দাসত্ব ও সন্তুষ্টি বিধানের জন্য জীবনচর্চা, তবে সে রাজনীতি ইসলামের মূল বিষয়। ইসলামের রয়েছে পাঁচটি স্তম্ভ। তার প্রথমেই রয়েছে তাওহীদের বাণী, যার ভিতরেই রয়েছে রাজনীতি। আর সে রাজনীতি হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর জন্য। তাগুতীশক্তি প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনসহ জীবনের সকল স্তরে কালেমার দাবী বাস্তবায়নের সংগ্রামই হচ্ছে রাজনীতি। কে কতটুকু মুসলিম তা নির্ভর করবে এ কালেমা বাস্তবায়নের বাস্তব অনুশীলনের ওপর। কালেমা তাইয়্যেবার ঘোষণা মূলত মানুষের গোটা জীবনকে গায়রুল্লাহর মতাদর্শ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, আইন-কানুন, বিধি-বিধান পরিহার করে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সা.) প্রদর্শিত নীতি আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালনার একটি শর্তহীন অঙ্গীকার। নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর মুখে এ বাণী শোনার সাথেই আরব জাহানের লোকজন এর অন্তর্নিহিত অর্থ ও এর ব্যাপকতা বুঝতে পেরেছিল। যার ফলে তারা মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর সাথীদেরকে প্রবল প্রতিরোধ করেছে। ফেরাউন মুসা (আ.) কে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে হত্যা করতে চেয়েছিল যেমনটি আজও দেখা যায়। এই বাণীর ধারক বাহকদেরকে সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদী, মৌলবাদী ও মানবতা বিরোধী ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। কেন করা হয়? কারণ, এটা একটি বিপ্লবী কালেমা। এর প্রকৃতি রূপায়ণ হতে গেলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরের মানুষের জীবন ধারা পরিবর্তন সূচিত হয়। তখন তাগুতের হাত থেকে ক্ষমতার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, যার কারণে তাগুতীশক্তিসমূহের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ইসলামের বাকী যে চারটি স্তম্ভ তার প্রত্যেকটিতেই রয়েছে মানবতার বৃহত্তরকল্যাণের কথা। নামাযের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে কল্যাণময় জীবনের নীতিমালা, আধ্যাত্মিকতা, সামাজিক সমতা, ঐক্য, নেতৃত্ব, আনুগত্য, দায়িত্ববোধ, দায়িত্বসচেতনতা এবং বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব অক্ষুন্ন রাখার পরিকল্পনা।
উল্লেখিত বিষয়গুলির সুষ্ঠুসমাধানের জন্য সরকার পারিচালনায় যদি রাজনীতি  করা হয় তাহলে এ রাজনীতি ইসলামের অন্যতম প্রধান বিষয়। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হচ্ছে, “আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা ( রাষ্ট্র ক্ষমতা) দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে।” (সূরা হাজ্জ: ৪১) আল্লাহ প্রদত্ত আইন-কানুন, হুকুম-আহকাম এবং রাসূলের আদর্শ অনুসরণের জন্য শাসক নিয়োগ ও শাসন ক্ষমতার অধিকারীদের আনুগত্যের যে নির্দেশ আল-কুরআনে দেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম কায়েম ও ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য কর, আর তোমাদের মধ্যে যারা দায়িত্বশীল (ক্ষমতার অধিকারী) তাদের আনুগত্য করো।” (সূরা আন-নিসা: ৫৯) ‘সৎ কাজের আদেশ কর এবং মন্দ কাজ নিষেধ কর’ কুরআনের এ আহবান; ন্যায়বিচার ও অন্যান্য ঐশী গুণাবলী ও নির্দেশনা সমুন্নত রাখার জন্য সমাজের প্রত্যেক মুসলমানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ অবশ্য প্রয়োজন। সেই সাথে তাগুতী শক্তিসমূহের যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ় থেকে এগিয়ে যাওয়াই হবে সবচেয়ে বড় জেহাদ। আল্লাহর বাণী, “হে নবী, কাফেরদের কথা কখনো মেনে নিয়ো না এবং এ কুরআন নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তম জেহাদ করো।” (সূরা ফুরকান: ৫২) কেননা যুগে যুগে কায়েমী স্বার্থবাদীরা লোকদেরকে আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছে তাদের হীন স্বার্থে। এতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে। প্রতি পদে পদে জনগণ প্রতারিত হয়েছে। ফেরাউনের আনুগত্যে সমাজে ন্যায় বিচার কায়েম হতে পারেনি। সে শুধু তার শক্তি, শাসন ও ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার ব্যবস্থা করেছে।
আজো পৃথিবীতে একই অবস্থা বিরাজ করছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে ক্ষমতা হাসিল করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে ক্ষমতার জন্য সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে রাজনীতি ইসলামের অন্যতম মৌলিক বিষয়। কেননা আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে তাওহীদ ভিত্তিক রাষ্টের গোড়াপত্তনে প্রয়োজন সমস্ত তাগুতী শক্তিকে নস্যাৎ করে দেয়া। অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত অধিকার ও ক্ষমতা দখল করতে হবে যাতে পৃথিবী থেকে সকল জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার অপসারণ করা যায়। ইসলামে কাঙ্খিত তাওহীদি সমাজ প্রতিষ্ঠায় কোন আপোষ চলে না। তাগুতী শক্তির ধারক বাহকদের সকল ক্ষমতা নস্যাৎ করে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিবর্গের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। এই কাজটি করার জন্য আল্লাহর নির্দেশেই মুহাম্মাদ (সা.) নির্জনতা হতে বেরিয়ে এসে ময়দানে কাজ করেছেন। তাঁর মদীনায় হিজরতের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কাজেই ইসলাম ক্ষমতার সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত। যে ক্ষমতার সাহায্যে সমগ্র মানবতার কল্যাণের জন্য ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালা অনুযায়ী জগতকে ঢেলে সাজানো যায়। আল্লাহর এই অভিপ্রায় বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে ‘জেহাদ ফি সাবীলিল্লাহ’ বলা হয়েছে। জেহাদকে ঈমানের কষ্টিপাথর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক ক্ষমতা পরিচালনাকে কুরআনে অত্যাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষমতা দখল ইসলামের উদ্দেশ্য নয়, বরং তা হারাম। ইসলাম ক্ষমতাকে একটি নৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যে স্থাপন করতে চায়। ক্ষমতা দখল আল্লাহর মহান উদ্দেশ্য পূরণের মাধ্যম মাত্র, যাতে চিরস্থায়ী জীবনে শান্তি লাভ করা যায়। উপরে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে রাজনীতি হচ্ছে ইসলামের নির্দেশনা এবং একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। (চলবে…)

Related Post