রোযার উপকারিতা ও ফযীলত

রোযার উপকারিতা ও ফযীলত

রোযার উপকারিতা ও ফযীলত

রোযার অনেক ফযীলত রয়েছে। কুরআন হাদীসের আলোকে উল্লেখ করা হলো,

এক. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের সাথে সিয়ামের সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন: এমনিভাবে তিনি সকল ইবাদত-বন্দেগি থেকে রোযাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন তিনি এক হাদীসে কুদসিতে বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোযা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। (মুসলিম) এ হাদীস দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারি নেক আমলের মাঝে রোযা পালনের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কত বেশি। তাই সাহাবি আবু হুরায়রা রা. যখন বলেছিলেন, হে রাসূলুল্লাহ! আমাকে অতি উত্তম কোন নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : তুমি রোযা পালন করবে। মনে রেখ এর সমমর্যাদার কোন আমল নেই। (নাসায়ি)

 রোযার এত মর্যাদার কারণ কী তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভাল জানেন। তবে, আমরা যা দেখি তা হল, রোযা এমন একটি আমল যাতে লোক দেখানো ভাব থাকে না। বান্দা ও আল্লাহ তাআলার মধ্যকার একটি অতি গোপন বিষয়। সালাত হজ, যাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি কে করল তা দেখা যায়। পরিত্যাগ করলেও বুঝা যায়। কিন্তু রোযা পালনে লোক দেখানো বা শোনানোর ভাবনা থাকে না। ফলে সিয়ামের মধ্যে এখলাস বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা নির্ভেজাল ও বেশি থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, রোযা পালনকারী আমার জন্যই পানাহার ও যৌনতা পরিহার করে। তাই রোযা পালনকারী আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কিছুর আশা করে না।

দুই. রোযা আদায়কারী বিনা হিসাবে প্রতিদান লাভ করে থাকেন: কিন্তু অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি ও সৎ কর্মের প্রতিদান বিনা হিসাবে দেয়া হয় না। বরং প্রত্যেকটি নেক আমলের পরিবর্তে আমলকারীকে দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত প্রতিদান দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু সিয়ামের বিষয়টা ভিন্ন। কেননা রোযা শুধু আমার জন্য আমিই তার প্রতিদান দেব। (মুসলিম)

সারা জাহানের সর্বশক্তিমান প্রতিপালক আল্লাহ নিজেই যখন এর পুরস্কার দেবেন তখন কি পরিমাণে দেবেন ?

ইমাম আওজায়ী র. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ যে রোযা আদায় কারীকে প্রতিদান দেবেন তা মাপা হবে না, ওজন করা হবে না।

তিন. রোযা ঢাল ও কুপ্রবৃত্তি থেকে সুরক্ষা: রোযা পালনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কু-প্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হে যুবকেরা ! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে না সে যেন রোযা পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষা কবচ। (বোখারি ও মুসলিম)

এমনিভাবে রোযা সকল অশ্লীলতা ও অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

রোযা হল ঢাল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে রোযা পালন করবে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সাথে কেউ ঝগড়া বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায় তবে তাকে বলে দেবে আমি রোযা পালনকারী। (মুসলিম)

রোযা পালনকারী যেমনি নিজের অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তেমনি সকল অশ্লীল আচরণ, ঝগড়া-বিবাদ, অনর্থক কথা ও কাজ থেকে নিজের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হেফাজত করবে।

চার. রোযা জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল: যেমন হাদীসে এসেছে, রোযা হল ঢাল ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার মজবুত দুর্গ। (আহমদ)

বোখারি ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর পথে রোযা পালন করবে আল্লাহ তার থেকে জাহান্নামকে এক খরিফ (সত্তুর বছরের) দুরত্বে সরিয়ে দেবেন। (মুসলিম)

এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা বহু রোযা পালনকারীকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। যেমন হাদীসে এসেছে, ইফতারের সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এটা রমজানের প্রতি রাতে। (আহমদ)

পাঁচ. রোযা হল জান্নাত লাভের পথ: হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিন যার দ্বারা আমি লাভবান হতে পারি। তিনি বললেন : তুমি রোযা পালন করবে। কেননা, এর সমকক্ষ কোন কাজ নেই। (নাসায়ি)

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য সিয়ামের সাথে কোন আমলের তুলনা হয় না। রোযা পালনকারীদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহের আরেকটি দৃষ্টান্ত হল তিনি রোযা পালনকারীদের জন্য জান্নাতে একটি দরজা নির্দিষ্ট করে দেন। যে দরজা দিয়ে রোযা পালনকারীরা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। যার নাম রইয়ান। কেয়ামতের দিন রোযা পালনকারীরাই শুধু সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন ঘোষণা করা হবে, রোযা পালনকারীরা কোথায় ? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য। যখন তারা প্রবেশ করবে দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে ফলে তারা ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (বোখারি ও মুসলিম)

ছয়. রোযা পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যার হাতে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন সে সত্তার শপথ, রোযা পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে মেশকের ঘ্রাণ হতেও প্রিয়। (বোখারি ও মুসলিম)

মুখের গন্ধ বলতে পেট খালি থাকার কারণে যে গন্ধ আসে সেটাকে বুঝায়। দাঁত অপরিষ্কার থাকার কারণে যে গন্ধ সেটা নয়।

সাত. রোযা ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের মাধ্যম: যেমন হাদীসে এসেছে, রোযা পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ : একটি হল ইফতারের সময় অন্যটি তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়। (বোখারি ও মুসলিম)

ইফতারের সময় আনন্দ হল এ কারণে যে রোযা পূর্ণ করতে পারল ও খাবার-দাবারের অনুমতি পাওয়া গেল। এটা বাস্তব সম্মত আনন্দের বিষয় যা আমাদের সকলের বুঝে আসে ও অনুভব করি। অপরদিকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের যে আনন্দ তা অনুভব করতে আমরা এখন না পারলেও কেয়ামতের দিন পারা যাবে। যখন সকল মানুষ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহমুখী থাকবে।

আট. রোযা কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে:  হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রোযা ও কুরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, রোযা বলবে হে প্রতিপালক ! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে হে প্রতিপালক ! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। (আহমদ)

রোযা হল গুনাহ মাফ ও গুনাহের কাফফারা। রোযা হল অনেকগুলো নেক আমলের সমষ্টি। আর নেক আমল পাপকে মুছে দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, সৎকর্ম অবশ্যই পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। (সুরা হুদ : ১১৪)

বহু হাদীস রয়েছে যা প্রমাণ করে যে, নেক আমলকে বিভিন্ন ছোট খাট পাপ সমূহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ নেক আমলের কারণে গুনাহসমূহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। যেমন হাদীসে এসেছে, মানুষ যখন পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী ও ধন-সম্পদের কারণে গুনাহ করে ফেলে তখন সালাত, রোযা, সদকা সে গুনাহগুলোকে মিটিয়ে দেয়। (বোখারি ও মুসলিম)

আর রমজান তো গুনাহ মাফ ও মিটিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আরো বেশি সুযোগ দিয়েছে। হাদীসে এসেছে, যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রোযা পালন করবে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বোখারি ও মুসলিম)

ইহতিসাবের অর্থ হল আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়া যাবে এ দৃঢ় বিশ্বাস রেখে নিষ্ঠার সাথে সন্তুষ্টচিত্তে আদায় করা।

রোযা ছোট পাপগুলোকে মিটিয়ে দেয় আর তাওবা করলে কবিরা গুনাহ মাফ করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা গুরুতর তা হতে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো ক্ষমা করে দেব। এবং তোমাদের সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব। সূরা নিসা : ৩১

এ আয়াত ও হাদীস দুটো দ্বারা প্রমাণিত হল আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ক্ষমার ওয়াদা করা হয়েছে তা তিনটি শর্ত সাপেক্ষে।

প্রথম: রমজানের রোযা পালন করতে হবে ঈমানের সাথে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান এবং রোযা যে একটি ফরজ ইবাদত এর প্রতি বিশ্বাস। রোযা পালনকারীকে আল্লাহ যে সকল পুরস্কার দেবেন তার প্রতি বিশ্বাস রাখা।

দ্বিতীয়: রোযা পালন করতে হবে ইহতিসাবের সাথে। ইহতিসাব অর্থ হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও পুরস্কারের আশা করা, তাকে সন্তুষ্ট করতেই রোযা পালন করা আর রোযাকে বোঝা মনে না করা।

তৃতীয়: কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। কবিরা গুনাহ ঐ সকল পাপকে বলা হয় যেগুলোর ব্যাপারে ইহকালীন শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে, পরকালে শাস্তির ঘোষণা রয়েছে, অথবা আল্লাহর ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে লানত (অভিসম্পাত) বা ক্রোধের ঘোষণা রয়েছে। যেমন, শিরক করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাত করা, ব্যভিচার করা, জাদু-টোনা, অন্যায় হত্যা, মাতা-পিতার সাথে দুর্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ, মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা, মাদক সেবন, ধোঁকাবাজি, মিথ্যা শপথ, অপবাদ দেয়া, গিবত বা পরদোষচর্চা, চোগলখোরি, সত্য গোপন করা ইত্যাদি।

 

Related Post