শিরক মহাপাপ

শিরক মহাপাপ

শিরক মহাপাপ

‘শিরক’ হলো আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ সমকক্ষ করা, মিলানো, সংমিশ্রণ করা, একত্রীকরণ, অংশীদার, ভাগাভাগি, সমান করা, সম্পৃক্ত করা। শিরক মানে বিশ্ব প্রভু আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার বা সমকক্ষ বানানো। এটা এমনসব বিশ্বাস, কাজ, কথা বা অভ্যাসকে বোঝায় যা দ্বারা মহান আল্লাহর রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত এবং সিফাতে অপর কারও অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়।

* আল্লাহর ‘রুবুবিয়াতে’ কাউকে শরিক বানানোর অর্থ লালন-পালন, সৃষ্টি, জীবন-জীবিকা, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদিতে অন্যকে অংশীদার করা।

* তাঁর ‘উলুহিয়াত’ বৈশিষ্ট্যে কাউকে সমকক্ষ করার অর্থ সালাত, সাওম, কোরবানী, মান্নত প্রভৃতিতে অন্য কারও উপাস্য মেনে নেয়া।

* আর আল্লাহর ‘সিফাতে’ কাউকে শরিক বানানোর অর্থ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির গায়েব জানা, নিজকে অমুখাপেক্ষী ভাবা, অভাবমুক্ত মনে করা প্রভৃতি।

যারা শিরক করে তারা আল্লাহকে অস্বীকার করে না। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে বটে, কিন্তু আল্লাহ সাথে অন্যান্য সত্তা বা শক্তিকে বিভিন্নভাবে শরীক করে। আল্লাহর সাথে কী কী ভাবে শরীক করা হয় তা বুঝতে হলে শিরক সর্ম্পকে ধারণা থাকতে হবে তাহলেই শিরক থেকে বেঁচে থাকাও সজহ হবে। শিরকমুক্ত আকিদা-বিশ্বাসই পরকালে সৎকর্মের প্রতিদান পাওয়ার পূর্বশর্ত। আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয়ভাজন হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনেকটা কড়া ভাষায় সম্বোধন করে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন। তুমি যদি শিরক কর, তাহলে তোমার আমল নিষম্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (যুমার : ৬৫)। যুগে যুগে মানুষ শয়তানের কবলে পড়ে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, দেব-দেবী, গাছ, পাথর প্রভৃতির পূজা করতে শুরু করে দিত। তারা তাদের হৃদয়-মনের সব আবেগ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আকুতি-মিনতি দিয়ে এদের ডাকত। এ পথহারা পাপিষ্ঠ বনি আদমগুলোকে সরল-সঠিক দ্বীন তথা তাওহীদি জিন্দেগীতে নিয়ে আসার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছে অসংখ্য নবী-রাসূল। তারা প্রত্যেকেই শিরকের পথ পরিহার করে খাঁটি ঈমানের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতেন।
শিরকের প্রকারভেদ
ইমাম ইযযাহাবী তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘আল-কাবায়ের’ (কবীরা গোনাহ) নামক গ্রন্থে লিখেছেন শিরক দুই প্রকার : (১) আকিদগত শিরক
আকিদাগত শিরক অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহ সমকক্ষ মনে করা এবং তার ইবাদত করা।
আকিদাগত শিরক ৪ (চার প্রকার) ঃ
ক) শিরকুন ফিয-যাত অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা
খ) শিরকুন ফিস-সিফাত অর্থাৎ আল্লাহর গুনাবলি
গ) শিরকুন ফিল এখতিয়ারাত অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা
ঘ) শিরকুন ফিল হুকুক অর্থাৎ আল্লাহর অধিকার
তাওহীদকে বুঝতে হলে শিরককে বুঝতে হবে। শিরকের বিপরীতই তাওহীদ। ঈমান শিরকমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাওহীদের দাবী পূরণ হতে পারে না।
ক) শিরকুন ফিয-যাত অর্থাৎ আল্লাহর সত্তার উদাহরণ : আল্লাহ সত্তাকে শরীক করা যেমন কাউকে আল্লাহ পুত্র, স্ত্রী মনে করা। ফেরেশতা, দেব-দেবী ইত্যাদিকে আল্লাহ বংশধর বলে বিশ্বাস করা।
খ) শিরকুন ফিস-সিফাত অর্থাৎ আল্লাহর গুনাবলির উদাহরণ : যে সব গুন একান্তই আল্লাহ সে সবগুন কারোর মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ছাড়া কাউকে সকল রকম দুর্বলতা ও দোষক্রটি থেকে পাক মনে করা। যেমন-গায়েবী ইলম বা অদৃশ্য সর্ম্পকে জ্ঞান। কারো সর্ম্পকে এমন ধারণা করা যে, তিনি সবকিছু জানেন, দেখেন বা শুনেন এবং সব দোষ ত্রুটি থেকে মুক্ত।
গ) শিরকুন ফিল এখতিয়ারাত অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতার উদারহণ : আলৌকিকভাবে উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা, প্রয়োজন পূরণ ও হেফাযত করার যোগ্যতা, মানুষের ভাগ্য গড়া ও ভাঙ্গা, দোয়া করা, মানব জীবনের জন্য আইন কানুন রচনা করা, সন্তান দান করা, রোগ ভাল করা, গুনাহ মাফ করা, হায়াত ও মওত দেয়া, রিযক দান করা ইত্যদি।
ঘ) শিরকুন ফিল হুকুক অর্থাৎ আল্লাহর অধিকারের উদাহরণ : কাউকে রুকু, সিজদা ও পূঁজা পাওয়ার অধিকারী বা হাত বেঁধে নত হয়ে দাড়িয়ে ভক্তি করার পাত্র মনে করা, কারো আস্তানাকে চুমু দেয়ার যোগ্য মনে করা, কুরবানী করা, নযর, নিয়ত, মানত পেশ করার যোগ্য মনে করা। নিয়ামতের শুকরিয়া পাওয়ার অধিকারী বা আপদে বিপদে সাহায্যের জন্য আবেদন গ্রহনের যোগ্য, সব অবস্থায় যাকে ভয় করা যায় বা যার জন্য আর সব মহ্বত ত্যাগ করা যায় বলে মনে করা।
(২) রিয়া
লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘তোমরা ছোট শিরক থেকে দূরে থাক। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন : ছোট শিরক কী? তিনি বললেন : রিয়া অর্থৎ লোক দেখিয়ে সৎ কাজ করা। যেদিন আল্লাহ বান্দাদের কর্মফল দেবেন সেদিন তাদের বলবেন, যাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তোমরা নেক কাজ করতে, তাদের কাছে চলে যাও। দেখ তারা তোমাদের কী প্রতিদান দেয়? (মুসনাদে আহমাদ ও সুনানে বায়হাকী)। ফজল ইবনে ইয়াজ বলেন : ‘লোকের ভয়ে খারাপ কাজ বর্জনকারী রিয়াকারী এবং মানুষকে খুশি করার জন্য ভালো কাজ করা শিরক। আর ইখলাস হচ্ছে এই উভয় রোগ থেকে মুক্ত থাকার নাম’।
শিরকে লিপ্ত হওয়ার কারণ
মানুষ নানাবিধ কারণে শিরকে লিপ্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ যে কত মহান, কত ক্ষমতাধর, তার কর্তৃত্বের পরিধি যে কত বিশাল বিস্তৃত ও প্রসারিত, তিনি যে কত নিকটতম; তার যথার্থ মূল্যায়নের অভাবে মানুষ শিরকে লিপ্ত হয়। আবার অনেকে তাদের বাপ-দাদার কৃষ্টি রেওয়াজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে ফেলে। কখনও কখনও অতি ভক্তি কিংবা অতি আবেগের বশীভূত হয়ে মানুষ মানুষের পায়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে, চুমু খায়, পায়ের ধুলা গায়ে মাখে যা সুস্পষ্ট শিরকের শামিল। আমাদের দেশে প্রচলিত শিরকগুলোর মধ্যে পীরপূজা, মাজারপূজা, কবরপূজা, মাজারের পার্শ্ববর্তী গাছের শিকড়, ছাল-বাকল ইত্যাদিতে রোগ আরোগ্য হয় বলে বিশ্বাস, মাজার থেকে আনা সুতা, তাগা, দড়ি প্রভৃতি আরোগ্য দান করে, মাজার পুকুরের পানি, কুমির, কাছিম, গজার মাছ, কবুতর প্রভৃতিকে খাবার দিলে মনের আশা পূর্ণ হয়, মৃত ওলীরা জীবিতদের সাহায্য করতে পারেন, দুর্ঘটনা রোধের জন্য মাজারে টাকা দেয়া, নবী-ওলীরা গায়েব (অদৃশ্য) জানেন, নানাবিধ ফায়েজ-বরকত হাসিলের জন্য মাজারের গিলাপে চুমু খাওয়া, টিয়া পাখি কিংবা বানরের মাধ্যমে ভাগ্য গণনা করা, কোনো বুযুর্গ একই সময় অনেক স্থানে অবস্থান করতে পারা প্রভৃতি। এগুলো সবই অজ্ঞতা ও বাড়াবাড়িরই নামান্তর। মানুষ অজ্ঞতা ও ভুল বিশ্বাসের কারণে তার যবান, বিশ্বাস, অভ্যাস, আচার-আচরণ প্রভৃতি দ্বারা শিরক করে থাকে। সতর্ক থাকার পরেও কখনও কখনও মনের অজান্তে এ মারাত্মক পাপ কর্মটি সংঘটিত হয়ে যায়। আখেরী জামানার দুর্বল মু’মিন হিসেবে আমাদের যতসামান্য নেক আমলগুলো সংরক্ষণের জন্য শিরক ও তাওহীদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করা সময়ের অনিবার্য দাবী।
শিরক নেক আমল নষ্ট করে দেয়
শিরক নেক আমলকে সম্পূর্ণরুপে বিনষ্ট করে দেয় এবং ব্যক্তিকে নিশ্চিত জাহান্নামের উপযোগী করে গড়ে তোলে। মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও কল্যাণকর জীবনযাপনের মহৎশক্তি হলো ঈমান। ঈমান এক অচলায়তন পর্বতের ন্যায়, যা চির অবিচল, সদা সমুন্নত। ইহা একটি দিগন্ত উজ্জ্বলকারী সূর্যশক্তি, যা জীবনের সবগুলো দিক ও আনাচ-কানাচ আলোকম-িত ও উজ্জ্বল করে দেয়। শিরক এমন একটি অন্ধকার জগত, যেখান থেকে আল্লাহর আক্রোশ আর গজবের হাওয়াই নির্গত হয়ে থাকে। আর যারা তাওবা করে না, আল্লাহ তাদের জালেম বলে আখ্যায়িত করেছেন।

Related Post