শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নীতিমালা

শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নীতিমালা

শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নীতিমালা

১. ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দেয়া
‘ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত : রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দেবে’ (ইবনে মাজাহ)।
২. শ্রমিকের পাওনাদারদের সঙ্গে আল্লাহর ঝগড়া: ‘আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতালা বলেছেন, কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির সঙ্গে আমার ঝগড়া হবে—১. ওই ব্যক্তি যে আমার নামে কোনো চুক্তি করে ভঙ্গ করেছে, ২. সেই ব্যক্তি, যে কোনো মুক্ত মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছে। ৩. সেই ব্যক্তি, যে মজুরের দ্বারা কোনো কাজ পুরোপুরি করে নিয়েছে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক দেয়নি’ (বুখারি)।
৩. অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা-‘আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিমের (সা.) সর্বশেষ বাণী ছিল—১. নামাজ এবং যারা তোমাদের অধীন তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর’ (আল আদাবুল মুফরাদ)।
৪. শ্রমিকের মজুরি ঠিক করে নাও-‘শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ নবী করিম (সা.) নিষেধ করেছেন (বুখারি)।
৫. সুন্দর ও নিখুঁতভাবে কাজ সম্পন্নকারী শ্রমিককে আল্লাহ ভালোবাসেন।-‘তোমাদের কেউ যখন কোনো শ্রমের কাজ করবে তখন তা নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করবে—এটাই আল্লাহ ভালোবাসেন’ (বায়হাকি)।
অর্থনীতির পরিভাষায় ‘পারিশ্রমিকের বিনিময়ে উত্পাদন কাজে নিয়োজিত মানুষের শারীরিক ও মানসিক সব ধরনের কর্ম প্রচেষ্টাকে শ্রম বলে।’ সুতরাং এর মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থোপার্জন। যারা শ্রম দেয় তাদের বলা হয় শ্রমিক।
শ্রম বলতে যা বোঝায়: ‘শ্রম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো—মেহনত করা, পরিশ্রম করা, কষ্ট করা, খাটুনি করা ইত্যাদি। ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায়: মানবতার কল্যাণ, নৈতিক উন্নয়ন, সৃষ্টির সেবা ও উত্পাদনে নিয়োজিত সব কায়িক ও মানসিক শক্তিকে শ্রম বলে। এ শ্রম উত্পাদন কাজে ব্যবহৃত হোক কিংবা পারিশ্রমিক না থাকুক অথবা সে পারিশ্রমিক নগদ অর্থ হোক বা অন্যকিছু হোক এবং শ্রমের পার্থিব মূল্য না থাকলেও পারলৌকিক মূল্য থাকবে।
শ্রমের প্রকারভেদ:  ইসলামের দৃষ্টিকোণে শ্রম তিন প্রকার। যথা—
০১. শারীরিক বা কায়িক শ্রম: কায়িক শ্রম হলো মানুষের পুঁজিবিহীন জীবিকা অর্জনের আসল মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) নিজেই একটি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন—দুনিয়াতে আল্লাহ এমন কোনো নবী পাঠাননি, যিনি বকরী চরাননি; তখন সাহাবায়ে কিরাম বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর আপনিও? নবী করিম (সা.) জওয়াবে বললেন হ্যাঁ, আমি কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরী চরিয়েছি।
০২. শৈল্পিক শ্রম: শৈল্পিক শ্রম বলতে বোঝায়, যে কাজে শিল্প ও কৌশলবিদ্যাকে অধিক পরিমাণে খাটানো হয়। যেমন—অঙ্কন, হস্তশিল্প ইত্যাদি কাজে শৈল্পিক শ্রমের ব্যবহার হয়ে থাকে।
০৩. বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম:  বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম বলতে ওইসব পুঁজিহীন শ্রমকে বোঝায় যেগুলোয় দেহের চেয়ে মস্তিষ্ককে বেশি খাটানো হয়। যেমন—পরিচালনা, শিক্ষকতা, ডাক্তারি, আইনজীবী ইত্যাদি।
ইসলামী অর্থনীতি ও সাধারণ অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্য
* সাধারণ অর্থনীতিতে পারিশ্রমিকবিহীন কোনো কাজই শ্রম নয়। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে শ্রমের জন্য পারিশ্রমিক শর্ত নয়।
* সাধারণ অর্থনীতিতে যে কাজে আনন্দ আছে তা শ্রম নয়। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে সৃষ্টির সেবা, নৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি যে কোনো কার্য যদিও আনন্দদায়ক হয়ে থাকে সবই শ্রম।
* ইসলামী অর্থনীতিতে জনকল্যাণবিরোধী কোনো কাজই শ্রম হতে পারে না। কিন্তু সাধারণ অর্থনীতিতে এরূপ কোনো শর্ত নেই। তাই এ শাস্ত্রের জন্য অনিষ্টকর কাজও শ্রম, যদি তাতে পারিশ্রমিক থাকে।
কাজের সময় নির্ধারণ
ইসলাম কাজের কোনো নির্ধারিত সময় ঠিক করে দেয়নি এবং ন্যায়ভিত্তিক মূলনীতি বর্ণনা করেছে। ইসলামে ততক্ষণই একজন শ্রমিকের কাছ থেকে এর কাজ নেয়া যেতে পারে, যতক্ষণ সে স্বাভাবিকভাবে তা কুলিয়ে উঠতে পারে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে কাজ তোমার জন্য অতি কষ্টকর, সে কাজের বোঝা শ্রমিকের ওপর চাপিয়ে দিও না।’
কাজের প্রকৃতি
এ সম্পর্কে ইসলামী আইনগ্রন্থ ‘হিদায়ায়’ বলা হয়েছে, মালিক কি রকমের উপকৃত হতে চায় তা নির্ধারণ ব্যতিরেকে শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করা সহিহ হবে না। কাজের প্রকৃতি কি ধরনের হবে এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হলো শ্রমিককে দিনে এমন কোনো কাজ করানো যাবে না, যা তার জন্য অতি কষ্টকর। এমনিভাবে কোনো শ্রমিককে এক কাজের জন্য নিয়োগ করে, তার সম্মতি ছাড়া তাকে অন্যকাজে নিয়োগ করা যাবে না।
লাভের অংশীদার
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকদের লাভের মধ্যে অংশীদার হওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এর নিমিত্তে ইসলাম, মুদারাবাত, মুজারাআত প্রভৃতি পন্থা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের মুনাফার অংশীদার হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকদের শ্রমার্জিত সম্পদ (লাভ) হতেও অংশ দিও। কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।
’ স্বাস্থ্য সংরক্ষণ
ইসলাম বলে শ্রমিকদের জন্য এমন স্থান নির্ধারণ করতে হবে, তাকে এমন পরিশোধ রাখতে হবে, যা সাধারণভাবে স্বাস্থ্যের উপযোগী। এ সম্পর্কে ইবনু হাজম (র.) বলেন, ‘মালিকের জন্য উচিত শ্রমিকের দ্বারা এমন কাজ না করানো, যার দ্বারা তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে, তার লোকসান হয়।’
ক্ষতির দায়িত্ব
ইমাম হাজম বলেন, যাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্রমিক হিসেবে রাখা হয়েছে, তার হাতে যদি কোনো কিছু ক্ষতি বা নষ্ট হয়ে যায়, তাতে ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব শ্রমিকের ওপর বর্তায় না। হ্যাঁ, সে যদি ক্ষতি করার ইচ্ছা নিয়ে তা করে, তবে অন্য কথা। আর এ ব্যাপারে কোনো সাক্ষী না থাকলে কসমসহ শ্রমিকের কথাই গ্রহণযোগ্য হবে।
ভাতা ও সামাজিক নিরাপত্তা
ইসলামের দৃষ্টিতে বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ, অসহায়, এতিম, বিধবা এবং দুর্বলজনদের ভরণ-পোষণ ও তাদের যাবতীয় দায়িত্বভার ইসলামী সরকার গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। এছাড়াও শ্রমিকদের আরও অনেক অধিকার রয়েছে। যেমন—দাবি-দাওয়া পেশের অধিকার, শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগদান ইত্যাদি। ইসলামের নীতিমালা মেনে চললে সব পর্যায়ের শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পেতে পারে শ্রমিকরা তাদের পূর্ণ অধিকার। শ্রমিকদের প্রাপ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের সেদিকেই ফিরতে হবে।

Related Post