সূরা কাহাফে বর্ণিত দ্বিতীয় কাহিনী মুছা ও খিজির

সূরা কাহাফে  বর্ণিত দ্বিতীয় কাহিনী মুছা ও খিজির

সূরা কাহাফে বর্ণিত দ্বিতীয় কাহিনী মুছা ও খিজির

খিযির সংক্রান্ত ঘটনার তাৎপর্যঃ- আসহাবে কাহ্ফ-এর কাহিনীর সূত্র ধরে মক্কার মুশরিক সরদার ও সচ্ছল অবস্থার লোকেরা নিজেদের লোকালয়ে মুসলমান লোকদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার ও যুলুম করত তা ঢাকার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করেছিল যে, খিযির সংক্রান্ত ঘটনার তাৎপর্য কি? তৎকালে মক্কায় কুফর ও ইসলামের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের যে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তার যথাযথ উত্তর দেওয়ার জন্য মহান রাব্বুল আলামীন নবী করীম (সা.) এর জবানীর মাধ্যমে হযরত মুসা (আ.) ও হযরত খিযির (আ.) এর ঘটনাটি জানিয়ে দিলেন।
খিযির (আ.) ও মুসা (আ.) এর কাহিনী এমনভাবে শুনানো হয়েছে যে, তাতে কাফেরদের প্রশ্ন গুলির জবাবও হয়ে গেছে আর মুমিন লোকদের জন্য তাতে সান্ত¡নার সামগ্রীও রয়েছে। উবাই ইবনে কাব, ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বলেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন যে- একবার মুসা (আ.) বনী ইসরাইলের মধ্যে বক্তৃতা করছিলেন, এমন সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হল মানব জাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জানে কে? উত্তরে তিনি বললেন আমি সবচেয়ে বেশি জানি। আল্লাহ তার উপর রুস্ট হলেন যেহেতু তাকে এ জ্ঞান দেয়া হয়নি। আল্লাহ মুসা (আ.)-কে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন – দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে আমার এক বান্দা আছে যে তোমার চেয়ে বেশি জানে। মুসা বললেন হে আমার রব! আমি তার কাছে কিভাবে পৌছাঁতে পারি? আল্লাহ বললেন; একটা মাছ সঙ্গে নাও, থলেতে রাখ তারপর রওয়ানা হয়ে যাও। যেখানে এ মাছটি হারিয়ে যাবে সেখানেই তাঁকে পাবে। আল্লাহর আদেশ মত তিনি সফর শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে ইউশা ইবনে নুন নামক এক যুবককে নিলেন। কোন প্রামানিক পন্থায় এ বিষয় জানা যায়নি যে, হযরত মুসা (আ.) এর এই সফর কোন সময়ে ঘটেছিল এবং সঙ্গমস্থলটি কোথায় ছিল। কিন্তু কাহিনীটি  নিয়ে চিন্তা করলে মনে হয় মুসা (আ.) যখন মিশরে অবস্থান করছিলেন ঘটনাটি সেই সময়ে যখন ফিরাউনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব চলছিল আর সঙ্গমস্থলটি ছিল – শ্বেতনীল (white nile) কটানীল (blue nile) যার সঙ্গমস্থলে বর্তমানে খার্তুম শহর বিদ্যমান। তারা সমুদ্রের কিনারায় একটি পাথরের কাছে পৌঁছে গেলেন এবং পাথরের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। এ সময় মাছটি থলির মধ্যে লাফিয়ে উঠলো এবং থলি থেকে বের হয়ে সমুদ্রের পানিতে পড়ে গিয়ে নিজের পথে চলল। আর সেখান দিয়ে মাছটি চলে গিয়েছিল আল্লাহ সেখানে সমুদ্রের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তাতে একটি সুড়ঙ্গ বা নালা বানিয়ে দিয়েছিলেন। ঘুম থেকে জেগে উঠার পর তাঁর সাথী সেই যুবক মাছটির কথা জানাতে ভুলে গিয়েছিল। সেই দিনের অবশিষ্ট সময় ও সেই রাত্র তাঁরা চললেন। পরের দিন মুসা বললেনঃ “এ সফরে বেশ ক্লান্তি অনুভত হচ্ছে, এখন আমাদের খাবার আন।” (সূরা কাহ্ফ : ৬২) রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আসলে আল্লাহ যে স্থানে সাক্ষাতের কথা বলেছিলেন (অর্থ্যাৎ যেখানে মাছটি পালিয়ে গিয়েছিল) সে স্থান ছেড়ে যাবার পর থেকেই মুসা (আ.) ক্লানিÍ অনুভব করছিলেন। তখন তাঁর খাদেম তাঁকে বললেন: “আপনার মনে আছে সে পাথরটার পাশে আমরা বিশ্রাম করেছিলাম সেখানেই মাছটি অদ্ভুদভাবে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি মাছটির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে শয়তান আমাকে এ কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। তাই আমি আপনাকে তা জানাতে পারিনি।” (সুরা কাহ্ফ: ৬৩) মুসা (আ.) বললেন: “আমরাতো এই স্থানটিই তালাশ করছিলাম: (সুরা কাহ্ফ: ৬৩) কাজেই তাঁরা নিজেদের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে সেই জায়গায় এসে পড়লেন। সেখানে এক ব্যক্তিকে কাপড় জড়িয়ে বসে থাকতে দেখলেন। মুসা তাকে সালাম দিলেন। জবাবে খিযির তাঁকে বললেন তোমাদের এ দেশে সালামের প্রচলন হলো কেমন করে? মুসা (আ.) বললেন- আমি মুসা। খিযির জিজ্ঞেস করলেন বনী ইসরাইলের নবী মুসা? মুসা (আ.) জবাবে বললেন হ্যাঁ। আমি এসেছি এ জন্য যে আপনি আমাকে সেই জ্ঞানের শিক্ষা দিবেন যা আপনাকে দান করা হয়েছে। তিনি (খিযির) জবাব দিলেন, তুমি কিছুতেই আমার সঙ্গে সবর বা ধৈর্যধারন করতে পারবে না। (সূরা কাহ্ফ: ৬৭) অর্থাৎ তুমি আমার সঙ্গে থেকে আমার কার্যাবলী দেখলে আমার নিকট তথ্যানু সন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকবেন। যেমনটি ছাত্র শিক্ষককে শিক্ষণীয় বিষয়ে অবিরত প্রশ্নবাদ করতে থাকলে তাকে সঙ্গে রাখা দুস্কর হয়ে পড়ে। তাছাড়া তুমি কিরূপে ধৈর্যধারন করবে এমন বিষয়ে যাহা তোমার জ্ঞান সীমার বাহিরে। (সূরা কাহ্ফ: ৬৮) মুসা বললেন ইনশাআল্লাহ  আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন আর আমি কোন কাজেই আপনার ব্যতিক্রম করব না। (ঐ আয়াত: ৬৯) তিনি (খিযির) বললেন যদি তুমি আমার সঙ্গে থাকতেই চাও তবে কোন বিষয়েই আমাকে প্রশ্ন করবে না যে পর্যন্ত আমি নিজে তৎসমন্ধে কিছু উল্লেখ না করি। (ঐ আয়াত: ৭০) অতঃপর উভয়ে চলতে লাগলেন। এই পর্যন্ত যে, যখন (চলতে চলতে) উভয়ে একটি নৌকায় আরোহন করলেন, তখন তিনি (খিযির) নৌকাটিতে একটি ছিদ্র করে দিলেন, মুসা বললেন আপনি কি নৌকাটিকে ছিদ্র করলেন এই উদ্দেশ্যে যে, উহার আরোহীদিগকে ডুবিয়ে দিবেন? আপনি বড় গুরুতর কাজ করলেন। (ঐ আয়াত: ৭১) খিযির বললেন, আমি কি বলিনি যে, তুমি আমার সঙ্গে ধৈর্যধারন করতে পারবে না। ( ঐ আয়াত:৭২) মুসা বললেন- আমার ভুলের জন্য আমাকে পাকড়াও করবেন না এবং আমার ব্যাপারে অত্যধিক কঠোরতা অবলম্বন করবেন না। (ঐ আয়াত: ৭) এরপর আসল একটা চড়ই পাখি। পাখিটা নৌকার এক কিনারায় বসে ঠোট দিয়ে সমুদ্রে থেকে এক বিন্দু পানি পান করল। এ দৃশ্য দেখে খিযির মুসাকে বলল, এই চড়ইটা সমুদ্র থেকে যতটুকু পানি পান করল আমার ও তোমার জ্ঞান আল্লাহ জ্ঞানের তুলনায় এতটুকুই। তারপর তারা নৌকা ছেড়ে হাঁটতে লাগলেন। পথে খিযির দেখলেন একটি ছোট ছেলে খেলা করছে। তিনি হাত দিয়ে ছেলেটিকে ধরলেন এবং দেহ থেকে তার মাথাটা আলাদা করে ফেললেন। অর্থাৎ তিনি ছেলেটিকে মেরে ফেললেন। মুসা বললেন আপনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করে অন্যায় কাজ করলেন এই রূপ শিশুকে তো হত্যার বদলেও হত্যা করা জায়েজ নহে। তদুপরি প্রতিশোধ নেওয়ার মত এমন কাজও তো সে করে নাই। সুতরাং ইহা প্রথম কাজটি অপেক্ষা অধিক গুরুতর। কেননা নৌকাটির ক্ষতি করায় শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছিল। আর এ ঘটনাটিতে প্রাণহানী ঘটল। তিনি (খিযির) বললেন, আমি কি বলিনি যে, তুমি আমার সাথে কিছুতেই ধৈর্যধারন করে থাকতে পারবে না? মুসা বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করি তাহলে আপনি আমাকে আর আপনার সঙ্গে রাখবেন না। আপনার কাছে আমার ওযর আপত্তি চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে। পুনরায় তারা উভয়ে চলতে  শুরু করলেন। চলতে চলতে তারা একটি জনবসতিতে গিয়ে পৌঁছালেন। কিন্তু উক্ত গ্রামবাসীদের নিয়ম ছিল যে, সন্ধ্যা সমাগমের সঙ্গে সঙ্গেই তারা গ্রামের প্রবেশ দ্বার বন্ধ করে দিত। কারও জন্য খুলত না। হযরত মুসা (আ.) হযরত খিযির (আ.) তথায় পৌঁছে দরজা খুলতে বললে কেউ তাতে সাড়া দিল না। এমন কি তারা মুসাফির হিসেবে খাবার চাইলে তাও দিল না। তারা দু জনেই  অনাহারে  গ্রামের বাইরে রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন তারা সেখানে একটি পতনোমুখ প্রাচীর বা দেয়াল দেখতে পেলেন। তিনি খিযির সে দেয়ালটি নিজ হাতে গেঁথে দিয়ে সোজা বা খাড়া করে দিলেন। ইহা দেখে মুসা বললেন, যারা আমাদেরকে খাবার দিল না বা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল, আপনি তাদের উপকার করলেন! বিনা পারিশ্রমিকে তাহা ঠিক করে দিলেন। অথচ, ইচ্ছা করলে আপনিতো এতে পারিশ্রমিক বা মুজুরি নিতে পারতেন। খিযির বললেন, এই মুহূর্ত থেকে তোমার আর আমার সহযাত্রা এখানেই শেষ। এখন আমি তোমাকে সেই বিষয় গুলির তাৎপর্য বা হকীকত বুঝিয়ে দিচ্ছি যেগুলির ব্যাপারে তুমি ধৈর্যধারন করতে পারনি।
প্রথমত: সেই নৌকাটির ব্যাপার এই ছিল যে, সেটির মালিক ছিল কয়েকজন গরীব লোক। সাগরে যারা জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিলাম এই কারণে যে, সামনে এমন এক বাদশাহর এলাকা রয়েছে যে প্রত্যেকটি নিখুঁত অর্থাৎ ভাল নৌকা জোর পূর্বক ছিনিয়ে নিত। তাই সেই রাজা যেন তা নিতে না পারে বা নিতে না চায়।
দ্বিতীয়ত: সেই ছেলেটির কথা। তার বাবা মা ছিল মুমিন বান্দা। আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে পরবর্তীকালে তার নাফরমানী ও বিদ্রোহাচরণ করে তাদেরকে কষ্ট দিবে এবং কুফরীর দিকে তাঁদেরকে নিয়ে যাবে। অতএব, আমি চাইলাম বা ইচ্ছা করলাম যে তাঁদের রব্ব তাঁদেরকে উহার পরিবর্তে এমন সন্তান দান করেন, যে হবে পবিত্রতায় উহার চেয়ে উত্তম ও ভক্তি ভালবাসায় ঘনিষ্টতর রেওয়ায়েত আছে যে, নিহত ছেলেটির পরিবর্তে তাহার পিতা-মাতাকে আল্লাহ তায়ালা একটি কন্যা সন্তান দান করেছিলেন। তাহার বংশে পরবর্তীতে কয়েকজন পয়গাম্বর জন্ম গ্রহণ করেছিল।
তৃতীয়ত: ঐ দেয়ালটির ব্যাপার এই ছিল যে, ঐ প্রাচীরটি ছিল এই শহরের দুইজন এতীম ছেলের। তাঁদের পিতা ছিল একজন সৎ ও নেককার ব্যক্তি। এই প্রাচীর বা দেয়ালটির নিচে তাঁদের জন্য গুপ্তধন পোঁতা ছিল। তাই তোমার প্রতিপালক দয়া পরবশ হয়ে ইচ্ছা করলেন যে, তারা যেন যৌবনে উপনীত হয় এবং তারা তাদের গুপ্তধন উদ্ধার করে নেয়। সুতরাং তাদের পিতার পূণ্যের খাতিরে তদীয় উত্তরাধিকারীদের সম্পদ রক্ষা করা আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রেত হয়েছে। কিন্তু এই প্রাচীর বা দেয়ালটি ধসে পড়লে দুষ্টেরা এই গুপ্তধন লুন্ঠন করতো। এখানে আমি কোন কাজই নিজের ইচ্ছায় করিনি। সবকিছুই আল্লাহর নির্দেশমত হয়েছে। আর এই হচ্ছে সেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা তাৎপর্য যে বিষয়ে তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ভাল হতো যদি মুসা (আ.) আরও একটু সবর করতেন তাহলে তাঁদের মাধ্যমে আমাদের আরও কিছু কথা জানাতেন। বুখারী হাদীস নং -৪৭২৫
একাহিনীতে একথাতো সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, হযরত খিযির (আ.) যে তিনটি কাজ করেছিলেন তা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশেই করেছিলেন। একথাও অতি পরিস্কার রূপে বুঝা যায় যে, তিনটি কাজের মধ্যে প্রথম দুটি কাজের অনুমতি কোন শরীয়তে কোন মানুষকে কখনও দেয়নি। এমন কি এলহামের ভিত্তিতেও কোন মানুষ অন্যের মালিকানাভুক্ত নৌকা খারাপ বা ত্রুটিপূর্ণ করে দিতে পারে না যে, সামনে কোন ছিনতাইকারী  নৌকাটি ছিনিয়ে নিবে আবার কোন বালককে এজন্য হত্যা করতে পারে না যে, বড় হয়ে সে কাফের বা অবাধ্য হবে। একারণে একথা না মেনে উপায় নেই যে, হযরত খিযির (আ.) একাজ শরীয়তের বিধান অনুসারে করেন নি। বরং তিনি একাজ করেছিলেন আল্লাহর মশিয়ত বা ইচ্ছানুযায়ী অনুসারে। সুতরাং কাহিনীর প্রকৃতি থেকে একথাও বুঝা যাচ্ছে যে, পর্দার অন্তরালে আল্লাহ তায়ালার  মশিয়তের কারখানায় কিরূপ মুসলেহাত  অনুযায়ী কাজ হয়ে থাকে যা বুঝা মানুষের সাধ্যের অতীত। পর্দা অপসারিত করে মুসা (আ.) কে তা এক নজর দেখানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আ.) কে তাঁর এই বান্দার কাছে প্রেরণ করেছিলেন।

Related Post