হিজরী সন গণনার নির্দেশ ও ইতিহাস

হিজরী সন গণনার নির্দেশ ও ইতিহাস

হিজরী সন গণনার নির্দেশ ও ইতিহাস

হিজরী সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর আদর্শ ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। যার সঙ্গে জড়িত আছে বিশ্বমানবতার মুক্তির অমর কালজয়ী আদর্শ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় ও পুণ্যময় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় গমনের ঐতিহাসিক ঘটনা।
মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই বর্ষ গণনার উদ্ভব ঘটেছে। এ সময় গণনায় মানুষ চাঁদের গতি ও প্রকৃতির প্রতি নজর রেখেছে। যা আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমের সূরা ইউনুসের ৫নং আয়াতে বলেন-
‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সূর্যকে করেছেন দ্বীপ্তিমান তেজস্বী এবং চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় আলোকোজ্জ্বল করেছেন। আর ওর (চন্দ্রের গতির)
জন্য কক্ষ বা মানজিলসমূহ নির্ধারিত করেছেন। যাতে তোমরা বছরসমূহের সংখ্যা গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার।’
হিজরী সনের সূচনার ইতিহাস
যখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াত পেলেন এবং একত্ববাদের (আল্লাহর পথে) দিকে আহ্বান করা শুরু করেন। তখন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষেরাও (বংশের লোক) বিরোধিতা শুরু করে।
তিনি গোপনে তিন বছর দাওয়াতি মিশন পরিচালনার পর আল্লাহর নির্দেশে সাফা পাহাড়ে প্রকাশ্যে এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন থেকেই পথে প্রান্তরে তাকে আহত, অপমানিত, লাঞ্ছিত ও নির্যাতনের ধারা শুরু হয়েছিল। অত্যন্ত ধৈর্য ও পরম সাহসিকতার সঙ্গে তিনি তাঁর মিশন নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন।
যখন তাঁকে একত্ববাদের দাওয়াতের মিশন থেকে বিরত রাখা যাচ্ছিল না তখন তারা দারুন নাদওয়া বৈঠকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধন্ত গ্রহণ করে।
ঘোষণা করা হয়, তাঁকে জীবিত বা মৃত নাদওয়া গৃহে উপস্থিত করতে পারলেই পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে ১০০টি উট। এ ঘোষণায় একদল শক্তিশালী যুবক ঐকমত্য পোষণ করল যে, সে রাতেই তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো হবে।
যখন থেকে হিজরী সন গণনা শুরু হয়
৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর। সে রাতেই মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের ফলে আল্লাহর নির্দেশে প্রিয় নবী মদীনায় হিজরত করলেন। আর মদীনার মানুষগুলো প্রিয় নবীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। প্রিয় নবী মদীনায় হিজরত করলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর মক্কা মুকাররামা থেকে মদীনার উদ্দেশে হিজরত শুরু করেন।
২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আউয়াল মদনিার পাশ্ববর্তী স্থান কুবায় এসে পৌঁছেন।
অবশেষে ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল মদীনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম । এ হিজরতেরই স্মৃতিবহন করে আসছে আরবী হিজরী সন।
উল্লেখ্য যে, আরবের গোত্রীয় প্রয়োজনে তারা হিজরী মাসগুলোকে ইচ্ছামত সামনে-পেছনে আনা-নেয়া করত। প্রিয় নবীর হিজরতকে কেন্দ্র করে আল্লাহর অশেষ রহমতে বিদায় হজ্জের দিন মাসগুলো যথারীতি স্ব স্ব স্থানে স্থায়িত্ব লাভ করে।
বিদায় হজ্জের দিন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন- ‘হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
‘আসমান-জমিন সৃষ্টির দিন যে বিন্যাসে আল্লাহ তাআলা মাহকালকে বিন্যাস্ত করেছিলেন আবার সে বিন্যাসেই তা ফিরে এসেছে। বারো মাসে এক বছর, এর মধ্যে চারটি মাস মহিমান্বিত।’ (মুসলিম)
হিজরী বর্ষের পূর্ণতা লাভ
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়েও বিক্ষিপ্তভাবে হিজরী বর্ষ গণনা হতো। বিদায় হজের ভাষণে প্রিয় নবী হিজরী সনের কথা ও সম্মানিত ৪ মাসের উল্লেখ করেন। আর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের সময় তা সুনির্দিষ্ট রূপে প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়।
সে সময় রাষ্ট্রীয় কাজে সন তারিখ ব্যবহার না করায় রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানকল্পে ১৭ হিজরীর ১০ জমাদিউল আউয়াল হযরত আবু মুসা আশয়ারি খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তখন হযরত উমর (রা.) সাহাবায়ে কেরামদের মজলিসে শূরায় সবার পরামর্শক্রমে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতকে ভিত্তি করে হিজরী সন গণনার সিদ্ধান্ত নেন।
সেই সম্মেলনের স্লোগান ছিল-‘হিজরতের ঘটনা মিথ্যা থেকে সত্যের পার্থক্য করেছে, মক্কার অবিশ্বাসীদের ওপর ইসলামের বিজয় এসেছে।’
পৃথিবীর ইতিহাসে মুসলমানদের উন্নতি, অগ্রগতি, বিজয় ও সাফল্যের প্রতীক ও শ্রেষ্ঠ তাওহিদী বিপ্লব ছিল প্রিয় নবীর ‘হিজরত’। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় জন্মভূমি ত্যাগ করা ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি মহান ঘটনা। সে কারণেই হিজরতের এ মহাঘটনাকে কেন্দ্র করেই হিজরী সন গণনা শুরু হয়।
হিজরী সন কেন মুহাররম দিয়ে শুরু?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনা মুনাওয়ারায় আসেন, তখন মাসটি ছিল রবিউল আওয়াল। আর হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হিজরী সনের প্রথম মাস ধরেন মুহাররমকে।
যদিও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় পৌঁছেন রবিউল আওয়াল মাসে। কিন্তু হিজরতের পরিকল্পনা হয়েছিল নবুওয়তের ১৩তম বর্ষের হজ্জের মৌসুমে। সময়টি ছিল মদীনার আনসারি সাহাবাদের সঙ্গে আকাবার দ্বিতীয় শপথ সংঘটিত হওয়ার পর। তখন ছিল যিলহজ্জ মাসে। আর তার পরের মাসই হলো মুহাররম।
প্রিয় নবীর হিজরতের আগে মক্কার কুরাইশদের দ্বারা নিরাপরাদ মুসলমানদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের করণে প্রিয় নবী মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দেন। আর মুসলমানদের মধ্য থেকে হিজরতকারী প্রথম দলটি মদীনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন মুহাররম মাসে। মুসলমানদের এ হিজরত ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় হিজরতের শুভ সূচনা।
বাংলাদেশে হিজরী সনের প্রচলন
৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক হিজরী সন প্রবর্তিত হওয়ার এক বছর পরই আরব বণিকদের আগমনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয়।
পরবর্তীতে ৫৯৮ হিজরী মোতাবেক ১২০৯ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয়ের মাধ্যমে বাংলার জমিনে মুসলিম শাসনের ইতিহাস সূচিত হয়।
এর ফলে হিজরী সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের মাধ্যমে জাতীয় সন গণনায় পরিণত হয়। সন গণনায় ৫৫০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর থাকার পর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের মধ্যমে হিজরী সনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অবসান হয়।
প্রতিটি নতুন চন্দ্র গণনায় বরকতের দোয়া
প্রতিটি নতুন হিজরীবর্ষ যেমন গোটা মুসলিম জাতিকে দ্বীনের জন্য ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিগত বছরে দ্বীনি কাজের হিসাব-নিকাষ এবং আগামী বছরের নতুন উদ্যমে দ্বীন ও ঈমানি কাজ আঞ্জামে ঈমানের মজবুতি গঠনেরও তাগিদ দেয়।
এ ধারবাহিকতা বজায় থাকে প্রতিটি নতুন চাঁদে নতুন মাসে। এ কারণেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম উম্মাহকে প্রতিটি নতুন চাঁদ দেখার সময় দোয়া পড়ার তাগিদ দিয়েছেন।
আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিলইউমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলামি রাব্বী ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনি এই চাঁদকে আমাদের সৌভাগ্য, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের জন্য ওঠান। আমার ও তোমার রব হলেন আল্লাহ।’ (মুসনাদে আহমদ)
পরিশেষে…
মুসলিম উম্মাহর জন্য চন্দ্র মাসের হিসাব রাখা ফরজে কেফায়া। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত। যার অনুসরণ, অনুকরণ করা মুসলিম উম্মাহর জন্য পূন্যময় ও কল্যাণকর আমল।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ ও ইদ্দত পালনের ক্ষেত্রে চান্দ্র মাস ও বছরের যথাযথ ব্যবহার করার তাওফিক দান করুন। চন্দ্র মাসের নিয়মিত যাবতীয় আমল করে আল্লাহ নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমীন।

Related Post