হিলফুল ফুযুল: মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ভূমিকা এবং আমাদের শিক্ষণীয়

হিলফুল ফুযুল: মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ভূমিকা এবং আমাদের শিক্ষণীয়

হিলফুল ফুযুল: মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ভূমিকা এবং আমাদের শিক্ষণীয়

পূর্বে প্রকাশিতের পর

শেষ পর্ব

আমাদের শিক্ষণীয়:
তরুণ মুহাম্মাদ (সাঃ) যেমন বুঝেছিলেন,যেভাবে সমাজে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন চলছে তা তিনি একা প্রতিরোধ করতে পারবেন না। এ অন্যায় রুখতে হলে শক্তির প্রয়োজন কিন্তু সবাইকে তিনি বুঝাতে গেলে হয়ত অনেকে বেঁকে বসতে পারে। তাই তিনি সর্বপ্রথম তাঁরই চাচা যোবায়ের বিন আব্দুল মুত্তলিবকে বুঝালেন এবং তাকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন গোত্রপতিদের বুঝাতে সক্ষম হলেন। এভাবে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যেবাবে “হিলফুল ফুযুল” বা হলফ উল ফুযুল সঙ্ঘ গঠিত হয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে আজকের বিশ্বেও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য অশান্ত পৃথিবঅকে শান্ত করার জন্য বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জঙ্গমশীল নির্যাতনের স্টিমরোলারকে স্থবির করে দেওয়ার জন্য অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত মানুষদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং সর্বোপরি ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের মূলোৎপাটন করার জন্য প্রতিটি এলাকায় প্রতিটি জনপদে প্রতি মহল্লায় ন্যায় ভিত্তিক কল্যাণকর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি।
এ জন্য প্রতিটি তরুণকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ নিজ প্রিয় ব্যক্তিদের নিয়ে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে জনসমর্থন আদায় করতে হবে এবং অত্যাধুনিক শান্তিময় বিশ্ব গড়ার জন্য প্রাণ-পণ চালিয়ে যেতে হবে। এ প্রচেষ্টা তরুণদের তারুণ্যকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।
নাম: মানুষের কল্যাণের জন্য যেহেতু সংগঠন সেহেতু এই সংগঠনের নাম মানব কল্যাণ সংগঠন দেওয়া যেতে পারে। আলে ইমরানের ১০৪ ও ১১০ আয়াতদ্বয় হতে এ নাম গ্রহণ যুক্তিযুক্ত প্রতীয়মাণ হয়।
নীতিমালা:
১. এই অঙ্গীকার নামা সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে সম্পাদন করতে হবে।
২. আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। মুহাম্মদ (সাঃ)কে শেষ ও বিশ্বনবী মানতে হবে।
৩. সকল প্রকার তাওহীদের উপর একনিষ্ঠভাবে ঈমান আনতে হবে। যেমন (ক) তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ তথা আল্লাহকে তাঁর কর্মসমূহে একক হিসাবে মেনে নেওয়া। যেমন সার্বভৌম ক্ষমতা, রিযিকদান, জীবন মৃত্যুদান, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি শুধুমাত্র তাঁরই কাজ। (খ) তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ তথা মা‘বূদের একত্ববাদ; উহা হচ্ছে সর্বপ্রকার ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক নির্ধারণ করা। (গ) তাওহীদুল আসমা ওয়াসসিফাত তথা নাম ও গুণাবলীর একত্ববাদ। আল্লাহ নিজে তাঁর বর্ণনা করেছেন সেগুলোর কোন প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, ধরণ বা সাদৃশ্য পেশ না করে যথাযথভাবে মেনে নেওয়া।
৪. সর্বাবস্থায় কুরআনুল কারীম এবং সহীহ হাদীসকে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড গ্রহণ করা।
৫. প্রতিটি সদস্যকে সকল প্রকার দল, মত, পথ, বংশীয় অহংকার ও আত্মীয়তার আকর্ষণ সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করতে হবে।
৬. যে কোন অন্যায় সাধ্যমত প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় কিংবা পররাষ্ট্রীয় হোক না কেন।
৭. অত্যাচারি যত শক্তিশালী হোক, তার হাত ধরে ফেলতে হবে এবং অত্যাচারিত যত দুর্বলই হোক তার পাশে দাড়িয়ে সাধ্যমত সাহায্য করতে হবে।
৮. দরিদ্র, দুর্বল, এতিম ও অসহায় মানুষের সহায়তাদানে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
৯. পরিবার, সমাজ, তথা সর্বপ্রকার অশান্তি দূর করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে।
১০. নিজেকে আল্লাহর আদালতে পেশ করার জন্য সাধ্যমত আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। যিনা, মদ্যপান, সুদ, ঘুষ, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ও পদলোভী হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
উল্লেখিত শর্তাবলী সামনে রেখে পৃথিবীর যে প্রান্তেই যত দল বা সংগঠন গড়ে উঠুক যেহতু তাদের আদর্শ হবে এক, সেহেতু তাদের সময়ের ব্যাপার মাত্র। দল গঠন মানে এ নয় যে, তাঁরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন দ্বীন সৃষ্টি করবে। বরং দল গঠনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে কুরআন এবং সহীহ হাদীসের বাস্তব চিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য সবদল সাধ্যমত নিজস্ব বলয়ে কাজ করে যাবে। প্রয়োজন দেখা দিলে সবাই সকল সহায় শক্তি নিয়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্মিলিতভাবে বাতিল শক্তি প্রতিরোধ করবে। তখন দলের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর জমিনে তাঁর সার্বভৌত্ব প্রতিষ্ঠা করা। দুনিয়াবী কোন স্বার্থ যেন বিভেদ সৃষ্টির কারণ না হয় তার প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখতে হবে।
উপসংহার
আল্লাহ বলেন: “রাসূল’র মধ্যেই রয়েছে তোমাদের উত্তম আদর্শ।” (আহযাব: ২১) তিনি আরও বলেন: “রাসূল তোমাদের যা দেন তোমরা তা গ্রহণ কর এবং তিনি যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” (সূরা হাশর: ৭) তিনি আরও বলেন: “ তিনি সরল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত।“ (সূরা ইয়সিন: ৪) তিনি আরও বলেন: “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভাল বাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর। ফলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুণাসমূহ মার্জণা করে দিবেন।” (সূরা আলে ইমরান: ৩১)
যদিও তরুণ মুহাম্মাদ ছিলেন সে কল্যাণমুখী চিন্তা-ভাবনার উদ্ভাবক এবং চাচা যোবায়ের ছিলেন প্রথম সমর্থক তথাপি এ সংগঠন সৃষ্টি হয়েছিল নবুয়ত পূর্বেকালে। এ জন্য হয়ত অনেকে ভাবতে পারেন, নবুওয়াত প্রাপ্তির পর এ সংগঠনের আর দরকার নেই। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, নবুওয়াত প্রাপ্ত হওয়াত পর মুহাম্মাদ (সাঃ) কখনও এ সংগঠনের কথা বিস্মৃত হননি। বদর যুদ্ধে বন্দীগণের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের সময় তিনি এ প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ কদা এ প্রসঙ্গের কথা উল্লেখকালে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন: “আজ যদি কোন উৎপীড়িত ব্যক্তি বলে, ‘হে ফুযুল অঙ্গীকার নামার ব্যক্তিবৃন্দ! আমি নিশ্চয়ই তার এ আহ্বানে সাড়া দিব। কারণ ইসলাম তো এসেছে ন্যায় ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং উৎপীড়িত ও অত্যাচারিতকে সাহায্য করতে।
অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন: “আব্দুল্লাহ বিন জুদয়ানের বাস ভবনে আমি এমন এক অঙ্গীকার নামায় শরীক ছিলাম যার বিনিময়ে আমি আসন্ন প্রসবা উটও পছন্দ করি না এবং যদি ইসলামের যুগেও এরূপ অঙ্গীকারের জন্য আমাকে আহ্বান জানানো হয় তাহলেও আমি প্রস্তুত আছি বলতাম।” উল্লেখ্য বক্তব্যে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ন্যায়ভিত্তিক সংগঠনের প্রতি গভীর অনুরাগের বহির্প্রকাশ ঘটেছে। আমরা জানি কোন বিষয়ে কোন কাজ রাসূল (সাঃ) করতে পারেন নাই বা করার সুযোগ হয়নি কিন্তু তিনি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন পরবর্তীতে উম্মতের জন্য তা সুন্নাতরূপে গৃহীত হয়েছে। যেমন আশূরার সিয়াম সম্পর্কে ইয়াহুদীদের বিরোধিতা করার জন্য তিনি বলেছিলেন: “আগামী বছর যদি বেঁচে থাকি, তবে অবশ্যই ৯ তারিখ রোযা রাখবো।” (মুসলিম ষিয়াম অধ্যায় হা/১১৩৪) তাই আমরা ৯ ও ১০ তারিখ এ রোযা রাখি। কুরআন কারীম ও রাসূলের বাচনিক উক্তি দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, ন্যায় ভিত্তিক সংগঠন প্রতিটি জনপদে প্রতিটি যুগেই একান্ত কাম্য। যারা সৎকাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে কোন নিন্দুকের পরোয়া করবে না এবং যালিমের যুলুুমকে ভয় করবে না। যারা সর্বদা সত্য কথা বলবে এবং সৎ পথে চলবে। এই সংগঠন পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক সময়ের প্রয়োজনে একই প্লাট ফর্মে দাড়াতে সক্ষম হবে। যেহেতু প্রতিটি সংগঠনই নির্ভেজাল তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একমাত্র মুহাম্মাদ (সাঃ) এর দেখানো পদ্ধতিতে কুরআন এবং সহীহ হাদীস ভিত্তিক জীবন যাপন করবে, সেহেতু তারা কখনও দ্বীনকে টুকরো টুকরো করবে না। যেমন বর্তমান বিশ্বে ইয়াহুদী, নাসারা পৌত্তলিকসহ ইসলাম বিদ্বেষী দল ও দেশগুলি ইসলামের নাম নিশানা ধরাপৃষ্ঠ থেকে উৎখাতের জন্য সমরাঙ্গণে এক লাইনে দাড়িয়ে যুদ্ধ করে, ঠিক তেমনি মানব কল্যাণ সংগঠন মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহর বিধানকে সমুন্নত করার এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রতিহত করার জন্য সীসাঢালা প্রাচীরের মত একতা বদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ বুহ্য গড়ে তুলবে। পরিশেষে এ কথা বলেই শেষ করছি যে, এ বিষয়টি ব্যাপক, এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। আমাদের প্রত্যেকের জন্য এটা জরুরি, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা।

Related Post