হুব্বে রাসূল, ইত্তেবায়ে রাসূল ও নুসরাতে রিসালাতুন্নবী (সা.)

হুব্বে রাসূল

হুব্বে রাসূল

হুব্বে রাসূল,
(এক) হুব্বে রাসূল (সা.): ‘হুব্বে রাসূল মানে রাসূল প্রেম-রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। আনাস বিন মালেক (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন: “তিনটি জিনিষ যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের সাধ গ্রহণ করবে। এক- আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তার নিকট দুনিয়ার সব কিছু হতে প্রিয় হওয়া। দুই- কোন মানুষকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসা। তিন- ঈমান আনার পর কুফরিতে ফিরে যাওয়াতে এমন অপছন্দ করবে, যেমন আগুনে নিক্ষেপ করাকে অপছন্দ করে”।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম নবী ও রাসূল। তাঁর ওপর ঈমান রাখা ও তাঁকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসা মুমিনের একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের একাধিক বর্ণনায় মুমিনদের রাসূলের প্রতি অগাধ প্রেম-ভালোবাসা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। যে হৃদয়ে নবীজির উপর সম্মানবোধ নেই, মায়া ও অনুভূতির দৈন্যতা রয়েছে, উহাতে ঈমানের অস্তিত্ব থাকতে পরে না। শুধু সম্মানের অনুভূতিই যথেষ্ট নয়, বরং মুমিনেরা তাদের স্বীয় জীবনের সঞ্চিত ধন-সম্পদ, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সব কিছুর উপর আল্লাহর রাসূলকে অগ্রাধিকার দেবে। তা নবী (সা.) এর প্রতি ভালোবাসারই দাবি। এ ক্ষেত্রে কুরআনের বক্তব্য সুস্পষ্ট: “নিশ্চয়ই মুমিনদের নিকট নবী তাদের স্বীয় জীবনের চাইতেও মর্যাদার ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার” (সূরা আল আহযাব : ৬) এর সারকথা হলো, প্রত্যক মুসলমানের পক্ষে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসা ও তার নির্দেশ পালন করা স্বীয় পিতামাতার নির্দেশের চাইতেও অধীক করণীয়। যদি পিতা মাতার নির্দেশ মহানবী (সা.) এর নির্দেশের বিপরীত হয়, তা পালন করা মোটেও জায়েজ নয়। এমনকি রাসূল (সা.) এর নির্দেশকে নিজের সকল আশা-আকাঙ্খার চাইতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আল্লাহর হাবীব বলেন- ‘এমন কোন মুমেন নেই যার পক্ষে আমি ইহকাল ও পরকালে সমস্ত মানবকূলের চাইতে হিতাকাঙ্খী ও আপনজন নই’। (বুখারী)
এ ক্ষেত্রে নবী (সা.) এর বাণীও স্বরণযোগ্য: “তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না একমাত্র আমিই তার কাছে তার জীবন, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা এবং দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।” (বুখারী ও মুসলিম)
রাসূল (সা.)-কে যে যতটুকু ভালোবাসে তার মধ্য ততটুকু ঈমান রয়েছে। ঈমান অধ্যায়ন করার বিষয় নয়, উহা অন্তরে ধারণ করার বিষয়। যারা আল্লাহ ও তার হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে মন, প্রাণ ও হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছেন তারাই হলেন ঈমানদার বা মুমেন।
হুব্বে রাসূলের তাৎপর্য হলো: রাসূলের (সা.) সুন্নাহর প্রতি ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) এর বক্তব্য প্রনিধাণযোগ্য: “যে আমার সুন্নতকে ভালবাসলো, সে যেন আমাকেই ভালবাসলো।” আরো একটা কথা এ প্রসঙ্গে জেনে নেয়া জরুরী যে, মুহাম্মদ (সা.) এর রিসালাত নিরপেক্ষ হয়ে নিছক হুব্বে মুহাম্মদ (সা.) বা মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন নাজাতের কারণ হতে পারে না। “ আবদুল্লাহ ইবনে আমর হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন: তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের প্রবৃত্তি বা কামনা বাসনাকে আমার আনিত বিধানের অধীন করে নিবে”। (শরহে সুন্নাহ) । এ সত্য কারো কাছে অজানা নয় যে, নবীর আপন চাচা আবু তালিব মুহাম্মদ (সা.) এর রিসালাতের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থেকে ‘হুব্বে মুহাম্মদ’ এর যে নজীর শিয়াবে আবু তালিব এর গিরিগুহায় রেখেছেন, তা একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এত কষ্ট-নির্যাতন, সামাজিক বয়কট শুধু মুহাম্মাদের জন্যেই স্বীকার করলেন, অথচ তাঁর রিসালাতের ব্যাপারে রইলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। এই রিসালাত নিরপেক্ষ ‘হুব্বে মুহাম্মদ’ আবু তালিবের মুক্তির কারণ হতে পারে নাই। রাসূল (সা.) বলেছেন: “সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, এই উম্মতের মধ্যে যে আমার সম্পর্কে শুনতে ও জানতে পারবে সে ইহুদী হোক কিংবা নাসারা হোক, আর আমি যে দ্বীনসহ প্রেরিত হয়েছি তার উপর ঈমান না এনেই মৃত্যু মুখে পতিত হবে সে নিশ্চয় জাহান্নামী হবে”। (মুসনাদে আহমদ)
মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে হৃদয়ে ও বিশ্বাসে; যার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তার আচার-আচরণ ও কর্মে। নবীকে (সা.) ভালোবাসলে তার আলামত নিশ্চয়ই আমাদের কাজে-কর্মে থাকতে হবে। যারা নবীকে (সা.) ভালোবাসেন, তাদের মধ্যে নিম্নের আলামতগুলো বিদ্যমান থাকা আবশ্যক:
(ক) রাসূলকে (সা.) সম্মান করা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন : ‘আমি তো আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষ্য প্রদানকারী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং রাসূলকে সাহায্য কর ও সম্মান কর এবং সকালে-সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবিহ পাঠ কর’। (সূরা আল ফাতহ : ৮-৯) আমাদের সবসময় নবীকে (সা.) সম্মান করতে হবে। নবী (সা.) যতটুকু মর্যাদার হকদার আমাদের ততটুকুই মর্যাদা দিতে হবে। এতে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না। নবীর (সা.) ওপর দরূদ সালাম পেশ করেও আমরা তাঁর প্রতি সম্মান প্রকাশ করতে পারি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফিরেশতারা নবীর ওপর সালাম পেশ করেন। অতএব, হে ঈমানদাররা! তোমরাও তাঁর ওপর সালাত ও সালাম পেশ কর’। (সূরা আল আহযাব :৫৭) এ প্রসঙ্গে নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তির সামনে আমার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আমার ওপর সালাম পেশ করল না, সে কৃপণ’। (আহমদ)
(খ) রাসূল (সা.) ও তাঁর সুন্নাতকে সমুন্নত রাখা: রাসূলকে (সা.) ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে তাঁকে এবং তাঁর সুন্নাতকে সবসময় সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন : ‘এ সম্পদে হক রয়েছে মুহাজিরদের, যারা নিজেদের ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদ থেকে উৎখাত হয়েছে। তারা কেবল অন্বেষণ করে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি এবং তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যবাদী’। (সূরা আল হাশর :৮) সাহাবীরা রাসূলকে (সা.) ও তাঁর সুন্নাতকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাসূলকে মর্যাদা দিতেন। তাঁর আদেশ-নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতেন। রাসূলের আদর্শকে সমুন্নত রাখাই ছিল তাদের একমাত্র সাধনা। আমাদেরও তাই রাসূলের আদর্শ ও তাঁর সুন্নাতকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
(গ) রাসূল (সা.) যা বলেছেন, তা সত্য বলে মেনে নেয়া: ঈমানের অন্যতম দাবি হচ্ছে রাসূলকে (সা.) সব ধরনের মিথ্যা ও অপবাদের ঊর্ধ্বে রাখা। তিনি যা বলেছেন, সত্য বলেছেন, এই বিশ্বাস হৃদয়ে ধারণ করা। তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যা খবর দিয়েছেন, তাকে সত্য জানা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি এবং তিনি প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কুরআন অহি, যা প্রত্যাদেশ হয়’। (সূরা আন নাজম :১-৪) নবীকে (সা.) অপবাদ দেয়া ও তাঁর কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা কুফুরি।
(ঘ) রাসূলের (সা.) অনুসরণ ও আনুগত্য : রাসূলকে (সা.) মুহব্বত করার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে নবী (সা.) যা বলেছেন এবং যা করেছেন, তার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও আনুগত্য করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’। (সূরা আল-আহযাব :২১) রাসূলের (সা.) আনুগত্য করা ফরজ: এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘রাসূল (সা.) তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক।’ (সূরা আল-হাশর :৭) আল্লাহ তায়ালা রাসূলের আনুগত্যকে তাঁর আনুগত্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন: ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহর আনুগত্য করে’। (সূরা আন-নিসা :৮০)
(ঙ) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সব বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী হিসেবে মেনে নেয়া : মানবসমাজ বিবাদের ঊর্ধ্বে নয়। সমাজের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন বিষয়ে মতদ্বৈধতা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে এই বিবাদ মিটানোর জন্য আমাদের রাসূলের (সা.) নীতি অনুসরণ করতে হবে। তিনি যে পথনির্দেশ দেখিয়েছেন, সেটিকেই চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে। রাসূলকে (সা.) ভালোবাসার এটিও একটি নজির। যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সব বিষয়ে সালিশ মানতে পারেন না, তিনি মুসলমান দাবি করতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের এবং তাঁদের, যাঁরা তোমাদের মধ্যে ফয়সালার অধিকারী। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে মতভেদ কর, তবে তা প্রত্যার্পণ কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি। যদি তোমরা ঈমান এনে থাক আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি। আর এটাই উত্তম এবং পরিণামে কল্যাণকর’। (সূরা আন-নিসা :৫৯) যারা নিজেদের মুসলমান দাবি করে অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালা মেনে নেয় না, তারা মূলত মুনাফিক; ইসলামের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকতে পারে না।
(চ) রাসূলকে (সা.) ভালোবাসার নামে বাড়াবাড়ি : আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন, যারা রাসূলকে (সা.) মুহাব্বত করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। অতিরিক্ত বাড়িবাড়ি মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। আল্লাহর কিছু গুণাবলীকেও রাসূলের জন্য নির্ধারিত মনে করেন। এসব বাড়াবাড়ি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল পছন্দ করেন না। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবীকে (সা.) বললেন : আপনি এবং আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। তখন নবী (সা.) বলেন : তুমি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেললে; বরং তুমি বল, একমাত্র আল্লাহ যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে।’ (আহমদ)
এ বিষয়ে শেষ কথা বলতে চাই, রাসূলকে (সা.) আমাদের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে হবে, কিন্তু সে ভালোবাসা যেন হয় শরীয়তের গণ্ডির মধ্য থেকেই। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা রাসূলকে (সা.) ভালোবাসতে গিয়ে এমন কথা বলেন বা বিশ্বাস রাখেন, যা মূলত আল্লাহর শানে মানায়। এ রকম কথা ও বিশ্বাসকে পরিহার করে রাসূল (সা.) যা করতে বলেছেন এবং তিনি যা করেছেন, তা হুবহু অনুকরণ করতে পারলেই তাঁর পরম ভালোবাসার পাত্র হওয়া যাবে, অন্যথায় নয়। মনে রাখা দরকার, রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে বেশি প্রয়োজন মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, বছরে একবার রমযান মাসে শুদ্ধভাবে রোযা রাখা, ইসলামের বিধান মানা, হারাম থেকে দূরে থাকা, সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজে বাধা দেয়া, ব্যক্তি পরিবার ও রাষ্ট্রের মধ্যে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করা। এগুলোর মধ্যেই রাসূলকে পাওয়া যাবে; পাওয়া যাবে তাঁর মুহাব্বত। রাসূলের (সা.) নামে মিলাদ-মাহফিল করলাম, কিন্তু তাঁর আদর্শকে বুকে ধারণ করতে পারলাম না। এটি দুঃখজনক। আল্লাহ আমাদের রাসূলকে (সা.) পরিশুদ্ধ ভালোবাসা অর্জনের তাওফিক দিন। (চলবে)

Related Post