হেরি বর্বরতা পোষাণ আঁখিল

হেরি বর্বরতা পোষাণ আঁখিল

হেরি বর্বরতা পোষাণ আঁখিল

প্রতিবাদ করার যখন কেউ থাকে না বা প্রতিবাদ করার সাহস যখন কেউ করে না, তখন অপরাধীদের দৌরাত্ম বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। আবু তালিবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সে সময়ে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের ওপরে শারীরিকভাবে নির্যাতন কেউ করতে পারেনি। আবু তালিব আর পৃথিবীতে নেই, প্রেমময়ী খাদিজাও নেই। কে ছুটে আসবে নবীর পাশে। মক্কার কাফিররা নির্ভীক চিত্তে নবীর ওপরে অত্যাচার শুরু করে দিল। ইসলাম বিরোধিদের ধারণা, বিগত দিনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচার আশ্রয়ে ইসলামী কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, এখন তাঁর আশ্রয়দাতা নেই। এবার তাঁর ওপরে নির্যতন শুরু করে দিলে সে বাধ্য হয়েই এই কার্যক্রম ত্যাগ করবেল এই অমূলক ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁরা আল্লাহর রাসূলের সাথে অকারণে অমানবিক আচরণ শুরু করলো। নির্যাতনের নিত্য-নতুন পদ্ধতি তাঁরা প্রয়োগ করতে থাকলো।
আল্লাহর নবী যে পথ দিয়ে কা‘বায় আসবেন,সে পথে ময়লা আবর্জনা বা বিষাক্ত কাঁটা বিছিয়ে রাখতো কাফির গোষ্ঠী। তিনি কা‘বায় নামাজ আদায় করছেন, তাঁকে নানাভাবে বিদ্রুপ করা হতো। নামাজে সিজদারত রায়েছেন আল্লাহর নবী, এ সময় তাঁর পবিত্র মাখথায় উটের পচা গলিত নাড়ি- ভুড়ি চাপিয়ে দেয়া হতো। ছোট মেয়ে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহা পিতার এই করুন অবস্থা দেখে আর্তচিৎকার করে কাঁদতেন আর পিতার মাথার ওপর থেকে আবর্জনা সরিয়ে পিতাকে ভার মুক্ত করতেন। তিনি নামাযে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর পবিত্র গলায় কাপড় জড়িয়ে দু‘দিক থেকে এমনভাবে টেনে ধরা হত যে, তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। ঐতিহাসেকগণ বর্ণনা করেছেন, এতে করে নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের কন্ঠে দাগ হয়ে যেত। তিনি বাইরে বের হলেই মক্কার কাফির নেতৃবৃন্দ দুষ্ট প্রকৃতির ছেলেদেরকে তাঁর পেছনে লেলিয়ে দিত। তাঁরা আল্লাহর রাসূলের পেছনে পেছনে যেত আর তাঁকে বিদ্রুপ করতো।
তিনি নামাযে উচ্চকন্ঠে কোরআন তিলাওয়াত করতেন আর আবু জেহেল তাঁর সাথিদের নিয়ে নবীকে গালাগালি দিতো। আল্লাহর নবী বাজারে গেলেন। সেখানে লোকজনকে ইসলামের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন। আবু জেহেল লোকদেরকে বললো- তোমরা এই লোকটার কথায় কান দিও না। এই লোকের প্রতারণায় তোমরা নেপতিত হবে না। এ লোক ধোকাবাজ যাদুকর। (নাউযুবিল্লাহ)
কথা শেষ করে আল্লাহর দুশমন আবু জেহেল লোকজনের সামনে আল্লাহর নবীর পবিত্র শরীরে নোংরা কাদা নিক্ষেপ করলো। আল্লাহর নবী কা‘বায় নামায আদায় করছেন। কাফিরের দল দূরে বসে বসে তাঁকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছিল। হঠাৎ আবু জেহেল বলে উঠলো- মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন নামাযে সিজদা করে তখন তাঁর মাথার ওপরে উটের নাড়ি- ভুড়ি চাপিয়ে দিলে ভালো হয়। তোমরা কি কেউ এ কাজ করতে পারবে?
সত্যের শত্রু ওকআ বললো -তোমরা দেখো, আমিই তাঁর মাথায় উটের নাড়ি- ভুড়ি চাপিয়ে দিচ্ছি। এ কথা  বরেই সে উটের নাড়ি- ভুড়ি এনে বিশ্বনবীর মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল তখন নামাজে সিজদায় ছিলেন। মাথা উঠাতে পারলেন না তিনি। নবীর এই কষ্ট দেখে কাফিরের দল হেসে হেসে একজনের শরীরে আরেকজন লুটিয়ে  পড়ছিল। পাঁচ বছরের শিশু মেয়ে ফাতিমা পিতার এই দূরাবস্থার সংবাদ পেয়ে করুণ কন্ঠে আর্তনাদ করে ছুটে এলেন। কচি হাত দুটো দিয়ে পরম মমতায় পিতার মাথা থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করে কাফিরদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর দরবারে বিচার চাইলেন ।
নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মক্কার ইসলাম বিরোধী লোকগুলো নিজেরা তো ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ করতোই সেই সাথে মক্কায় যাদের নতুন আগমন ঘটতো, তাদের সামনে ও তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করতো আবু জেহেলর অনুসারীরা। মক্কার বাইরের একজন লোক একটা উট নিয়ে মক্কায় এসেছিল। আবু জেহেলর সে উট কিনে নিয়ে উটের মালিককে অর্থ প্রদান করতে অনিচ্ছা প্রদর্শন করতে থাকে।লোকটা যখন বুঝলো আবু জেহেল তাকে অর্থ না দিয়েই উট নিয়ে নেবে তখন সে কা‘বাঘরে এসে চিৎকার করে বলতে তাকে- আবু জেহেল আমার উট নিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করছে না। সে আমার ওপরে জুলুমর করছে। আপনাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন, যিনি এই জুলুমের প্রতিকার করবেন? আমার অধিকার আমাকে আদায় করে দিবেন? লোকটির কথা শুনে কাফিরের দল মনে করলো আল্লাহর রাসূলকে হাসির পাত্রে পরিণত করার এই তো সুযোগ। মক্কার বাইরের ঐ লোকটির সামনে আবু জেহেল যেন নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামকে অপমান করে সে ব্যবস্থা করলো লোকটিকে তারা তারা ডেকে আল্লাহর রাসূলকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে বললো ঐলোকটির কাছে যাও, সে তোমার অধিকার আদায় করে দেবে।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম সে সময়ে কা‘বায় অবস্থান করছিলেন। লোকটি তাদের কথানুসারে আল্লাহর রাসূলের কাছে সমস্ত ঘটনা বলে আবেদন করলেন হে আল্লাহর বান্দাহ! আপনার ওপরে আল্লাহ রহমত নাযিল করুন, আপনি আবু জেহেলের কাছ থেকে আমার অধিকার আদায় করে দিন।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে সাথে করে আবু জেলেলের বাড়ির দিকে চললেন। ওদিকে কাফিররা একজনকে আল্লাহর রাসূলের পেছনে প্রেরণ করলো আবু জেহেল কিভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামকে অপমান করে তা দেখার জন্য। আল্লাহর নবী আবু জেহেলের বাড়ির দরজায় আঘাত করলেন। সে ভেতর থেকে জানতে চাইলো আগন্তুকের পরিচয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন- দরজা খুলে বাইরে এসো।
আবু জেহেল বাইরে এসে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তাঁর টেহারায় মৃত্যু আতষ্ক ফুটে উঠেলো। গোটা অবয়ব বিবর্ণ হয়ে গেল- সে যেন তার সামনে মৃত্যুদূত দেখছে। আল্লাহর নবী গম্ভীর কন্ঠে আদেশ দিলেন- এই লোকের যে অধিকার রয়েছে তোমার কাছে, তাঁর অধিকার তাকে বুঝিয়ে দাও।
আবু জেহেল আতষ্কিত কন্ঠে বললো, এখুনি দিচ্ছি। এ কথা বলেই সে তার ঘরে গিয়ে দ্রুত অর্থ এনে লোকটিকে দিয়ে দিল। আল্লাহর রাসূলও কা‘বায় ফিরে এলেন। বিদেশী লোকটি কা‘বায় এসে কাফিরদেরকে বললো- মহান আল্লাহর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের ওপর রহমত নাযিল করুন, তিনি আমার অধিকার আদায় করে দিয়েছেন।

কাফিররা ধারণা করেছিল আবু জেহেল লোকটির সামনে আল্লাহর রাসূলকে অপমান করবে। কিন্তু বিষয়টি হলো উল্টো। আশাহত কাফিররা প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেলো। ইতোমধ্যে আবু জেহেল সেখানে এলো। তাঁর ছেহারা থেকে তখন পর্যন্ত ভয়ের চিহৃ মুছে যায়নি। অন্যরা তাকে জিজ্ঞাসা করলো ঘটনা কি? তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের কথায়  মূল্য দিয়ে দিলে ?
আবু জেহেল বললো- মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের কথায় মূল্য না দিলে সে ভয়ষ্কর একটি উট আমাকে খেয়ে ফেলতো। আমি দরজা খোলার পরে দেখলাম তাঁর পেছনে একটি বিরাট উট দাঁড়িয়ে আছে। খোদার শপথ! তেমন উট আমি কোথাও দেখিনি। উটের চেহারা বড় ভয়ষ্কর, আমি মূল্য প্রদান না করলে উট আমাকে খেয়ে ফেলতো। (ইবনে হিশাম)
এভাবেই সেদিন আল্লাহর তা’য়ালা তাঁর রাসূলকে অপমান করার কাফিরদের ষড়যন্ত্র বান্চাল করে দিয়েছিলেন। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা তাঁরা ঘটিয়েছে।যারা প্রত্যক্ষভাবে নবীর সাথে শত্রুতা করেছে, মহান আল্লাহর পবিত্র কোরআনে তাদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।রাসূলের চাচা আবু লাহাব এবং তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল আল্লাহর নবীকে নানাভাবে অত্যাচার করেছে। তাদের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লহর পবিত্র কোরআনের সূরা লাহাব অবতীর্ণ করেছেন। আবু লাহাব যখন জানতে পারলো তাঁর পরিণতি সম্পর্কে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, তখন সে পাথর খন্ড নিয়ে আল্লাহর রাসূলকে আঘাত করার জন্য কা‘বায় বসে থাকলো। কিছুক্ষণ পরে নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম সঙ্গী আবু বকরকে সাথে করে কা‘বায় এলেন। মহান আল্লাহর আবু লাহাবের চোখ থেকে তাঁর রাসূলকে অদৃশ্য করে দিলেন। আবু লাহাব হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করলো- কোথায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম? আমি জানতে পারলাম সে আমার সম্পর্কে শাস্তির কথা বলছে। তাঁকে এখন আমি কাছে পেলে এই পাথর দিয়ে আঘাত করতাম।
এ কথা বলে গর্বিত ভঙ্গিতে সে চলে গেল। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছে জানতে চাইলেন- হে আল্লাহর রাসূল! আবু লাহাব আপনাকে দেখতে পেল না কেন?
আল্লাহর রাসূল বললেন -সে আমাকে দেখতে পায়নি। আল্লাহ তার চোখকে আদেশ দিয়েছিলেন যেন সে আমাকে দেখতে না পায় ।
কাফির নেতা উমাইয়া ইবনে খালফ আল্লাহর রাসূলকে দেখা মাত্র কটুবাক্য বর্ষণ করতো এবং অকারণে হৈচৈ করতো। লোকদের কাছে নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নিন্দা করতো।এই নিকৃষ্ট লোকটির অশুভ পরিণতি এবং তাঁর চরিত্রের খারাপ দিক সম্পর্কে আল্লাহ সূরা হুমাঝা অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহর রাসূলের সাহাবী হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু ছিলেন একজন কর্মকার। তিনি লৌহকাত অস্ত্র নির্মাণ করে বিত্রিু করতেন্ তাঁর কাছ থেকে তরবারী ত্রুয় করেছিল আ’স ইবনে ওয়ায়েল নামক এক কাফির। সম্পূর্ণ অর্থ সে তখন পর্যন্ত পরিশোধ করেনি। হযরত খাব্বাব তার কাছে তরবারীর মূল্য চাইলেই সে বিদ্রুপ করে বলতো -হে খাব্বব! তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম তো বলে বেড়ায় জান্নাতে যারা যাবে তাঁরা ইচ্ছে অনুযায়ী স্বর্ণ রৌপ্য হিরা জহরত ও অসংখ্য দাস দাসী পাবে, তাঁর কথা ঠিক কিনা?
হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু জবাব দিতেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের কথা অবশ্যই ঠিক।
আ‘স ইবনে ওয়ায়েল বিদ্রুপ করে বলতো- হে খাব্বাব! তাহলে আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময় দাও! আমি তোমাদের ঐ জান্নাতে গিয়েই তোমার অর্থ পরিশোধ করব আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তুমি আর তোমার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার চেয়ে বেশী মর্যাদা লাভ করতে পারবে না। আমার চেয়ে বেশী সৌভাগ্যবান হতে পারবে না।
এই কাফিরের ঘৃণ্য পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা মরিয়মের আয়াত অবতীর্ণ করেন। নাদার ইবনে হারেস ছিল ইসলামের আরেক শত্রু। নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন কোরআন তিলাওয়াত করতেন, লোকদেরকে ইসলামের দিকে আহবান জানাতেন, ইসলামের সাথে অতীতে বিরোধিতা করার কারণে আল্লাহর গযবে পড়ে ধ্বংস হয়েছে, এসব ইতিহাস শোনাতেন তখন এই কাফির সে সমাবেশে নীরবে বসে থাকতো। আল্লাহর নবী চলে যাবার পরে সে উঠে দাঁড়িয়ে মানুষদেরকে বলতো- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম যা বলে তার কোন ভিত্তি নেই। তাঁর বলা কাহিনী জানি।
এই লোকের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহর সূরা ফুরকানের আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। আরেকজন কাফির আখনাস ইবনে শুরাইক, সেছিল সমাজের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এই লোকটি নানাভাবে আল্লাহর নবীকে অত্যাচার করতো। তার নিন্দনীয় পরিণতি সম্পর্কে সূরা কলমের আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহর দুশমনদের নেতা ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা বলতো- আমি এবং আবু মাসউদের মত প্রভাবশালী লোক থাকতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের মত লোকের ওপরে ওহী নাযিল হলো? আল্লাহ আর লোক পাননি বুঝি?
এই কাফিরদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ সূরা যখরূফের আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের কথার প্রতিবাদ করে তাদের নির্মম পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। ইসলামের দুশমন উকবা এবং উবাই ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু । বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন এক সমাবেশে মানুষদেরকে ইসলামের কথা বলছিলেন, তখন উকবা এসে রাসূলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। উবাই এ সংবাদ জানতে পেরে ছুটে এসে তাঁর বন্ধু উকবাকে বললো- তুমি তাঁর কথা শুনো তা কি আমি জানিনা মনে করেছো? তুমি যদি তাঁর চেহারায় থুথু নিক্ষেপ না করো তাহলে তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না।

হতভাগা উকবা বন্ধুর কথায় তাই করেছিল, কিন্তু আল্লাহ ত’য়ালা কাফিরের অপবিত্র থুথু থেকে তাঁর নবীকে হেফাজত করেছিলেন। মহান আল্লাহ উকবা এবং উবাইকে জাহান্নামের অতলে নিমজ্জিত করুন। তাদের কঠিন পরিণতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনেব আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের ভয়ংকর অবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে দিলেন। একদিন উবাই একটা পুরোনো হাড় এনে নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বললো – হে মুহাম্মাদ! তোমার কি বিশ্বাস হয় এই পচা হাড়কে আল্লাহ আবার জীবিত করবেন? এ কথা বলে সে হাড়টি গুড়ো করে বাতাসে উড়িয়ে দিল।
নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম দৃঢ়কন্ঠে বললেন  মহান আল্লাহ বাতাসে মিশ্রিত হাড়কে আবার জীবিত করবেন এবং জাহান্নামে প্রেরণ করবেন। এসম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে –
قُلْ كُونُوا حِجَارَةً أَوْ حَدِيدًا ﴿٥٠﴾ أَوْ خَلْقًا مِّمَّا يَكْبُرُ فِي صُدُورِكُمْ ۚ فَسَيَقُولُونَ مَن يُعِيدُنَا ۖ قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ ۚ فَسَيُنْغِضُونَ إِلَيْكَ رُءُوسَهُمْ وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هُوَ ۖ قُلْ عَسَىٰ أَن يَكُونَ قَرِيبًا ﴿٥١﴾
এদেরকে বলে দাও, তোমরা পাথর বা লোহাই হয়ে যাও অথবা তার চাইতেও বেশি কঠিন কোন জিনিস, যার অবস্থান তোমাদের ধারণায় জীবনীশক্তি লাভ করার বহুদূরে (তবুও তোমাদের ওঠানো হবেই) তারা নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে, কে আমাদের আবার জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনবে? জবাবে বলো, তিনিই, যিনি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন। তারা মাথা নেড়ে নেড়ে জিজ্ঞেস করবে, আচ্ছা, তাহলে এটা  কবে হবে? তুমি বলে দাও, অবাক হবার কিছুই নেই, সে সময়টা হয়তো নিকটেই এসে গেছে । (সূরা বনী ইসরাঈল- ৫০-৫১)
আরেকদিন বিশ্বনবী কা‘বাঘর তাওয়াফ করছিলেন, এ সময়ে কাফের নেতারা বিশ্বনবীকে ঘিরে ধরে প্রস্তাব দিল – এসো, আমরা একটা প্রক্রিয়ায় আমাদের বিরোধ শেষ করে দেই। তাহলো, আমরা তোমার আল্লাহর দাসত্ব কিছুটা করি তুমিও আমাদের প্রতিপালকের দাসত্ব কিছুটা করো। তাহলে আমাদের ভেতরে কোন বিরোধ থাকবে না।
তাদের কথার জবাবে মহান আল্লাহর সূরা কাফেরূন অবতীর্ণ করে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, হে নবী আপনি তাদেরকে জানিয়ে দিন আমি যার দাসত্ব করি তোমরা তাঁর দাসত্ব করো না। তোমরা যার দাসত্ব করো আমি তাঁর দাসত্ব করি না। তোমাদের জন্য তোমাদের জীবন ব্যবস্থা আর আমার জন্য আমার জীবন ব্যবস্থা।
ইসলামে আপোষের কোন স্থান নেই -সহঅবস্থানের স্থান রয়েছে। কোন সাস্প্রদায়িকতার স্থান নেই ইসলামে – যার যার ধর্ম সে সে অবশ্যই পালন করবে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান ইসলামে নেই। পবিত্র কুরআনের এই আয়াত দিয়ে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলেন তাদের উচিত আয়াতটির পটভূমি দেখা। পৃথিবীর কোন নবী- রাসূল ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ছিলেন না। কাফির এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সাথেই তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। নবীগণের আগমন ঘটেছেই মহান আল্লাহর বিধান রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। সুতরাং কুরআনের আয়াতকে যারা ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করে তাদের সতর্ক থাকা উচিত। মহান আল্লাহর ক্রোধ যে কোন মুহূর্তে অবতীর্ণ হতে পারে।
এ ব্যাপারে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর ঘোষণা বলবৎ থাকবে যে, খণ্ডিতভাবে ইসলাম অনুসরণ করা যাবে না বা ব্যক্তি জীবনে ইসলামের নামায- রোযা- হজ্জ- এর বিধান পালন করা হবে, এই সুযোগ আল্লাহ তা‘য়ালা কাউকে দেননি। এ ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন এবং আমাদের জন্য আমাদের দ্বীন। এ দুয়ের সংমিশ্রণ, সহ-অবস্থান, সন্ধি,পরস্পর তাল মিলিয়ে চলার কোন পথ উন্মক্ত নেই।
মুসলমানদের দ্বীন হচ্ছে সম্পূর্ণ নির্ভেজাল তাওহীদ ভিত্তিক দ্বীন এবং এর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান- ধারণা, আইন-বিধান, আকীদা-বিশ্বাস তথা জীবনের সামগ্রিক দিক সম্পূর্ণভাবে মহান আল্লাহ দেয়া বিধানের অনুকূলে প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে শিরকের কোন নাম-গন্ধও নেই। এর কোন একটি পর্যায়ে বা স্তরে শিরকের কোন মিশ্রণ নেই এবং শিরকের প্রতি সামান্যতম নমনীয়তাও নেই। সম্পূর্ণ শিরকের পঙ্কিলতা মুক্ত এক পবিত্র পরিচ্ছন্ন জীবন ব্যবস্থা। এই জীবন ব্যবস্থার সাথে শিরকের বিন্দুমাত্র আপোষ হতে পারে না- এ জন্য চিরস্থায়ীভাবে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের পথ তোমাদের জন্য আর আমার পথ আমার জন্য। তোমরা যে জীবনধারা অনুসরণ করছো, তা একান্তভাবেই তোমাদের জন্যই, আর আমরা যে জীবনধারা অনুসরণ করছি, তা একান্তভাবেই আমাদেরই জন্য। এর ভেতরে আপোষ করার কোন সুযোগই নেই। ইসলামে শক্তি প্রয়োগের স্থান নেই। ইসলাম তাঁর আকিদা- বিশ্বাসকে গ্রহণ করতে কাউকে বাধ্য করে না। কারণ বিশ্বাস জিনিসটা হলো একান্তভাবেই মনের ব্যাপার, এটা  করো ওপর শক্তি প্রয়োগ করে চাপিয়ে দেয়ার জিনিস নয়। একইভাবে, ইসলাম তার আকিদা- বিশ্বাসের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ইবাদাতকেও কোন ব্যক্তির ওপর শক্তি প্রয়োগ করে চাপিয়ে দেয় না। কারণ দৃঢ় বিশ্বাস ব্যতীত ইসলামের ইবাদতসমূহ অর্থহীন। দৃঢ় বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করেই নামায- রোযা ইত্যাদি আদায় করতে হয়। এসব দিকে ইসলাম মানুষকে স্বাধীনতা দিতে চায়। পক্ষান্তরে ইসলাম এটা সহ্য করতে না রাজ যে, সমাজ ও সভ্যতা পরিচালনাকারী যে আইন ও বিধানের ওপর রাষ্ট্রের কাঠামো ও বিধি-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ রচনা করে দিক, আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহী মানুষজন আল্লাহর পৃথিবীতে আইনের প্রয়োগ করুক বা বাস্তবায়ন করুক, মুসলিম জনগোষ্ঠী তা পালন করুক এবং তাদের দাস হয়ে থাকুক- এই সুযোগ ইসলাম দিতে নারাজ।
আল্লাহর রাসূলের প্রতিবেশী যারা ছিল তাদের ভেতরে একমাত্র হাকাম ইবনে আ‘স রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা ব্যতীত আর কেউ ইসলাম কবুল করেনি। নবী করীম সাল্লাহু আলায়াহি ওয়াসাল্লাম যখন নিজের বাড়িতেই নামাযে দাঁড়াতেন তখন প্রতিবেশী উকরা, আদী এবং অন্যরা তাঁর ওপরে পশুর নাড়ি- ভুড়ি ছুড়ে দিত। তিনি বাধ্য হয়ে দেয়ালের আড়ালে নামায আদায় করতেন। তিনি রান্নার জন্য উনুনে পাত্র উঠাতেন আর তাঁরা সেই পাত্রের ভেতরেও আবর্জনা ছুড়ে দিত। তিনি নিজ হাতে সেসব আবর্জনা পরিঙ্কার করতেন। এভাবে হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা ও আবু তালিবের অভাবে বিশ্বনবী সাল্লাহু আলায়াহি ওয়াসাল্লাকে কাফিরের দল তাঁর নিজ বাড়ির ভেতরে ও নির্যাতন করেছে। সে সমস্ত ঘটনা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে রায়েছে।

Related Post