সন্তানদের সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলা এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রত্যেক বাবা-মার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তোলা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ। আল্লাহ বলেন,‘হে মুমিন, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর ওই অগ্নি থেকে—যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর—যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয়,কঠোর স্বভাব ফেরেশতারা—যারা অমান্য করে না আল্লাহকে—যিনি তাদের আদেশ করেন তা এবং তাঁরা যা করতে আদিষ্ট হন, তা-ই করেন।’ (আল-তাহরিম : ৬)
খেলাধুলা ও জাগতিক আরও কিছু বিষয় এর সঙ্গে যোগ করা হয়। এভাবে তারা তাদের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারেন না। কারণ তাদের গুরুত্বের সবটুকু জুড়ে থাকে শারীরিক প্রতিপালন। কখনও বুদ্ধিবৃত্তিক লালনকেও এর সঙ্গে যোগ করা হয়। তবে রুহ তথা আত্মার খোরাক সম্পর্কে উদাসীনতা দেখানো হয়। অথচ বাস্তবে মানুষ প্রথমে রুহ, তারপর বুদ্ধি, এরপর দেহ।
সন্তানকে দুনিয়াদারির সঙ্গে সঙ্গে আখিরাতের প্রস্তুতির শিক্ষা দিতে হবে। জাগতিক সব শিক্ষা-দীক্ষার পাশাপাশি পারলৌকিক জ্ঞানও দিতে হবে। শরিয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকামের ইলম শেখাতে হবে। শুধু ধারণা দেয়াই যথেষ্ট নয়;সার্বিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে তার অনুশীলনও করাতে হবে। মৌলিক দ্বীনি জ্ঞান এবং আমল-ইবাদত শেখাতে হবে। আর ইমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক চর্চিত আমল সালাত। সন্তানকে তাই প্রাপ্তবয়স্ক না হতেই সালাত শেখাতে হবে। শিক্ষা দিতে হবে সালাত আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ইলম।
আল্লাহ দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন। আত্মার পরিচর্যার সর্বোত্তম মাধ্যম সালাত। সালাতের মাধ্যমে রুহের সঙ্গে তার রবের যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন থাকে। এতে রুহকে কোনো দুর্বলতা স্পর্শ করে না। রিপু ও কামনা-বাসনাসহ দেহ ব্যক্তির ওপর বিজয়ী হতে পারে না। দার্শনিক ইমাম গাজ্জালির ভাষায়, ‘আল্লাহ দেহকে সৃষ্টি করেছেন রুহের একটি বাহন হিসেবে। রুহ যখন মানুষের দেহকে পরিচালনা করে, তখন মানুষ সত্যিকার মানুষে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে রুহ যখন দেহের অনুগত হয়ে পড়ে, মানুষ তখন তার মনুষ্যত্বহারা হয়ে যায়।
এখানেই সালাতের গুরুত্ব নিহিত। সালাত তাই দ্বীনের স্তম্ভ। যে ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত ত্যাগ করে, সে ইমানের গণ্ডির প্রায় বাইরে চলে। এ থেকেই সন্তানকে সালাতের প্রশিক্ষণ দেয়ার গুরুত্ব অনুমেয়। সন্দেহ নেই, এর গুরুত্ব কোরআন শিক্ষা, লেখাপড়া ও হিসাব-নিকাশ শেখানোর চেয়ে বেশি। বাবা-মা হিসেবে আমরা কি সত্যিই এর গুরুত্ব অনুধাবন করি?কত অভিভাবকই তো আছেন, যারা তাদের সন্তানকে দশ বছর ধরে বিদ্যালয়ে আনা-নেয়া করে ক্লান্ত। কখনও তাদের হোমওয়ার্ক করাতে গিয়ে তারা রাতও জাগেন,অথচ এ সন্তানকে কখনও সালাতের আদেশ দেন না; সালাতের অপরিমেয় গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ করেন না।
অনেক উদাসীন মুসলিম মনে করেন, তার সন্তান বড় হলে ঠিকই সালাত আদায় করবে। সাবালক না হওয়া অবধি তার আর সালাত কী! অথচ সিংহভাগ বাবা-মাকেই দেখা যায়, তাদের সাবালক সন্তানের সালাতের ব্যাপারেও গাফেল। তাদের সালাতের জন্য কোনো কথাই বলেন না। এদিকে যথাযথ শিক্ষা না পাওয়ায় সন্তানরাও সুযোগ গ্রহণ করে। ইহকালীন বিষয়ের মতো পরকালীন ব্যাপারেও বাবা-মা’র সঙ্গে চালাকি ও ধূর্তামি করে। সালাত আদায় না করেও তারা বাবাকে ইতিবাচক উত্তর দেয়। তারা মনে করে, এখন কেন, আমরা তো বুড়ো বয়সে সালাত কায়েম করব।
অপরিসীম গুরুত্বের কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশব-কৈশোর থেকেই সন্তানকে সালাতে অভ্যস্ত করাতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাত বছর হলে তাদের সালাতের নির্দেশ দাও, তাদের বয়স দশ বছর হলে এজন্য তাদের প্রহার করো এবং তাদের পরস্পরে বিছানা পৃথক করে দাও।’ (আবু দাউদ : ৪৯৫; মুসনাদ আহমদ : ৬৬৮৯) এদিকে আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও এবং তাতে নিজে অবিচল থাক, আমি তোমার কাছে কোনো জীবনোপকরণ চাই না, আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকিদের জন্য।’ (সুরা ত্বা-হা : ১৩২)
অথচ সাধারণ মুসলিমরা তো দূরের কথা,আমরা যারা নিয়মিত সালাত আদায় করি, শরিয়তের গণ্ডির মধ্যে থেকে জীবনযাপনের চেষ্টা করি, তারাও এ ব্যাপারে কর্তব্যে অবহেলা করি। নিজে ঘুম থেকে জেগে ফজরের সালাত আদায় করতে মসজিদে যাই, অথচ পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা সন্তানকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে যাই না। অনেকে আদরের সন্তানের ঘুম ভাঙানোর চেয়ে রমজানের ফরজ রোজা কাজা করা সহজ ভাবেন। তারা কি জানেন, সাহাবিদের বাণী হিসেবে অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, কিয়ামতের দিন সন্তানরা বাবা-মার পেছনে লেগে থাকবে। তারা চিত্কার করে বলবে, হে বাবা, আপনি আমাকে ধ্বংস করেছেন কেন?!!এমন হওয়ার কারণ সাধারণ বাবা-মার ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা আর যারা ইসলাম সম্পর্কে জানেন,তাদের ইসলামের নির্দেশনামাফিক সন্তান প্রতিপালনের জ্ঞান না থাকা। ইসলাম পিতৃত্ব ও মাতৃত্বকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করে। মুসলিম নর-নারীর উচিত,নিজেকে এ দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত করা। শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও কর্তব্য আগামী প্রজন্মকে এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলা।= সমাপ্ত=