মুত্তাকীরা রাতের বেলা কম ঘুমান

namaj

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মতদেরকে উপহার দিয়েছেন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ মাস রমযানুল মোবারক। এ মাসেই আল্লাহ তা’আলার পক্ষথেকে রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। রমযান মাসে সিয়াম সাধনায় মহান আল্লাহর অনন্ত অসীম রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। তাই তো রমযানের আগমনে আল্লাহ প্রেমিক বান্দার অন্তরে এক অনাবিল আনন্দধারা প্রবাহিত হয়। সকল ঈমানদারেরা শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে এই পবিত্র মাসটি অতিবাহিত করে। মুসলিম উম্মাহর জন্য রমযান অত্যন্ত কাংক্ষিত ও প্রাপ্তির মাস। রমজান এমন একটি মাস যে মাসে ইবাদতের সওয়াব অনেক বেশি। সুতরাং আল্লাহর দরবারে বিনয়াবনত হয়ে কাতর কণ্ঠে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে যেন শারীরিক সুস্থতা ও মনের শুদ্ধতা নিয়ে দিনের বেলায় সিয়াম সাধনা ও রাতে নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে এই মোবারক মাসের সদ্ব্যবহার করা যায়। রমজান মাস সতকর্ম ও আখিরাতের নেকি লাভের উত্তম মৌসুম। কিয়ামুল-লাইল বা রাতের নামাজের ফজীলত আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ কোন সন্দেহ নেই। ফরয নামাজের পর এ নামাজের স্থান। এ নামাজের বৈশিষ্ট্য শুধু ব্যক্তির পাপ মোচন করা নয়, বরং পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে হিফাযত করা। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা রাতের নামাজ জরুরী করে নাও, কারণ তা নেককার লোকদের অভ্যাস, তোমাদের রবের নৈকট্য, গুনাহের কাফফারা ও পাপ থেকে সুরক্ষা। (তিরমিযী) অর্থাত, আমাদের পূর্বপুরুষগণ কিয়ামুল লাইল বা রাতের নামাজের ব্যাপারে শিথিলতা করতেন না, কিন্তু বর্তমান যুগে অবস্থা পাল্টে অনেকের রাত পরিণত হয়েছে দিনে। তাদের থেকে বিদায় নিয়েছে রাতে আল্লাহর সাথে মোনাজাতের স্বাদ। অনেকের শিথিলতা ফজর নামাজের সীমা অতিক্রম করে গেছে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন : (রহমানের আসল বান্দা) তারাই যারা নিজেদের রবের সামনে সিজদায় অবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। (সূরা ফুরকান-৬৪)

আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন :- (মুত্তাকীরা) রাতের বেলা তারা কমই ঘুমাতো। (সূরা যারিয়াত-১৭) অর্থাত, তারা রাতের বেশীর ভাগ সময়ই মহান আল্লাহর ইবাদতে কাটাতেন এবং অল্প সময় ঘুমাতেন।

অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :- তাদের পিঠ থাকে বিছানা থেকে আলাদা, নিজেদের রবকে ডাকে আশংকা ও আকাংকা সহকারে এবং যা কিছু রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। তারপর কেউ জানে না তাদের কাজের পুরস্কার হিসেবে তাদের চোখের শীতলতার কি সরঞ্জাম লুকিয়ে রাখা হয়েছে। (সূরা সিজদাহ-১৬/১৭)

হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, হাদীসে কুদসীটি উদ্ধৃত হয়েছে যে, নবী করীম (সা) বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা বলেন : আমার সতকর্মশীল বান্দাদের জন্য আমি এমনসব জিনিস সংগ্রহ করে রেখেছি যা কখনো কোন চোখ দেখেনি,  কোন কান শোনেনি এবং কোন মানুষ কোনদিন তা কল্পনাও করতে পারে না। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও মুসনাদে আহমাদ)

জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম উপায় রাতের সালাত : আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করেন, তখন লোকেরা তার দিকে ছুটে গেল। আর চারদিকে ধ্বনিত হল : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করেছেন (তিনবার) আমি মানুষের সাথে তাকে দেখতে আসলাম। আমি যখন তার চেহারা ভালভাবে দেখলাম, পরিষ্কার বুঝলাম তার চেহারা কোন মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। আমি সর্বপ্রথম তাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন : হে লোকেরা! তোমরা সালামের প্রসার কর, খাদ্য দান কর, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখ ও রাতে নামাজ আদায় কর যখন মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী, ইবনে মাজা)

রমযানুল মোবারক মাসের শেষ দশকে রাব্বুল আলামীন লাইলাতুল কদর নামে এমন এক মহামূল্যবান ও মহিমান্বিত রজনী আমাদের দান করেছেন, যা ইতিপূর্বে কোন উম্মাতকে দেয়া হয়নি। লাইলাতুল কদর এমন একটি রজনী যা হাজার মাস (ইবাদাত) অপেক্ষা উত্তম।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে ইবাদত-বন্দেগীতে বেশি সময় ও শ্রম দিতেন, যা অন্য কোন রাতে দেখা যেত না। যেমন মুসলিম শরীফে আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে এসেছে যে, তিনি এ রাতে কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, নামাজ ও দোয়ার মাধ্যমে জাগ্রত থাকতেন এরপর সেহরী গ্রহণ করতেন। রমযানের শেষ দশক আসলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরনের লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। যেমন বোখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে এসেছে। তিনি এ দশদিনের রাতে মোটেই নিদ্রা যেতেন না। পরিবারের সকলকে তিনি এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য জাগিয়ে দিতেন। এ দশদিনের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ শেষ দশদিনে মসজিদে এ’তেকাফ করতেন। প্রয়োজন ব্যতীত তিনি মসজিদ থেকে বের হতেন না।

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব : আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এ রাতকে সকল রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি তার কালামে পাকে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ইরশাদ করেন : (১) হা-মীম, (২) শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, (৩) আমি তো এটা (কুরআনুল কারীমকে) অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমি তো সতর্ককারী। (৪) এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়; (৫) আমার আদেশক্রমে, আমি তো রাসূল প্রেরণ করে থাকি। (সূরা দুখান) ব্যাখ্যা : মুবারক রজনী দ্বারা মুফাস্সিরগণ লাইলাতুল কদরকে বুঝিয়েছেন। বরকতময় রজনী হল লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তা’আলা একে বরকতময় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এ রাতে রয়েছে যেমন বরকত তেমনি কল্যাণ ও তাতপর্য। বরকতের প্রধান কারণ হল এ রাতে আল-কোরআন নাযিল হয়েছে। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল আল্লাহ তা’আলা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন : (১) নিশ্চয় আমি একে (কুরআনুল কারীমকে) নাযিল করেছি কদরের রাতে। (২) কদরের রাত সম্পর্কে আপনি কী জানেন? (৩) কদরের রাত হচ্ছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (৪) এই রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতারা ও রূহ জিবরাঈল (আঃ) অবতীর্ণ হন তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। (৫) এ রাত সালাম তথা নিরাপত্তার রাত, যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা কদর)

লাইলাতুল কদরের ফযীলত ও মর্যাদা : মহান রাব্বুল আলামীন বিশ্ব মানবের হিদায়াত ও পথ নির্দেশিকা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এ রজনীতেই লাওহে মাহ্ফুজ থেকে প্রথম আসমানে সম্পূর্ণ রূপে অবতীর্ণ করেছেন। অতঃপর সুদীর্ঘ তেইশ বছর যাবত প্রয়োজন অনুসারে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অবতীর্ণ করেছেন। (ইবনে কাসীর) দুনিয়ার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ রজনী হলো কদরের রজনী। এ রজনীর গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে উম্মতে মুহাম্মদীকে অবহিত করানোর জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন’ ‘সূরা কদর’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। এ সূরায় উম্মাতে মুহাম্মদীকে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এই একটি রাতের ইবাদাত হাজার মাস ইবাদাতের চেয়েও উত্তম বলে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি কদরের রাতে পূর্ণ বিশ্বাস ও সওয়াবের নিয়্যাতে ইবাদাত করবে তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বুখারী)

হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রমযান মাসের আগমনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : দেখ এ মাসটি তোমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। এতে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাস থেকে অধিক উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর চিরবঞ্চিত ব্যক্তিই কেবল এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাযাহ)

আল-কোরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাত। তবে কুরআনের ভাষ্য হল লাইলাতুল কদর রমযান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমযান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রাত রমযানের শেষ দশকে হবে বলে সহী হাদীসে এসেছে। এবং তা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে হাদীসে এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর। (বুখারী)  নিঃসন্দেহে ঐ বরকতপূর্ণ রাতটি যে ব্যক্তি অবহেলায় বা অলসতায় অবমূল্যায়ন করল, এর যথার্থ গুরুত্বারোপ করল না সে সমূহ কল্যাণ থেকে নিজকে বিরত রাখল। প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উচিত যে, ঐ রাতের যথাযথ ভাবে হক আদায় করে মহান আল্লাহর পক্ষথেকে কল্যাণ, ফযীলত, বরকত ও আশাতীত সওয়াব লাভে ধন্য হওয়া। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে বেশী-বেশী করে ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে শেষ দশকের ফযীলত অর্জন করে তার নৈকট্য লাভের তাওফীক দান করুন। আমীন…

Related Post