Originally posted 2013-02-27 16:56:59.
আল্লাহ তা’আলার দেয়া ইবাদতগুলোর মধ্যে নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদত। কারণ মানুষ নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সামনে আপাদমস্তক অবনত করে দেয় এবং তারই শাহী দরবারে গোটা অবয়বই লুটিয়ে দেয়। সৃষ্টির সার্থকতা এখানেই পরিস্ফুট হয় বিধায় মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে যেহেতু নামাজের মাধ্যমেই এর প্রতিফলন ঘটে অর্থাত, একমাত্র নামাজের মাধ্যমেই মানুষ তার মর্যাদার সকল প্রতীককে আল্লাহর সামনে বিনা দ্বিধায় নত করে দেয়, সে জন্য অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদতে পরিণত হয়েছে। আল কুরআনের কোনো কোনো স্থানে শুধু রুকু ও সেজদাকেই নামাজ বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন : তুমি সেজদা করো এবং (তোমার রবের) নৈকট্য অর্জন করো। (সুরা আলাক-১৯) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন : তোমরা রুকু করো এবং সেজদা করো। (সূরা হাজ্জ-৭২) এখানে দুটি আয়াতে সেজদা করা মানে নামাজ পড়া।
আমরা নিয়মিত যে স্থানটিতে নামাজ আদায় করে থাকি সেটিকে মসজিদ তথা সেজদার স্থান বলা হয়। অর্থাত, মাথা অবনত করার স্থান। প্রকৃতপক্ষে গোটা নামাজে সেজদা এমন একটি কর্ম যার মাধ্যমে মানুষ তার সকল প্রকার অহংবোধ, অযথা সব মর্যাদা, আভিজাত্য, আমিত্ব, গর্ব-অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ, মান-অভিমানকে একপেশে ঠেলে দিয়ে সারা জাহানের প্রভু, পরম দয়ালু মনিব, সার্বভৌম ক্ষমতার নিরঙ্কুশ মালিক, পরাক্রমশালী রাজাধিরাজ, ইজ্জত অপমানের একমাত্র মালিকের সামনে মর্যাদার প্রতীক তথা মাথা, কপাল ও নাক মাটিতে লুটিয়ে দেয়। আনুগত্যের এ সুন্দর দৃশ্যটি নামাজ ব্যতীত অন্য কোনো ইবাদতে সুষ্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি নামাজের অন্যান্য কর্মে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় না বিধায় নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদতে পরিণত হয়েছে। সেজদার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সমীপে আরজ করি “তুমি সকল প্রকার দুর্বলতা, অক্ষমতা, অপারগতা, অংশীদারিত্ব থেকে পবিত্র। আমি দুনিয়ার সকল কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র তোমারই সামনে আমার সবকিছু উতসর্গ করে দিয়ে আমি তোমার মহানত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠত্বের পবিত্রতা ঘোষণা করছি। সেজদার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে কাছে চলে যায়। এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর রহমতের সব চাইতে নিকটবর্তী হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন : তুমি সেজদা করো এবং (তোমার রবের) নৈকট্য অর্জন করো। (সুরা আলাক-১৯) এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাকী নামাজ পড়ার সময় দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত সিজদায় পড়ে থাকতেন। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে : বান্দা সিজদায় থাকা অবস্থায় তার রবের সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী হয়। (সহীহ মুসলিম)
সর্বোপরি ইসলামের গোটা রূপটিই এখানে দৃশ্যমান হয়। ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ। সেজদা হলো এ আত্মসমর্পণের বাস্তব রূপ। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক হলো মনিব-গোলাম। মনিব-গোলামের এ সম্পর্ক বাস্তব রূপ দেখার জন্য সেজদাই হলো উপযুক্ত কর্ম। কপাল-নাক-মাটিতে রেখে গোটা দেহ সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দিয়ে গোলাম তার মহান মনিবের কাছে ধরনা দেয়ার এ সত্যিই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন : নিশ্চয় আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই গোলামী করো এবং আমার কথা সর্বদা মনে রাখার জন্য নামাজ কায়েম করো। (সূরা ত্বাহা-১৪) এ আয়াতে প্রথমেই আল্লাহর উলুহিয়াত ও উবুদিয়াত-এর সার্বক্ষণিক স্মরণ রাখার জন্য নামাজের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত আল্লাহকে ইলাহ তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে এ কথা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় যে, মানুষ আল্লাহকে মালিকরূপে মেনে নিয়েছে, আজীবন তাঁর আবদ বা বান্দাহ্ বা গোলাম হয়ে থাকবে। আর উবুদিয়াতের বাস্তব প্রতিফলন বা প্রদর্শনী বা গোলাম হিসেবে বেঁচে থাকার নামই নামাজ। নামাজের মধ্যে রুকু ও সেজদাই সবচেয়ে বেশি উবুদিয়াতের প্রতিফলন ঘটায়। একজন ব্যক্তি ঈমান গ্রহণ করে আনুগত্যের এ প্রশিক্ষণ ব্যক্তির নামাজের বাইরের সকল প্রকার কাজকে ইসলামের আলোকে সুসংহত করে। একজন ব্যক্তি ঈমান গ্রহণ করে ইসলামের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করার পর পরই তার প্রথম ও প্রধান বাধ্যতামূলক কাজ হলো নামাজ আদায় করা। ঈমান গ্রহণের পর যে নামাজই সামনে আসবে তা তাকে আদায় করতে হবে।
দুনিয়ার যাবতীয় কাজ আল্লাহর বান্দাহ্ হিসেবে করতে হবে। এ অনুভূতিকে বার বার জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তুলবে নামাজ। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : নামাজ আদায় করার পর যমিনে ছড়িয়ে পড়া আল্লাহর অনুগ্রহের সানে ব্যাপৃত হও এবং আল্লাহকে খুব স্মরণ করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (সুরা জুমআ-১০) নামাজ প্রতিদিন ধনী-দরিদ্র, রাজা-ফকীর সবাইকে একই সত্তায় সামনে নিজের নাক-কপাল ও মাথা লুটিয়ে দিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে নিশ্চিহ করে দেয়। সবাই এখানে একই কায়দায় নিজেদের সকল প্রকার গর্ব-অহঙ্কার, আভিজাত্য ও মর্যাদার উঁচু নিচুকে সমান করে একই রাজাধিরাজের কাছে ধরণা দিয়ে থাকে। যে রাজাধিরাজ কোনো ব্যক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিশেষ মর্যাদা ও উঁচু নিচুর শ্রেণী বিন্যাস করেন না। এবং তাকেও কোনো ব্যক্তি কখনো তার বিশেষ মর্যাদার প্রভাবে প্রভাবিত করতে পারেন না। কুরআন ও হাদীসে নামাজের কথা এত বেশি উদ্ধৃত হয়েছে যা অন্য কোনো ইবাদতের বেলায় দেখা যায় না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : সালাত মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে। যেমন আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন : তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করে খাঁটিভাবে ঈমান আনে এবং নামাজ কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দীনি ভাই হিসেবে গণ্য হবে। (সূরা তাওবা-১১) এ নামাজের কথা বলে বলে নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সুতরাং নামাজের অন্যান্য আহকামসহ বিশেষ করে রুকু ও সেজদার সময় যদি আমরা মনে রাখতে পারি যে, আমরা কার সামনে এ মর্যাদার প্রতীককে লুটিয়ে দিচ্ছি। তাহলে আমাদের নামাজের সার্থকতা সর্বকাজে প্রতিফলিত হবে।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র স্মরণ (জীবনের জন্য) সর্বোতকৃষ্ট কাজ। তোমরা (যে কাজ) কর, আল্লাহ্ তা জানেন। (সূরা আনকাবুত-45) আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে নামাজ প্রতিষ্ঠা করার তাওফীক দান করুন। আমীন…