নামাযের মৌলিক শিক্ষা

নামাযের মৌলিক শিক্ষা

নামাযের মৌলিক শিক্ষা

সালাত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। অতএব তোমরা শুধু আমারই ইবাদত করো এবং আমার স্মরণে সালাত কায়েম করো(সূরা তাহা : ১৪)। আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি,সালাত হচ্ছে বান্দার ওপর আল্লাহর হক।

সালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘কারো দিকে মুখ ফিরানো, কারো দিকে অগ্রসর হওয়া, কারো কাছে প্রার্থনা করা অথবা কারো নিকটবর্তী হওয়া।’ তা ছাড়া ঈমানের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে সালাত। রাসূল সা: বলেছেন, ‘ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ বা খুঁটি। ১. সাক্ষ্যদান করা যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই আর মুহাম্মদ সা: আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, ২. সালাত কায়েম করা, ৩. জাকাত আদায় করা, ৪. হজ পালন করা ও ৫. রমজান মাসে সিয়াম সাধনা করা।’

অতএব ঈমানের পর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা আমল হচ্ছে সালাত কায়েম করা। যে কেউ যখনই ঈমান আনবে পরক্ষণে বা তখনই সালাতের সময় হলে সে ব্যক্তির ওপর সালাত ফরজ হবে।

আমরা সাধারণত সালাতের ফজিলত, ফায়দা বা নেকির কথাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সালাতের ফজিলত বা নেকি পেতে হলে সালাতের হাকিকত বা মৌলিক শিক্ষা কী তা জানতে হবে। সালাতের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে সব ধরনের অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে (সূরা আনকাবুত: ৪৫) সালাতের আরো অনেক ফজিলত আছে। সালাতের এ ফজিলত পেতে হলে তার হাকিকত বা মৌলিক শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের জানতে ও মানতে হবে এবং সে মোতাবেক আমল বা কাজ করতে হবে।

সালাত কিভাবে আমাদেরকে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে? এ প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ বলেছেন, ওয়া আক্কিমুসসালাতা লিজিকরি অর্থাৎ তোমরা আমার স্মরণে সালাত কায়েম করো। (সূরা তোহা : ১৪) এখানে জিকির শব্দের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর সব আইন-কানুন, বিধি-বিধান বা হুকুম-আহকাম মেনে নেয়া আর সে মোতাবেক আমল বা কাজ করা। তা ছাড়া আল্লাহ সালাতের ফজিলতের সাথে সাথে হাকিকতের কথাও বলেছেন। যেমন বলা হয়েছে, ‘মূলত (সালাতের মাধ্যমে) আল্লাহকে স্মরণ করাও একটি মহান কাজ, তোমরা যা কিছু করো না কেন আল্লাহ তা অবগত আছেন’। (সূরা আনকাবুত: ৪৫) অর্থাৎ সালাতে ইমাম সাহেব বা আমাদের পঠিত আয়াত থেকে আল্লাহর বিধি-বিধান বা হুকুম-আহকামগুলো জেনে ও মেনে নিয়ে আমল করাই হচ্ছে সালাতের মৌলিক শিক্ষা। কুরআনে নামাজকে সালাত বলা হয়েছে।

সালাত আমাদেরকে কী শিখায়? এ প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ বলেন, অবশ্যই আমি তোমাদেরকে সাত আয়াতবিশিষ্ট (একটি সূরা) দিয়েছি, যা (সালাতের ভেতর ও বাইরে) বারবার পঠিত হয়, আরো দিয়েছি (হিদায়াতের জন্য মহাগ্রন্থ) আল কুরআন (সূরা হিজর: ৮৭)

 আমরা অবশ্যই সালাতে সাত আয়াত বিশিষ্ট সূরা ফাতিহা ও তার সাথে অন্য সূরা বা আয়াত পাঠ করি। আমরা যখন জামায়াতে সালাত আদায় করি তখন ইমাম যা পাঠ করেন তা আমরা শুনি। এ পাঠ করা ও শোনা থেকে আমরা আল্লাহর হুকুম-আহকাম জানতে পারি। যেমন : আমরা সালাতের জন্য কেবলামুখী হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দু‘খানা দু‘কান বা কাঁধ পর্যন্ত উঠিয়ে আত্মসমর্পণে “আল্লাহু আকবার” বলে হাত দু‘খানা বুকের ওপর বেঁধে তাকবিরে তাহরিমার পর আল্লাহর প্রশংসা বা ছানা পড়ি। আমরা বলি, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমারই পবিত্রতা ঘোষণা করছি, তোমার প্রশংসাসহ তোমার নামের বরকত ও মহাত্ম্য সত্যই অতুলনীয়,তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ,তোমার সম্মান সবার উচ্চে,তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই”। (আবু দাউদ ও তিরমিজি) অথবা আমরা বলি, নিশ্চয়ই আমি নিষ্ঠার সাথে সেই মহান সার্বভৌম সত্তার দিকেই আমার মুখ ফিরিয়ে নিলাম,যিনি এ আসমান ও জমিনের সব সৃষ্টি করেছেনআমি এখন আর মুশরিকদের দলভুক্ত নই (সূরা আনয়াম: ৭৯)

 এ দু‘টির যেকোনো একটি আমরা পাঠ করে আউজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পাঠ করে সূরা ফাতিহায় যা বলি:

১. সমস্ত প্রশংসা শুধু বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের জন্য।

২. যিনি অতিশয় দয়ালু ও মেহেরবান।

৩. যিনি শেষ বিচার দিনের মালিক।

৪. হে আল্লাহ!আমরা তোমারই দাসত্ব বা ইবাদত করি আর তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।

৫. তুমি আমাদের সহজ সরল ও সঠিক পথ প্রদর্শন করো।

৬. তাদের পথ যাদের তুমি অনুগ্রহ করেছ,

৭. তাদের পথ নয়, যারা পথভ্রষ্ট ও তোমার অভিশপ্ত।

এখানে আমরা আল্লাহর প্রশংসা ও ক্ষমতা ইখতিয়ার বর্ণনা করার পর বলি, ইয়্যাকা নায়াবুদু অর্থ: (হে আল্লাহ!) আমরা তোমারই ইবাদত করি। এ কথা আমরা এ কারণে বলি যে, আল্লাহ বলেছেন, ওয়ামা খালাকতুলজিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিইয়াবুদুন অর্থ: আমি জিন আর মানুষ সৃষ্টি করেছি শুধু আমার ইবাদত করার জন্য। (সূরা আজজারিয়াত: ৫৬) যেহেতু আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, আমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে, আল্লাহর ইবাদত করার জন্য সেহেতু আমরাও বলে দিলাম যে,হে আল্লাহ! আমরা তোমারই ইবাদত করি।

আসলে আমরা কি বুঝি ইবাদত কাকে বলে? ইবাদতের বাংলা তরজমা হচ্ছে, গোলামি, দাসত্ব বা মনিবের হুকুম মেনে কাজ করা। আমরা সূরা ফাতিহায় আল্লাহকে রাব্বিল আলামিন, অর্থাৎ বিশ্বজাহানের প্রতিপালক,অভিভাবক,মালিক ও মনিব বলে স্বীকার করি। যাকে আমরা প্রতিপালক,অভিভাবক,মালিক বা মনিব বলে স্বীকার করি আমরা তার গোলাম, চাকর ও হুকুমের দাস। হুকুমের গোলাম বা দাসের কাজ হচ্ছে মালিক বা মনিবের কথা মতো কাজ করা। আসলে আমরা সে মালিক বা মনিবের কথা মতো কাজ করছি কি না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সূরা ফাতিহায় আমরা আল্লাহর হুকুম মেনে চলছি এমন প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর এবার প্রার্থনা বা আবেদন করছি যে, ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম অর্থ (হে আল্লাহ!) তুমি আমাদের সঠিক,সহজ ও সরল পথ দেখাও। আমরা আসলে আল্লাহর গোলামি করলাম কি করলাম না এটা না বুঝে অথবা গোলামি বা দাসত্ব না করেও সহজ,সরল পথ চাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সঠিক,সহজ ও সরল পথ দেখানোর জন্য সাত আয়াতবিশিষ্ট সূরার সাথে দিয়েছেন (হিদায়াতের জন্য মহাগ্রন্থ) আল কুরআন। (সূরা হিজর: ৮৭)

তা ছাড়া বলা হয়েছে, এই সেই গ্রন্থ যার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই, যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে এ গ্রন্থ তাদের হিদায়াতের পথ দেখাবে(সূরা বাকারা: ২) সালাতের মাধ্যমে হিদায়াতের পথ পাওয়ার জন্যই সূরা ফাতিহাসহ আরো সূরা বা আয়াত পাঠ করা হয়। এসব পঠিত সূরা বা আয়াতে আল্লাহর হুকুম-আহকাম বা আইন-কানুন জানানো হয় যাতে করে আমরা এগুলো মেনে আমল বা কাজ করে নিজেদের পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করতে পারি।

যেমন পাঠ করা হয়: ‘তোমার প্রতিপালক বা ‘রব’ নির্দেশ করছেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো আদেশ বা হুকুম মানবে না (বা আর কারো ইবাদত করবে না) আর তোমাদের পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে,তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়,তাহলে তাদের সাথে বিরক্তসূচক আহ বা উহ শব্দ উচ্চারণ করো না এবং তাদের ধমক দিও না, আর তাদের সাথে সম্মানজনক ভদ্রজনোচিত কথা বলো। অনুকম্পায় তুমি ওদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বলো “হে আমার প্রতিপালক বা ‘রব’ তাদের প্রতি ঠিক সেভাবেই তুমি দয়া করো, যেমনি করে শৈশবে তারা আমাকে লালন পালন করেছেন।” (সূরা আল ইসরা: ২৩-২৪)।

আল্লাহর আরো অনেক আদেশ-নিষেধ সংবলিত আয়াত আমরা শুনি বা পাঠ করি,যেমন: দ্বীন কায়েমের নির্দেশ আছে শুরার ১৩ নম্বর আয়াতে। ঘুষ লেনদেন নিষেধ করা হয়েছে বাকারার ১৮৮ নম্বর আয়াতে। সুদ হারাম করা হয়েছে  বাকারার ২৭৫ নম্বর আয়াতে। হত্যার বিচারের নির্দেশ আছে  বাকারার ১৭৮ ও ১৭৯ নম্বর আয়াতে। চুরির বিচারের নির্দেশ আছে  মায়েদার ৩৮ নম্বর আয়াতে। সন্ত্রাসের বিচারের নির্দেশ আছে,মায়েদার ৩৩ নম্বর আয়াতে। হত্যা প্রচেষ্টা ও জখমের বিচারের নির্দেশ আছে মায়েদার ৪৫ নম্বর আয়াতে। জেনা বা ব্যভিচারের বিচারের নির্দেশ আছে নিসার ১৫-১৬ নম্বর ও আন নূরের ২-৪ নম্বর আয়াতে। মদ ও জুয়া, পাশা খেলা বা আর্থিকভাবে লাভ-ক্ষতির মতো হারজিতের খেলা,ভাগ্যগণনা ইত্যাদিকে হারাম করা হয়েছে মায়েদার ৯০ নম্বব আয়াতে। এমন বড় বা ছোট অনেক সূরা বা আয়াত আমরা পাঠ করি বা আমাদের সামনে পাঠ করা হয় যাতে করে এসব আয়াত বা সূরা আমরা আমল করে অশ্লীলতা,অপবিত্রতা ও জাহান্নাম থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে পারি। সূরা আল আসর আমরা পাঠ করি, যেখানে আল্লাহ বলছেন, নিশ্চয়ই সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে, যারা হকের উপদেশ দিচ্ছে এবং ধৈর্য ধারণ করছে ও ধৈর্যের উপদেশ দিচ্ছে। আমরা কি এ ছোট্ট সূরাটি আমলে নিতে পেরেছি?

আমরা সালাত আদায় করছি,অথচ আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে ওয়া আকিমুসসালাতা লিজিকরি অর্থাৎ তোমরা আমার স্মরণে সালাত কায়েম করো। (সূরা : তোয়াহা ১৪) এখানে আমাদের একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে যে, ব্যক্তিগতভাবে সালাত কায়েম করা যায় না। ব্যক্তিগতভাবে সালাত কায়েমের চেষ্টা করা যায়। সালাত কায়েমের পূর্বশর্ত হচ্ছে দ্বীন কায়েম করা। সূরা আশ শুরার ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, আমি সকল নবী রাসূলকে দ্বীন কায়েমের নির্দেশ দিয়েছিলাম। যেহেতু, আমরা যে সকল নবী ও রাসূলের ওপর ঈামন এনেছি সেহেতু, দ্বীন কায়েমের চেষ্টা করা আমাদের ওপর ফরজ।

মূলত সালাত কায়েমের দায়িত্ব হচ্ছে মুসলিম রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের। এ ব্যাপারে আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে, আমি যদি এ (মুসলমানদের) জমিনে (পৃথিবীতে) প্রতিষ্ঠা দান করি (বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিই) তা হলে তার দায়িত্ব হবে, সালাত কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, নাগরিকদের সৎ কাজের আদেশ দেয়া এবং সকল মন্দ বা খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা (সূরা হাজ : ৪১)। রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি সুদ, ঘুষ, জিনা-ব্যভিচার, বেপর্দাসহ সকল প্রকার খারাপ কাজ নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে আমরাও সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে মুক্ত থাকতে পারব। আল্লাহর হুকুম মেনে নিলেই সালাত আমাদেরকে সকল প্রকার অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। সালাতের এই ফজিলত পেতে হলে সার্বিকভাবে সকল সালাত আদায়কারীর কাজ হবে দ্বীন কায়েমের চেষ্টা করা ও যারা দ্বীন কায়েমের চেষ্টা করছেন তাদের সর্বাত্মক সাহায্য করা। কারণ আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, নিশ্চয়ই আমার কাছে একমাত্র মনোনীত জীবনব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম। (সূরা আল ইমরান: ১৯)

Related Post