পূর্বে প্রকাশিতের পর
সফল ব্যবসায়ী মুহাম্মদ (সা.)
আরবদের, বিশেষত কুরাইশদের পুরনো পেশা ছিল ব্যবসা। কিশোর বয়সে মুহাম্মদ (সা.) চাচা আবু তালেবের সাথে ব্যবসায় অংশ গ্রহণ করেছেন। যৌবনে তিনি খাদীজার (রা.) পক্ষ হয়ে ব্যবসা করেছেন। ফলে ব্যবসা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তাই তিনি ব্যবসাকে অর্থ উপার্জনের উপায় হিসাবে গ্রহণ করেন। ক্রেতা-বিক্রেতার সন্তুষ্টিতে হালালভাবে যে ব্যবসা করা হয়, তাকেই আল্লাহ পাক বৈধ করেছেন। “হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা ব্যতীত অন্যায়ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পত্তি গ্রাস করো না।” (সূরা আন-নিসা: ২৯)। রাসূল (সা.) এর ব্যবসায়ীক নীতিও ছিল এ ধরনের । তাঁর লেন-দেনের সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সকলের নিকট সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। লোকেরা তাঁর সাথে ব্যবসায়ে অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ মূল ধন তাঁর নিকট জমা করতে লাগলো। পরন্তু ওয়াদা পালন, সদাচারণ, ন্যায়পরায়নতা, বিশ্বস্ততার জন্য সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করলেন। আজ আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ীদের যে অবস্থা তাতে মনে হয় যেন, মিথ্যা আর প্রতারণাই হচ্ছে ব্যবসার মূলধন। এর দ্বারা শুধু ব্যক্তির সাময়িক অর্থের উন্নতি হতে পারে, স্থায়ীভাবে জাতীর অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। উল্লেখ থাকে যে, মুহাম্মদ (সা.) ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন ও ইয়ামান ভ্রমণ করেছেন।
শাদী মোবারক
বিখ্যাত কোরাইশ বংশের সম্ভ্রান্তÍ ও বিত্তশালী মহিলা খাদীজা (রা.)। প্রথম বিবাহের পর তিনি বিধবা হন এবং দ্বিতীয় বিবাহ করেন। কিন্তু কিছু দিন পর তাঁর দ্বিতীয় স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন এবং পুণরায় তিনি বিধবা হন। তিনি অত্যন্ত সম্মানিতা ও সচ্চরিত্রের অধিকারিণী ছিলেন। এমন সতী-সাধবী নারী তখনকার দিনে আরবে দ্বিতীয়টি আর ছিলনা। সমগ্র দেশ জুড়ে যেখানে নারী জাতীর লাঞ্ছনা ও দূর্গতির সীমা ছিলনা, কেবল মাত্র ভোগের বস্তু রূপেই ব্যবহৃত হত, সেখানে এ মহিয়সী নারী আপন মর্যাদা রক্ষা করে পবিত্রতার সহিত জীবন যাপন করছিলেন। অন্তরের শুচিতায় ও শুভ্রতায় তিনি এতটাই বিখ্যাত হয়েছিলেন যে, লোকেরা তাঁকে ‘তাহেরা’ (কলোষ মুক্ত) বলে ডাকতো। তদুপরী তিনি ছিলেন অগাধ সম্পত্তির মালিক। তখনকার আরবে এ গৌরবের অধিকারী হওয়া সহজ ব্যাপার ছিলনা।
অপর দিকে মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স তখন পঁচিশ বছর। তাঁর গুণ-গরিমাও আরবের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ত্যাগ-তিতিক্ষা, সেবা, সততা, চরিত্র ও মাধুর্য দ্বারা তিনি সমগ্র আরবের হৃদয় জয় করেছেন। এই ধী শক্তি সম্পন্ন প্রতিভাবান যুবকটির কীর্তির কথা খাদীজা (রা.)-এর কর্ণে পৌঁছিতে বিলম্ব ঘটেনি। তাঁর এ খ্যাতির কথা শুনে খাদীজা (রা.) তাঁর কাছে এই মর্মে এক পয়গাম পাঠান, “আপনি আমার ব্যবসায়ের পণ্য নিয়ে সিরিয়া গমন করুন। আমি অন্য সবাইকে যে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকি, আপনাকেও তা-ই দেবো।” মুহাম্মদ (সা.) খাদীজার (রা.)-এই প্রস্তাব গ্রহণ করে পণ্যদ্রব্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা গমন করেন। খাদীজা (রা.) মুহাম্মদ (সা.)-এর অসামান্য যোগ্যতা ও অতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হন। তিনি দুনিয়ার কোন বৈষয়িক চিন্তা না করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। অথচ তৎকালে আরব সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই চলতো মানবতা বিবর্জিত গোপন প্রেমের ছড়াছড়ি। খাদীজা (রা.) আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবের মাধ্যমে তাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে চরম আঁঘাত হানলেন। একই ভাবে মুহাম্মদ (সা.) ও আনুষ্ঠানিকভাবে তাতে সম্মতি দিলেন।
উভয় পক্ষের আনুষ্ঠানিকতায় শরীয়ত সম্মতভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রকৃত পক্ষে তাঁদের বিবাহ হয়েছিল সত্য ও পবিত্রতার মধ্যে। তাঁদের জীবন থেকে, আজকের যুবক-যুবতীদের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে যে, পবিত্র বন্ধন কাকে বলে। আজকে আমাদের সমাজে যা ঘটছে, আমরা যা করছি, আধুনিক সভ্যতার বুলি আওড়িয়ে প্রকৃত পক্ষে জাহেলি সমাজের দিকেই ফিরে যাচ্ছি। অথচ এটা যে, আমাদের জন্য কত বড় আত্মঘাঁতি ধ্বংসের কাজ তা ভেবেও দেখি না। তা না হলে কুরআনে আল্লাহ পাক কেন নিষেধ করলেন, যা সূরা নিসা ২৫ ও মায়িদাহ ৫ আয়াতাংশে বলা হয়েছে, “মেয়েরা গোপনে বা চুপিসারে বন্ধুত্ব করবে না।’ পুরুষেরাও গোপনে বা চুপিসারে বন্ধুত্ব করবে না।” এটা ছিলো জাহেলিয়াতের যুগের লোকদের নফস ও প্রবৃত্তির পূজা এবং লজ্জাহীনতার কাজ। এর দ্বারা মানুষের বিবেক-বোধ ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে মানুষ বিপথগামিতার দিকে পা বাড়ায় এবং সমাজে বিপর্যয় দেখা দেয়। বর্তমান যুগেও তারই পূণরাবৃত্তি ঘটছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, দূর দৃষ্টি এবং দর্শনের দোহাই দিয়ে এটাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছেন। আর নিজেদের প্রগতির ধারক-বাহক এবং জ্ঞানী বলে জাহির করছেন। অথচ এদের পরিচয় আল্লাহ পাক দিচ্ছেন, “যখন তারা কোন লজ্জাকর ও অশ্লীল আচরণ করে, তখন তারা বলেঃ আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এসব কাজ করতে পেয়েছি এবং আল্লাহ ও আমাদের এটা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তুমি বলে দাও, আল্লাহ লজ্জাহীনতার কাজে কক্ষনো আদেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহ সম্পর্কে এমন সব কথা বলো যার কোন জ্ঞান তোমাদের নেই। (আ’রাফ-২৮)। এটা চিন্তা করে দেখার মত বিষয় যে, আজকের অপরাধী ও পাপী চক্র আর আরব জাহেলিয়াতের বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিতদের ধ্যান ধারনা ও আকীদা বিশ্বাসের মধ্যে কত সামঞ্জস্য বিদ্যমান।
মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র সন্তানগণ
বিবাহ কালে খাদীজা (রা.) এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। মুহাম্মদ (সা.)-এর পুত্র- কন্যাদের মধ্যে একমাত্র মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভজাত ইবরাহীম ছাড়া বাকী সবাই হযরত খাদীজা (রা.)-এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। এরা হলেন: কাসেম, আব্দুল্লাহ, জয়নব, রোকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা (রা.)। এদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা (রা.) ই হযরত আলী (রা.) এর স্ত্রী এবং ইমাম হাসান হোসাইনের জননীরূপে খ্যাতিলাভ করেন।
অসাধারণ ঘটনাবলী
দুনিয়ায় যতো বিশিষ্ট লোকের আবির্ভাব ঘটে, তাঁদের জীবনে শুরু থেকেই অসাধারণ কিছু নিদর্শনাবলী লক্ষ্য করা যায়। এ দ্বারা তাঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা সহজেই অনুমান করা চলে। এ কথা এমন সব লোকের বেলায় প্রযোজ্য, যারা পরবর্তী কালে দেশের কোন উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধন করে থাকেন। আর মুহাম্মদ (সা.) যাকে কিয়ামত অবধি সারা দুনিয়ার নেতৃত্বের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যাঁকে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের পূর্ণ সংস্কারের জন্যে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁর জীবন সূচনায় এমন অসাধারণ নিদর্শনাবলী তো প্রচুর পরিমানে দৃষ্টিগোচর হওয়াই স্বাভাবিক। নিম্নে দু’একটি, উল্লেখ করা হলোঃ
(ক) মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম, তখন আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর দেহ থেকে একটি আলো নির্গত সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে গেছে।” তখন ইহুদী ও খৃষ্টানগণ এক নতুন নবীর আগমণের অপেক্ষায় ছিলো এবং এ ব্যাপারে তারা নানারূপ ভবিষ্যদ্বাণী করছিলো।
(খ) আরবে তখন আসর জমিয়ে কল্প-কাহিনী বলার কু-প্রথা চালু ছিলো। রাতের বেলা এ আসর বসতো। বাল্য বয়সে মুহাম্মদ (সা.) কে সাথে নিয়ে একবার তাঁর সাথীরা এ ধরনের আসরে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে একটি বিয়ের মজলিস দেখার জন্য তিনি দাঁড়িয়ে যান এবং পরে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন এবং সেখানেই ভোর হয়ে যায়। এভাবে আল্লাহ পাক তাঁকে কুসংসর্গ থেকে রক্ষা করেন।
(গ) মুহাম্মদ (সা.)-এর বিশাল হৃদয় ও উন্নত চরিত্রের তাগিদে পালিত পুত্র জায়েদকে অতি প্রিয়জনের ন্যায় লালন-পালন করেন। ইত্যবসরে জায়েদের পিতা ও চাচা তার সন্ধানে মক্কায় এসে জায়েদকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানায়। মুহাম্মদ (সা.) বললেন, যদি জায়েদ ফেরত যেতে চায় তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই।
কিন্তু জায়েদ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মুহাম্মদ (সা.)-এর চেয়ে প্রিয় ব্যক্তি তার জীবনে দ্বিতীয় আর কেউ নেই, বিধায় আমি তাঁকে ছেড়ে কক্ষনো যাব না। এ কথা শুনে মুহাম্মদ (সা.) জায়েদকে কা’বা ঘরের কাছে নিয়ে মুক্ত করে দেন এবং তাকে পুত্র বলে ঘোষণা করেন। এ দৃশ্য দেখে জায়েদের পিতা ও চাচা জায়েদকে মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট রেখে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরে যান।
(ঘ) তাঁর বাল্যকালের আরেকটি ঘটনা। তখন কা’বা গৃহের কিছুটা সংস্কার কাজ চলছিলো এবং এ ব্যাপারে বড়োদের সাথে ছোট ছোট ছেলেরাও ইট বহন করছিলো। ছেলেদের মধ্যে মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর চাচা আব্বাস (রা.) ও ছিলেন। আব্বাস (রা.) তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোমার তহবন্দ খুলে কাঁধের ওপর দিয়ে নাও, তাহলে ইটের চাপে ব্যথা পাবে না।” তখন তো বড়োরা পর্যন্ত নগ্ন হতে লজ্জানুভব করতো না। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) যখন এরূপ করলেন, তখন নগ্নতার অনুভূতিতে সহসা তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তাঁর চোখ দু’টো প্রায় ফেটে বেরিয়ে যাবার উপক্রম হলো। সম্বিত ফিরে এলে তিনি শুধু বলতে লাগলেন, “আমার তহবন্দ, আমার তহবন্দ।” লোকেরা তাড়াতাড়ি তাঁকে তহবন্দ পড়িয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবুতালিব তাঁর অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি সাদা কাপড় পরিহিত এক লোককে দেখতে পাই। সে আমাকে বললো, শিগ্গির সতর ঢাকো। সম্ভবত এই প্রথম মুহাম্মদ (সা.) গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান। আজকের এই সভ্য দুনিয়ায় উলঙ্গপনা বিরাট এক ফিতনা। যা মানুষের আবেগ ও অনুভূতির জগতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং মানুষকে যৌনতা ও কুপ্রবৃত্তির পেছনে উম্মাদ বানিয়ে দিয়েছে। নারী ও পুরুষ এমনিতেই তার বিপরীত লিংগের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। উলঙ্গপনা এই আকর্ষণকে এত তীব্রতা দান করে যে, মানুষের জন্য গোনাহ থেকে দূরে থাকা অসম্ভব হয়ে যায়। এ জন্য প্রকৃতির দাবী হলো, অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের এই চালিকা শক্তিকে ধ্বংস করা হোক। প্রকৃতির এই দাবীর কারণেই ইসলাম উলঙ্গপনাকে একটি ধ্বংসাত্মক ব্যাধি মনে করে নারী ও পুরুষের ‘সতরের’ সীমানা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলতে উভয়কে নির্দেশ দিয়েছে। (চলবে)