পূর্বে প্রকাশিতের পর-২
অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর, আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়াতা‘আলা দীর্ঘ ৭টি বৎসর আমাকে নানানভাবে পরীক্ষার মাধ্যমে ১৯৯৯ ঈসায়ী সনের ২৮শে অক্টোবর পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত ধর্ম (জীবন ব্যবস্থা) ইসলামে প্রবেশ করার দ্বার উম্মুক্ত করে দেন। কুয়েতে আসার পর দুই মাস পর এক বন্ধুর মাধ্যমে (কুয়েতী অবসরপ্রাপ্ত এক সামরিক অফিসার) ইসলাম প্রেজেণ্টেশন কমিটি (IPC) -তে রাত ৭-৮ দিকে আসি। ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন সাইট নিয়ে আলোচনা করি, সম্মানিত দাঈদের নিকট হতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় প্রশ্ন করে জেনে নেই। ইসলাম সম্পর্কে আরো বিশদভাবে জানার জন্য আই পি সি কর্তৃপক্ষ আমাকে কিছু বই দেন। যেহেতু আমি পূর্ব থেকেই ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটিভাবে জেনেছি, আর ইসলাম গ্রহণ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি, তাই আর কালবিলম্ব না করে পর দিন সকালে আবার আই. পি. সিতে যাই। সম্মানিত দা‘ঈর মাধ্যমে কালিমায়ে শাহাদাত (আশহাদু আন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ; অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল) পাঠ করে জনসম্মুখে একজন মুসলিম হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করি।
আশ্চর্যের ব্যাপার যখন কালিমা পড়া শেষ হয়, তখন আমি নিজেকে এতই হালকা অনুভব করলাম, যেন আমার শরীর থেকে হাজার মণ ওজনের পাথর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর এতই সুখ অনুভব করছিলাম যে, মনে হয় পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মানুষ দ্বিতীয় আর নেই। তার জন্য মহান আল্লাহর নিকট লক্ষ-কোটি কৃতজ্ঞতা আদায় করছি, সাথে এই প্রার্থনা করছি মহান মনীবের দরবারে তিনি যেন, মৃত্যু পর্যন্ত একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে জীবন-যাপন করার তাওফীক দান করেন। আমীন।
জানুয়ারি মাসে আমি ইসলাম গ্রহণ করি, ঐ বৎসরই আই পি সির পক্ষ থেকে ওমরা ও পরে হজ্জ করার তাওফীক মহান আল্লাহ আমাকে দান করেন। দীর্ঘ দিনের মনের আশা ছিল যে পবিত্র ঘর কা‘বা নিজের দৃষ্টিতে দেখবো, মনের আশাটি পূরণ হওয়ায় আল্লাহর লক্ষ-কোটি শুকরিয়া আদায় করছি।
ইসলাম গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই GROUP-4 নামক এক কোম্পানীতে গার্ড হিসেবে কাজে যোগদান করি। ঐ কোম্পানীর অফিসার থেকে শুরু করে যখন যে Place ডিউটি করি, সবাই আমার ইসলাম গ্রহণের কথা শুনে। আমাকে এত সম্মান ও মুহাব্বত করতো, তা ভেবে আবেগে দুই নয়নে অশ্রু এসে যেত। ভাবতাম ইসলাম গ্রহণের আগে আমার কি নোংরা জীবন ছিলো! অথচ যখনই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা তাঁর এই নগন্য বান্দাকে ঈমানের আলো দান করলেন, সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া ও আখেরাতে কত মান-মর্যাদা, সমাদর বৃদ্ধি পেলো, এ যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অলৌকিক দান তাঁর মনোনীত দ্বীনে প্রবেশ করার জন্য।
আমি মুসলমান ভাই-বোনদের আহ্বান করবো সামান্য কয় দিনের দুনিয়ার মোহে আবদ্ধ না থেকে আল্লাহর বিধান ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বলা পদ্ধতি বা পবিত্র কুরআন ও হাদীসের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা। তবেই এই দুনিয়ার মায়াময় জগৎ থেকে সত্যিকার মুসলমান হিসেবে বিদায় নেওয়া যাবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাঁর দ্বীনের উপর চলার তাওফীক দান করুন। আমীন
যাক GROUP-4 চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন প্লেসে কাজ করার সুযোগ করে দেন। যেমন জামইয়া (সুপার মার্কেট), স্কুল, হাসপাতাল, বড় বড় কোমপ্লেক্স, অফিস ইত্যাদিতে। এভাবে প্রায় তিন বৎসর কাজ করার পর হঠাৎ করে সালমিয়া অঞ্চলে এক আমেরিকান স্কুলে রাতের সিপাটে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। প্রতিদিন ফজরের নামাযের সময় পাশের এক মসজিদে ফজরের নামায পড়তে যেতাম। সেখানে নোয়াখালীর বানীপুরের জসিম নামের এক মুসল্লির সাথে পরিচিত হই। কথোপকথোনে বুঝতে পারলাম যে, ছেলেটা প্রচণ্ডভাবে আল্লামা দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী সাহেবের ভক্ত। আমার ইসলাম গ্রহণের কথা শোনে আমাকে তাদের এলাকায় বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। আমিও তাকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী দেখে তার প্রস্তাবে রাজী হই। এবং শর্ত দেই যে, আমি অতি সাধারণ পরিবারে বিয়ে করবো, যে পরিবারের লোকজন ইসলামের প্রতি অনুগত। তার কথায় আস্থা রেখে ২০০৩ সালে এক মুসলিম পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করি। বর্তমানে আমার দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। বড় জনের নাম আয়েশা বিনতে সাইফ পিমা, আর ছোট জনের নাম আসমা বিনতে সাইফ প্রমি।
নোয়াখালী জেলার চাটখীল উপজেলায় আমি বিয়ে করি। দাম্পত্য জীবনে প্রথম বৎসর ভালোই ছিলো। স্বামী-স্ত্রীর তথা আমাদের মাঝে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করছিলো। কুয়েতে আমি যে চাকুরি করতাম, বেতন পেতাম ৮০ দিনার, তা দিয়ে স্ত্রীকে ভাড়া বাসায় রাখবো সেই সামর্থ আমার ছিলো না। তাই বাধ্য হয়েই শ্বশুর বাড়িতে রেখে কুয়েত চলে আসি। আমার শ্বশুর বিয়ের পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন, সুতরাং তাদের ফ্যামিলী তেমন সচ্ছল ছিলো না। আমাকে তারা সহযোগিতা করবে এমন সামর্থ তারা রাখতো না। এই কারণে আমার স্ত্রী ছিলো ক্ষুব্ধ। কারণ আমার শ্বশুর বাড়ির আশেপাশে যারা বসবাস করতো, তারা সকলেই ছিলো নামে মুসলিম। তাদের কাজে কামে আচার ব্যবহারে ইসলামের কোন কিছু প্রতিফলিত হতো না। ফলে কারণবশত ঝগড়া কিংবা কথা কাটাকাটি হলে, প্রতিবেশীরা আমার সন্তানদের বলতো, ‘হিন্দুর জন্মা’ স্ত্রী অপবাদ দিতো এই বলে যে, হিন্দুর নিকট বিয়ে বসেছে। আমার স্ত্রী এসব সহ্য করতে না পেরে, আমাকে ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়ে ছিলো। আল্লাহর রহমতে এতো ঝড়িছাপটার পরেও আমাদের সংসার টিকে আছে আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের দেশে কিংবা বিদেশে যারা বাংলাদেশী আছি, তারা সহজে একজন নওমুসলিমকে মেনে নিতে কিংবা সাদরে গ্রহণ করতে কুণ্ঠাবোধ করি। তাদের ধারণা তারা জন্মগত মুসলিম বলে, নামায পড়–ক কিংবা না পড়–ক, আল্লাহর হুকুম আহকাম পালন করুক কিংবা না করুক; তারাই মুসলিম। নও মুসলিম হওয়টা যেন অপরাধ! যা মোটেও বঞ্ছনীয় নয়। পিছনের দিকে তাকান, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় একজন নও মুসলিমের মর্যাদা আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে প্রকাশ করেছেন। আসলে বর্তমানে বৃহৎ মুসলিম সমাজই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও জ্ঞান থেকে পিছিয়ে আছে, ফলে তারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, তাহযিব, তামাদ্দুন বুঝা থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের ধারণা মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছি, সুতরাং শিরক বিদয়াত, জুলুম নির্যাতন যাই করি না কেন, জান্নাতে আমরা যাবই। ইহুদীদের মতো বলে কিছু দিন জাহান্নামে থাকার পর তো আমরা জান্নাতে ঠিকই যাবো। সুতরাং ইসলামের মূল স্তম্ভ যে পাঁচটি তার কোনটাই সঠিকভাবে পালন করছে না। শুধুমাত্র ঐ অমূলক ধারণার কারণে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিদায় হজ্জের ভাষণে একবার নয় চার বার বলেছেন; ‘হে আমার উম্মতেরা! তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। এই অমিয় বাণীটা মুসলিম সমাজকে ভালোভাবে উপলব্ধি করার অনুরোধ রইল।