সংকলণে: মাওলানা মামুনুর রশীদ
রমযান মাসকে সামনে রেখে আপনাদের সামনে কিছু পরিকল্পনা তুলে ধরলাম। এর সাথে আপনারাও আরো কিছু করণীয় যোগ করে নিতে পারেন। আল্লাহ আমাদের হিম্মত বাড়িয়ে দিন ও আমল করার তৌফিক দিন:
গোটা মানব জাতির মধ্যে নবী (সা.) সবচেয়ে দানশীল ছিলেন। রমযান মাসে জিবরাঈল (আ:) যে সময় তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন সে সময় তিনি সবচেয়ে বেশি দানশীল হয়ে উঠতেন। জিবরাঈল (আ.) রমযান মাসে প্রতি রাতেই তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। এভাবেই রমযান মাস অতিবাহিত হত। নবী (সা.) (এ সময়) তার সামনে কুরআন শরীফ পড়ে শুনাতেন। যখন জিবরাঈল (আ.) তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি গতিবান বায়ুর চাইতেও বেশি দানশীল হয়ে উঠতেন। (বুখারী, কিতাবুস সাওম: ১৭৬৭)
আমরা এই হাদীস থেকে জানলাম যে নবী (সা.) রমযান মাসে বেশি বেশি দান করতেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
প্রিয় পাঠক! আমারাও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি যেন মহিমান্বিত এই মাসটি কুরআন তেলাওয়াত, কুরআনের দারস, ইসলামী সাহিত্যসহ মাসায়েল শিক্ষা ও দান খয়রাত এবং ইবাদত বন্দেগীতে কাটাতে পারি। এখন থেকে সেভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১। কুর’আন পুরোটা অর্থসহ পড়া: যারা খতম তারাবীতে যাবেন তাদের জন্য, দিনের বেলা সেই রাতের তারাবীতে পড়াবে এমন কুর’আনের অংশটুকুর অর্থসহ বুঝে পড়া, প্রয়োজনে তাফসীরসহ পড়ে নেওয়া। এখানে তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো হতে বিষয় ভিত্তিক আয়াতগুলো, দারস তৈরি করার চেষ্টা করা। যারা আগ্রহী তারা মার্কার পেন বা কলম দিয়ে দাগিয়ে পড়তে পারেন অথবা ডায়রীতে লিখে নিতে পারেন কোনো কোনো আয়াত বিষয় ভিত্তিক।
এখানে আরেকটু করা যায়, এই সময়ে সমগ্র কুরআনের আল্লাহর শেখানো দোয়াগুলো আমরা ডায়রীতে তুলে ফেলে ধীরে ধীরে সেগুলো মুখস্ত করতে পারি।
প্রতি সূরা শেষ করে পরিবারের সবাইকে কিংবা নিজের শাখা বা অঞ্চলের দ্বীনি ভাইদের নিয়ে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা।
২। সহীহ হাদীসগুলো ধীরে ধীরে জানা: তেমনিভাবে সহীহ বুখারী-মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের সহীহ হাদীসগুলো থেকে উক্ত দিন গুলোতে নামায, রোযা, যাকাত বা দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কিত প্রতিদিন কমপক্ষে একটি হাদীস পড়া।
৩। জীবনী থেকে উদাহরণ: রাসূলের জীবনী-মহিলা সাহাবী অথবা সাহাবা চরিত ভালো করে জানার সঙ্গে সঙ্গে সালফে সালেহীনদের জীবনী আমাল করার পদ্ধতি জানার চেষ্টা করা।
৪। নামায: প্রতি পাঁচ ওয়াক্তের সাথে রাতে তারাবীহ, তাহাজ্জুদ ও দিনের বিভিন্ন নফল নামায পড়ার চেষ্টা করা। এই সময়ে আমরা সবাই সেহরীতে উঠি, একটু আগে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এর উপকারিতা লাভ করতে পারি। প্রতিদিনই তারাবীহ যেন আদায় করি। আল্লাহ তা’লা বলেন: তাদের পার্শ্বদেহ বিছানা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের প্রভূকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।’ (সিজদা : ১৬)
আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র এরশাদ করেন: ‘যে ব্যক্তি রাতের বেলা সিজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তার রবের রহমত প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান যে এরূপ করে না)।’ (৯: যুমার)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত রাত্রে জাগতেন ও নামায আদায় করতেন। এ প্রসঙ্গে আয়শা রা. বলেছেন :‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলায় নামাযে (এত দীর্ঘ সময়) দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তার পা দু’টো যেন ফেটে যেত। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমনটি করছেন কেন? অথচ আপনার পূর্ব ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে গিয়েছে। তিনি বললেন, ‘আমি কি (আল্লাহর) কৃতজ্ঞ বান্দাহ হব না?’ (বুখারী ও মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাবার খাওয়াও, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়। (এগুলো করে) তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (তিরমিযী)
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ করুণা করুন ঐ ব্যক্তির উপর, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়। স্ত্রী যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ করুণা করুন ঐ নারীর প্রতি, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়। স্বামী যদি উঠেতে না চায় তাহলে তার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ)
‘রাসূল (সা.) বলেছেন: বান্দার কাছ থেকে কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে বিষয়ের হিসেব গ্রহণ করা হবে তা হলো তার নামায। সে যদি তা পুরোপুরিভাবে আদায় করে থাকে তবে তা পুরো লেখা হবে। আর সে যদি তা পুরোপুরি আদায় না করে, তবে মহান ও পরাক্রান্ত আল্লাহ ফেরেশ্তাদেরকে বলবেন: “দেখো, আমার বান্দাহর কোন নফল নামায আছে কি না, যা দিয়ে তোমরা তার ফরয পুরো করে নিতে পারো।’ (আবু দাউদ)
আমাদের প্রয়োজন নামাযে পঠিত সব সূরা ও তাসবীহ দরূদ অন্যান্য যা পড়ি তা এখন থেকে আবার সুন্দর সহীহ ও অর্থগুলো জানার কাজ শুরু করা।
৫। যিকর–এ ছাড়া বাকী সময়গুলো সব সময় আল্লাহর যিকিরে নিজের জিহবাকে সিক্ত রাখা, যেমন রান্না বা অন্য কাজের সময় দোয়া এস্তেগফার দরূদ পড়া।
৬। দান: এ সময় নিকটাত্মীয় গরীব, মিসকীন, ফকীর এদের মাঝে সাহায্য বাড়ানো। নিজের ঘরের যে অধিনস্ত লোক থাকে কাজের জন্য তাকেও সাহায্য করা।
৭। প্রতিদিনই কাউকে ইফতার করানো: একটি খেজুর কিংবা একটি লেবেন বা জুস দিয়ে হলেও। গরীব আত্মীয়দের বাসায় উপহার হিসাবে ইফতারের কিছু কাঁচা মাল (খেজুর, ছোলা, মুড়ি) আগেই পাঠিয়ে দেয়া। আর ধনীদের মাঝে ইসলামের শিক্ষার জন্য বই উপহার দেয়া বা কিনতে উৎসাহিত করা। পরিবারের সবাই মিলে ইফতারের আয়োজন করা। হালকা করে ইফতারের আগের সময়টুকু কুরআন তেলওয়াত ও দোয়ায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইফতার সামনে রেখে একসাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
৮। রোযাতে অধীনস্ত কাজের লোকদের কাজ হালকা করে দেয়া: এবং তাদেরকেও ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান দান করা। এবং নিজে যা খাবে চাকর-বাকরকেও তাই খেতে দিবে।
৯। নাবালক অর্থাৎ ছোটদেরকে মাঝে মধ্যে রোযা রাখার অভ্যাস করা।
১০। সংশোধন: নিজের দোষগুলো বের করে একটি একটি করে সেগুলো থেকে সরে আসা এবং তওবা করে আল্লাহর বিধান পালনে যত্নশীল হওয়া।
১১। দোয়া করা: রমযান মাসের প্রতি দিন ও রাতে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন, তাই আমাদের রমযানের পূর্বে প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট করে দোয়া করা।
১২। শবে-ক্বদরের রাতগুলো (শেষ দশদিনের বেজোড় রাত) বিশেষভাবে রাত জেগে এবাদত করা।
১৩। ইতেকাফ: শেষ দশদিনে ই’তেকাফে বসার সুযোগ করা ।
১৪। ঈদের ছালাতের পূর্বেই সঠিক সময়ে ফিতরা আদায় করা।
১৫। যাকাত সঠিক হিসাবে ও সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা।
পরিশেষে বলবো, আসুন আমরা রমযান মাসের মর্যাদা রক্ষা করি এবং রাসূল (সা.)-এর বলে দেওয়া নিয়মে এই মাসে ইবাদত বন্দেগী করি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সকলকে সেই তাওফীক ও শক্তি দান কর। আমীন।