সদকায়ে জারিয়ার ফজিলত

images[11]

সদকায়ে জারিয়া আরবি শব্দ। সদকা শব্দের অর্থ দান করা এবং জারিয়া অর্থ প্রবহমান,সদাস্থায়ী প্রভৃতি। সদকায়ে জারিয়া হলো এমন দান যার কার্যকারিতা কখনো শেষ হবে না এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ এই পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত কবরে শুয়ে শুয়ে সদকাকারী ব্যক্তি এর সওয়াব পেতেই থাকবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিত্তশালী লোকদের ওপর সম্পদের জাকাত এবং ওশর ফরজ করেছেন। সেই সঙ্গে সদকার ব্যাপারেও তাকিদ দিয়েছেন। ইসলাম জাকাত এবং ওশরের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে; কিন্তু সদকার ব্যাপারে কোনো সীমা বেঁধে দেয়নি। এ জন্য যে,এর মাধ্যমে মুসলিম সমাজে মজবুত অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে। অপরদিকে সদকার ব্যাপারে ধনী-দরিদ্রের কোনো শর্ত নেই। সবাই সদকা করতে পারেন। তাই সদকা করা বিশেষত সদকায়ে জারিয়ার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। এর ফলে পরকালীন জীবন অত্যন্ত শান্তিময় হয়ে উঠবে এমনটি আশা করা যায়। সদকায়ে জারিয়া সম্পর্কে হাদিস শরিফে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমল জারি থাকে_

(১) সদকায়ে জারিয়াহ। (২) উপকারী জ্ঞান এবং(৩) নেককার সন্তান যে দোয়া করবে। (বোখারি ও মুসলিম)। আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা আমরা তাঁর সৃষ্টি তথা গোলাম। আমাদের কল্যাণার্থেই তিনি পৃথিবীকে সুন্দর সাজে সজ্জিত করেছেন। প্রতিটি বিধিবিধান প্রণয়ন করেছেন। যখন সময় চলে আসবে তখন এক এক করে সবাই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অন্ধকার কবরে চলে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজা-বাদশাহ, আমির-উমরাহ, ধনী-গরিব কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
দুনিয়াতে বিভিন্ন পেশায় নির্দিষ্ট মেয়াদে নিয়োজিত চাকরিজীবী ব্যক্তি যখন অবসর গ্রহণ করে তখন তার পরবর্তী দুনিয়াবি জীবন সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর জন্য কোম্পানি বা সরকার পেনশন এবং গ্র্যাচুইটির ব্যবস্থা রাখে। এতে করে সে বৃদ্ধ বয়সেও ভালোভাবে দিনাতিপাত করতে পারে। এটা ব্যবস্থাপনার বিশেষ অনুগ্রহ। অথচ আল্লাহতায়ালা এর চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি দয়ালু তাঁর বান্দাদের প্রতি, যা অনেকেই উপলব্ধি করতে সক্ষম নই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, ওঠা-বসা, চলাফেরা, লেনদেন, বিভিন্ন কাজে-কর্মে অনেক ভুলত্রুটি হয়ে থাকে। এর থেকে তওবা না করে মারা গেলে নেকির পাল্লা হালকা হয়ে বান্দা বিপদে পড়তে পারে। তাইতো আল্লাহ বান্দার দুরবস্থা দূর করার জন্য মৃত্যুর পরও নেকি অর্জনের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। হাদিসে বর্ণিত, তিনটি কাজের যে কোনো একটি করে গেলে বান্দা কবরে বসে বসে নেকি পেতেই থাকবে।

প্রথমত, সদকায়ে জারিয়া কী? মহান আল্লাহতায়ালা এবং তার প্রিয় হাবিবের সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ, এতিমখানা তৈরি, গরিব ছাত্রদের বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ও হাসপাতাল নির্মাণ, পুকুর খনন, নলকূপ বসানো, পাঠাগার ও সেতু নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, ইসলামী পুস্তক দান প্রভৃতিই হলো সদকায়ে জারিয়া।
মসজিদ : মসজিদে যতদিন মানুষ নামাজ আদায় করবে, কোরআন হাদিসের আলোচনা করবে, জিকির-আজকার এবং ওয়াজ মাহফিল করবে ততদিন পর্যন্ত নির্মাণ ও সহায়তাকারী ব্যক্তি এবং অন্য মুসলি্লরা ও কোরআন-হাদিস চর্চাকারীদের সমপরিমাণ সওয়াব কবরে বসে পেতেই থাকবে।
মাদ্রাসা : মাদ্রাসায় যতদিন কোরআন, হাদিস ও অন্যান্য কিতাবাদি পড়ানো হবে ততদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এবং ওই মাদ্রাসা থেকে যত আলেম তৈরি হবে সবার সমপরিমাণ সওয়াব নির্মাণকারী,দানকারী এবং ভালো পরামর্শদাতার আমলনামায় যোগ হতে থাকবে।

এতিমখানা :পিতা-মাতাহীন এতিম সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য এতিমখানা নির্মাণ। এ প্রতিষ্ঠান থেকে যত এতিম সন্তান লেখাপড়া করে বেরিয়ে যাবে এবং জ্ঞানের আলো অন্যের মধ্যে বিলাতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাকারী সওয়াব লাভ করতে থাকবে। এ ছাড়া গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করে যাওয়া। যে অর্থে বহু গরিব ও অসহায় সন্তান লেখাপড়া করে যেতে পারে।
পাঠাগার :সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে ইসলামী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা। এ পাঠাগার থেকে একটি বই পড়ে কেউ যদি ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ হয়,তাহলে তাদের সবার সমপরিমাণ সওয়াব প্রতিষ্ঠাকারী, সাহায্যকারী কবরে বসে পেতে থাকবে।

হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা : মানবসেবায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সর্বোত্তম কাজ। মানুষ এখান থেকে সেবা পায়। রোগমুক্তি ও মানুষের দীর্ঘদিনের কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থা করা হয়। যতদিন এখানে মানবসেবার কাজ চলতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতা এর সওয়াব কবরে বসে পাবেন।

রাস্তাঘাট নির্মাণ : রাস্তাঘাট নির্মাণ একটি জনকল্যাণ কাজ। যতদিন পর্যন্ত এ রাস্তা দিয়ে যত মানুষ, পশু-পাখি, জীবজন্তু চলাচল করবে_ ততদিন পর্যন্ত নির্মাতার আমলনামায় এর সওয়াব পেঁৗছতে থাকবে।
পুকুর খনন ও নলকূপ বসানো : মানুষের মঙ্গলার্থে পুকুর খনন ও নলকূপ বসানোর মাধ্যমে এর থেকে যত মানুষ পানি পান করবে তার সওয়াব মালিক লাভ করবে।

বৃক্ষরোপণ : যতদিন পর্যন্ত মানুষ, পশু-পাখি এই গাছের ফল খাবে, ছায়ার নিচে বসে শরীর জুড়াবে, ততদিন রোপণকারী সওয়াব পাবে।

দ্বিতীয়ত, উপকারী জ্ঞান : যে জ্ঞান অর্জন করার কারণে জ্ঞানী ব্যক্তি উভয় জাহানে সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে পারে এবং অপরকেও অগ্রসর করতে পারে এমন জ্ঞান লাভ। এ প্রকারের জ্ঞান কুরআন-হাদিস, বালাগাত-মানতিক, তাফসির গ্রন্থ ও ইসলামি দর্শন অধ্যয়ন ছাড়া লাভ হয় না। এ প্রসঙ্গে হজরত উসমান ইবনে আফ্?ফান (রা.) থেকে বর্ণিত প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে কোরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয় (বুখারি)। অন্যকে শিক্ষা দেয়ার কয়েকটি উপায় আছে। যেমন_ মক্তব বা মাদ্রাসায় লোকজন সমবেত করে শিক্ষা, কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা সংবলিত বই লিখে এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়ে বই লিখে। আর এ উপকারী জ্ঞানার্জন করা আল্লাহর খাস রহমত ছাড়া সম্ভব নয়। হাদিস শরিফে মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ যার মঙ্গল কামনা করেন তাকে দীনের সঠিক বুঝ দান করেন।নেক সন্তান যে দোয়া করে : প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, কোনো পিতা তার সন্তানের জন্য সুশিক্ষা এবং চরিত্র গঠন ব্যতিরেকে উত্তম কোনো সম্পদ রেখে যেতে পারে না। সন্তানকে নেককার না বানিয়ে পিতা যদি লাখ লাখ টাকা রেখে যায়, তবে এর দ্বারা পিতা-পুত্র কারো বিন্দুমাত্র উপকার হবে না। বরং এ সম্পদ অসৎ পথে ব্যয় করে নিজেও ধ্বংস হবে বাপকেও কবর জগতে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করাবে। সুশিক্ষা আর উত্তম চরিত্র বলে সম্পদহীন সন্তানও সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।
সবার শ্রদ্ধা-সম্মান, ভালোবাসা ও দোয়া লাভ করতে পারে। এছাড়া তার যাবতীয় ভালো কাজের সওয়াব পিতা-মাতার আমলনামায় যেমন যোগ হবে তেমনি নেক সন্তানের দোয়ার বরকতেও পরজগতে পিতা-মাতার গুনাহ মাফ হবে, শাস্তি লাঘব হবে, জান্নাত নসিব হবে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তাই আদর্শ পিতা-মাতার উচিত ছোটবেলা থেকেই সন্তানের চরিত্র গঠনের প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়া। তাহলে পিতা হিসেবে সে নিজেকে পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত রাখতে পারবেন এবং সন্তান সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। অপর দিকে কেউ যদি নেক সন্তানের পরিবর্তে ধন-দৌলতসহ নাস্তিক, মুরতাদ, বেনামাজি, সুদখোর, ঘুষখোর, মদখোর, হারাম ভক্ষণকারী, জিনাকার, চরিত্রহীন সন্তান রেখে যায় তাহলে ওই সন্তান তো জাহান্নামি হবেই উপরন্তু পিতা-মাতাকেও জাহান্নামের পথিক বানাবে। কেননা পিতা-মাতা সন্তানকে শুধু দুনিয়াবি চাকচিক্যে মত্ত রেখেছে; কিন্তু চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করেনি। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, তারা বলবে (সন্তানরা), হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের মহা অভিসম্পাত করুন। (সুরা আহজাব, ২২ পারা, ৬৭ ও ৬৮ আয়াত)।

আলোচ্য আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট, সন্তানকে চরিত্রবান হিসেবে গড়তে না পারলে পিতা-মাতা যদি জান্নাতিও হয় তবুও সন্তানের কারণে জাহান্নামই হবে তাদের ঠিকানা। এজন্য আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন : মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগি্ন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতাগণ (সুরা তাহরিম, ৬ আয়াত, ২৮ পারা)। সদকায়ে জারিয়ার বিপরীতে হলো গুনাহে জারিয়া। কেউ যদি মসজিদ, মাদ্রাসা না গড়ে সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা, কনসার্টের ও যাত্রাগানের আসর করে তাহলে এসব স্থানে যতদিন গুনাহর কাজ চলতে থাকবে ততদিন প্রতিষ্ঠাতার আমলনামায় সমপরিমাণ গুনাহ পেঁৗছতে থাকবে এবং কবরের আজাব বাড়তেই থাকবে। তবে এসব স্থানে যদি ইসলামি আলোকে কোনো ভালো জিনিস দেখানো হয় বা শিক্ষা দেয়া হয় তাহলে ফলাফলটা আবার সেরকম হবে।

(সমাপ্ত)

Related Post