ইসলামে কিছু পর্ব বা দিবস আছে। যেগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্ধারণ করেছেন ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য। এমনি একটা দিবসের নাম আশুরা। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখ। মুসলিম উম্মাহর দ্বারে কড়া নাড়ে প্রতি বছর।
এ মাসে রয়েছে এমন একটি দিন, দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে যে দিনে নবী মুসা (আঃ) এর বিজয় হয়েছিল। পতন হয়েছিল তৎকালীন সবচেয়ে শক্তিশালী জালেম সম্রাট ফেরআউন ও তার সম্রাজ্যের। সে দিনটিই হল আশুরা; মুহাররম মাসের দশ তারিখ।
এ দিনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে খুবই প্রিয়। তাই তিনি এ দিনে রোযা পালনের সওয়াব প্রদান করে থাকেন বহুগুণে।
যেমন হাদীসে এসেছে “আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ রমযানের পর সর্বোত্তম রোযা হল আল্লাহর প্রিয় মুহাররম মাসের রোযা। এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হল রাতের নামাজ” (মুসলিম)
আশুরার বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে এ দিনে আল্লাহ তা’আলা তার নবী মুছা (আঃ) ও তার অনুসারী ঈমানদারদের ফেরআউনের জুলুম থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার বাহিনীসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছেন।
রাসূল (সাঃ) যখন মদীনায় আগমন করলেন তিনি আশুরার দিনে ইহুদীদের রোযা পালন করতে দেখলেন। যেমন হাদীসে এসেছে “ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূল (সাঃ) মদীনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে রোযা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন “এটা কোন দিন যে তোমরা রোযা পালন করছ? তারা বললঃ এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুছা (আঃ) ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুছা (আঃ) শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে রোযা পালন করেছেন। এ কারণে আমরাও রোযা পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “তোমাদের চেয়ে আমরা মুছা (আঃ) এর অধিকতর ঘনিষ্ট ও নিকটবর্তী।” অতঃপর রাসূল (সাঃ) রোযা পালন করলেন ও অন্যদেরকে রোযা পালনের নির্দেশ দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
রাসূলে কারীম (সাঃ) ইহুদীদের কথা বিশ্বাস করে রোযা পালন করেছেন এমনটি নয়। সম্ভবত আল্লাহ তা’আলা অহীর মাধ্যমে ইহুদীদের এ বক্তব্যের সত্যতা জানিয়েছিলেন অথবা তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে এর সত্যতা উপলদ্ধি করেছিলেন।
এ দিনে রোযা পালনের ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে আরো এসেছে; আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সাঃ) কে আশুরার রোযা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল, তিনি বললেনঃ “ বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গৃহীত হয়।” (মুসলিম, তিরমিযী)
ইমাম বায়হাকী (রহঃ) বলেনঃ “এ হাদীসের ব্যাখ্যা হলঃ যে রোযা পালনকারীর গুনাহ রয়েছে তার গুনাহের কাফফারা হবে আর যার গুনাহ নেই আশুরার রোযা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।” (ফাযায়েলুল আওকাত: বায়হাকী) মোট কথা আশুরার দিনের রোযা হল এক বছরের রোযাতুল্য।
রাসূলে কারীম (সাঃ) এ রোযাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। যেমন হাদীসে এসেছে; ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “আমি রাসূল (সাঃ) কে এ রোযা ছাড়া অন্য কোন রোযাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি। আর তা হল আশুরার রোযা ও এই রমযান মাসের রোযা।” (বুখারী ও মুসলিম)
আমাদের সালফে সালেহীন এ রোযাকে গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। এমনকি সফরে থাকাকালীন সময়েও তারা এ রোযাকে পরিত্যাগ করতেন না। যেমন ইমাম ইবনে রজব (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে আব্বাস (রাঃ), আবু ইসহাক আস-সাবেয়ী, ইমাম যুহরী (রহঃ) প্রমুখ বলতেনঃ “রমযানের রোযা কোন কারণে ছুটে গেলে অন্য সময়ে আদায় করার সুযোগ থাকে, কিন্তু আশুরার রোযা ছুটে গেলে আর রাখা যায় না।” (লাতায়েফুল মাআ‘রিফ : ইবনে রজব)
তাই তারা সফরে থাকা অবস্থায়ও আশুরার রোযা আদায় করতেন। নেক কাজে অগ্রণী হওয়ার ব্যাপারে এই ছিল আমাদের পূর্বসূরী ওলামায়ে কেরামের আদর্শ।
আশুরার রোযার ব্যাপারে ইহুদীদের বিরোধীতা করার নির্দেশ
যে সকল বিষয়ে কোন শরয়ী হুকুম অবতীর্ণ হয়নি মদীনায় আসার পর সে সকল বিষয়ে রাসূল (সাঃ) ইহুদীদের অনুরূপ আমল করা পছন্দ করতেন। যেমন তিনি মসজিদুল আকসাকে কিবলা হিসেবে গ্রহণ করলেন। উদ্দেশ্য ছিল ইহুদীরা যেন ইসলামকে নিজেদের ধর্মের মতই মনে করে, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে যখন সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে ইহুদীদের অবাধ্যতা, হিংসা, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা, বর্ণবাদী নীতি ও চরম সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পেল, তখন সকল ব্যাপারে তাদের বিরোধীতা করার নির্দেশ দেয়া হল, এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে তাদের সাথে সাদৃশ্যতাপূর্ণ সকল আমল ও আচরণ করতে নিষেধ করা হল।
তাই রাসূল (সাঃ) সংকল্প করলেন, আশুরার দিনে তিনি ইহুদীদের মত আর একটি করে রোযা পালন করবেন না। বরং এ রোযার সাথে মুহাররম মাসের নবম তারিখে একটি রোযা বাড়িয়ে রাখার মাধ্যমে ইহুদীদের ধর্ম ও সাংস্কৃতির বিরোধীতা করবেন। এর প্রমাণ হিসেবে বহু হাদীস এসেছে।
যেমনঃ- ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, যখন রাসূল (সাঃ) আশুরার রোযা পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বললেনঃ “এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদী ও খৃষ্টানরা সম্মান করে থাকে।” তখন রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “আগামী বছর আসলে ইনশা-আল্লাহ আমরা নবম তারিখে রোযা পালন করব।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই রাসূল (সাঃ) ইন্তেকাল করলেন।” (মুসলিম)
হাকাম ইবনুল আ‘ওয়াজ নামে এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে আশুরার রোযা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “যখন মুহাররম মাসের চাঁদ দেখবে তখন থেকে হিসেব করবে এবং নবম তারিখের সকাল থেকে রোযা পালন করবে।” (মুসলিম ও তিরমিযী)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর এ উত্তর থেকে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশংকা নেই যে, আশুরার রোযা আসলে কোন দিন; নবম না দশম তারিখে?
ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন ঃ “কেউ যদি আশুরা সম্পর্কিত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বর্ণনাসমূহ একত্র করে পড়ে দেখে, তা হলে তার সামনে কোন বিভ্রান্তি বা অস্পষ্টতা থাকবে না, এবং সে ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ইলম ও প্রজ্ঞার গভীরতা উপলদ্ধি করতে পারবে। বর্ণিত হাদীসে প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন নি যে আশুরা নবম তারিখে। তিনি শুধু নবম তারিখে রোযা আরম্ভ করতে বলেছেন। (যাদুল মাআ‘দ)
হাদীসে এসেছে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আশুরা দিবসে রোযা পালন কর ও এ ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধীতা কর। তাই তোমরা আশুরার একদিন পূর্বে অথবা একদিন পরে রোযা পালন করবে। (আহমদ)
এ হাদীসে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ঃ
(১) রাসূল (সাঃ) আশুরার দিনে রোযা পালন করতে বলেছেন। তাই আশুরার দিনকে বাদ দিয়ে রোযা পালন করলে তা আশুরার রোযা হবে না।
(২) আশুরার রোযা পালনের ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধীতা করতে হবে। তাই ইহুদীদের মত দশম তারিখে একটি মাত্র রোযা পালন করা যাবে না।
(৩) আশুরার একদিন পূর্বে রোযা পালন করতে হবে।
(৪) যদি আশুরার পূর্বের দিন রোযা পালন করা কোন কারণে সম্ভব না হয় তাহলে আশুরা ও তার পরের দিন রোযা পালন করতে হবে।
অতএব আশুরার দিন বাদ দিয়ে আশুরার একদিন পূর্বে ও একদিন পরে রোযা পালন করা ঠিক হবে না। তেমনি আশুরার দিন সহ একদিন পূর্বে ও একদিন পরে মোট তিনটি রোযা পালন করাও ঠিক হবে না।
ইহুদীদের ধর্মীয় আচারের বিরোধীতা করার জন্য এ পদ্ধতিতে রোযা পালন করা হবে ।
যেমন হাদীসে এসেছে; আবু মুছা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ খায়বর অঞ্চলের ইহুদীরা আশুরার দিনে রোযা পালন করত ও ঈদ উদযাপন করত। এ দিনে তাদের মেয়েরা অলংকারাদি পরিধান করত ও তারা উত্তম পোষাকে সজ্জিত হত। রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “তাহলে তোমরা সেদিনে রোযা পালন করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস দ্বারা কয়েকটি বিষয় জানা যায়ঃ
(১) অঞ্চল ও গোত্র ভেদে ইহুদীদের ধর্মীয় আচরণের বিভিন্নতা। মদীনার ইহুদীরা শুধু রোযা পালন করত আর খায়বারের ইহুদীরা রোযা পালন ও উৎসব পালন করত।
(২) যেহেতু এ দিনে ইহুদীরা ঈদ পালন করত। আর রোযা হল ঈদের বিরোধী। তাই রোযা পালন করে তাদের ঈদের বিরোধীতা করার নির্দেশ দিলেন আল্লাহ রাসূল (সাঃ কে।
(৩) রোযা ও ঈদ পরস্পরের বিরোধী। তাই তা একই দিনে একত্র হতে পারে না।
(৪) আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর এ বাণীটি ইসলামের শেষ দিকের। কারণ খায়বর বিজয় ও হাদীসের বর্ণনাকারী আবু মুছা আল-আশ‘আরীর রাসূলের সঙ্গ লাভ তাঁর জীবনের শেষ দিকের ঘটনা। যদিও আবু মুছা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন মক্কী জীবনে।
ইবনে রজব (রহঃ) বলেনঃ “এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা গেল এ দিনকে উৎসবের দিন হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর কাফির মুশরিকদের ঈদের সাথে সংহতি প্রকাশ না করে ঐদিনে রোযা পালন করে তাদের উৎসবের বিরোধীতা করতে বলা হয়েছে।” (লাতায়েফুল মাআ’রিফ)