আস্সালামু আলাইকুম

আস্সালামু আলাইকুম

আস্সালামু আলাইকুম

মুসলমানদের কাছে ও মুসলমান পরিবেশে সালাম অবিশ্যই অভিবাদন, সম্ভাষণ, দোয়া, সংস্কৃতির পরিচায়ক, অহংকার নাশক বাক্য। যার মাধ্যমে সালামদাতার বিনয়ী মনের প্রকাশ ঘটে। এ ছাড়া সালাম অনুমতি প্রর্থনাসূচক একটি বাক্যও বটে। সালামের বহুমুখী ফজিলত ও উপকারী ব্যবহার রয়েছে। আল্লাহর নেক বান্দাগণের জান্নাতে প্রবেশের সময় ফেরেশতারা তাদের সালাম জানাবেন।
কেউ কেউ লেখার শিরোনাম দেখে অলক্ষ্যে আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখতে পারনে ‘আস্সালামু আলাইকুম’ কি কোন লেখার শিরোনাম হতে পারে? তাহলে আমার উত্তর হবে, হ্যাঁ, অবিশ্যই তা লিখার শিরোনাম হতে পারে। না হওয়ার পক্ষে কোন যুক্তি যতক্ষণ আমাকে কাবু করতে না পারবে ততক্ষণ আমি আমার যুক্তিতে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে থাকবে। লেখালেখির জগতে শিরোনাম অপরিহার্য। আমার দেওয়া শিরোনাম হয়ত অনেকের পছন্দ হবে আবার অনেকের পছন্দ হবে না, উভয় পক্ষকে ‘আস্সালামু আলাইকুম’ দিয়ে আমার আলোচনা শুরু করছি।
‘আস্সালামু আলাইকুম’ ছোট্ট একটি বাক্য। যার বাংলা তরজমা বা মানে হলো ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক’। যাকে বা যাদেরকে লক্ষ্য করে এই ছোট্ট বাক্যটি উচ্চারিত হয়, তিনি বা তাদের গ্রহণের মধ্য দিয়ে সালাম দাতাও উপকৃত হন। তাই এটি দ্বিপাক্ষিক দোয়া। এই ছোট্ট দোয়ার বিরাট ফল। প্রতি মিনিটে বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে কোটি কোটি বার মহা বরকতময় এই দোয়ার বিনিময় হচ্ছে। অতীতে হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। কী চমৎকার, সুন্দর নেক অভ্যাস বা আমল! দুজনের সাক্ষাৎ ঘটলে বা অসাক্ষাতে পত্র বিনিময় হলে বা টেলিফোনে-মোবাইল ফোনে কথা কিংবা ইন্টারনেটে চ্যাটিং করা হলে প্রথমেই সালাম ‘আস্সালামু আলাইকুম’। পরস্পরকে সম্ভাষণ বা পারস্পরিক যে দোয়া সালামের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে বিনিময় হয়, এমন একটি দোয়া আর কোথাও নেই। বিশ্বের অন্য কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন অর্থবোধক, পারস্পরিক আশির্বাদ জ্ঞাপন মূলক ‘আস্সালামু আলাইকুম’ এর মত বা এর কাছাকাছি কোন সম্ভাষণ আছে বলে আমাদের জানা নেই। নমস্কার, প্রণাম, আদাব, শুভ সকাল, শুভ সন্ধ্যা আর শুভ রাত্রি কোন আশির্বাদ নয়। মুসলমানদের ‘আস্সালামু আলাইকুম’ যেমন একটা সর্বোন্নত গুণসম্পন্ন মধুর সম্ভাষণ, তেমনি শুভকামনামূলক একটি দোয়া। এই দোয়া বা সম্ভাষণ অনন্য, অদ্বিতীয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, বে-মেছাল। একের ভিতর দুই। সম্ভাষণের সম্ভাষণ আবার দোয়া। অন্য কোন জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় থেকে এমন এক উদাহরণ বা কাছাকাছি উদাহরণ কেউ দিতে পারবেন? শ্রেষ্ঠ ইসলামের শ্রেষ্ঠ সম্ভাষণ, রীতিমত এক চ্যালেঞ্জ।
কালামে পাকে সালাম শান্তি ও নিরাপত্তা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সালামের আভিধানিক অর্থ নিরাপদ থাকা। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তার হাবিবকে সালাম জানিয়েছেন একাধিকবার। ইসলামের সালাম মানুষের রচনা নয়; এর আগমন ঘটেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী হয়ে পয়গাম্বর পরম্পরায়। জিব্রাইল (আ.) যতবার রাসূলে কারীম (সা.) এর কাছে এসেছেন ততবার উভয়ের মধ্যে সালাম বিনিময় হয়েছে। ইসলামে সালাম হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতীক। এ সালাম দেওয়া নেওয়ার জন্য কোন কোন সাহাবী হাটে-বাজারে চলে যেতেন। কারণ লোক সমাগম সে সব স্থানে বেশি। অনেক লোককে সেখানে সালাম দেওয়া সম্ভব।
আল্লাহর রাসূল ছোট বড় সকলকে সালাম দিতেন। একবার শিশুদের এক মজমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নবী কারীম (সা.) শিশুদের সালাম দিয়েছেন। কারণ তিনি ছোটদের খুব বেশি ¯েœহ করতেন, সম্ভাষণের মাধ্যমে তাদের জন্য তিনি দোয়াও করতেন। মুসলিম বুজুর্গ মনীষীরা সালামের মধ্যে শুধু সম্ভাষণ আর দোয়াই পান নি, তারা একটি দূর্লভ বস্তু পেয়েছেন, যার নাম ‘ইসলামী সংস্কৃতি’। যে সংস্কৃতি মুসলিম মিল্লাতের সুবিশাল সৌধের রাজতোরণ দিয়ে প্রবেশের আই ডি কার্ড বিশেষ। সাধারণত ধরে নেওয়া হয়, যিনি বা যারা এই রাজতোরণ দিয়ে প্রবেশের সময় ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলবেন, তিনি ইসলামী সংস্কৃতির মানুষ। যদিও এই তোরণে প্রবেশের অনুমতি সকল জাতি ধর্মের মানুষের রয়েছে, কিন্তু যারা ‘আস্সালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করবেন তারা অন্যদের থেকে আলাদা পরিচি নিয়ে আলাদাভাবে পরিচিত হবেন। আগেই বলেছিলাম, একের মধ্যে দুই, “সম্ভাষণ ও দোয়া” এখন বলতে হচ্ছে একের মধ্যে তিন। অর্থাৎ সম্ভাষণ, দোয়া ও সংস্কৃতি। আধুনিক এক মনীষী পন্ডিত বলেছেন, সালামের মধ্যে অহংকার নাশক ওষুধ আছে। এ সালাম যারা উচ্চারণ করেন তারা নিজেদের অহংকারকে দাবিয়ে রাখেন। এ কারণে তার মতে একের মধ্যে চার; অহংকার নাশক ওষুধ এর মধ্যে সংযোজিত।
ইসলামে সালামের অভ্যাস গঠনের তাগিদ রয়েছে। নিজের সম্পর্ক ও সোহার্দ্য প্রকাশের জন্য ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলা আল্লাহর নির্দেশ: হে নবী! যারা আমার আয়াতের উপর ঈমান রাখে এমন লোকেরা যখন আপনার দরবারে আসে তখন, আপনি তাদের ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলুন। (সূরা: আনআম ৫৪)। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও (মুসলিম)।
যাকে সালাম দিলাম, সে ব্যক্তি যদি সালাম নেওয়ার পর গাছের আড়াল হয়ে যায়, পরে আড়াল থেকে বের হয়, তাহলে তাকে আবার সালাম দেওয়া যায়।  সালাম যেহেতু দোয়া, তাই দোয়া তো বার বার করা যায়, বিনিময়ে দোয়া পাওয়াও যায়।
সালাম নবী কারী (সা.) থেকে এসেছে, এ ধারণা যাদের রয়েছে, তাদের ধারণা সাঠিক নয়। খোদ নবী কারীম (সা.) বলেছেন, সালাম এসেছে আদম (আ.) থেকে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) থেকে, আখেরী নবী মুহাম্মদ (সা.) থেকে। নবী কারীম (সা.) বর্ণনা করেন, যখন আল্লাহ পাক আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন, তখন ফেরেশতাদের একটি দল অদুরে অবস্থান করছিলেন। তখন আল্লাহ পাক আদম (আ.) কে নির্দেশ করলেন, ‘যাও এই ফেরেশতাদের সালাম করো’। (আল্লাহ পাক আদম (আ.) কে সালাম শিখিয়ে দিলেন), তারা সালামের কি জবাব দেয় তা শ্রবণ কর। কারণ, এই সালামই তোমার ও তোমার বংশধরদের অভিবাদন হবে। অতঃপর হযরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের নিকট গিয়ে বললেন ‘আস্সালামু আলাইকুম’। জবাবে তারা বললেন, ‘আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহ্মাতুল্লাহ’।  (বুখারী-মুসলিম) এ ঘটনা থেকে শুরু হলো সালাম দেওয়া নেওযার রেওয়াজ ও পদ্ধতি।
কারো গৃহে প্রবেশের অনুমতি প্রর্থনার বাক্য হলো সালাম (সূরা নূর ২৭)। ঘরের দরজা খোলা থাকলেও সালামের জবাব না পাওয়া পর্যন্ত অন্যের গৃহে প্রবেশ নিষেধ। সালাম দিয়ে অনুমতি প্রার্থনার একটি বিখ্যাত ঘটনা হাদীস গ্রন্থে ও ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। বুখারী শরীফে এর উল্লেখ থাকায় বেশী গুরুত্ব পেয়েছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, একবার এক মজলিসে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু মুসা আল আশআরী (রা.) আমাদের পাশে বসেছিলেন। এমন সময় ফারুকে আযম (রা.) আমাকে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ডেকে পাঠালেন। আমি এই ব্যক্তির সাথে তার বাড়ীতে গেলাম এবং দরজায় দাঁড়িয়ে তিনবার সালাম করলাম, কিন্তু অনেক্ষণ পর্যন্ত কোন জবাব না পাওয়ায় আমি ফিরে আসলাম। পরবর্তী কোন এক সময়ে যখন হযরত ওমর (রা.) এর সঙ্গে দেখা হলো, তিনি জানতে চাইলেন কেন আমি তার সাথে দেখা করতে যাইনি। আমি জবাবে বললাম, অবশ্যই আমি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তবে কোন সাড়া না পেয়ে ফিরে আসি। কারণ রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন, তোমাদের কেউ তিনবার সালাম বা অনুমতি চাওয়ার পরে যদি কোন উত্তর না পায়, সে যেন ফিরে আসে। আমার কাছ থেকে এই কথা শুনে হযরত ওমর (রা.) বললেন, এ ব্যাপারে তোমাকে অবশ্যই প্রমাণ দেখাতে হবে। তখন আমি হযরত আবু মুসা আল আশআরীকে নিয়ে হযরত ওমর (রা.) এর নিকট গেলাম এবং প্রমাণ দিলাম যে হাদীসটি সহীহ্। হযরত ওমর (রা.) তা মেনে নিলেন।
মুসলমানদের কাছে ও মুসলমানদের পরিবেশে সালাম অবিশ্যই অভিবাদন, সম্ভাষণ, দোয়া, সংস্কৃতির পরিচায়ক, অহংকার নাশক বাক্য এবং যার মাধ্যমে সালাম দাতার বিনয়ী মনের প্রকাশ ঘটে। এ ছাড়া সালাম অনুমতি প্রার্থনাসূচক বাক্যও বটে। সালামের বহুমূখী কল্যান, ফজিলত ও উপকারী ব্যবহার রয়েছে। আল্লাহর নেক বান্দাগণ জান্নাতে প্রবেশের সময় ফেরেশতারা তাদের সালাম জানাবেন- (সুরা ঝুমার, সুরা রা’দ-২৩-২৪)।

Related Post