পূর্বে প্রকাশিতের পর
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এ সময় আবু জাহেল রাসূল (সা.) কে যে হত্যা করতে পারবে তাকে দু‘শো উট পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করলো এবং সে পুরস্কার পাওয়ার জন্যে উমর তলোয়ার নিয়ে মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যার জন্য ঘর থেকে বের হলেন। কিন্তু উমরের মেজাজের সাথে তার এ ধরনের লোভের শিকার হওয়াটা বেমানান। যাই হোক, তিনি তলোয়ার হাতে রওয়ানা দিলেন। পথিমধ্যে নঈম বিন আবদুল্লাহর সাথে সাক্ষাত হওয়ায় বাধা গ্রস্ত হলেন। নঈম বললেন, ‘আগে তোমার নিজের ঘরে খোঁজ নাও, তারপর যেখানে যেতে চাও যেয়ো।’ উমর তৎক্ষণাত সোজা বোনের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। তাঁর বোন- ভগ্নীপতি উভয়ই তখন কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। উমরকে আসতে দেখেই তাঁরা চুপ হয়ে গেলেন এবং কুরআনের অংশটি লুকিয়ে ফেললেন। উমর ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়ছিলে? তোমরা নাকি বাপ-দাদার ধর্মকে ত্যাগ করেছো? একথা বলেই তিনি ভগ্নিপতিকে প্রহার করতে লাগলেন। স্বামীর সাহায্যে বোন এগিয়ে এলে তাঁকেও তিনি পিটাতে লাগলেন। তাঁরা উভয়েই রক্তাক্ত হয়ে গেল। অশ্রুভরা চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে বোন বললেন, ‘ উমর ! যা ইচ্ছে করতে পার। কিন্তু আমাদের পক্ষে ইসলাম ত্যাগ করা সম্ভব নয়।” ক্ষতবিক্ষত দেহ, রক্তাক্ত পোশাক, চোখভরা অশ্রু ও আবেগ ভরা মন নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে সহোদর বোনের মুখে এমন তেজদীপ্ত কথা শুনে উমর প্রভাবিত হলেন। এমন মর্মস্পর্শী দৃশ্যের সামনে কে ধৈর্য ধরতে পারে! উমরের দুর্ধর্ষ শক্তিও হার মানলো। তিনি বললেন, “ তোমরা কি পড়ছিলে আমাকে শোনাও দেখি।” ফাতেমা গিয়ে কুরআনের লুকিয়ে রাখা পাতাগুলো নিয়ে এলেন। তেলাওয়াত করতে করতে যখন এ আয়াত পর্যন্ত এসে পৌঁছলেনঃ “ আমি অল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোনো মা‘বুদ নেই; সুতরাং আমারই ইবাদত করো এবং আমার স্মরণের জন্যে নামাজ পড়ো।” অমনি স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঘোষণা করলেনঃ লা-ইলাহা ইল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ।” ঈমান আনার পর ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র হযরত আরকামের বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হলেন। উমর দরজার নিকট পৌঁছলে তাঁর হাতে তরবারী দেখে উপস্থিত সাহাবিগণ ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু হামযা (রা.) বললেন, “ আসুক না, তাঁর নিয়্যাত যদি ভালো হয় তো ভালো কথা। নচেত তার তরবারী দ্বারাই তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলবো।”উমর ঘরের মধ্যে পা বাড়াতেই মুহাম্মাদ (সা.) এগিয়ে এসে তাঁকে সজোরে আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “ কি উমর, কি উদ্দেশ্য এসেছো?”একথা শুনেই যেন উমর ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন, “ঈমান আনার উদ্দেশ্যে।” মুহাম্মাদ সা. স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠলেন, “ আল্লাহু আকবার।” সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সাহাবী তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। উমর (রা.) এর ঈমান আনার পর থেকেই কা‘বা ঘরে সর্ব প্রথম প্রকাশ্যে জামায়াতে নামায পড়া শুরু হলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘ আমরা হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের আগে কা‘বায় প্রকাশ্যে নামায পড়তে পারতাম না। উমর ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি কুরাইশদের সাথে লড়াই করে কা‘বায় নামায পড়লেন এবং আমরাও তাঁর সাথে নামায পড়লাম। উমর (রা.) মক্কার যুবকদের মধ্যে স্বীয় মেধা ও আবেগ উদ্দীপনার জন্য বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর আচার ব্যবহার ছিল আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় পরিপূর্ণ। জাহেলিয়াতের যুগে তিনি ইসলামের সাথে যে শত্রুতা পোষণ করতেন, তাও কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা তাড়িত হয়ে নয় বরং তাঁকে ন্যায় সংগত মনে করে আন্তরিকতার সাথেই করতেন। তারপর যখন প্রকৃত সত্য তাঁর কাছে উদঘাটিত হলো এবং বিবেকের ওপর থেকে পর্দা সরে গেল, তখন পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে ইসলামের পতাকা উচুঁ করে তুলে ধরলেন। তীব্র সহিংসতার ভিতর দিয়েও শত্রুদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিবর্গ এভাবেই ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে।
জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বন্দী জীবন
ইসলামী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি দেখে ইসলামের শত্রুরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। তারা ইসলামের আলো নিভিয়ে দেবার জন্যে নিত্য-নতুন ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের সকল ফন্দি ফিকিরের ব্যর্থতা, ইসলামের অগ্রগতি ও বড় বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণের দৃশ্য দেখে দিশাহরা হয়ে উঠে। নবুয়্যতের সপ্তম বছরে মক্কার সব গোত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে বনু হাশেম গোত্রকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বয়কট করার চুক্তি সম্পাদন করলো এবং তা কা‘বার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। চুক্তিতে স্থির করা হলো যে, বনু হাশেম যতক্ষণ মুহাম্মদ (সা.) কে আমাদের হাতে সমর্পন না করবে এবং তাকে হত্যা করার অধিকার না দিবে, ততক্ষণ কেউ তাদের সাথে মেলা-মেশা, বেচা-কেনা, বিয়ে শাদী, লেনদেন, কোন খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য সরবরাহ করতে পারবেনা। এবার বনী হাশিমের সামনে মাত্র দু‘টি পথই খোলা রইলোঃ হয় মুহাম্মদ (সা.) কে কাফিরদের হাতে সমর্পন করতে হবে, নচেত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কটের ফলে বন্দী জীবনের দুঃখ- মুসিবত সহ্য করার জন্যে তৈরি হতে হবে। গোত্রীয় ব্যবস্থায় এ সিদ্ধান্তটা ছিলো অত্যন্ত মারাত্মক এবং চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সমগ্র বনু হাশিম অসহায় অবস্থায় শেষক্ত ধারা মেনে নিয়ে ‘শিয়াবে আবু তালেব’ উপত্যকায় আটক হয়ে গেল। এ গিরি-দূর্গের মধ্যে মুহাম্মদ (সা.) সহ বনু হাশিমকে দীর্ঘ তিন বছরকাল মহা দূর্গতির মধ্যে মানবেতর জীবন কাটাতে হলো। এসময় কখনো কখনো তাঁদের গাছের পাতা ও শুকনো চামড়া পর্যন্ত খেতে হতো। যখন ক্ষুধার জ্বালায় নিষ্পাপ শিশুরা চিৎকার করতো, তখন কুরাইশরা আনন্দে ঊল্লাস করতো। কখনো কোন হৃদয়বান ব্যক্তির মনে করুণার উদ্রেক হলে হয়তো লুকিয়ে তিনি কিছু খাবার পাঠিয়ে দিতেন। সমগ্র বনু হাশিম গোত্র একমাত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতা মুহাম্মদ (সা.)-এর কারণে এই করুন পরিস্থিতির শিকার হলো। এভাবে ক্রমাগত তিন বছরকাল বনু হাশিম গোত্র ধৈর্যের অগ্নি- পরীক্ষা প্রদান করলো। অতঃপর আল্লাহ তা‘য়ালা জালিমদের হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার করলেন। একের পর এক কুরাইশদের মন নরম হতে লাগলো এবং তাদের পক্ষ থেকেই চুক্তি বাতিলের আন্দোলন শুরু হলো। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হলো। লোকেরা যখন চুক্তিটাকে কা‘বার প্রাচীর থেকে নামালো তখন অবাক হয়ে দেখলো যে, সমগ্র চুক্তিটাকে উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে। কেবল ‘বিইসমিকা আল্লাহুম্মা’ (আল্লাহর নামে লেখা হলো) কথাটি বাকী আছে। আবু জাহেল এবং তার কিছু অনুসারী বিরোধীতা করেছিলো; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হলো। নবুয়্যতের দশম বছর মুহাম্মাদ (সা.) সহ বনু হাশিম গোত্র বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করলেন। (চলবে)